অপ্রিয় সেই প্রিয়জন পর্ব ২ || Ishita Rahman Sanjida

অপ্রিয় সেই প্রিয়জন পর্ব ২
Ishita Rahman Sanjida

মেঝেতে পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে মীরা। পিহু চিৎকার করে উঠল মীরার দিকে তাকিয়ে। পিহু মীরার কাছে যেতে নিলে নেহাল ওর হাত টেনে ধরে। ঘৃণায়

মেঝেতে পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে মীরা। পিহু চিৎকার করে উঠল মীরার দিকে তাকিয়ে। পিহু মীরার কাছে যেতে নিলে নেহাল ওর হাত টেনে ধরে। ঘৃণায় পিহুর গা ঘিন ঘিন করে উঠলো। পিছনে ঘুরেই নেহালের গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিল। থাপ্পর খেয়ে নেহাল পিহুর হাত ছেড়ে দিলো। পিহু দৌড়ে গিয়ে মীরাকে কোলে তুলে নিয়ে চিৎকার করে বলল,’কি চাই আর তোমার??সব তো শেষ করেই দিলে। এখন আবার কিজন্য এসেছো??’
থাপ্পর খেয়েও নেহালের কোন অনুশোচনা বা রাগ হলো না। সে ঠোঁটজোড়া প্রসারিত করে হাসলো। তার হাসি দেখে পিহু চোখ সরিয়ে নিলো। ঘেন্না হচ্ছে আজ নেহালের প্রতি। অথচ এই নেহালকেই এতদিন নিজের সবচেয়ে ভালো বন্ধু ভেবে এসেছে। নিজের এহেম কাজে নিজের প্রতি ঘৃণা হচ্ছে পিহুর। নেহাল পিহুর দিকে তাকিয়ে বলল,’চলো আমার সাথে।’
পিহু তীরের মতো প্রশ্ন ছুঁড়ল নেহালের দিকে, ‘কোথায় যাবো আমি??আর তুমি ভাবলে কি করে তোমার মতো নিচ লোকের সাথে আমি যাব?? এখুনি বের হয়ে যাও??’
পিহুর তীক্ষ্ণ চাহনিতে দমলো না নেহাল কড়া গলায় বলল,’তোমাকে যেতেই হবে পিহু। এখন তো ইফাজ নেই তোমার সাথে। সো তোমাকে আমার সাথেই থাকতে হবে।’
নেহালের কথাগুলো রাগ বাড়িয়ে দিচ্ছে পিহুর। মীরার হাত শক্ত করে চেপে ধরে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগল সে। জোর গলায় বলল,’আমার জীবনের শেষ নিঃশ্বাস থাকা পর্যন্ত তোমার সাথে কোথাও যাব না আমি।’
নেহাল হেসে পিহুর দিকে এগিয়ে এসে বলল, ‘জানি তুমি সোজা কথায় আসবে না তাই জোর করেই নিয়ে যাব।’
পিহু ব্যথিত কন্ঠে বলল,’কেন করছো আমার সাথে এসব??কি চাও আমার থেকে তুমি??কি ক্ষতি করেছি আমি তোমার??’
‘সবচেয়ে বড় ক্ষতি করেছো ওই ইফাজকে বিয়ে করে। কি আছে ওর যা আমার মধ্যে নেই?? আমি তোমাকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসতাম কিন্তু তুমি কি করেছো???ইফাজের জন্য আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছো। সেদিন থেকেই আমি প্রতিজ্ঞা করেছি তোমাকে একদিনের জন্য হলেও আমার করে ছাড়ব। তাই তো এখানে এসে তোমাদের সবার মন জয় করলাম। আর দেখো আমার কষ্ট সার্থক হলো আজ। তাই এখন চলো আমার সাথে।’
নেহাল পিহুর কথা শুনলো না। পিহুর থেকে মীরাকে ছাড়িয়ে ধাক্কা মারলো। মীরা গিয়ে ফ্লোরে পড়লো। কনুই এবং হাঁটুতে ব্যথা পেয়ে মীরা কেঁদে উঠলো। পিহু মীরার কাছে যাওয়ার আগেই নেহাল পিহুকে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে যেতে লাগলো। পিহু পারছে না চিৎকার দিতে কারণ গলা ব্যথা হয়ে গেছে কাঁদতে কাঁদতে। কাউকে ডাকলে সে শুনতে পাবে না। দরজার কাছে এসেই ওরা মুখোমুখি হলো একটা মেয়ের। বয়স খুব একটা বেশি নয়। পিহুর মতোই বয়স হবে। মেয়েটা পিহুর দিকে তাকিয়ে বেলে উঠলো,’কি হয়েছে পিহু??কাদছিস কেন??আর এই ছেলেটা কে??’
বলতে বলতে মেয়েটা আরো এগিয়ে আসলো।পিহু বলল,’আমাকে বাঁচা মুক্তা নয়তো এই লোকটা আমাকে নিয়ে যাবে??’
নেহাল বিশ্রি হাসি দিয়ে বলে,’লাইক সিরিয়াসলি??এই মেয়েটা তোমাকে বাঁচাবে??হাসালে পিহুমনি।’
নেহালের কথা শুনে মুক্তা রাগে গজগজ করে উঠলো। এই ছেলেটা কি জানে ওর ব্যপারে??
মুক্তা রেগেমেগে ব্যাগ থেকে একটা ছুরি বের করলো। প্রটেকশনের জন্য এটা সে সবসময় সাথে রাখে। নেহাল সেটা দেখে হাসতে হাসতে বলল,’এই ছোট ছুরি দিয়ে আমাকে ভয় দেখাবে??ওহ আমি তো খুব ভয় পেয়ে গেলাম।’
মুক্তা এতে আরো রেগে গেলো। ছুরি চালিয়ে দিলো যেহাতে সে পিহুর হাত ধরে আছে। নেহাল পিহুর হাত ছেড়ে নিজের রক্তমাখা হাত চেপে ধরে বিশ্রি গালি দেয় মুক্তাকে। ও ভাবেনি যে সত্যি সত্যি মুক্তা ওকে আঘাত করবে??মুক্তা ক্ষেপে গিয়ে বলে,’পৃথিবীর সব মেয়েকে পিহুর মতো নরম মনের মেয়ে ভাবলে ভুল করছিস তুই। ভালোয় ভালোয় এখান থেকে কেটে পর নাহলে এই ছুরি তোর গলায় চালাতে আমার এক মূহুর্ত সময় লাগবে না।’
নেহাল কিছু বলার আগেই মুক্তার হাজবেন্ড সামির এসে হাজির। নেহাল আর কিছু বলল না। ওখান থেকে চলে গেলো। রুমে এসেই মুক্তা দেখলো মীরা কাঁদছে। সে দ্রুত মীরাকে কোলে তুলে নেয়।
সোফায় বসে মীরাকে বুকে চেপে ধরে সামলায় পিহু। তার বুকেই ঘুমিয়ে পড়ে সে। মুক্তা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল যে কি হয়েছে?? বিনিময়ে পিহু চুপ করে রইলো। যখন মুক্তা ইফাজ আর ইশানের কথা জিজ্ঞেস করল তখন পিহু নিজেকে সামলে রাখতে পারলো না হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলো। এতে মুক্তা বেশ ঘাবড়ে গেল বলল,’আর কাদিস না পিহু এবার বল কি হয়েছে??’
পিহু নিজেকে সামলিয়ে বলতে লাগলো,’তুই তো জানিস যে ইফাজ অফিসের কাজে ঢাকার বাইরে থাকে। দু এক মাস পরপর এসে সপ্তাহখানেক থেকে আবার চলে যায়। এবার ও এসেছিল। আজকে বিকেলে আমরা সবাই ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান করি। কিন্তু আমার প্রচন্ড মাথা ব্যথা করছিল। তারউপর মীরাও ঘুমিয়ে পড়েছিল তাই আমি যাইনি ইফাজ আর ইশান গিয়েছিল। তার কিছুক্ষণ পর নেহাল আসলো।’
মুক্তা উৎফুল্ল হয়ে বলল,’এই নেহালটা কে??আগে তো দেখিনি।’
