বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ২৮
জাওয়াদ জামী
তাহমিদ নিজের কাজে ভিষণ ব্যস্ত হয়ে গেছে। ও সকালে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। বাসায় ফিরতে রাত দেড়টা কখনো কখনো দুইটাও বেজে যায়। প্রতিমাসে দেশের বিভিন্ন জেলায় ফ্রি ক্যাম্পিং শুরু করেছে। যেদিন ক্যাম্পিংয়ের জন্য বাহিরে যায়, সেদিন রাতে বাসায় ফিরতে পারেনা। ক্যাম্পিং থেকে সোজা মেডিকেলে ঢুকে যায়।
কুহু সানাউল রাশেদিনের সাথে ভার্সিটিতে গিয়ে ভর্তি হয়েছে। সাথে আনান আর সিক্তাও ছিল। কুহুর ইচ্ছে ছিল তাহমিদের সাথে গিয়ে ভর্তি হবে। কিন্তু তাহমিদের ব্যস্ততার কারণে তা সম্ভব হয়নি। ভর্তির দিনে কিংবা ক্লাসের প্রথম দিনে তাহমিদের সাথে ভার্সিটিতে না যেতে পেরে কুহুর মনটা খারাপ হয়ে যায়। নতুন জীবনের শুরুতে কুহু খুব করে তাহমিদকে পাশে চেয়েছিল। কিন্তু ওর চাওয়া অপূর্ণই থেকে যায়।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
” কি গো উড়াল পাখি, এইভাবে উইড়া উইড়া চললে তো সবার নজরে পড়বা। এমনিতেই তুমি ডাঙ্গর মেয়ে, তারউপর চেহারাসুরতও মাশা-আল্লাহ। এইভাবে আকাশে না উইড়া ইকটু মাটিতেও পা রাখ। আমরাও খুব কাছে থেকে তোমার রূপ দেখে চোখ জুড়াই। এমন নয়া গাঙের পানির মত শরীর দেখলে যে করো লোভ জাগবে। তাই এমন উইড়া উইড়া চলতে নাই। ” দৃষ্টি স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিল। পথিমধ্যে জমিরউদ্দীন মেম্বার ওকে দেখে বাজেভাবে কথাগুলো বলল।
দৃষ্টিও ছেড়ে দেবার পাত্রী নয়। ও এমনিতেই এই বুড়ো মেম্বারকে সহ্য করতে পারেনা। তার ওপর আজকের বলা কথাগুলো শুনে ওর রা’গ তরতর করে বেড়ে যায়।
” আপনার ঐ বুইড়া চোখ দিয়ে আমার রূপ দেখার দরকার নেই। আমার রূপ কোন জোয়ান, সুদর্শন ছেলে দেখবে। আপনাদের মত কিছু বুইড়া খা’টা’শে’র জন্য রাস্তা দিয়ে উইড়া উইড়া হাঁটতে হয়। আপনাদের বাতাস যদি শরীরে লাগে তবে সেই শরীরে পোকা ধরবে বুঝলেন? আমার রূপ দেখে আপনার দৃষ্টি জুড়ানোর দরকার নেই। আপনি বরং ক’ব’রে’র মাটি দেখে চোখ জুড়ান। কয়দিন পর তো ঐখানেই আসল ঠিকানা গড়বেন। ” দৃষ্টি মুখ ঝামটা দিয়ে বাড়ির পথে পা বাড়ায়।
” আহ্ কি তেজ। এমন তেজি মেয়েই তো দরকার। কেমন কথায় কথায় ফোঁ’স কইরা উঠে। এইডারে দেখলে নিজেকে ধইরা রাখা যায়না। এর বড় বোনডারে তো পাওয়া হলোনা। যদি একবার এইডারে পাই, তবে কুহুরে না পাওয়ার আফসোস ঘুচব। ” জমিরউদ্দীন মেম্বার বুকে হাত রেখে অশ্লীল ভঙ্গিতে বলল।
দৃষ্টি গজগজ করতে করতে বাড়িতে প্রবেশ করল। শিউলি আক্তার উঠানে কাজ করছিল। দৃষ্টি ভেতরে আসলে ওর মুখের দিকে তাকিয়েই শিউলি বুঝল, তার মেয়ের কিছু একটা হয়েছে।
” কি রে দৃষ্টি, কি হইছে তর। চোখমুখ ইমুন কুঁচকায় রাখছস ক্যান? ”
” আম্মু, তুমি যদি আর কখনো ঐ বুইড়া মেম্বারকে বাড়িতে ঢুকতে দাও, তবে আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাব, বলে দিলাম। ”
” হেরে সেই কবেই আকারইঙ্গিতে এই বাড়িতে আসবার মানা করছি। হেয় তো আর এদিকে আসেনা। কেন কি হইছে? হেয় কি করছে? ”
” ঐ বুইড়া ভাম, আমার শরীর দেখে মজা নিতে চায়। খ’বি’শ বুইড়া, আর কত খারাপ কথা বলল!
