জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ১০ || রোমান্টিক ভালবাসার গল্প

জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ১০
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

সৌহার্দ্যর এতো কাছে আসাতে তুর্বী নিশ্বাস আটকে আসছে। তুর্বীর ভয় আরও বাড়িয়ে দিয়ে সৌহার্দ্য চার আঙ্গুল দিয়ে তুর্বীর কানের নিচ দিয়ে গলায় স্লাইড করে চুলগুলো সরিয়ে দিল। মৃদু কেঁপে উঠল ও। কখনও কোন ছেলের এত কাছে আসা হয়নি তো! তাই এই সামান্য ছোঁয়াও সহ্য হচ্ছে না। তুর্বী যথেষ্ট শক্ত একটা মেয়ে। কিন্তু এখন ওর ঠিক কী হয়েছে ও নিজেই বুঝে উঠতে পারছেনা। সৌহার্দ্য আবারও একই ভঙ্গিতে বলল,

” ভয় করছে?”
তুর্বী এবার কম্পিত কন্ঠে বলল,
” আমি কিন্তু পুলিশ কেস করব, যদি আপনি আমার সাথে এমন কিছু করার সাহস দেখান।”
সৌহার্দ্য ঠোঁট চেপে হাসল, এরপর বলল,
” তাই? তা ঠিক কী বলবে পুলিশকে?”
” বলব যে আর.জে. SR আমায় কিডন্যাপ করে এনে আমার সাথে বাজে ব্যাবহার করেছে।”
” আচ্ছা! তা তুমি কী S.R. কে দেখেছ?”
তুর্বী না বোধক মাথা নাড়ল। সৌহার্দ্য আবার বলল,
” তাহলে কীকরে পুলিশকে বিশ্বাস করাবে যে তোমাকে S.R ই তোমাকে কিডন্যাপ করেছেন?”
তুর্বী এবার সত্যিই ভাবনায় পরল। এখন যদি S.R.ওর সাথে খারাপ কিছু করেও। ও তো কাউকেই বিশ্বাস করাতে পারবেনা যে S.R. ই এসব করেছে। কী করবে ও? ও কাঁদোকাঁদো গলায় বলল,
” আপনি খুব শেয়ানা একটা মাল আছেন।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সৌহার্দ্য চোখ ছোট ছোট করে ফেলল তুর্বীর মুখে দ্বিতীয়বার ‘মাল’ শব্দটা শুনে। কিন্তু কিছু না বলে প্রথমে তুর্বীর পা আর পরে ওর চোখ খুলে দিলো। তুর্বী আবছা অন্ধকারে কালো মাস্ক পরা একটা লোককে দেখে চমকে একটু দূরে সরে গেল। জোরে জোরে দুটো শ্বাস নিয়ে বলল,
” বাপড়ে বাপ! আমাকে হার্ট অ‍্যাটাক করিয়ে মারবেন না কী? কী ভয়ঙ্কর। এটা কী আপনার রিয়াল ফেস? এই জন্যেই কারো সামনে আসেন না বুঝে গেছি।”
” চুপ স্টুপিড! এরকম কোন মানুষ চেহারা হয়?”
তুর্বী বিড়বিড় করে বলল,
” আপনি যে মানুষ সেটা নিয়েও আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে।”
সৌহার্দ্য শুনতে পেল তুর্বীর কথা, কিন্তু সেদিকে পাত্তা না দিয়ে একটানে নিজের কাছে নিয়ে এল। হাত খুলতে খুলতে বলল,