পিহু মাথা নিচু করে বলল,’নেহাল আমার চাচাতো ভাই। আমাকে প্রপোজ করেছিল কিন্তু আমি রিজেক্ট করেছিলাম। কারণ তখন আমি আর ইফাজ দুজন দুজনকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। তারপর আর নেহালকে দেখিনি। শুনেছিলাম সে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। এসব নিয়ে আমি আর ভাবিনি। কিন্তু পাঁচ মাস আগে নেহাল দেশে ফেরে। আর আমাদের বাড়িতে যাতায়াত শুরু করে। আমি প্রথমে আপত্তি করেছিলাম কিন্তু নেহাল বলেছিল যে ও সবকিছু ভুলে আমার সাথে বন্ধুত্ব করবে। আমি তাতে সায় দিয়েছিলাম। এটাই হলো আমার সবচেয়ে বড় ভুল। কেন যে ওর পাতা ফাঁদে পা দিলাম??এজন্য এখন আমার সংসার শেষ হতে চলেছে।’
পিহু আবার কেঁদে উঠলো। মুক্তা বলল, ‘তারপর কি হয়েছে??’
‘বিকেলে নেহাল আসায় আমি বিরক্তি হই। কারণ একসপ্তাহ আগে সে আবার আমাকে বিয়ের কথা বলেছে। আমি যাতে ইফাজকে ডিভোর্স দিয়ে ওকে বিয়ে করি। এজন্য ওকে আমি আসতে বারণ করে দেই তবুও ও আসে। জানি না কোন উদ্দেশ্য নিয়ে ও এসেছে। আমাকে টেনে রুমে নিয়ে এসে বিছানায় ধাক্কা মেরে ফেলে নিজের শার্ট খুলতে শুরু করলো। আমি চিৎকার করলাম। তাতে মীরার ঘুম ভেঙ্গে যায়। মীরাকে দেখে নেহাল অবাক হলো। কিন্তু আমার সাথে ধস্তাধস্তি করা শুরু করে দিল। আমি ধাক্কা মেরে ওকে সরিয়ে তাড়াতাড়ি শাড়ি ঠিক করতে করতে বের হই। আমার উদ্দেশ্য ছিল মানুষ জড়ো করা কিন্তু তার আগেই দেখি ইফাজ এসে পড়েছে। আমাকে আর নেহালকে ওভাবে দেখে উল্টো ভেবে নেয়। ইফাজ আমার কথা শুনতো কিন্তু তার আগেই কেউ বা কারা ওর কানে আমার নামে বিষ ঢেলেছে তাই ইফাজ আমাকে ভুল বুঝে চলে গেছে।’
পিহু আবার কাঁদতে লাগলো। মুক্তা একধ্যানে পিহুর দিকে তাকিয়ে রইল। মুক্তা খুব ভালো করেই জানে পিহু নরম মনের মানুষ। একদম তুলোর মতো। না, তুলোর থেকে যদি কিছু নরম হয় তা হলো পিহু। মুক্তা আর পিহু একই স্কুলে চাকরি করে। পিহু কখনো স্টুডেন্টদের সাথে ধমকের সুরে কথা বলেনি। সবসময় আদর করে কথা বলেছে যার দরুন সব স্টুডেন্টরা তাকে ভালোবেসে। কিন্তু মুক্তা তার বিপরীত। ক্লাসে গেলে সবসময় জোড়া বেত নিয়ে যেতো। পড়া না করে আসলে তার পিঠে ঠাস ঠুস মেরে দিতো। সবাই মুক্তাকে খুব ভয় পায়।আড়ালে সবাই রাক্ষসী রানি বলে ডাকে সবাই। কিন্তু সামনাসামনি সবাই মিষ্টি করে কথা বলে।
মুক্তা ভেবে পায়না এতো নরম কেন মেয়েটা। আজকে ও থাকলে হয়তো ইফাজ যেতে পারতো না। সবকিছু এখানেই মিটমাট করে ফেলতো সে। কিন্তু দূর্ভাগ্য ওদের সহায় হয়েছে। মুক্তা তিন মাসের প্রেগন্যান্ট তাই  ছুটিতে বাবার বাড়ি গিয়েছিল। আজ দুপুরে ফিরেছে সে। তাই রাতেই এসেছে পিহুর সাথে দেখা করতে।
মুক্তা কপালে ভাঁজ ফেলে বলে,’নেহালকে বিশ্বাস করাই ভুল হয়েছে তোর??হয়তো নেহাল ইফাজের চোখে তোকে খারাপ বানানোর জন্য এমনটা করেছে। নেহাল ইফাজের আসার খবর পেয়েই এসবের করেছে। তো এখন কি করবি??’
পিহু কিছু বলল না। সামির উদগ্রীব হয়ে বলে,’আমাদের উচিত ইফাজ ভাইকে গিয়ে সবকিছু খুলে বলা। আমার মনে হয় আমরা বোঝালে সে বুঝবে। তখন মাথা হয়তো গরম ছিল বলে পিহুর কথা শোনেনি। মাথা ঠান্ডা হলে অবশ্যই তাকে বোঝালে সে বুঝবে।’
মুক্তা সামিরের দিকে তাকিয়ে বলল,’অবশ্যই বুঝবেন। কারণ ইফাজ ভাইয়া পিহুকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে। একদিনের ভুল বোঝাবুঝি তে কিছু হবে না। পিহু গিয়ে সবটা বোঝালেই ওনি বুঝবেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ইফাজ ভাইয়ের কান ভাঙালো কে??’
সামির কিছুটা হেসে বলে,’আশেপাশে কি কম মানুষ আছে নাকি?? আমাদের সমাজে এমন কিছু মানুষ আছে যাদের ঠোঁটে মধু আর অন্তরে বিষ থাকে। মধুর সাথে বিষ মিশিয়ে তা পরিবেশন করে মানুষের মনে,যাতে কেউ বুঝতে না পারে। একে অপরের ভালো তারা দেখতে পায়না তাই হয়তো পিহুর নামে মিথ্যা বদনাম রটিয়েছে।’
মুক্তা মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,’হুম একদম ঠিক বলেছো। কিন্তু আমাদের দেরি করলে চলবে না। কালকেই সব মিটমাট করতে হবে।’
মুক্তা একটু থেমে পিহুর দিকে তাকিয়ে বলে,’ইফাজ ভাইয়া এখন কোথায় গেছে জানিস কিছু???’
পিহু মাথা নেড়ে না বোধক বলল।
নরম বেডের উপর ঘুমিয়ে আছে ইশান। পাশেই ইফাজ বসে আছে। ওর ঘুম আসছে না। একটু পর পর চোখের পানি মুছছে। পিহুর দেওয়া আঘাতটা জোরেই লেগেছে তার। পনেরো বছরের সম্পর্ক ওদের এভাবে শেষ করে দিতে পারলো পিহু?? টাকার এতোই যদি লোভ তাহলে একটা বার বলতে পারতো। ইফাজ হাসিমুখে তার আবদার পূরণ করতো। এতে যত কষ্টই হোক না কেন সে পিহুর আবদার মেটাতো। কিন্তু পিহু এভাবে ওর বুকে ছুরি মারলো কেন??ইফাজ বারবার বলছে,’কেন‌ করলে এরকম পিহু??আমি তো সবটা দিয়ে তোমাকে ভালোবেসেছিলাম।’
ইফাজ এখন বুঝতে পারছে যে পিহু আদৌ নরম মনের মানুষ নয়। কেননা আজ সে তার আসল রূপ দেখিয়ে দিয়েছে। যার জন্য প্রিয় মানুষদের ছেড়ে দিলো সেই আজকে সবচেয়ে অপ্রিয় ইফাজের। ভেতরটা ওর দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। কাঁদতে কাঁদতে সে এখন ফুঁপিয়ে উঠছে। ছেলেদের কাঁদা বারণ কিন্তু ইফাজ পারছেনা নিজেকে শান্ত রাখতে। বারবার পিহুর প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠছে চোখের সামনে।
এরমধ্যে ইশান একটু নড়েচড়ে উঠলো। ঘুমের ঘোরে সে আম্মু আম্মু বলতে লাগলো। এতে ইফাজ আরো ভেঙে পড়লো। তার এই ছোট ছেলেটা কিভাবে থাকবে তার মা’কে ছাড়া??
ইশান তো ঠিকমতো নিজের হাতে খেতেও পারে না। পিহু আদর করে খাইয়ে দিতো। তাহলে কি হবে ওর ছেলের ভবিষ্যত?? ইফাজ পরম যত্নে ইশানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। ইশান আবারও ঘুমের ঘোরে তলিয়ে গেলো।
ইফাজ বাসা থেকে বের হয়ে সোজা খান ম্যানশনে চলে এসেছে। ভেবেছিল ওর বাবা মা হয়তো আবার ওকে ফিরিয়ে দেবেন। কিন্তু তারা অবাক করে দিয়ে ইফাজকে সাদরে গ্রহণ করলো। তারাও খুশি হয়েছে তাদের ছেলে ফিরে আসায়। নাতিকে পেয়েও তারা খুশি। কিন্তু তারা বৌমা চায় না। ইশান তো ওনাদের বংশের রক্ত তাই ইশানকে ফিরিয়ে দেয়নি। ইফাজ ইশানকে নিয়ে নিজের বেডরুমে চলে যায়। কত বছর পর এই রুমে পা দিয়েছে সে ভাবতেই চোখজোড়া ভিজে আসে তার।
