হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব ৪১

হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব ৪১
সাদিয়া জাহান উম্মি

চোখ মুখ গম্ভীর করে বসে আছে আরাবী।তীক্ষ্ণ চোখে একটু পর পর জায়ানকে দেখছে। আর হাঁচি দিচ্ছে ক্রমাগত।উপুর হয়ে শুয়ে জায়ান আরাবীকেই দেখছে।ঠোঁটে তার হাসি বিদ্যমান।ওকে এইভাবে হাসতে দেখে আরাবী তেতে উঠে বলে,’ একদম হাসবেন নাহ আপনি।খা’রাপ লোক কোথাকার।সুযোগ দিয়েছি বলে আপনি আমার সাথে এমন করবেন?হাঁচি দিতে দিতে আমার অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।’

বলতে বলতে আবারও হাঁচি দিয়ে বসল আরাবী।পর পর আরও দু তিনটে দিয়ে দিল।এইবার জায়ানের খারাপ লাগল।তরতরিয়ে উঠে বসল সে।জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বলল, ‘ আচ্ছা আ’ম সরি।কি করব বলো?অনেকদিন দূরে ছিলাম তোমার থেকে।তার উপর তোমাকে এমন ওই অবস্থায় দেখে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারেনি। শুভ্র তোয়ালে জড়ানো ফর্সা শরীরে তোমাকে কি যে আবেদনময়ী লাগছিলো।বল বুঝাতে পারবোনা।’
জায়ানের কথায় আরাবীর লজ্জা লাগলেও তা জায়ানকে বুঝতে দিল নাহ।বরংচ আরও রাগ দেখিয়ে বলে, ‘ আমার অতো বুঝা লাগবে নাহ।আগামী একসপ্তাহ আমার কাছে আসবেন নাহ আপনি।একদম দূরে থাকবেন।দূরে মানে বুঝেন তো?দূরেএএএএ।’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

লাস্ট লাইনটা টেনে টেনে বলল আরাবী।জায়ান চোখ ছোটো ছোটো করে তাকালো আরাবীর দিকে।তারপর দাম্ভীকতার সহিত বলে, ‘ হাহ্? আমার কথা নাহয় বাদই দিলাম।তুমি থাকতে পারবে আমার থেকে দূরে?রাতে পিনপিন করে কে আসে আমার কাছে?আমার বুকে শোয়ার জন্যে?’
এই পর্যায়ে এসে থেমে যায় আরাবী।দিকদিশা না পেয়ে বলে, ‘ আমি ওই শুধু একটু আপমার বুকেই তো ঘুমোতে যাই।তাই বলে আপনি আমায় এইভাবে তা নিয়ে খোটা দিবেন?’
‘ আরে?তুমি তো উল্টো বুঝছ।আমি সেটা বলেনি।’ জায়ান বুঝাতে চেষ্টা করল আরাবীকে।আরাবী মুখ ফুলিয়ে বলে, ‘ হ্যা, বুঝি বুঝি।’

আরাবী অন্যদিকে ফিরে গেল।জায়ান এইবার হাত বাড়িয়ে টেনে আনল আরাবীকে।আরাবী হকচকিয়ে গেল।থেমেথেমে বলে, ‘ আরেহ! কি করছেন?ছাড়ুন আমায়।’
জায়ান আরাবীর কাধে থুতনী ঠেকিয়ে বলে, ‘মুখ ফুলিয়ে থাকবেনা একদম।এইভাবে মুখ ফুলিয়ে থাকলে তোমার গালদুটো টমেটোর মতো হয়ে যায়।তখন আমার কাম’ড় দিতে ইচ্ছে করে।’
আরাবীর গালে স্লাইড করল জায়ান।লজ্জা পেল আরাবী।দুহাতের সাহায্যে জায়ান থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল।তারপর বলে, ‘ হয়েছে আর বলতে হবে নাহ।আপনার লাগামছাড়া কথাবার্তা এই জীবনে বন্ধ হবে না আমি জানি।লু’চু জানি কোথাকার।’

‘ লু’চু বলবে না একদম।তাহলে কিন্তু লু’চুগিরি আবার শুরু করব।’
জায়ানের কথায় ভয় পেয়ে যায় আরাবী।’নাহহ!’ বলে চিৎকার করে দ্রুত কম্বল দিয়ে নিজেকে ঢেকে ফেলে।আরাবীর এমন বাচ্চামো দেখে হেসে ফেলে জায়ান।রুমময় ঝংকার তুলছে জায়ানের হাসি।আরাবী কম্বল একটু উঠিয়ে উঁকি দিল।জায়ানের প্রাণখোলা হাসিটুক মুগ্ধ নয়নে মন ভরে দেখে নিল।