আমার শরীর নাকি নয়া গাঙের পানির মত। কয়দিন আপুর পিছনে লেগেছিল। এখন আপু নেই তাই আমার দিকে নজর দিয়েছে। ”
” এইগুলান কি কস! হেয় তরে এইসব কতা কইছে! আবার কুহুরেও খারাপ নজরে দেখছে! আজ তর বাপে আসুখ। হের এত্তবড় সাহস। আমার মাইয়ার দিকে কুনজর দেয়। হের চোখডি আমি তুইলা নিমু। ”
” থাক এখনই আব্বুকে কিছু বলোনা। আব্বুর শরীর এমনিতেই ভালো নেই। তার ওপর এসব শুনলে আব্বুর জন্য ভালো হবেনা। এরপর সে যদি কিছু বলে তখন আব্বুকে বল। ”
দৃষ্টি নিজের ঘরে যেতে যেতে বলল
এদিকে শিউলি রা’গে ফোঁপাচ্ছে। ওর মেয়ের দিকে মেম্বার নজর দিয়েছে। এখন যদি মেম্বার ওর সামনে থাকত, তবে ও মেম্বারকে দা দিয়ে কো’পা’ত।
” কি করছ, ভাবি? ভেতরে আসব? ” কুহু নীরার দরজার বাইরে থেকে ডাক দিল।
” ভেতরে এস, কুহু। তুমি জিজ্ঞেস করেই তবে আমার রুমে আসবে! কখনো আর এমন করোনা। তোমার যখন মন চাইবে, তুমি কখনই রুমে আসবে। ”
” না ভাবি, এটা খারাপ দেখায়। তোমার রুমে তুমি স্বাধীনভাবে, খোলামেলা হয়ে থাকতে পার। নিজের রুমের স্বাধীনতা অন্যান্য জায়গার তুলনায় একটু বেশিই হয়। আমি যদি অনুমতি না নিয়ে আসি তখন বিষয়টা খারাপ দেখাবে। তূর কোথায়? ”
” তূর ওর দিদুনের সাথে বেড়াতে গেছে। কিন্তু আমাদের কুহু দেখছি বড়দের মত কথা বলছে। এরপর থেকে তাহলে কুহুর রুমেও আমাদের নক করে ঢুকতে হবে ” নীরা দুষ্টুমি করে বলল।
” ভাবি, তুমি আমার কথা অন্যভাবে নিওনা। আমি কিন্তু এমনটা ভেবে বলিনি। তাছাড়া ছোট বোনের রুমে ঢুকতে নক না করলেও চলে। ”
” এটা কিন্তু তুমি ঠিক বললেনা। প্রাইভেসি কিন্তু সবারই থাকে। তাই বিষয়টা আমারও মেনে চলা উচিত। ”
” বাদ দাও এসব কথা। এবার বল ভাইয়ার কাছে কবে ফিরছ? একমাস হতে চলল ঢাকায় এসেছ। ভাইয়াকে ছাড়া দিনকাল কেমন কাটছে? তবে তুমি চলে গেলে আমি একা হয়ে যাব। আজকাল সিক্তাও ব্যাস্ত থাকে। ”
কুহুর কথা শুনে নীরার মুখ ছোট হয়ে যায়। মুখে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে জবাব দেয় নীরা,
” আরও কিছুদিন তোমাদের কাছে রাখবেনা আমাকে? আমি যে আরও কিছুটা সময় তোমাদের সাথে কাটাতে চাই। তোমাদের সাথে কাটান একেকটা দিন, একেকটা ক্ষন আমাকে জীবনের কালো দিক ভুলে থাকতে সাহায্য করে। আমি তোমাদের মাঝে থেকে একটু প্রান খুলে বাঁচতে চাই কুহু। ” নীরার চোখ ভর্তি নোনাজলে বিচ্ছেদের সুর বাজছে।
” ভাবি, তুমি এভাবে বলছ কেন? তোমার কি কিছু হয়েছে? ভাইয়ার সাথে মনোমালিন্য হয়েছে বুঝি? তুমি চাইলে আমাকে বলতে পার। আমি যতটুকু পারি তোমাকে সাহায্য করব। ”