ঘুটঘুটে অন্ধকার বিরাজ করছে রুমে। খাটের উপর গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে ছোট্ট মীরা। পিহু জানালার গ্রিল ধরে বাইরে তাকিয়ে আছে। ঘুম আসছে না তার। কি করে ঘুম আসবে??যার বুকে মাথা রেখে ঘুমাতো সেই তো নেই। তাই পিহুর চোখে ঘুম নেই। এর আগেও ইফাজের সাথে মনোমালিন্য হয়েছে পিহুর। কিন্তু পরে ইফাজই এসে পিহুকে জড়িয়ে ধরে বলেছে,’আ’ম সরি!!আর কখনও তোমাকে ভুল বুঝবো না।’
পিহু তখন অভিমানী কন্ঠে বলতো,’যদি ভুল বোঝো কখনো??’
ইফাজ তখন হেসে পিহুর গাল টেনে বলতো, ‘তুমি আছো না??আমি ভুল বুঝলে তুমি ভালোবাসা দিয়ে সেটা পুষিয়ে দেবে। তোমার ভালোবাসায় যে আমি বড্ড কাতর পিহুরানি। তোমার পবিত্র ভালবাসা যে আমার সব রাগ অভিমান ভুলিয়ে দেয়। সেটা কি জানো না??’
পিহু সেদিন লাজুক হেসেছিলো। এই লাজুক মুখখানি যে ইফাজের খুব ভালো লাগে। তাই সবসময় রোমান্টিক কথা বলে পিহুকে লজ্জায় ফেলতো। এইতো সেদিন পিহু রান্না করছিল হুট করে ইফাজ এসে তাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে,’তোমার ওই নরম ঠোঁটের উষ্ণ পরশ পেতে চাই দেবে কি??’
পিহু তখন লজ্জায় একাকার হয়ে গিয়েছিল। বিয়ের এতবছর হওয়ার পর ও এত লজ্জা কোথা থেকে আসে তা ইফাজ আজও বুঝতে পারলো না।
এসব ভাবতেই আনমনে পিহু হেসে উঠলো। পিহু ভাবলো কালকে গিয়ে তার সব ভালোবাসা উজাড় করে ইফাজকে সবটা বোঝাবে। ইফাজ নিশ্চয়ই বুঝবে। কারণ সে যে পিহুকে ভালোবাসে। পরে হয়তো ইফাজ নিজের ভুল বুঝতে পেরে সরি বলবে পিহুকে তখন সে আচ্ছা মতো বকে দেবে ইফাজকে।
কিন্তু যদি ইফাজ না বোঝে আর ওকে ছেড়ে চলে যায়??একথা ভাবতেই বুকটা ধক করে উঠল পিহুর। ইশানের কথা মনে পড়ে গেল তার। ইশান মা’কে ছাড়া থাকবে কিভাবে?? খাওয়া দাওয়া গোসল করা। স্কুলে যাওয়ার জন্য রেডি করা সবই তো পিহু নিজের হাতে করতো।
পিহু ঘাড় ঘুরিয়ে মীরার দিকে তাকালো। তাহলে কি তার ছেলের জীবন মীরার মতো হবে??বেচারি মীরা!! এটুকু বয়সে বাবা মা হারিয়ে সে নিঃস্ব। মীরার মা পুষ্পা পিহুর ছোটবেলার বন্ধু ছিলো। ওদের সব সময়কার চলাফেরা একইসাথে হতো। পুষ্পা বিয়ে করে মিলন নামের একটা ছেলেকে। লাভ ম্যারেজ ছিলো ঠিক পিহুর মতো। তবে মিলনের পরিবার বলতে কেউ নেই সে একাই। পুষ্পা কন্সিভ করাতে মিলন খুব খুশি হয়েছিলো। মিলন চেয়েছিল তার একটা সুন্দর পরীর মত রাজকন্যা হবে। নাম ও রেখছিলো মীরা।ঠিক তাই হলো। একটা পরী এলো পুষ্পার কোল জুড়ে। কিন্তু দূর্ভাগ্য যে সেই পরীকে একনজড় দেখতে পেলো না মিলন। হাসপাতালে আসার পথে গাড়ি এক্সিডেন্ট করে মিলন।
তারপর সাতদিন হসপিটালে ভর্তি থেকে মারা যায়। এই সাতদিন মিলনের হিতাহিত জ্ঞান ছিল না বললেই চলে। শুধু চোখদুটো খোলা রেখেছিল। মিলনের মৃত্যু তে সবচেয়ে বেশি ভেঙে পড়েছিল পুষ্পা। পিহুই সামলেছে পুষ্পাকে। তাছাড়া দুজনে একসাথে চাকরি করছিল একই স্কুলে। কিন্তু মীরা মেয়েটা বোধহয় পোড়া কপাল নিয়ে জন্মেছে। পাঁচ মাস আগে পুষ্পা পিহুর কাছে মীরাকে রেখে ব্যাংকে যায় একটা কাজে। কিন্তু সেখান থেকে পুষ্পা ফিরে আসেনি। এসেছিল ওর ডেডবডি। এক্সিডেন্টে স্পটডেড হয় পুষ্পার। একইভাবে সে পৌঁছে যায় মিলনের কাছে।
আর মীরাকে রেখে যায় পিহুর কাছে। ছোট মীরা এখন ও জানে না তার মায়ের মৃত্যুর খবর। তার মা যাওয়ার সময় এটা বলে গিয়েছে যে সে যেন মনি’মার কাছে থাকে এবং কোন দুষ্টুমি না করে। মা তার জন্য অনেক খেলনা আনতে যাচ্ছে। সহজ সরল মীরা সেটাই বুঝে নিয়েছে। সে ভাবছে অনেক খেলনা কিনতে তো সময় লাগে তাই তার মায়ের আসতে দেরি হচ্ছে। কিন্তু মীরা তার মায়ের জন্য প্রতিদিন অপেক্ষা করে।
পিহু আস্তে করে মীরার পাশে গিয়ে বসলো। ঘুমন্ত মুখটাতে আলতো করে চুমু খেলো সে। তারপর একধ্যানে তাকিয়ে রইল মীরার দিকে। যদিও অন্ধকার কিছুই দেখা যাচ্ছে না তবুও সে তাকিয়ে থাকলো।
গভীর রাতে ওযু করে তাহাজ্জুদের নামায আদায় করলো পিহু। মোনাজাতে কেঁদে কেঁদে সে খুব করে ইশান আর ইফাজকে চাইলো। তারপর ও ঘুম আসলো না পিহুর। ফজরের নামাজ পড়ে সে উত্তেজিত হয়ে পড়লো। কখন যাবে ইফাজের কাছে আর কখন ওদের ফিরিয়ে আনবে??
সকাল হতেই মুক্তা সামির কে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো পিহু। সাথে মীরাকেও নিলো। পিহুর ধারণা ওরা খান ম্যানশনে গিয়েছে। তাই আগে ওরা খান বাড়িতে যাবে।
কিন্তু ওদের খান বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হলো না। গেটের সামনে দারোয়ান আটকে দাঁড়ায় বলে,’আপনারা কারা?? কাকে চাই??’
পিহু কথা বলতে পারলো না। গলা আটকে আসছে তার বারবার বাড়ির ভেতরে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে সে। সামির এগিয়ে এসে বলে,’আমরা ইফাজ খানের সাথে দেখা করতে এসেছি। উনি কি এখানে এসেছেন??’
দারোয়ান জবাব দিলো,’হ্যা কাল রাতেই এসেছেন।’
‘তাহলে ওনাকে বলুন যে সামির আর পিহু এসেছে ওনার সাথে দেখা করতে।’
দারোয়ান সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে বলে,’কিন্তু আজ তো বাসায় কেউ নেই।’
কপালে ভাঁজ ফেলে সামির বলল,’কোথায় গেছে??’
‘স্যাররা আজ পুরো পরিবার সহ লন্ডন চলে যাচ্ছে। একটু পরেই তাদের ফ্লাইট। সকালেই সবাই ইয়ারপোর্ট চলে গেছে।’
সামির আর কিছু বলল না। দারোয়ানের কথাগুলো পিহুর কানে বাজতেছে। নাহ এভাবে ইফাজ তাকে ছেড়ে যেতে পারে না। পিহুর মাথাটা ঘুরে এলো। পড়ে যেতে নিলেই সামির ওকে ধরে ফেললো। সামির বলল, ‘ভেঙে পড়ো না পিহু শক্ত হও। রাতারাতি এসব হয় না কখনো। ইফাজ দেশের বাইরে যায়নি।’
পিহু কম্পিত কন্ঠে বলল,’দারোয়ান যে বলল।’
‘আমাকে ভাবতে দাও পিহু। তুমি এখনই ইফাজকে ফোন করো তাড়াতাড়ি।’
পিহুর হাত পা কাঁপছে তবুও সে কাঁপা হাতে ফোন করলো ইফাজকে

