হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব ৪৭

হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব ৪৭
সাদিয়া জাহান উম্মি

সাখাওয়াত বাড়িতে আজ মানুষের আনাগোনায় ভরপুর।জিহাদ সাহেব তার পরিবার নিয়ে এসেছেন।আলিফাও এসেছে ওকে ইফতি গিয়ে নিয়ে এসেছে।বসার রুমে সবার আড্ডা চলছে।আরাবী চুপচাপ বসে।তার ভালো লাগছে না কিছুই।সকাল থেকেই প্রচন্ড খারাপ লাগছে ওর।আলিফা আরাবীর শুকনো মুখ দেখে ওর কাছে গিয়ে বসল।ধীর আওয়াজে ডেকে উঠে,’ আরাবী?’

আলিফার ডাকে চোখজোড়া খুলে আরাবী বলে, ‘ হুম কিছু বলবি?’
‘ তোর কি হয়েছে?খারাপ লাগছে তোর?’
‘ আসলে তেমন কিছুই না।সকাল থেকেই কেমন যেন লাগছে।’
আলিফাকে চিন্তিত দেখাল।কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে কিছু একটা ভাবল।অতঃপর ওর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল।ওকে এমন হাসতে দেখে আরাবী ভ্রু-কুচকে বলে,’ আমি অসুস্থ আর তুই হাসছিস?’
আলিফা ওর বত্রিশ পাটি দাঁত দেখিয়ে দিল।তারপর আবার সিরিয়াস হয়ে গেল।অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে আরাবীকে জিজ্ঞেস করে, ‘ তোর কি খাবার দেখলে বমি পায়? সত্যি করে বলবি।’
আরাবী অতোশতো না ভেবে সত্যি কথাই বলল, ‘ হ্যা ইদানিং বমি পায়।’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘ মাথা ঘুরায়।’
‘ ওতোটাও না। তবে মাঝে মধ্যে।’
‘ ঘন ঘন ক্ষিদে পায়?’
‘ হ্যা।আর আমি খাচ্ছিও অনেকগুলো করে খাবার।’
‘ হুট হাট মুড সুয়িং হয়?’
‘ হ্যা হয়!’
‘ তোর লাস্ট পিরিয়ড কবে হয়েছিল?’

এই প্রশ্নটা ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল আলিফা।আরাবী চোখ বড় বড করে তাকাল আরাবীর দিকে।এইবার একনিমিষেই বুঝে গেল আলিফা কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে।আলিফা শুকনো ঢোক গিলে বলে,’ সত্যিই কি এটা হবে আলু?’
‘ তুই তোরটা ভালো জানিস।আমি যাস্ট ইঙ্গিতগুলো ধরিয়ে দিলাম।বাকিটা তোর হাতে।’
আরাবী দুহাতে মুখ ঢেকে নিল।ওর শরীর কাঁপছে।সত্যিই কি এটা হবে? ও কি মা হতে চলেছে? ওর পিরিয়ডের ডেট অনেক অভার হয়ে গিয়েছে।এতো ঝুট ঝামেলার মাঝে তো সেটা খেয়ালই নেই আরাবীর। আলিফা আরাবীর অবস্থা বুঝতে পেরে ওর কাধে হাত রাখল।আরাবী ছলছল চোখে ওর দিকে তাকাল।আলিফা হেসে বলে,’ বোকা মেয়ে।কাঁদছিস কেন?’

‘ আমি কি সত্যি মা হবো আলিফা?’
‘ আল্লাহ্ যদি রহমত করেন। আর এতে কান্নার কি আছে?এটা খুশির খবর।’
‘ আমি তো খুশিতে কাঁদছি।’
‘ ধুর এতো কান্না কাটি করে লাভ নেই।আমি বলে কি তুই একটা প্রেগ্ন্যাসি কিট এনে টেস্ট করে দেখে নিস।অথবা তুই হাসপাতালে গিয়ে টেস্ট করতে পারিস।এটাই বেস্ট হবে।এটায় একেবারে ১০০% সিউর হতে পারবি।’

আলিফার কথায় আরাবী মাথা নাড়িয়ে সায় জানাল।ইস,সত্যিই কি ও মা হবে? উপরওয়ালার কাছে দোয়া করল আরাবী যাতে এটা যেন সত্যি হয়।আচ্ছা জায়ান যখন জানবে সে বাবা হতে চলেছে। তখন লোকটা কি করবে?খুশিতে কি করবে লোকটা?যদিও এটা অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে হয়ে গিয়েছে।এখনও বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে কোন প্লানিং করেনি ওরা।