লোকটার হাসি মারাত্মক সুন্দর।জায়ান সচরাচর এমনভাবে হাসেনা।লোকটা কি জানে তাকে হাস্যরত অবস্থায় ঠিক কতোটা সুদর্শন দেখায়।এইযে আরাবীর বক্ষস্থলে চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে জায়ানের এই হাসি দেখে।যাকে বলে সুখের ব্যথা।জায়ান হাসি থামাল।তারপর কম্বল সরিয়ে টেনে উঠাল আরাবীকে।আরাবী কিছু বলবে তার আগেই দরজায় করাঘাত হলো।আরাবী সরে আসল দ্রুত।জায়ান নিজেকে ঠিক করে নিয়ে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিল।দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে নূর।জায়ান দরজা খুলতেই ও বলে,’ ভাইয়া নিচে জিহাদ আংকেল’রা এসেছেন।তোমাকে আর ভাবিকে নিচে যেতে বলেছেন আব্বু।’

‘ হুম তুই যা।আমরা আসছি।’
নূর মাথা দুলিয়ে চলে গেল।জায়ান শান্ত চোখে তাকালো আরাবীর দিকে।আরাবীর কোন ভাবান্তর দেখা গেল নাহ।জায়ান জিজ্ঞেস করল, ‘ নিচে যাবে?’
আরাবী মাথা দুলিয়ে সায় জানাল।তারপর ধীর আওয়াজে বলে, ‘ আমায় একটু সাহায্য করুন উঠে দাড়াতে।’
আরাবীর কাছে এগিয়ে গেল জায়ান।তারপর আরাবীকে কোলে তোলার জন্যে দুহাত বাড়াতেই আরাবী পিছিয়ে যায়।জায়ান ভ্রু-কুচকালো।বলল,’ সরলে কেন?’

আরাবী নাকচ করল, ‘মাথা ঠিক আছে আপনার?নিচে সবাই আছে।আপনার কোলে করে আমি কিছুতেই নিচে যাব নাহ।আমায় শুধু একটু ধরুন আপনি।তাহলেই হবে।’
‘ ডু ইউ থিংক আই কেয়ার এবাউট দ্যাট?’
‘ ইউ ডোন্ট কেয়ার বাট আই ডু।সো প্লিজ।’
‘ওকেহ, আসো।’

জায়ানের কণ্ঠে স্পষ্ট বিরক্ত।আরাবী হেসে এগিয়ে আসল।জায়ান দুহাতে যতোটা সম্ভব আরাবীকে সাহায্য করল।আরাবী জায়ানের নাক ফোলানো দেখে হেসে বলে, ‘ এইভাবে নিচে গেলে সবাই হাসবে।’
‘ হাসুক তাতে তোমার কি?’
‘ উফ, যান যাব-ই না আমি।খালি শুধু শুধু রাগ করে।’

জায়ান বলে, ‘ আমিই রাগ দেখাই তাই নাহ?তুমি কি করো?আমার কোলে উঠলে কি হবে?’
‘ আপনি কি অবুঝ জায়ান?কেন এমন করেন?জানেন না আমার লজ্জা লাগে?’
আরাবী কথায় জায়ান দুষ্টু হাসল।বলে,’ এতো বার লজ্জা ভাঙ্গালাম তাও লজ্জা শেষ হয়না তোমার?’
‘উফ,থামবেন আপনি?’ আরবী বাহুতে মুষ্ট্যাঘাত করল।হেসে দিল জায়ান।আরবীও হাসল তা দেখে।এদিকে উপর থেকে হাস্যজ্জ্বল কপোত-কপোতীকে দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল সবারই।জায়ান আর আরাবী বসারঘরে আসতেই জিহাদ সাহেব বলে উঠেন, ‘ কেমন আছিস আরাবী মা?’