গা ঘিন ঘিন করে উঠলো। পিছনে ঘুরেই নেহালের গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিল। থাপ্পর খেয়ে নেহাল পিহুর হাত ছেড়ে দিলো। পিহু দৌড়ে গিয়ে মীরাকে কোলে তুলে নিয়ে চিৎকার করে বলল,’কি চাই আর তোমার??সব তো শেষ করেই দিলে। এখন আবার কিজন্য এসেছো??’

থাপ্পর খেয়েও নেহালের কোন অনুশোচনা বা রাগ হলো না। সে ঠোঁটজোড়া প্রসারিত করে হাসলো। তার হাসি দেখে পিহু চোখ সরিয়ে নিলো। ঘেন্না হচ্ছে আজ নেহালের প্রতি। অথচ এই নেহালকেই এতদিন নিজের সবচেয়ে ভালো বন্ধু ভেবে এসেছে। নিজের এহেম কাজে নিজের প্রতি ঘৃণা হচ্ছে পিহুর। নেহাল পিহুর দিকে তাকিয়ে বলল,’চলো আমার সাথে।’

পিহু তীরের মতো প্রশ্ন ছুঁড়ল নেহালের দিকে, ‘কোথায় যাবো আমি??আর তুমি ভাবলে কি করে তোমার মতো নিচ লোকের সাথে আমি যাব?? এখুনি বের হয়ে যাও??’
পিহুর তীক্ষ্ণ চাহনিতে দমলো না নেহাল কড়া গলায় বলল,’তোমাকে যেতেই হবে পিহু। এখন তো ইফাজ নেই তোমার সাথে। সো তোমাকে আমার সাথেই থাকতে হবে।’

নেহালের কথাগুলো রাগ বাড়িয়ে দিচ্ছে পিহুর। মীরার হাত শক্ত করে চেপে ধরে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগল সে। জোর গলায় বলল,’আমার জীবনের শেষ নিঃশ্বাস থাকা পর্যন্ত তোমার সাথে কোথাও যাব না আমি।’
নেহাল হেসে পিহুর দিকে এগিয়ে এসে বলল, ‘জানি তুমি সোজা কথায় আসবে না তাই জোর করেই নিয়ে যাব।’
পিহু ব্যথিত কন্ঠে বলল,’কেন করছো আমার সাথে এসব??কি চাও আমার থেকে তুমি??কি ক্ষতি করেছি আমি তোমার??’

‘সবচেয়ে বড় ক্ষতি করেছো ওই ইফাজকে বিয়ে করে। কি আছে ওর যা আমার মধ্যে নেই?? আমি তোমাকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসতাম কিন্তু তুমি কি করেছো???ইফাজের জন্য আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছো। সেদিন থেকেই আমি প্রতিজ্ঞা করেছি তোমাকে একদিনের জন্য হলেও আমার করে ছাড়ব। তাই তো এখানে এসে তোমাদের সবার মন জয় করলাম। আর দেখো আমার কষ্ট সার্থক হলো আজ। তাই এখন চলো আমার সাথে।’

নেহাল পিহুর কথা শুনলো না। পিহুর থেকে মীরাকে ছাড়িয়ে ধাক্কা মারলো। মীরা গিয়ে ফ্লোরে পড়লো। কনুই এবং হাঁটুতে ব্যথা পেয়ে মীরা কেঁদে উঠলো। পিহু মীরার কাছে যাওয়ার আগেই নেহাল পিহুকে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে যেতে লাগলো। পিহু পারছে না চিৎকার দিতে কারণ গলা ব্যথা হয়ে গেছে কাঁদতে কাঁদতে। কাউকে ডাকলে সে শুনতে পাবে না। দরজার কাছে এসেই ওরা মুখোমুখি হলো একটা মেয়ের। বয়স খুব একটা বেশি নয়। পিহুর মতোই বয়স হবে। মেয়েটা পিহুর দিকে তাকিয়ে বেলে উঠলো,’কি হয়েছে পিহু??কাদছিস কেন??আর এই ছেলেটা কে??’

বলতে বলতে মেয়েটা আরো এগিয়ে আসলো।পিহু বলল,’আমাকে বাঁচা মুক্তা নয়তো এই লোকটা আমাকে নিয়ে যাবে??’
নেহাল বিশ্রি হাসি দিয়ে বলে,’লাইক সিরিয়াসলি??এই মেয়েটা তোমাকে বাঁচাবে??হাসালে পিহুমনি।’
নেহালের কথা শুনে মুক্তা রাগে গজগজ করে উঠলো। এই ছেলেটা কি জানে ওর ব্যপারে??
মুক্তা রেগেমেগে ব্যাগ থেকে একটা ছুরি বের করলো। প্রটেকশনের জন্য এটা সে সবসময় সাথে রাখে। নেহাল সেটা দেখে হাসতে হাসতে বলল,’এই ছোট ছুরি দিয়ে আমাকে ভয় দেখাবে??ওহ আমি তো খুব ভয় পেয়ে গেলাম।’

মুক্তা এতে আরো রেগে গেলো। ছুরি চালিয়ে দিলো যেহাতে সে পিহুর হাত ধরে আছে। নেহাল পিহুর হাত ছেড়ে নিজের রক্তমাখা হাত চেপে ধরে বিশ্রি গালি দেয় মুক্তাকে। ও ভাবেনি যে সত্যি সত্যি মুক্তা ওকে আঘাত করবে??মুক্তা ক্ষেপে গিয়ে বলে,’পৃথিবীর সব মেয়েকে পিহুর মতো নরম মনের মেয়ে ভাবলে ভুল করছিস তুই। ভালোয় ভালোয় এখান থেকে কেটে পর নাহলে এই ছুরি তোর গলায় চালাতে আমার এক মূহুর্ত সময় লাগবে না।’

নেহাল কিছু বলার আগেই মুক্তার হাজবেন্ড সামির এসে হাজির। নেহাল আর কিছু বলল না। ওখান থেকে চলে গেলো। রুমে এসেই মুক্তা দেখলো মীরা কাঁদছে। সে দ্রুত মীরাকে কোলে তুলে নেয়।
সোফায় বসে মীরাকে বুকে চেপে ধরে সামলায় পিহু। তার বুকেই ঘুমিয়ে পড়ে সে। মুক্তা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল যে কি হয়েছে?? বিনিময়ে পিহু চুপ করে রইলো। যখন মুক্তা ইফাজ আর ইশানের কথা জিজ্ঞেস করল তখন পিহু নিজেকে সামলে রাখতে পারলো না হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলো। এতে মুক্তা বেশ ঘাবড়ে গেল বলল,’আর কাদিস না পিহু এবার বল কি হয়েছে??’

পিহু নিজেকে সামলিয়ে বলতে লাগলো,’তুই তো জানিস যে ইফাজ অফিসের কাজে ঢাকার বাইরে থাকে। দু এক মাস পরপর এসে সপ্তাহখানেক থেকে আবার চলে যায়। এবার ও এসেছিল। আজকে বিকেলে আমরা সবাই ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান করি। কিন্তু আমার প্রচন্ড মাথা ব্যথা করছিল। তারউপর মীরাও ঘুমিয়ে পড়েছিল তাই আমি যাইনি ইফাজ আর ইশান গিয়েছিল। তার কিছুক্ষণ পর নেহাল আসলো।’
মুক্তা উৎফুল্ল হয়ে বলল,’এই নেহালটা কে??আগে তো দেখিনি।’
পিহু মাথা নিচু করে বলল,’নেহাল আমার চাচাতো ভাই। আমাকে প্রপোজ করেছিল কিন্তু আমি রিজেক্ট করেছিলাম। কারণ তখন আমি আর ইফাজ দুজন দুজনকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। তারপর আর নেহালকে দেখিনি। শুনেছিলাম সে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। এসব নিয়ে আমি আর ভাবিনি। কিন্তু পাঁচ মাস আগে নেহাল দেশে ফেরে। আর আমাদের বাড়িতে যাতায়াত শুরু করে। আমি প্রথমে আপত্তি করেছিলাম কিন্তু নেহাল বলেছিল যে ও সবকিছু ভুলে আমার সাথে বন্ধুত্ব করবে। আমি তাতে সায় দিয়েছিলাম। এটাই হলো আমার সবচেয়ে বড় ভুল। কেন যে ওর পাতা ফাঁদে পা দিলাম??এজন্য এখন আমার সংসার শেষ হতে চলেছে।’
পিহু আবার কেঁদে উঠলো। মুক্তা বলল, ‘তারপর কি হয়েছে??’

