ধূসর রঙ্গের সন্ধ্যা পর্ব ৬ || লেখায়- মোসাঃফাতেমা আক্তার

ধূসর রঙ্গের সন্ধ্যা পর্ব ৬
লেখায়- মোসাঃফাতেমা আক্তার

আজকের সকালটা ছিলো একদমই অন্যরকম। ঘুম ভাঙ্গার পর প্রায়ই ২ মাস পর আমার পাশে খালামনিকে দেখতে পেলাম । ওনি আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। আমার কাছে এই ব্যাপারটা একদম নতুন না। এই ঘটনাটা আমার ছোটবেলা থেকেই ঘটে আসছে। ছোট খালামনির কোনো সন্তান নেই। ডিভোর্স হওয়ার পর আর ওনি বিয়ে করেন নি। ওনি আমাকে নিজের সন্তান মনে করেন।

আমি যখন ছোট ছিলাম স্কুলে যখন “My mother ” প্যারাগ্রাফ লিখতে বললা হতো। তখন আমি আমার আম্মুর জায়গায় খালামনির নাম লিখে দিতাম। অবশ্য এর পেছনে একটা মজার কারণ আছে তাহলে আমার আম্মুর নাম জেসমিন, আর খালামনির নাম জুঁই। যার ফলে আম্মুর নামের ইংরেজি বানান আমার একদমই মনে থাকতো না। কিন্তু খালামনির নাম জুঁই হওয়ায়। তার নাম ইংজেরিতে বানান করে লিখতে খুবই সহজ হতো। একবার আমার ইংলিশ ম্যাম আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলো, “সন্ধ্যা তোমার আব্বু কি দুটো বিয়ে করেছে? না মানে তোমার বার্থ সাটিফিকেট তোমার আম্মুর নাম জেসমিন আর তুমি কাগজে কলমে লিখো জুঁই।” এই কথা যখন বাসায় এসে বলি।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সেইদিনের কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে। কারণ আমি যখন ম্যামের বলা কথা বাসায় সবাইকে বলি। তখন আমরা রাতের খাবার খাচ্ছিলাম সবাই একসাথে সেদিন। খালামনিও আমাদের বাসায় ছিলো। খালামনি আমাকে মাছের কাটে বেছে দিছিলো। ঠিক তখনই আব্বুকে বললাম,

– আব্বু জানো, আজকে আমার ইংলিশ টিচার কি বলেছে ক্লাসে?
– না তো আম্মু কি বলছে ওনি তোমাকে?
– ওনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছে সন্ধ্যা তোমার আব্বু কি ২টা বিয়ে করছে?
আমার কথায় বাবার গলায় খাবার আটকে গিয়েছিল। খালামনি, আম্মু, আব্বু, দাদা, দাদি, আমার দিকে চোখ বড় করে তাকিয়ে ছিলো। ওনাদের ওভাবে তাকিয়ে থাকা দেখে আমিও ভয় পেয়ে গেছিলাম তখন। পরে দাদু বললো,
-সন্ধ্যামনি তোমার টিচার একথা কেন বলেছে? তুমি কি কিছু করেছো?
তখন আমি বললাম ,

– আমি তো কিছু করি নি। কিন্তু আমার বার্থ সাটিফিকেটে আম্মুর নাম জেসমিন আর আমি কাগজে কলমে লিখি আম্মুর নাম জুঁই তাই ওনি একথা জিজ্ঞেস করেছে আমাকে।
আমার কথা শুনে সেদিন খাবার টেবিলে সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছিলো। আমি সেদিন তাদের হাসি দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলাম। তখন তো বুঝি নাই তারা কেন হাসছিলো। এখন বুঝি ঐদিন তাদের হাসির পেছনে কি কারণ ছিলো। এর পর দাদু বললেন,
– শুনো দাদু মনি তোমার খালামনিও তোমার আম্মু হয়৷ তুমি তোমার ছোট খালামনিকে, ছোট আম্মু বলে ডাকবে। কেমন?
আমি তখনন মাথা নেড়ে বলে ছিলাম,
– আচ্ছা।