” সবসময় এমন ক্যাঙ্গারু স্টাইলে না লাফালে হয় না?”
” আমার বডি, আমার উইশ। আপনার কী তাতে?”
সৌহার্দ্য হতাশার নিশ্বাস ত্যাগ করল। এমন কেন মেয়েটা? একটু বেশিই চঞ্চল। ওর কী একবারও মনে হচ্ছেনা এখান থেকে পালানো উচিত? তুর্বী মুখ ফুলিয়ে বলল,
” এইযে মিস্টার? আপনি জানেন আপনি একটা কিপটে, হাড় কিপটে ? একটা মেয়েকে তুলে এনেছেন অথচ কিছু খেতে অবধি দিলেন না এখনও। সেই দুপুরে ক্যানটিনে একটু খেয়েছি। জানেন খিদেতে আমার পেট জ্বলে যাচ্ছে।”
সৌহার্দ্য তুর্বীর কথায় এবার আর অবাক হলনা। কারণ ইতিমধ্যে বুঝে গেছে মেয়েটা কেমন। কিন্তু ভাবল যে সত্যিই তো। সেই দুপুরে খেয়েছে এতক্ষণ না খাইয়ে রাখাটা ঠিক হয়নি মোটেই। সৌহার্দ্য ফোন বের করে কাউকে একটা ফোন করে বলল রুমে খাবার দিয়ে যেতে। তুর্বী মনে মনে কিছু একটা ভেবে সৌহার্দ্যর মুখে পরা মাস্কটা টান মেরে খুলতে গেল কিন্তু তার আগেই সৌহার্দ্য তুর্বীর হাত ধরে ফেলল। তুর্বী একটু হকচকিয়ে গেল। স‍ৌহার্দ্য মুচকি হেসে বরর,
” তুমি নিজেকে যতটা চালাক ভাবো। এক্চুয়ালি তুমি এতটাও চালাক নও ইউ নো।”

তুর্বী একটানে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে হাত ভাড মুখ ঘুরিয়ে ফেলল। সৌহার্দ্য কিছু বলল না। পকেট থেকে ফোন বেড় করে স্ক্রোল করতে লাগল। তুর্বী মনে আড়চোখে এই মুখশধারী ব্যাক্তিকে দেখছে আর ভাবছে যে এখন আপাতত ভীষণ খিদে পাচ্ছে। আগে খেয়ে নিক তারপর ভাববে কীকরে পালানো যায়। এসব ভাবতে ভাবতে দরজায় নক পরল। সৌহার্দ্য উঠে গিয়ে দরজাটা অর্ধেক খুলে খাবারের ট্রে টা নিয়ে দরজা আবার লাগিয়ে দিয়ে তুর্বীর সামনে রেখে বলল,
” নিন আগে খেয়ে নিন ম্যাম। আপনার সাথে অনেক হিসেব এখনও বাকী আছে।”
তুর্বী খেতে নিয়েও থেমে গেল? রিখিয়া টা খেয়েছে তো? ও নেই রিখিয়ার কী অবস্থা হয়েছে এখন? কান্নাকাটি করছে না-কি? তুর্বীকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে সৌহার্দ্য বলল,
” খাচ্ছোনা কেন?”
তুর্বী আনমনেই বলল,

” রিখুটা কী করছে কে জানে? খেয়েছে কী-না সেটাও জানিনা। সব আপনার জন্যে।”
সৌহার্দ্য মনে মনে বেশ অবাক হল। ও এতদিন ভাবত যে ওর আর বিহানের মত বন্ডিং কারো কখনও হতেই পারেনা। কিন্তু তুর্বী আর রিখিয়ার বন্ডিং দেখে সেই ধারণা ভেঙ্গে গেছে সৌহার্দ্যর। ও একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল,
” তুমি এখানে না খেয়ে থাকলে কী ওর খাওয়া হয়ে যাবে? বরং তুমি এখন না খেলে আমার হাত থেকে পালানোর উপায় বা শক্তি কোনটাই পাবে না।”
তুর্বী একটা মুখ ভেংচি দিয়ে খেতে শুরু করল। সৌহার্দ্য মুচকি হেসে বেডে হেলান দিয়ে ফোন দেখতে লাগল। কিন্তু মূলত ও ফোন দেখার বদলে তুর্বীকেই দেখছে। তুর্বীর সেদিকে খেয়াল নেই। ওর ভীষণ খিদে পেয়েছে তাই ওর পুরো মনোযোগ খাওয়াতেই। সৌহার্দ্যর কী হয়েছে ও নিজেই জানেনা। কখনও কোন মেয়ের দিকে এভাবে তাকায়নি। কিন্তু আজ নিজের অজান্তেই দেখছে। তাও এমন একটা মেয়েকে যে ওর চিন্তাধারা, দৃষ্টিভঙ্গির সম্পূর্ণ বিপরীত জগতে বসবাস করে।