‘বিকেলে নেহাল আসায় আমি বিরক্তি হই। কারণ একসপ্তাহ আগে সে আবার আমাকে বিয়ের কথা বলেছে। আমি যাতে ইফাজকে ডিভোর্স দিয়ে ওকে বিয়ে করি। এজন্য ওকে আমি আসতে বারণ করে দেই তবুও ও আসে। জানি না কোন উদ্দেশ্য নিয়ে ও এসেছে। আমাকে টেনে রুমে নিয়ে এসে বিছানায় ধাক্কা মেরে ফেলে নিজের শার্ট খুলতে শুরু করলো। আমি চিৎকার করলাম। তাতে মীরার ঘুম ভেঙ্গে যায়। মীরাকে দেখে নেহাল অবাক হলো। কিন্তু আমার সাথে ধস্তাধস্তি করা শুরু করে দিল। আমি ধাক্কা মেরে ওকে সরিয়ে তাড়াতাড়ি শাড়ি ঠিক করতে করতে বের হই। আমার উদ্দেশ্য ছিল মানুষ জড়ো করা কিন্তু তার আগেই দেখি ইফাজ এসে পড়েছে। আমাকে আর নেহালকে ওভাবে দেখে উল্টো ভেবে নেয়। ইফাজ আমার কথা শুনতো কিন্তু তার আগেই কেউ বা কারা ওর কানে আমার নামে বিষ ঢেলেছে তাই ইফাজ আমাকে ভুল বুঝে চলে গেছে।’

পিহু আবার কাঁদতে লাগলো। মুক্তা একধ্যানে পিহুর দিকে তাকিয়ে রইল। মুক্তা খুব ভালো করেই জানে পিহু নরম মনের মানুষ। একদম তুলোর মতো। না, তুলোর থেকে যদি কিছু নরম হয় তা হলো পিহু। মুক্তা আর পিহু একই স্কুলে চাকরি করে। পিহু কখনো স্টুডেন্টদের সাথে ধমকের সুরে কথা বলেনি। সবসময় আদর করে কথা বলেছে যার দরুন সব স্টুডেন্টরা তাকে ভালোবেসে। কিন্তু মুক্তা তার বিপরীত। ক্লাসে গেলে সবসময় জোড়া বেত নিয়ে যেতো। পড়া না করে আসলে তার পিঠে ঠাস ঠুস মেরে দিতো। সবাই মুক্তাকে খুব ভয় পায়।আড়ালে সবাই রাক্ষসী রানি বলে ডাকে সবাই। কিন্তু সামনাসামনি সবাই মিষ্টি করে কথা বলে।

মুক্তা ভেবে পায়না এতো নরম কেন মেয়েটা। আজকে ও থাকলে হয়তো ইফাজ যেতে পারতো না। সবকিছু এখানেই মিটমাট করে ফেলতো সে। কিন্তু দূর্ভাগ্য ওদের সহায় হয়েছে। মুক্তা তিন মাসের প্রেগন্যান্ট তাই ছুটিতে বাবার বাড়ি গিয়েছিল। আজ দুপুরে ফিরেছে সে। তাই রাতেই এসেছে পিহুর সাথে দেখা করতে।
মুক্তা কপালে ভাঁজ ফেলে বলে,’নেহালকে বিশ্বাস করাই ভুল হয়েছে তোর??হয়তো নেহাল ইফাজের চোখে তোকে খারাপ বানানোর জন্য এমনটা করেছে। নেহাল ইফাজের আসার খবর পেয়েই এসবের করেছে। তো এখন কি করবি??’

পিহু কিছু বলল না। সামির উদগ্রীব হয়ে বলে,’আমাদের উচিত ইফাজ ভাইকে গিয়ে সবকিছু খুলে বলা। আমার মনে হয় আমরা বোঝালে সে বুঝবে। তখন মাথা হয়তো গরম ছিল বলে পিহুর কথা শোনেনি। মাথা ঠান্ডা হলে অবশ্যই তাকে বোঝালে সে বুঝবে।’
মুক্তা সামিরের দিকে তাকিয়ে বলল,’অবশ্যই বুঝবেন। কারণ ইফাজ ভাইয়া পিহুকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে। একদিনের ভুল বোঝাবুঝি তে কিছু হবে না। পিহু গিয়ে সবটা বোঝালেই ওনি বুঝবেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ইফাজ ভাইয়ের কান ভাঙালো কে??’

সামির কিছুটা হেসে বলে,’আশেপাশে কি কম মানুষ আছে নাকি?? আমাদের সমাজে এমন কিছু মানুষ আছে যাদের ঠোঁটে মধু আর অন্তরে বিষ থাকে। মধুর সাথে বিষ মিশিয়ে তা পরিবেশন করে মানুষের মনে,যাতে কেউ বুঝতে না পারে। একে অপরের ভালো তারা দেখতে পায়না তাই হয়তো পিহুর নামে মিথ্যা বদনাম রটিয়েছে।’
মুক্তা মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,’হুম একদম ঠিক বলেছো। কিন্তু আমাদের দেরি করলে চলবে না। কালকেই সব মিটমাট করতে হবে।’
মুক্তা একটু থেমে পিহুর দিকে তাকিয়ে বলে,’ইফাজ ভাইয়া এখন কোথায় গেছে জানিস কিছু???’
পিহু মাথা নেড়ে না বোধক বলল।

নরম বেডের উপর ঘুমিয়ে আছে ইশান। পাশেই ইফাজ বসে আছে। ওর ঘুম আসছে না। একটু পর পর চোখের পানি মুছছে। পিহুর দেওয়া আঘাতটা জোরেই লেগেছে তার। পনেরো বছরের সম্পর্ক ওদের এভাবে শেষ করে দিতে পারলো পিহু?? টাকার এতোই যদি লোভ তাহলে একটা বার বলতে পারতো। ইফাজ হাসিমুখে তার আবদার পূরণ করতো। এতে যত কষ্টই হোক না কেন সে পিহুর আবদার মেটাতো। কিন্তু পিহু এভাবে ওর বুকে ছুরি মারলো কেন??ইফাজ বারবার বলছে,’কেন‌ করলে এরকম পিহু??আমি তো সবটা দিয়ে তোমাকে ভালোবেসেছিলাম।’

ইফাজ এখন বুঝতে পারছে যে পিহু আদৌ নরম মনের মানুষ নয়। কেননা আজ সে তার আসল রূপ দেখিয়ে দিয়েছে। যার জন্য প্রিয় মানুষদের ছেড়ে দিলো সেই আজকে সবচেয়ে অপ্রিয় ইফাজের। ভেতরটা ওর দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। কাঁদতে কাঁদতে সে এখন ফুঁপিয়ে উঠছে। ছেলেদের কাঁদা বারণ কিন্তু ইফাজ পারছেনা নিজেকে শান্ত রাখতে। বারবার পিহুর প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠছে চোখের সামনে।
এরমধ্যে ইশান একটু নড়েচড়ে উঠলো। ঘুমের ঘোরে সে আম্মু আম্মু বলতে লাগলো। এতে ইফাজ আরো ভেঙে পড়লো। তার এই ছোট ছেলেটা কিভাবে থাকবে তার মা’কে ছাড়া??