” না গো আমার কিছুই হয়নি। মাঝে মাঝে নিজেকে কেমন এলোমেলো লাগে। উদাসী মলয় এসে হৃদয়মাঝারে ছুঁয়ে দিয়ে যায়। তাই এমন আবোলতাবোল বকি। ” নীরা চোখ মুছে বলল।
কুহু আজ নিশ্চিত হয়ে গেল নীরার সাথে তাওহীদ ভাইয়ার সম্পর্ক ভালো যাচ্ছেনা। দুজনের মধ্যে গুরুতর কিছু একটা ঘটেছে। আজই একবার এটা নিয়ে তাহমিদের সাথে আলোচনা করতে হবে। তবে নীরাকে কিছু বুঝতে দেয়না কুহু। ও হাসিমুখেই নীরার সাথে গল্প করতে থাকে।
” আচরণের ভাবি, তুমি পড়াশোনা করেছ কোথায়? তোমাদের গ্রামের বাড়ি কোথায়? তুমি তো ঢাকায় ভাইয়ের বাসা থেকে বেড়িয়ে আসলে। ”
” আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ম্যানেজমেন্টে পড়াশোনা করেছি। আর আমার গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জ। গ্রামে একটা চাচা ছাড়া কেউই থাকেনা। ভাইবোন, দুই চাচা, ফুপুরা সবাই জীবিকার তাগিদে দেশের বিভিন্ন জায়গায় থাকে।বছরে একবার শুধু রমজানের ঈদে সবাই গ্রামে যায়। তুমি যাবে কুহু, আমাদের গ্রামে? ”
” ব’জ্জা’ত ডক্টর না বললে আমার কোথাও যাওয়া হবেনা, ভাবি। আমার গন্তব্য শুধু বাসা থেকে ভার্সিটি, আর ভার্সিটি থেকে বাসা। ঐ ব’জ্জা’ত’টা আমার সীমানা নির্ধারন করে দিয়েছে। ” কুহু স্নিগ্ধ হেসে বলল।
” আমার দেবরের ভালো উপাধি দিয়েছ। সে কি জানে তাকে এই নামে ডাক? ”
” পা’গ’ল হয়েছ! আমি তাকে জানিয়ে ডাকি, আর সে সবার সামনে আমার সম্মানের দফারফা করুক। তাকে জানোনা, সে কেমন মানুষ! ঠোঁ’ট’কা’টা, ফাজিল লোক একটা। ”
” তবে যা-ই বলনা কেন, তাহমিদ তোমাকে প্রচন্ড ভালোবাসে। সব সময়ই তোমাকে কেমন বুকে আগলে রাখে। তোমার জন্য ওর চোখে আমি সত্যিকারের ভালোবাসা দেখেছি। তোমাকে নিয়ে পাহাড়সম চিন্তা করতে দেখেছি। এমন ভালোবাসা সবার ভাগ্যে জোটেনা। এমন যত্নবান মানুষ চাইলেও সবাই পায়না। এমন মুল্যবান রত্নটিকে ভাগ্যগুনে তুমি পেয়েছ। হৃদয় কুঠুরিতে অতি যত্নে তাকে ভালোবাসায় বন্দী করে রেখ। ” নীরার চোখে অদ্ভুদ একটা দ্যুতি ছড়াচ্ছে। সেই দ্যুতির প্রতিটা কনা সাক্ষ্য দিচ্ছে নীরা কঠিনভাবে ভালোবাসাহীনতায় ভুগছে।
” আমি জানি ভাবি, সে আমাকে অনেক ভালোবাসে। তার শরীরের প্রতিটা রোমকূপও তার হৃৎস্পন্দনের ন্যায় আমাকে জানান দেয় তার ভালোবাসার গভীরতা সম্পর্কে। ”
” ভাবি, তুমি এখানে! আর ঐদিকে দিদুন তোমাকে খুঁজে খুঁজে হয়রান। ” সিক্তা এসে ওদের কথার মধ্যে বাঁধ সাধল।