বিহান রিলাক্স মুডে গাড়ি চালাচ্ছে। রিখিয়া এদিক ওদিক তুর্বীকে খুঁজছে। বিহানও মাঝেমাঝে রিখিয়াকে দেখিয়ে দেখিয়ে খোঁজার ভান করছে। রিখিয়া কয়েকবার পুলিশে যাওয়ার কথা বলেছে কিন্তু বিহান ওকে এটা ওটা বুঝিয়ে কনভেন্স করে নিয়েছে। এমনভাবে বুঝিয়েছে যে রিখিয়াও মানতে বাধ্য হয়েছে।হঠাৎ রিখিয়া শব্দ করে কেঁদে দিল। বিহান পুরো হকচকিয়ে গেল। তাড়াতাড়ি গাড়ি ব্রেক করে রিখিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
” হেই, কাঁদছো কেন তুমি? লিসেন, কিচ্ছু হবেনা তুর্বীর খুঁজে পেয়ে যাবো ওকে আমরা।”
রিখিয়া ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল,

” আপনি বুঝতে পারছেন না। তুর খুব চঞ্চল। জানিনা কী করে বসে আছে মেয়েটা।”
বিহান রিখিয়ায় কাঁধে হাত রাখল। এতে রিখিয়া আরও জোরে কেঁদে উঠল। বিহান মনে মনে বলল, ‘ব্রো, এটা কাকে তুলে নিয়ে গেলি তুই? তার বান্ধবী তো এখন আমার মাথা খাচ্ছে।’ লম্বা একটা শ্বাস ফেলে বলল,
” আচ্ছা, কেঁদোনা। আমি বলছি তো খুঁজে পেয়ে যাবো।”
রিখিয়া অধৈর্য হয়ে বিহানের দুই হাত ধরে বলল,
” প্লিজ, খুঁজে দিন ওকে। প্লিজ! ”
বিহান হাতের দিকে একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নরম গলায় বলল,
” তুর্বীর কোন ক্ষতি হবেনা, আমি কথা দিচ্ছি।”

কিছুক্ষণ পর রিখিয়ার খেয়াল হল যে ও বিহানের হাত ধরে আছে। তাড়াতাড়ি নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল ও। খোলা চুলগুলো কানের পিঠে গুজে একটু সরে বসল। কখনও কোন ছেলের এভাবে কাছে যায়নি ও। তাই এমন অনুভূতি। বিহান রিখিয়ার অস্বস্তি বুঝতে পেরে ওকে নরমাল করতে বলল,
” রাতে খেয়েছ কিছু?”
রিখিয়া মাথা নেড়ে না বলল। বিহান একটু ভেবে বলল,
” চলো আগে কিছু খেয়ে নি হ্যাঁ?”
রিখিয়া ভাঙা গলায় বলল,
” আমি এখন খাবো না।”
” দেখ আমার এখন ভীষণ খিদে পেয়েছে। তুমি খাবেনা তারমানে এটা নয় যে আমিও খাবোনা।”
” আপনি গিয়ে খেয়ে নিন না। আমি খাবোনা।”
” আজব। আমার সাথে একটা মেয়ে আছে। সে খাবেনা অথচ আমি খাবো? আমাকে দেখে কী এতোটা ম্যানারলেস মনে হয়?”