ইশান তো ঠিকমতো নিজের হাতে খেতেও পারে না। পিহু আদর করে খাইয়ে দিতো। তাহলে কি হবে ওর ছেলের ভবিষ্যত?? ইফাজ পরম যত্নে ইশানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। ইশান আবারও ঘুমের ঘোরে তলিয়ে গেলো।

ইফাজ বাসা থেকে বের হয়ে সোজা খান ম্যানশনে চলে এসেছে। ভেবেছিল ওর বাবা মা হয়তো আবার ওকে ফিরিয়ে দেবেন। কিন্তু তারা অবাক করে দিয়ে ইফাজকে সাদরে গ্রহণ করলো। তারাও খুশি হয়েছে তাদের ছেলে ফিরে আসায়। নাতিকে পেয়েও তারা খুশি। কিন্তু তারা বৌমা চায় না। ইশান তো ওনাদের বংশের রক্ত তাই ইশানকে ফিরিয়ে দেয়নি। ইফাজ ইশানকে নিয়ে নিজের বেডরুমে চলে যায়। কত বছর পর এই রুমে পা দিয়েছে সে ভাবতেই চোখজোড়া ভিজে আসে তার।
ঘুটঘুটে অন্ধকার বিরাজ করছে রুমে। খাটের উপর গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে ছোট্ট মীরা। পিহু জানালার গ্রিল ধরে বাইরে তাকিয়ে আছে। ঘুম আসছে না তার। কি করে ঘুম আসবে??যার বুকে মাথা রেখে ঘুমাতো সেই তো নেই। তাই পিহুর চোখে ঘুম নেই। এর আগেও ইফাজের সাথে মনোমালিন্য হয়েছে পিহুর। কিন্তু পরে ইফাজই এসে পিহুকে জড়িয়ে ধরে বলেছে,’আ’ম সরি!!আর কখনও তোমাকে ভুল বুঝবো না।’

পিহু তখন অভিমানী কন্ঠে বলতো,’যদি ভুল বোঝো কখনো??’
ইফাজ তখন হেসে পিহুর গাল টেনে বলতো, ‘তুমি আছো না??আমি ভুল বুঝলে তুমি ভালোবাসা দিয়ে সেটা পুষিয়ে দেবে। তোমার ভালোবাসায় যে আমি বড্ড কাতর পিহুরানি। তোমার পবিত্র ভালবাসা যে আমার সব রাগ অভিমান ভুলিয়ে দেয়। সেটা কি জানো না??’
পিহু সেদিন লাজুক হেসেছিলো। এই লাজুক মুখখানি যে ইফাজের খুব ভালো লাগে। তাই সবসময় রোমান্টিক কথা বলে পিহুকে লজ্জায় ফেলতো। এইতো সেদিন পিহু রান্না করছিল হুট করে ইফাজ এসে তাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে,’তোমার ওই নরম ঠোঁটের উষ্ণ পরশ পেতে চাই দেবে কি??’

পিহু তখন লজ্জায় একাকার হয়ে গিয়েছিল। বিয়ের এতবছর হওয়ার পর ও এত লজ্জা কোথা থেকে আসে তা ইফাজ আজও বুঝতে পারলো না।
এসব ভাবতেই আনমনে পিহু হেসে উঠলো। পিহু ভাবলো কালকে গিয়ে তার সব ভালোবাসা উজাড় করে ইফাজকে সবটা বোঝাবে। ইফাজ নিশ্চয়ই বুঝবে। কারণ সে যে পিহুকে ভালোবাসে। পরে হয়তো ইফাজ নিজের ভুল বুঝতে পেরে সরি বলবে পিহুকে তখন সে আচ্ছা মতো বকে দেবে ইফাজকে।

কিন্তু যদি ইফাজ না বোঝে আর ওকে ছেড়ে চলে যায়??একথা ভাবতেই বুকটা ধক করে উঠল পিহুর। ইশানের কথা মনে পড়ে গেল তার। ইশান মা’কে ছাড়া থাকবে কিভাবে?? খাওয়া দাওয়া গোসল করা। স্কুলে যাওয়ার জন্য রেডি করা সবই তো পিহু নিজের হাতে করতো।

পিহু ঘাড় ঘুরিয়ে মীরার দিকে তাকালো। তাহলে কি তার ছেলের জীবন মীরার মতো হবে??বেচারি মীরা!! এটুকু বয়সে বাবা মা হারিয়ে সে নিঃস্ব। মীরার মা পুষ্পা পিহুর ছোটবেলার বন্ধু ছিলো। ওদের সব সময়কার চলাফেরা একইসাথে হতো। পুষ্পা বিয়ে করে মিলন নামের একটা ছেলেকে। লাভ ম্যারেজ ছিলো ঠিক পিহুর মতো। তবে মিলনের পরিবার বলতে কেউ নেই সে একাই। পুষ্পা কন্সিভ করাতে মিলন খুব খুশি হয়েছিলো। মিলন চেয়েছিল তার একটা সুন্দর পরীর মত রাজকন্যা হবে। নাম ও রেখছিলো মীরা।ঠিক তাই হলো। একটা পরী এলো পুষ্পার কোল জুড়ে। কিন্তু দূর্ভাগ্য যে সেই পরীকে একনজড় দেখতে পেলো না মিলন। হাসপাতালে আসার পথে গাড়ি এক্সিডেন্ট করে মিলন।

তারপর সাতদিন হসপিটালে ভর্তি থেকে মারা যায়। এই সাতদিন মিলনের হিতাহিত জ্ঞান ছিল না বললেই চলে। শুধু চোখদুটো খোলা রেখেছিল। মিলনের মৃত্যু তে সবচেয়ে বেশি ভেঙে পড়েছিল পুষ্পা। পিহুই সামলেছে পুষ্পাকে। তাছাড়া দুজনে একসাথে চাকরি করছিল একই স্কুলে। কিন্তু মীরা মেয়েটা বোধহয় পোড়া কপাল নিয়ে জন্মেছে। পাঁচ মাস আগে পুষ্পা পিহুর কাছে মীরাকে রেখে ব্যাংকে যায় একটা কাজে। কিন্তু সেখান থেকে পুষ্পা ফিরে আসেনি। এসেছিল ওর ডেডবডি। এক্সিডেন্টে স্পটডেড হয় পুষ্পার। একইভাবে সে পৌঁছে যায় মিলনের কাছে।

আর মীরাকে রেখে যায় পিহুর কাছে। ছোট মীরা এখন ও জানে না তার মায়ের মৃত্যুর খবর। তার মা যাওয়ার সময় এটা বলে গিয়েছে যে সে যেন মনি’মার কাছে থাকে এবং কোন দুষ্টুমি না করে। মা তার জন্য অনেক খেলনা আনতে যাচ্ছে। সহজ সরল মীরা সেটাই বুঝে নিয়েছে। সে ভাবছে অনেক খেলনা কিনতে তো সময় লাগে তাই তার মায়ের আসতে দেরি হচ্ছে। কিন্তু মীরা তার মায়ের জন্য প্রতিদিন অপেক্ষা করে।
পিহু আস্তে করে মীরার পাশে গিয়ে বসলো। ঘুমন্ত মুখটাতে আলতো করে চুমু খেলো সে। তারপর একধ্যানে তাকিয়ে রইল মীরার দিকে। যদিও অন্ধকার কিছুই দেখা যাচ্ছে না তবুও সে তাকিয়ে থাকলো।

গভীর রাতে ওযু করে তাহাজ্জুদের নামায আদায় করলো পিহু। মোনাজাতে কেঁদে কেঁদে সে খুব করে ইশান আর ইফাজকে চাইলো। তারপর ও ঘুম আসলো না পিহুর। ফজরের নামাজ পড়ে সে উত্তেজিত হয়ে পড়লো। কখন যাবে ইফাজের কাছে আর কখন ওদের ফিরিয়ে আনবে??
সকাল হতেই মুক্তা সামির কে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো পিহু। সাথে মীরাকেও নিলো। পিহুর ধারণা ওরা খান ম্যানশনে গিয়েছে। তাই আগে ওরা খান বাড়িতে যাবে।

কিন্তু ওদের খান বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হলো না। গেটের সামনে দারোয়ান আটকে দাঁড়ায় বলে,’আপনারা কারা?? কাকে চাই??’
পিহু কথা বলতে পারলো না। গলা আটকে আসছে তার বারবার বাড়ির ভেতরে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে সে। সামির এগিয়ে এসে বলে,’আমরা ইফাজ খানের সাথে দেখা করতে এসেছি। উনি কি এখানে এসেছেন??’