আরাবীর চোখ ভরে উঠতে চাইল।তাও নিজেকে সামলালো।আরাবী জায়ানকে ইশারা করল আর বাবার কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্যে।জায়ান মাথা দুলিয়ে সায় জানালো।তারপর জিহাদ সাহেবের কাছে গিয়ে আরাবীকে বসিয়ে দিল।আরাবী সাথে সাথে জিহাদ সাহেবকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘ কেমন আছো বাবা?’
‘ তুই কেমন আছিস সেটা বল।তুই ভালো আছিস মানে আমিও ভালোবাসি।’
আরাবী মুঁচকি হেসে বলে, ‘ আমি অনেক ভালো আছি।’

‘ আমিও ভালো আছি মা।তোকে সুখে শান্তিতে দেখে আমার প্রাণটা জুড়িয়ে গেলো।’
এদিকে মাথা নিচু করে বসে আছেন লিপি বেগম।ঠিক কিভাবে তিনি কথা বলবেন আরাবীর সাথে তা ভেবে পাচ্ছেন নাহ তিনি।মাথা উঁচু করে তো কারো দিকে তাকাতেই তিনি পাচ্ছেন নাহ।জিহাদ সাহেব সেটা লক্ষ করে তাকে ডেকে উঠলেন, ‘ লিপি?মেয়েটাকে বুকে নেবে নাহ?’

লিপি বেগম ছলছল চোখে স্বামির দিকে তাকালেন।ফের আরাবীর দিক তাকিয়ে ঠোঁট ভেঙে কেঁদে দিলেন।দু হাত জোড় করে ধুকরে কেঁদে উঠে বলেন,’ আমাকে মাফ করে দে মা।আমি তোর সাথে অনেক অন্যায় করেছি।ক্ষমা করে দে আমায় মা।তুই আমায় যেই শাস্তি দিবি আমি সব মাথা পেতে নিব।তবুও আমায় ক্ষমা করে দে মা।’

আরাবী সাথে সাথে লিপি বেগমের হাত দুটো আঁকড়ে ধরল।ধরা গলায় বলে, ‘ এভাবে বলবে না প্লিজ।তুমি যা করেছ এতে কোন অন্যায় নেই।এই পৃথিবীতে কেই বা আছে যে অন্যের সন্তান তাও আবার কুড়িয়ে পাওয়া তাকে ছোটো থেকে এতো বড় করে?তুমি করেছ।সেইভাবেই হোক আমায় নিজের সন্তানের পরিচয়ে বড় তো করেছ?বাবা আর তুমি না থাকলে তো আমি সেই ছোটো বেলাই ময়লার স্তুপে পরে থাকতাম।কাঁদতে কাঁদতে একসময় ম’রেই যেতাম।খাদ্য হতাম কাঁক,শকুনের।বাবা আমায় বাড়ি নিয়ে গিয়েছে। তবে তুমি যদি আমায় গ্রহন না করতে বুকে টেনে না নিতে তাহলে তো আমার ঠাই হতো না কোথায়ও।তাই মাফ চাইবে না আমার কাছে।উলটো তুমি আমার জন্যে যা করেছ তার জন্যে আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকব তোমার কাছে।’

লিপি বেগম নতমস্তকে বলেন,’ এভাবে বলিস না মা।এইভাবে বলে আমাকে পর করে দিস নাহ।তাহলে যে আমি ম’রে যাব।তোর সাথে আমি অনেক অন্যায় করেছি।তুই আমার জন্যে যা করেছিস তা তো আমার পেট থেকে জন্ম নেওয়া সন্তানও আমার জন্যে কোনদিন করেনি।আমি একটু ব্যাথা পেলে তুই সবার আগে ছুটে আসতি আমার কাছে।জ্বরে বিছানায় পরে কাতরাতে থাকলে তুই এসেই আমার মাথা জলপট্টি দিতি।অথচযেই মেয়ের জন্যে আমি তোর সাথে দিনের পর দিন অন্যায় করে গিয়েছি সেই মেয়ে তো ফিরিয়েও তাকাতো নাহ।আমায় পর করে দিস না রে মা।তুই আমার মেয়ে।আমার মেয়ে তুই।আমায় মা বলে ডাক নাহ মা।মা বল।’

আরাবী কেঁদে ‘মা’ বলে লিপি বেগমকে জড়িয়ে ধরল।লিপি বেগমও জড়িয়ে ধরলেন আরাবীকে।মা মেয়ের মিলন দেখে সবার চোখে জল অথচ ঠোঁটে তৃপ্তির হাসি।জিহাদ সাহেব হাসিমুখেই বলেন,’ কি গো?মা মেয়ে কি খালি কাঁদবেই?হয়েছ তো?’
আরাবী সরে আসল।লিপি বেগমও চোখ মুছে সরে বসলেন।জিহাদ সাহেব আবার বলেন, ‘ এইবার তাহলে উঠি?আরাবীকে দেখতে এসেছিলাম।ও ঠিক আছে দেখেই আমার শান্তি।’