তবুও উপরওয়ালার রহমত বর্ষণ করে দিয়েছেন।তাই উপরওয়ালার দরবারে লাখো কোটি শুকরিয়া আদায় করে নিল।এটাই যেন হয়।আরাবীর খুশিতে তো পাগল পাগল লাগছে। ছুটে চলে যেতে ইচ্ছে করছে জায়ানের কাছে।লোকটা সেইযে বেড়িয়েছে কোন খবর নেই।কে বলে স্পেশাল একজন নাকি আসবে।তাকে আনতে গিয়েছে।কে এমন স্পেশাল মানুষটা কে জানে।আরাবী বুকের মাঝে চাপা উত্তেজনা নিয়ে অধীর আগ্রহে প্রিয় মানুষদের অপেক্ষা করতে লাগল।

এদিকে আলিফা খুশিতে পারে না চিল্লিয়ে বাড়ি মাথায় উঠিয়ে ফেলতে।নিজ বাড়িতে হলে এতোক্ষণে তাই করত।এখন আছে শশুড়বাড়ি।নিজেকে অনেক কষ্টে কন্ট্রোল করে রেখেছে।এইবার আল্লাহ্ আল্লাহ্ করে ওর ভাবনাটা একশো পার্সেন্ট সিউর হলেই হলো।আলিফা যখন নিজের ভাবনায় ব্যস্ত।এমন সময় ওর ফোনের টোন বেজে উঠল।ভাবনা চ্যুত হয়ে আলিফা ফোন হাতে নিয়ে দেখে ইফতির মেসেজ।মেসেজটা ওপেন করল আলিফা।সেখানে লিখা,

‘ একটু উপরে আসবে।কথা আছে।’
আলিফা মেসেজটা পড়া শেষ করেই আশেপাশে তাকাল এখানে সবাই আছে।ইফতির কাছে যেতে হলে সবার সামনে দিয়ে গিয়ে সিড়ি পেড়িয়ে তারপর যেতে হবে।যা ওর কাছে লজ্জার বিষয়।আর এখন এটা ওএ শশুডবাড়ি।বাগদানের পর এইটাই ওর প্রথম আসা।আলিফার রিপ্লাই মেসেজ লিখল,
‘ এখানে সবাই আছে।কিভাবে আসব?’
‘ সবাই আছে তো কি হয়েছে?’

‘ সবার সামনে দিয়ে সিড়ি ডিঙিয়ে আপনার রুমে যাব আমি।মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে আপনার?’
‘ মাথা তো অনেক আগেই খারাপ হয়ে গিয়েছে।যবে থেকে তোমার প্রেমে পরেছি।’
‘ ফ্লার্টিং বন্ধ করুন।আর এতোগুলো মানুষ আমরা নিচে আপনি উপরে কি করছেন?’
‘ ভাবছিলাম তোমার সাথে একটু রোম্যান্স করব।তাই রুমে এসেছিলাম।এখন সেই ঘুরে বালি।’
আলিফা হেসে দিল ইফতির মেসেজে।তারপর লিখে,

‘ রোম্যান্সের ধান্দা বাদ দিন।এই মুহূর্তে ভদ্র ছেলের মতো।’
‘অভদ্র হ‌য়ে‌ছি আমি তো‌মা‌রি প্রে‌মে , তাই
কা‌ছে আসো না আরো কা‌ছে আসো না’
‘উফ কি শুরু করলেন।নিচে আসুন।’
‘ আসছি।’
আলিফা লাজুক হেসে মাথা নত করে নিল।ইফতি টাও যে এমন।লোকটার কথায় এতো লজ্জা পায় আলিফা।তবে যাই হোক ভালোলাগে আলিফার ইফতির এই স্বভাবটা।

আরাবী জিহাদ সাহেব আর লিপি বেগমের দিকে বার বার তাকাচ্ছে। উশখুশ করছে কিছু জিজ্ঞেস করার জন্যে।জিহাদ সাহেব অনেকক্ষন যাবত মেয়েকে এমন আনচান করতে দেখে এইবার বলে উঠলেন,’ কিরে মা কিছু বলবি?’
বাবার কথায় যেন ভরসা পেল আলিফা।
‘ তোমাকে অনেকদিন একটা কথা জিজ্ঞেস করব।কিন্তু তুমি আর মা যদি কষ্ট পাও তাই সাহস করে উঠতে পারছি না।’
লিপি বেগম বলেন,’ তুই নির্দ্বিধায় আমায় বল মা।’