দারোয়ান জবাব দিলো,’হ্যা কাল রাতেই এসেছেন।’
‘তাহলে ওনাকে বলুন যে সামির আর পিহু এসেছে ওনার সাথে দেখা করতে।’
দারোয়ান সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে বলে,’কিন্তু আজ তো বাসায় কেউ নেই।’
কপালে ভাঁজ ফেলে সামির বলল,’কোথায় গেছে??’
‘স্যাররা আজ পুরো পরিবার সহ লন্ডন চলে যাচ্ছে। একটু পরেই তাদের ফ্লাইট। সকালেই সবাই ইয়ারপোর্ট চলে গেছে।’

সামির আর কিছু বলল না। দারোয়ানের কথাগুলো পিহুর কানে বাজতেছে। নাহ এভাবে ইফাজ তাকে ছেড়ে যেতে পারে না। পিহুর মাথাটা ঘুরে এলো। পড়ে যেতে নিলেই সামির ওকে ধরে ফেললো। সামির বলল, ‘ভেঙে পড়ো না পিহু শক্ত হও। রাতারাতি এসব হয় না কখনো। ইফাজ দেশের বাইরে যায়নি।’

পিহু কম্পিত কন্ঠে বলল,’দারোয়ান যে বলল।’
‘আমাকে ভাবতে দাও পিহু। তুমি এখনই ইফাজকে ফোন করো তাড়াতাড়ি।’
পিহুর হাত পা কাঁপছে তবুও সে কাঁপা হাতে ফোন করলো ইফাজকে

মেঝেতে পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে মীরা। পিহু চিৎকার করে উঠল মীরার দিকে তাকিয়ে। পিহু মীরার কাছে যেতে নিলে নেহাল ওর হাত টেনে ধরে। ঘৃণায় পিহুর গা ঘিন ঘিন করে উঠলো। পিছনে ঘুরেই নেহালের গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিল। থাপ্পর খেয়ে নেহাল পিহুর হাত ছেড়ে দিলো। পিহু দৌড়ে গিয়ে মীরাকে কোলে তুলে নিয়ে চিৎকার করে বলল,’কি চাই আর তোমার??সব তো শেষ করেই দিলে। এখন আবার কিজন্য এসেছো??’

থাপ্পর খেয়েও নেহালের কোন অনুশোচনা বা রাগ হলো না। সে ঠোঁটজোড়া প্রসারিত করে হাসলো। তার হাসি দেখে পিহু চোখ সরিয়ে নিলো। ঘেন্না হচ্ছে আজ নেহালের প্রতি। অথচ এই নেহালকেই এতদিন নিজের সবচেয়ে ভালো বন্ধু ভেবে এসেছে। নিজের এহেম কাজে নিজের প্রতি ঘৃণা হচ্ছে পিহুর। নেহাল পিহুর দিকে তাকিয়ে বলল,’চলো আমার সাথে।’

পিহু তীরের মতো প্রশ্ন ছুঁড়ল নেহালের দিকে, ‘কোথায় যাবো আমি??আর তুমি ভাবলে কি করে তোমার মতো নিচ লোকের সাথে আমি যাব?? এখুনি বের হয়ে যাও??’
পিহুর তীক্ষ্ণ চাহনিতে দমলো না নেহাল কড়া গলায় বলল,’তোমাকে যেতেই হবে পিহু। এখন তো ইফাজ নেই তোমার সাথে। সো তোমাকে আমার সাথেই থাকতে হবে।’

নেহালের কথাগুলো রাগ বাড়িয়ে দিচ্ছে পিহুর। মীরার হাত শক্ত করে চেপে ধরে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগল সে। জোর গলায় বলল,’আমার জীবনের শেষ নিঃশ্বাস থাকা পর্যন্ত তোমার সাথে কোথাও যাব না আমি।’
নেহাল হেসে পিহুর দিকে এগিয়ে এসে বলল, ‘জানি তুমি সোজা কথায় আসবে না তাই জোর করেই নিয়ে যাব।’
পিহু ব্যথিত কন্ঠে বলল,’কেন করছো আমার সাথে এসব??কি চাও আমার থেকে তুমি??কি ক্ষতি করেছি আমি তোমার??’

‘সবচেয়ে বড় ক্ষতি করেছো ওই ইফাজকে বিয়ে করে। কি আছে ওর যা আমার মধ্যে নেই?? আমি তোমাকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসতাম কিন্তু তুমি কি করেছো???ইফাজের জন্য আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছো। সেদিন থেকেই আমি প্রতিজ্ঞা করেছি তোমাকে একদিনের জন্য হলেও আমার করে ছাড়ব। তাই তো এখানে এসে তোমাদের সবার মন জয় করলাম। আর দেখো আমার কষ্ট সার্থক হলো আজ। তাই এখন চলো আমার সাথে।’

নেহাল পিহুর কথা শুনলো না। পিহুর থেকে মীরাকে ছাড়িয়ে ধাক্কা মারলো। মীরা গিয়ে ফ্লোরে পড়লো। কনুই এবং হাঁটুতে ব্যথা পেয়ে মীরা কেঁদে উঠলো। পিহু মীরার কাছে যাওয়ার আগেই নেহাল পিহুকে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে যেতে লাগলো। পিহু পারছে না চিৎকার দিতে কারণ গলা ব্যথা হয়ে গেছে কাঁদতে কাঁদতে। কাউকে ডাকলে সে শুনতে পাবে না। দরজার কাছে এসেই ওরা মুখোমুখি হলো একটা মেয়ের। বয়স খুব একটা বেশি নয়। পিহুর মতোই বয়স হবে। মেয়েটা পিহুর দিকে তাকিয়ে বেলে উঠলো,’কি হয়েছে পিহু??কাদছিস কেন??আর এই ছেলেটা কে??’

বলতে বলতে মেয়েটা আরো এগিয়ে আসলো।পিহু বলল,’আমাকে বাঁচা মুক্তা নয়তো এই লোকটা আমাকে নিয়ে যাবে??’
নেহাল বিশ্রি হাসি দিয়ে বলে,’লাইক সিরিয়াসলি??এই মেয়েটা তোমাকে বাঁচাবে??হাসালে পিহুমনি।’
নেহালের কথা শুনে মুক্তা রাগে গজগজ করে উঠলো। এই ছেলেটা কি জানে ওর ব্যপারে??
মুক্তা রেগেমেগে ব্যাগ থেকে একটা ছুরি বের করলো। প্রটেকশনের জন্য এটা সে সবসময় সাথে রাখে। নেহাল সেটা দেখে হাসতে হাসতে বলল,’এই ছোট ছুরি দিয়ে আমাকে ভয় দেখাবে??ওহ আমি তো খুব ভয় পেয়ে গেলাম।’

মুক্তা এতে আরো রেগে গেলো। ছুরি চালিয়ে দিলো যেহাতে সে পিহুর হাত ধরে আছে। নেহাল পিহুর হাত ছেড়ে নিজের রক্তমাখা হাত চেপে ধরে বিশ্রি গালি দেয় মুক্তাকে। ও ভাবেনি যে সত্যি সত্যি মুক্তা ওকে আঘাত করবে??মুক্তা ক্ষেপে গিয়ে বলে,’পৃথিবীর সব মেয়েকে পিহুর মতো নরম মনের মেয়ে ভাবলে ভুল করছিস তুই। ভালোয় ভালোয় এখান থেকে কেটে পর নাহলে এই ছুরি তোর গলায় চালাতে আমার এক মূহুর্ত সময় লাগবে না।’

নেহাল কিছু বলার আগেই মুক্তার হাজবেন্ড সামির এসে হাজির। নেহাল আর কিছু বলল না। ওখান থেকে চলে গেলো। রুমে এসেই মুক্তা দেখলো মীরা কাঁদছে। সে দ্রুত মীরাকে কোলে তুলে নেয়।
সোফায় বসে মীরাকে বুকে চেপে ধরে সামলায় পিহু। তার বুকেই ঘুমিয়ে পড়ে সে। মুক্তা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল যে কি হয়েছে?? বিনিময়ে পিহু চুপ করে রইলো। যখন মুক্তা ইফাজ আর ইশানের কথা জিজ্ঞেস করল তখন পিহু নিজেকে সামলে রাখতে পারলো না হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলো। এতে মুক্তা বেশ ঘাবড়ে গেল বলল,’আর কাদিস না পিহু এবার বল কি হয়েছে??’

পিহু নিজেকে সামলিয়ে বলতে লাগলো,’তুই তো জানিস যে ইফাজ অফিসের কাজে ঢাকার বাইরে থাকে। দু এক মাস পরপর এসে সপ্তাহখানেক থেকে আবার চলে যায়। এবার ও এসেছিল। আজকে বিকেলে আমরা সবাই ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান করি। কিন্তু আমার প্রচন্ড মাথা ব্যথা করছিল। তারউপর মীরাও ঘুমিয়ে পড়েছিল তাই আমি যাইনি ইফাজ আর ইশান গিয়েছিল। তার কিছুক্ষণ পর নেহাল আসলো।’
মুক্তা উৎফুল্ল হয়ে বলল,’এই নেহালটা কে??আগে তো দেখিনি।’
পিহু মাথা নিচু করে বলল,’নেহাল আমার চাচাতো ভাই। আমাকে প্রপোজ করেছিল কিন্তু আমি রিজেক্ট করেছিলাম। কারণ তখন আমি আর ইফাজ দুজন দুজনকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। তারপর আর নেহালকে দেখিনি। শুনেছিলাম সে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। এসব নিয়ে আমি আর ভাবিনি। কিন্তু পাঁচ মাস আগে নেহাল দেশে ফেরে। আর আমাদের বাড়িতে যাতায়াত শুরু করে। আমি প্রথমে আপত্তি করেছিলাম কিন্তু নেহাল বলেছিল যে ও সবকিছু ভুলে আমার সাথে বন্ধুত্ব করবে। আমি তাতে সায় দিয়েছিলাম। এটাই হলো আমার সবচেয়ে বড় ভুল। কেন যে ওর পাতা ফাঁদে পা দিলাম??এজন্য এখন আমার সংসার শেষ হতে চলেছে।’
পিহু আবার কেঁদে উঠলো। মুক্তা বলল, ‘তারপর কি হয়েছে??’