সেদিন খালামনি সবার সামনে বসেই আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করেছিলো অনেকক্ষণ।
আমি আমার আম্মু থেকে বেশি খালামনির কাছে থাকতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করতাম, এখনো করি । আম্মুও কখনো এই নিয়ে অভিযোগ করে নি। লোকে বলে আমি নাকি আমার খালামনির মতো গায়ের রং পেয়েছি।

খালামনি গায়ের রং একদম ধবধবে ফর্সা। একটু চিমটি দিলে সেই স্থানে রক্ত জমাট বেঁধে কালো হয়ে যায়। আমারও অবস্থা ঠিক একই রকম। শুধু একটা দিকেই মিল নেই তা হলো উচ্চতা। খালামনি আমার থেকে অনেক লম্বা। খালামনির হাইট ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি আর আমি শুধু ৫ ফুট। এছাড়া আমাদের চুল, চেহারার গঠন প্রায়ই এককই রকম। আমরা দুজন যখন কোথাও ঘুড়তে যাই তখন অনেকেই মনে করে আমরা দু বোন।

আমার নানুমনি যখন মারা যায়, তখন বলে খালামনি ৩ বছরের ছিলো । তখন থেকেই আম্মু খালামনিকে লালন-পালন করতো। তাই বলাই যায় আমার আম্মু খালামনির জীবনে প্রায়ই মায়ের ভূমিকা পালন করতো, এখনো করো। আমি আমার অপকটে স্বীকার করি যে আমি আমার সর্বত্রই জুড়েই খালামনিকে ভালোবাসা।
ঠিক তখনই খালামনি কথা আমার ধ্যান ভাঙ্গলো। খালমনি বললো,

-কিরে কি ভাবিস এতো? বেলা ক টা বাজে খেয়াল আছে তোর?
– কয়টা বাজে?
– ১০ টা বাজে উঠ জলদি।
আমি অনিচ্ছা থাকা সত্যেও উঠে পড়লাম বিছানা থেকে। হঠাৎই মনে পড়লো কালকের সেই মেয়ের কথা এতোক্ষণে হয়তো ঘুম ভেঙ্গে গেছে। জলদি ফ্রেশ হয়ে খালামনি, রুবি কে নিয়ে ছুটলাম আমার রুমে। রুমের দরজা খোলাই ছিলো তাও নক করে রুমে ঢুকলাম। রুমের ভিতরে গিয়ে দেখে মেয়েটা রুমে নেই। তাই আমি বারান্দায় গেলাম সেখানে গিয়ে দেখি মেয়েটা এক ধ্যানে আকাশে দিকে তাকিয়ে আছে।

একটুপরই হয়তো বুঝতে পারলো তার পাশে কারো উপস্থিতি। তাই সে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকালো আমি তা দেখে একটুকরো হাসি উপহার দিলাম। কিন্তু আমার হাসির উত্তরে সে হাসলো না। আগের মতোই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। এরপর বললাম,
-তোমায় আমার খালামনি ডাকছে রুমে আসো।
বলেই রুমে চলে এলাম মেয়েটার ব্যবহার আমার কাছে মোটেও ভালো লাগে নি। রুমে এসে রুবি কে বললাম দুধ চা করে আনতে সবার জন্য সাথে দইচিড়া।

আমি আকাশে দিকে যখন তাকিয়ে আমার জীবনের সুখ দুঃখের হিসাব করছিলাম ঠিক তখনই বারান্দায় মানুষের অবস্থানের টের পেয়ে আমি পিছনে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলা একটা অপরিচিত মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটা আমাকে দেখে একটু মুচকি হাসি দিয়ে ছিলো তার প্রতিত্তোরে আমি একটু হাসি ফেরত দেই নি। মেয়েটা নিশ্চয়ই আমাকে অহংকারী মনে করছে হয়তো। মেয়েটা আমাকে বললো খালামনি তোমাকে ডাকছে।