আরাবী সাহস পেয়ে বলে উঠে,’ মা ফিহা কোথায়?ওকে কেন দেখিনা।প্রায় মাস পেড়িয়ে গেল ওর কোন খবর পেলাম নাহ।কি হয়েছে ওর?ও কি এখনও আমায় ঘৃ’না করে মা?’
আরাবীর কথায় তারা জিহাদ সাহেব আর লিপি বেগমের মুখ অন্ধকার হয়ে গেল।চুপ হয়ে গেলেন তারা।নিহান সাহেব বলে উঠেন,’ আসলেই ভাই। মানছি ফিহা যা করেছে সেটা অন্যায়।তবে এভাবে আর কতোদিন চলবে?ওর কোন খবরই নেই একদম।’

ফাহিম বাবা মায়ের দিকে তাকাল।তারপর আরাবীর দিকে তাকাল।বাবা মায়ের কষ্টটা বুঝল ফাহিম।ওর নিজেরও কম কষ্ট হচ্ছে না ফিহার জন্যে।হাজার খারাপ হোক বোন তো ওর।ফাহিম বাবা মা’কে চুপ থাকতে দেখে নিজেই বলে উঠল,’ ফিহাকে আমরা লন্ডন পাঠিয়ে দিয়েছি।ওর এখানে থাকা ভালো হবে না।ওর মনে তোর প্রতি এতোই ঘৃ’না যে ওর মস্তিষ্ক কোনটা ভালো কোনটা মন্দ তাও মানছে না।

উন্মাদের মতো হয়ে গিয়েছে।মা যখন নিজের ভুল বুঝতে পারে।তখন ওকেও বলেছিল তোর কাছে এসে যেন ও ক্ষমা চায়।ও মাকেও আক্রমন করতে গিয়েছিল।তাই সবটা বিবেচনা করে তোর জন্যে,ওর জন্যে মোট কথা আমাদের সবার ভালোর জন্যে ওকে দূরে পাঠিয়ে দিয়েছি।দূরে গিয়ে যদি মেয়েটা পরিবারের গুরুত্ব বুঝে।’

ফাহিমের বুক ভার হয়ে আসল।চোখটা জ্বলছে।বোনের জন্যে বুকের ভীতর হাহাকার করছে।কেমন আছে মেয়েটা কে জানে? অভিমান করে আছে অনেক ওদের প্রতি।তাই তো লন্ডন যাওয়ার পর কোন প্রকার যোগাযোগ করেনি ওদের সাথে।জিহাদ সাহেবও মেয়ের জন্যে বুকটা পু’ড়ে যাচ্ছে।সন্তান যতোই খারাপ হোক।সন্তান তো সন্তানই।লিপি বেগম চোখ থেকে পানি ঝরছে।মেয়েটার সাথে আজ কতোদিন হলো তিনি কথা বলেন নাহ।কতোদিন হলো ফিহার কণ্ঠে মা ডাক শোনা হয় না।এসবই যে উনার পাপের ফল তা উনি ভালো ভাবেই জানেন।তবুও উপরওয়ালার কাছে উনি সর্বদা চান তার মেয়েটাকেও যেন তার মতো সুবুদ্ধি দান করেন।সময় থাকতে ভালো পথে ফিরে আসে।পরিবার, পরিজন যে কতোটা গুরুত্বপূর্ণ তা যেন মেয়েটা বুঝতে পারেন।

এদিকে আরাবী স্তব্ধ। ও কোনদিন ভাবতেও পারেনি।বাবা মা এমন একটা সিদ্ধান্ত নিবেন।শেষে কিনা ফিহাকে সবার থেকে এতো দূরে পাঠিয়ে দিলেন।তারা তো ওর জন্মদাতা পিতা মাতা না।তাও ওর ভালোর জন্যে নিজের জন্ম দেওয়া সন্তানকে তাদের থেকে দূরে সরিয়ে দিলেন।আরাবী কি বলবে ভেবে পেল না।আপন মা বাবারাও তো সন্তানের জন্যে এতোটা করে না।আর ও তো দত্তক নেওয়া।কুড়িয়ে পাওয়া সন্তান তাদের।কৃতজ্ঞতায় বুক ভার হয়ে আসে আরাবীর।সোজা গিয়ে ঝাপিয়ে পরে জিহাদ সাহেবের বুকে।কাঁপা গলায় বলে উঠে,’ আমার জন্যে আজ ফিহাকে এতো কষ্ট করতে হচ্ছে।আমার জন্যে ওকে এতো দূরে গিয়ে পরিবার ছাড়া থাকতে হচ্ছে।আমায় ক্ষমা করে দিও বাবা।আমার জন্যে তোমাদের এতো কষ্ট সহ্য করতে হচ্ছে।’