রিখিয়া ভ্রু কুচকে তাকাল। বিহান ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বলল,
” কী আর করার। একজনের উপকার করতে এসে এখন সারারাত না খেয়ে কাটিয়ে দিতে হবে। একেই বলে কপাল!”
রিখিয়া এবার বিরক্ত হয়ে বলল,
” আজব লোকতো আপনি? এরকম সময়েও মজা করছেন?”
বিহান ইনোসেন্ট মুখ করে বলল,
” আরেহ! আমিতো তোমাকে হেল্প করছি। আর তুমি আমাকেই কথা শোনাচ্ছ? ভালাই কা জামানাই নেহি রাহা। ঠিকাছে, কী আর করার? না খেয়েই থাকতে হবে।”
রিখিয়া এবার ভাবল ঠিকই তো। না খেয়ে কতক্ষণ খুঁজবে ছেলেটা? অনেক্ষণ তো হলো। রিখিয়া ইতস্তত করে বলল,
” আচ্ছা চলুন। কিন্তু এখন তো বেশ রাত হয়েছে। এতো রাতে কোন রেস্টুরেন্ট খোলা আছে?”
“সামনে রেলওয়ে স্টেশন আছে। ওখানে কিছু খাবারের দোকান সারারত খোলা থাকে চল ওখানে যাওয়া যাক?”
রিখিয়া মাথা নাড়ল। বিহান গাড়ি স্টার্ট করে স্টেশন অবধি গেল। ওখানে গিয়ে দুজনেই গাড়ি থেকে নামল। বাইরে এখন বেশ ঠান্ডা। চারপাশে ছোটখাটো অনেক দোকান।ওখানে একটা দোকানে বিহান দুজনের জন্যে পরোটা আর ডিম ভাজা দিতে বলল। এরপর দুজনে বেঞ্চে বসল। বিহান কিছু একটা ভেবে বলল,

জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ৯

” তুমি একটু বসো আমি একটা কল করে আসছি।”
রিখিয়া মাথা নাড়ল। বিহান একটু দূরে গিয়ে সৌহার্দ্যর নাম্বারে কল দিল। ওপাশ থেকে সৌহার্দ্য ফোন তুলে বলল,
” হ্যাঁ বল।”
” তোর ভয়েজের কী হল? এনিওয়ে ব্রো, তুর্বী তোর কাছে নাকি?”
সৌহার্দ্য একপলক তুর্বীর দিকে তাকিয়ে বলল,
” হ্যাঁ কেন বলত?”
বিহান একটা শ্বাস ফেলে রিখিয়ার কথা খুলে বলল। সব শুনে সৌহার্দ্য বলল,
” এক কাজ কর। আজ রাতটা ওকে তোর কাছেই রাখ। দেখিস যাতে প্রবলেম না হয়।”
” তা কতক্ষণ রাখবি ওকে তোর কাছে? আর কী করছিস বলত ওর সাথে?”
” যতক্ষণ না আমাকে জ্বালানোর ভুত নামছে মাথা থেকে। আর বিশেষ কিছু করছি না। সবে প্রাইমারি ডোস দিয়েছি। অারেকটু খানি টাইট দেওয়া বাকি আছে।”
বিহান হেসে বলল,

” ওকে। দেখ টাইট দিতে গিয়ে নিজেই টায় টায় ফিস হয়ে যেওনা।”
” চুপ কর আর ওই মেয়েটার খেয়াল রাখ।”
বিহান ফোন রেখে রিখিয়ার কাছে গিয়ে দেখে রিখিয়া ঠান্ডায় কাঁপছে। দুইহাতের বাহু জড়িয়ে বসে আছে। তাড়াহুড়োয় গরম পোশাকও নিয়ে আসেনি মেয়েটা। বিহানের কী হল নিজেই জানেনা। ও ওর জ্যাকেট খুলে রিখিয়ার গায়ে জড়িয়ে দিল। রিখিয়া চমকে উঠল। কাঁপা গলায় কিছু বলার আগেই বলল,
” পরে নেও নইলে ঠান্ডা লেগে যাবে। আমার গায়ে ফুল হাতা গেঞ্জি আছেই। প্রবলেম হবেনা।”
এরমধ্যেই খাবার চলে এল। বিহান তাড়াতাড়ি হাত ঘসে খেতে শুরু করে দিল। রিখিয়া কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল বিহানের দিকে। রিখিয়ার খুব অস্বস্তি লাগছে বিহানের আশেপাশে থেকে। কিন্তু আপাতত ওর আর কিছু করারও নেই। তবে বিহান সম্পর্কে নতুন একটা ধারণা জন্ম নিল ওর। সেটা হল, ” ছেলেটা ভালোবাসার যোগ্য হোক, চাই না হোক ঘৃণার যোগ্য না।”

জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ১১