কে ওনি? তা জানতে আমি রুমে দিকে চললাম। রুমে গিয়ে দেখি অত্যন্ত এক সুন্দরী মহিলার সাথে সে বসে গল্প করছে খাটে। আমি তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমাকে দেখে মেয়েটা চুপ হয়ে গেলো। মেয়েটার দৃষ্টি অনুসরণ করে মহিলাটা আমার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। আমি ওনাদের দিকে হা করে তাকিয়ে আছি কারণ দুইজনই দেখতে এককই রকম। একটু আগে আমাকে যে মেয়েটি ডেকেছিলো সে একটু খাটো আর মহিলাটি লম্বা। এই পার্থক্য। মহিলাটি আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি এসে বলেন,

– বসো আমাদের সাথে।
একপ্রকার বাধ্য হয়েই ওনার থেকে একটু দূরে গিয়ে বসলাম এর মাঝেই একটা মেয়ে দইচিড়া দিয়ে গেলো। একবাটি দইচিড়া আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে মহিলা বললেন,
– দইচিড়া খাও? ভিষণ সুস্বাদু কিন্তু এটা খেতে।
দইচিড়া এমনেও আমার প্রিয় খাবার। কিন্তু এই মুহূর্তে খেতে ইচ্ছে করছে না।
ওনি আবারও বললেন,
– খেয়ে দেখো ভালো লাগবে।
ওনার কথা একচামচ দইচিড়া মুখে দিলাম। ওনি খেতে খেতে বললেন,

– নাম কি তোমার?
– নুসরাত জাহান কুহু।
– কি করা হয়?
– জ্বি, অনার্স প্রথম বর্ষে পড়ছি একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি থেকে।
– কাল এতো রাতে কোথায় যাচ্ছিলে তুমি?
– কমলাপুর রেলস্টেশনে।
– কেন?
– সুইসাইড করতে।
আমার উত্তর শুনে আমার দিকে চোখ বড় করে তাকিয়ে আছে এবং মেয়েটি মুখে চামচ নিয়ে তাকিয়ে আছে। ওনি আবার বলেন,

ধূসর রঙ্গের সন্ধ্যা পর্ব ৫

-মানে? কি বললে বুঝতে পারি নি।
-আপনি ঠিকই শুনেছেন । আমি সুইসাইড করতেই সেখানে যাচ্ছিলাম।
– পারিবারিক সমস্যা নাকি প্রেমিক ছেড়ে চলে গেছে অন্য কেউর হাত ধরে?
ওনার কথায় আমার প্রচন্ড হাসি পেলো। তাও বললাম,
– তেমন কোনো কিছু না।
– তাহলে কারণ কি? জানতে পারি যদি তোমার কোনো সমস্যা না হয়।
– আমার মতো মেয়েদের বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই দুনিয়াতে।
– কি বলছে কেন অধিকার থাকবে না,তোমার এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার?
– কারণ আমি একজন ধর্ষিতা ।

আমার কথায় ওনি আমার দিকে তাকিয়ে রইলে কিছুক্ষণ । এরপর একটু সময় নিয়ে বললেন,
– তুমি কেন এমন মনে করছো? তুমি ধর্ষিতা বলে তোমার বেঁচে থাকার অধিকার নেই? আল্লাহ তায়ালা তোমাকে দুইটা হাত ও পা দিয়েছে। যতদিন ওনি তোমার জন্য দুনিয়াতে রিজিক রেখেছে, ঠিক ততদিন তোমার এই দুনিয়াতে বেঁচে থাকার অধিকার আছে।
ওনার কথা শুনে আমার দু নয়ন দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লে।

ধূসর রঙ্গের সন্ধ্যা পর্ব ৭