জিহাদ সাহেব মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলেন,’ কে বলেছে তোর জন্যে?আমরা ওর জন্যে,ওর ভালোর জন্যেই ওকে দূরে সরিয়েছি।তাই একদম নিজেকে দোষারপ করবি না।’
আরাবী ছলছল চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে তারপর আবার মায়ের দিকে তাকাল।কান্নারত গলায় বলে,’ আমায় ক্ষমা করে দিও মা।আমার কারনে তুমি তোমার সন্তান থেকে দূরে।’

লিপি বেগম আরাবীর গালে মমতাময়ী হাতের স্পর্শ দিয়ে বলেন,’ এইসব কি ক্ষমা টমা চাচ্ছিস তুই।লন্ডন পাঠিয়েছি ফিহার ভালোর জন্যেই।ওখানে গিয়ে ওর পড়ালেখাও ভালো হবে।নিজেকে সময় দিতে পারবে।পরিবারের ভালোবাসা কি সেটাও বুঝবে।আর আমার এক মেয়েকে দূরে পাঠিয়েছি তো কি হয়েছে?আরেক মেয়ে তো এখানেই আছে।’
আরাবী লিপি বেগমকে জড়িয়ে ধরল।সবার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল বাবা মা আর সন্তানের এই আবেগঘন মূহুর্ত দেখে।ঠিক এমন সময় বাড়ির কলিংবেল বেজে উঠল।সাথি বেগম বলেন,’ ওই তো জায়ান এসে পরেছে বোধহয়।মুন্নি যা তো দরজাটা খুলে দিয়ে আয়।’

মিহান সাহেব বলে, ‘ কে এমন স্পেশাল মানুষটা এসেছে দেখতে তো হবেই।যার জন্যে আজ জায়ান কাউকেই কোন কাজে যেতে দেয়নি।’
‘ এইতো চাচ্চু।এখন অনায়াসে তাকে দেখে নিতে পারো।’
জায়ানের কণ্ঠস্বর পেয়ে সবাই দরজার দিকে তাকাল।আরাবীর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল জায়ানকে দেখে।পরক্ষণে ওর পাশে দাঁড়ানো একজন মধ্যবয়স্ক থেকে একটু বেশি বয়স হবে এমন একজন মহিলাকে দেখে ভ্রু-কুচকালো। কে এই মহিলা?একে তো কোনদিন দেখেনি আরাবী? আরাবী সাথি বেগমের দিকে তাকিয়ে ধীরে বলে উঠে,’ ইনি কে মা?’
সাথি বেগম নিজেও আজ প্রথম দেখলেন এই মহিলাকে।তাই আরাবীর প্রশ্নে তার ভাবুক গলার উত্তর,’ আমি নিজেও জানি না মা।আমি তো আজ তাকে প্রথম দেখলাম।’

সাথি বেগমও চিনেন না।আরাবী অবাক নজরে তাকিয়ে রইল জায়ান আর ওই মহিলাটির দিকে।
এদিকে দরজার দিকে একজনের নজর যেতেই যে ওর বুকের কাঁপন বেড়ে গিয়েছে।হাঁপা’নি রোগের ন্যায় শ্বাস নিচ্ছেন তিনি।ভয়ে তার হাত পা কাঁপছে। বরফের ন্যায় শীতল হয়ে পরেছে দেহ।

বাইশ বছর পর আবার সেই মুখের সাথে দেখা পেলেন তিনি।বাইশ বছর আগের অতীত কি এইবার সবার সামনে আসতে চলেছে?আর কি পারবেন না তিনি তা লুকিয়ে রাখতে?এদিকে জায়ান তার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসি দিল।এতে যেন তার গলা আরও শুকিয়ে গেল।মরুভূমির মতো।তার কণ্ঠনালি ভেদ করে কাঁপা স্বরে একটা নাম বেড়িয়ে আসল অস্ফুটস্বরে, ‘ রোজি?’

হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব ৪৬

ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।কেমন হয়েছে জানাবেন।দেরি হওয়ার জন্যে দুঃখিত।

হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব ৪৮