সিক্তার কথা শুনে নীরা আর দেরি করলনা। কুহুকে নিয়ে বেরিয়ে যায় দিদুনের রুমের উদ্দেশ্যে।
রাত দেড়টায় তাহমিদ বাসায় এসে দেখল কুহু ওর অপেক্ষায় ক্ষন গুনছে।
ও ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করেই কুহুকে বুকে জড়িয়ে ধরে ললাটে অধর ছোঁয়ায়।
” আমার সুখ পাখি বুঝি এতক্ষণ না খেয়েই, আমার জন্য অপেক্ষা করছে? আমি না আসা পর্যন্ত নাহয় একটু ঘুমিয়ে নিতে। ”
” আপনার চিন্তা মন-মস্তিকে সর্বদা বিরাজ করে। যেই মন মস্তিস্কে সদা আপনারই বিচরণ, সেই আপনাকেই দূরে রেখে আমি কিভাবে ঘুমাতে পারি। আপনি রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসেন। আমি ততক্ষনে খাবার গরম করছি। ”
” উহু, তুমিও আমার সাথে রুমে চল। আমি ফ্রেশ হব আর তুমি আমার অপেক্ষায় প্রহর গুনবে। এরপর দু’জনে একসাথে নিচে আসব। তুমি রান্নাঘরে টুকটাক কাজ করবে, আমি দেখব। খাওয়া শেষে দু’জনে কিছুক্ষণ নির্জন রাস্তায় রাতের সৌন্দর্য দেখব। অনেকদিন বাইক চালানো হয়না। এই সুযোগে অনেকদিন পর একটু নিজেকে ঝালাই করে নিব। ”
” আপনার অন্য কথা মানলেও, রাতে বাইক নিয়ে বেরোনোর কথা মানতে পারলামনা। সারাদিন অনেক পরিশ্রম করেন, রাতে বাসায় এসে এ ধরনের কোনও বায়না করবেননা। খেয়েদেয়ে সোজা বিছানায় যাবেন। ”
” ও বউ, বাঁধা দিচ্ছ কেন? আমারওতো ইচ্ছে করে তোমাকে নিয়ে বাহিরে যেতে। নেহাৎই সময় হয়না, তাই মনকে বেঁধে রাখি। শোন দু’জন মিলে খাওয়াদাওয়াও করব, বাইরে ঘুরতেও যাব, বিছানায়ও যাব আবার বউকে আদরও করব। তোমার জামাই অল ইন ওয়ান, বুঝলে বউ? অনেক রাত হয়েছে, আর দেরি নয়। রুমে এস। আজকের রাতটা আমি স্পেশাল করে তুলব। ”
এরপর আর কোন কথা থাকেনা। তাহমিদের সাথে কুহু রুমে আসে।
কুহু রান্নাঘরে টুংটাং শব্দে কাজ করছে। তাহমিদ ডাইনিং রুমে বসে কুহুকে দেখছে। আজ ওর সুখ পাখিকে পুরোদস্তুর গিন্নী লাগছে। কোমড়ে আঁচল গুঁজে খাবার গরম করছে কুহু। চুলের বেনী একটু ঢিলা হয়ে বেবি হেয়ারগুলো কপালে লেপ্টে আছে।
বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ২৭
দুই হাতে একগোছা করে চিকন সোনার চুড়ি একে অপরের সাথে লেগে রিনিঝিনি ছন্দ তুলেছে। তাহমিদ মুগ্ধ হয়ে দেখছে ওর রাতজাগা পাখিকে। যে পাখির মাঝেই ওর অস্তিত্ব। দিনশেষে যে পাখিতেই বিলীন হয় ওর পুরুষ সত্তা। যে পাখির মাঝেই ওর সুখ-দুঃখ নিহিত। যে পাখিতেই ও মত্ত থাকতে চায় আজীবন।