‘ সে কি ভাইসাহেব।এটা হবে না।আজ এখানে থাকবেন আপনারা।’ বলে উঠলেন সাথি বেগম।’
‘ আরে কি বলছেন ভাবি? এটা হয় না।বাড়িটা খালি পরে আছে।আর ফিহা যেমনই হোক।মেয়ে তো আমার।ওকে একলা বাড়িতে রেখে কিভাবে থাকি বলেন তো?’
সাথি বেগম বলেন,’ তাহলে আজ রাতের ভোজন করিয়েই তবেই ছাড়ব।আর একটা কথাও না ভাইসাহেব।’
‘ কিন্তু ফাহিম?ছেলেটা যে সন্ধ্যায় বাড়িতে এসেই আমাকে খুঁজবে।’ লিপি বেগম উদাস হয়ে বলেন।

তার উদাসিনতার একটাই কারন।তা হলো ফাহিম আগে কাজ থেকে ফিরিই উনার খবর নিতেন।তার হাতের এককাপ চা না হলে যেন চলেই না ফাহিমের।অথচ সেই ঘটনার পর থেকে যেন ছেলেটার মুখটা দেখাও কষ্টসাধ্য হয়ে পরেছে।ও যে কখন যায় আর কখন আসে কিছুই টের পাননা তিনি।আর যেদিন ছেলেটাকে একটু দেখেন।ওর সাথে একটু কথা বলতে গেলেই ফাহিম মুখ ঘুরিয়ে চলে যায়।ভীতরটা কষ্ট পুড়ে যাচ্ছে উনার।তাও সবার সামনে স্বাভাবিক থাকলেন।মিলি বেগম বলেন,’ ফাহিমকে এখানে আসতে বলে দিন ভাবি তাহলেই হবে।ও এসে খাওয়া দাওয়া করে একেবারে আপনাদের নিয়েই ফিরবে নেহ।’

মিলি বেগমের কথাটা যবারই যুক্তিগত মনে হলো।তাই জিহাদ সাহেব রাজি হলেন।তা দেখে নূরের মুখে হাসি ফুটে উঠল।সাথি বেগম বলেন,’ আরাবী মা জিহাদকে ফোন করে আসতে বলে দেও।’
আরাবী বলে,’ মা আমি তো ফোনটা রুমে রেখে এসেছি।’
এর মধ্যে চট করে নূর বলে, ‘ আমি ফোন করছি।আমি ফোন করছি।’

সবাই নূরের এতো উত্তেজিত কণ্ঠ শুনে অবাক হয়ে তাকালো।নূর ভড়কাল,থমকাল।নিজের বোকামি বুঝতে পেরে জিভ কাটল।অতি খুশিতে মাথাটা গেছে ওর।নূর বোকা বোকা হেসে বলে,’ হা হা আই মিন আমি ফোন করছি।ভাবি তো ফোন আনেনি।মানে ওই আরকি।’
‘ হুম ফোন কর।বলিস জলদি আসতে।’ সাথি বেগমের স্বাভাবিক কণ্ঠে হাফ ছাড়ল নূর।যাক তাহলে কেউ সন্দেহ করেনি।নাহলে কি একটা কান্ড হতো।ফাহিমকে ফোন করল নূর।তা কেটে দিল ফাহিম।উলটো মেসেজ করল, ‘ ব্যস্ত আছি নূর।ক্লাস নিচ্ছি।’

নূর মেসেজটা পড়ে মুখ ফোলায়।ফাহিমকে মেসেজ দেয়,’ আমি সাধে দেয়নি ফোন।আপনার সাথে এমনিতেও আমি কথা বলতাম নাহ।সেতো আম্মু বলল তাই ফোন দিলাম।’
‘ আম্মু মানে সাথি আন্টি?তিনি কি বলেছেন?’
‘ আম্মু বলেছেন আপনাকে আমাদের বাড়িতে আসতে বলেছেন।আপনার বাবা মা মানে আমার হবু শশুড় শাশুড়ি আমাদের বাড়িতে এসেছেন ভাবিকে দেখার জন্যে। এখন আম্মু তাদের যেতে দিবে নাহ।আর আপনাকেও আসতে বলেছে।ডিনার করে একেবারে আংকেল আন্টিকে নিয়েই ফিরবেন।’

হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব ৪০

‘ আচ্ছা বুঝলাম এবার।’
‘ আসবেন?’
‘ না এসে পারা যায়?হবু শাশুড়ির হুকুম।’
ফাহিমের লাস্ট মেসেজে হেসে দিলো নূর।তারপর আবার ফাহিম আসবে শুনে দৌড়ে রুমে চলে গেলো।ভালোবাসার মানুষটার জন্যে একটু সাজগোছ তো করাই যায় তাই নাহ?

হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব ৪২