‘বিকেলে নেহাল আসায় আমি বিরক্তি হই। কারণ একসপ্তাহ আগে সে আবার আমাকে বিয়ের কথা বলেছে। আমি যাতে ইফাজকে ডিভোর্স দিয়ে ওকে বিয়ে করি। এজন্য ওকে আমি আসতে বারণ করে দেই তবুও ও আসে। জানি না কোন উদ্দেশ্য নিয়ে ও এসেছে। আমাকে টেনে রুমে নিয়ে এসে বিছানায় ধাক্কা মেরে ফেলে নিজের শার্ট খুলতে শুরু করলো। আমি চিৎকার করলাম। তাতে মীরার ঘুম ভেঙ্গে যায়। মীরাকে দেখে নেহাল অবাক হলো। কিন্তু আমার সাথে ধস্তাধস্তি করা শুরু করে দিল। আমি ধাক্কা মেরে ওকে সরিয়ে তাড়াতাড়ি শাড়ি ঠিক করতে করতে বের হই। আমার উদ্দেশ্য ছিল মানুষ জড়ো করা কিন্তু তার আগেই দেখি ইফাজ এসে পড়েছে। আমাকে আর নেহালকে ওভাবে দেখে উল্টো ভেবে নেয়। ইফাজ আমার কথা শুনতো কিন্তু তার আগেই কেউ বা কারা ওর কানে আমার নামে বিষ ঢেলেছে তাই ইফাজ আমাকে ভুল বুঝে চলে গেছে।’

পিহু আবার কাঁদতে লাগলো। মুক্তা একধ্যানে পিহুর দিকে তাকিয়ে রইল। মুক্তা খুব ভালো করেই জানে পিহু নরম মনের মানুষ। একদম তুলোর মতো। না, তুলোর থেকে যদি কিছু নরম হয় তা হলো পিহু। মুক্তা আর পিহু একই স্কুলে চাকরি করে। পিহু কখনো স্টুডেন্টদের সাথে ধমকের সুরে কথা বলেনি। সবসময় আদর করে কথা বলেছে যার দরুন সব স্টুডেন্টরা তাকে ভালোবেসে। কিন্তু মুক্তা তার বিপরীত। ক্লাসে গেলে সবসময় জোড়া বেত নিয়ে যেতো। পড়া না করে আসলে তার পিঠে ঠাস ঠুস মেরে দিতো। সবাই মুক্তাকে খুব ভয় পায়।আড়ালে সবাই রাক্ষসী রানি বলে ডাকে সবাই। কিন্তু সামনাসামনি সবাই মিষ্টি করে কথা বলে।

মুক্তা ভেবে পায়না এতো নরম কেন মেয়েটা। আজকে ও থাকলে হয়তো ইফাজ যেতে পারতো না। সবকিছু এখানেই মিটমাট করে ফেলতো সে। কিন্তু দূর্ভাগ্য ওদের সহায় হয়েছে। মুক্তা তিন মাসের প্রেগন্যান্ট তাই ছুটিতে বাবার বাড়ি গিয়েছিল। আজ দুপুরে ফিরেছে সে। তাই রাতেই এসেছে পিহুর সাথে দেখা করতে।
মুক্তা কপালে ভাঁজ ফেলে বলে,’নেহালকে বিশ্বাস করাই ভুল হয়েছে তোর??হয়তো নেহাল ইফাজের চোখে তোকে খারাপ বানানোর জন্য এমনটা করেছে। নেহাল ইফাজের আসার খবর পেয়েই এসবের করেছে। তো এখন কি করবি??’

পিহু কিছু বলল না। সামির উদগ্রীব হয়ে বলে,’আমাদের উচিত ইফাজ ভাইকে গিয়ে সবকিছু খুলে বলা। আমার মনে হয় আমরা বোঝালে সে বুঝবে। তখন মাথা হয়তো গরম ছিল বলে পিহুর কথা শোনেনি। মাথা ঠান্ডা হলে অবশ্যই তাকে বোঝালে সে বুঝবে।’
মুক্তা সামিরের দিকে তাকিয়ে বলল,’অবশ্যই বুঝবেন। কারণ ইফাজ ভাইয়া পিহুকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে। একদিনের ভুল বোঝাবুঝি তে কিছু হবে না। পিহু গিয়ে সবটা বোঝালেই ওনি বুঝবেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ইফাজ ভাইয়ের কান ভাঙালো কে??’

সামির কিছুটা হেসে বলে,’আশেপাশে কি কম মানুষ আছে নাকি?? আমাদের সমাজে এমন কিছু মানুষ আছে যাদের ঠোঁটে মধু আর অন্তরে বিষ থাকে। মধুর সাথে বিষ মিশিয়ে তা পরিবেশন করে মানুষের মনে,যাতে কেউ বুঝতে না পারে। একে অপরের ভালো তারা দেখতে পায়না তাই হয়তো পিহুর নামে মিথ্যা বদনাম রটিয়েছে।’
মুক্তা মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,’হুম একদম ঠিক বলেছো। কিন্তু আমাদের দেরি করলে চলবে না। কালকেই সব মিটমাট করতে হবে।’
মুক্তা একটু থেমে পিহুর দিকে তাকিয়ে বলে,’ইফাজ ভাইয়া এখন কোথায় গেছে জানিস কিছু???’
পিহু মাথা নেড়ে না বোধক বলল।

নরম বেডের উপর ঘুমিয়ে আছে ইশান। পাশেই ইফাজ বসে আছে। ওর ঘুম আসছে না। একটু পর পর চোখের পানি মুছছে। পিহুর দেওয়া আঘাতটা জোরেই লেগেছে তার। পনেরো বছরের সম্পর্ক ওদের এভাবে শেষ করে দিতে পারলো পিহু?? টাকার এতোই যদি লোভ তাহলে একটা বার বলতে পারতো। ইফাজ হাসিমুখে তার আবদার পূরণ করতো। এতে যত কষ্টই হোক না কেন সে পিহুর আবদার মেটাতো। কিন্তু পিহু এভাবে ওর বুকে ছুরি মারলো কেন??ইফাজ বারবার বলছে,’কেন‌ করলে এরকম পিহু??আমি তো সবটা দিয়ে তোমাকে ভালোবেসেছিলাম।’

ইফাজ এখন বুঝতে পারছে যে পিহু আদৌ নরম মনের মানুষ নয়। কেননা আজ সে তার আসল রূপ দেখিয়ে দিয়েছে। যার জন্য প্রিয় মানুষদের ছেড়ে দিলো সেই আজকে সবচেয়ে অপ্রিয় ইফাজের। ভেতরটা ওর দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। কাঁদতে কাঁদতে সে এখন ফুঁপিয়ে উঠছে। ছেলেদের কাঁদা বারণ কিন্তু ইফাজ পারছেনা নিজেকে শান্ত রাখতে। বারবার পিহুর প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠছে চোখের সামনে।
এরমধ্যে ইশান একটু নড়েচড়ে উঠলো। ঘুমের ঘোরে সে আম্মু আম্মু বলতে লাগলো। এতে ইফাজ আরো ভেঙে পড়লো। তার এই ছোট ছেলেটা কিভাবে থাকবে তার মা’কে ছাড়া??

ইশান তো ঠিকমতো নিজের হাতে খেতেও পারে না। পিহু আদর করে খাইয়ে দিতো। তাহলে কি হবে ওর ছেলের ভবিষ্যত?? ইফাজ পরম যত্নে ইশানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। ইশান আবারও ঘুমের ঘোরে তলিয়ে গেলো।

ইফাজ বাসা থেকে বের হয়ে সোজা খান ম্যানশনে চলে এসেছে। ভেবেছিল ওর বাবা মা হয়তো আবার ওকে ফিরিয়ে দেবেন। কিন্তু তারা অবাক করে দিয়ে ইফাজকে সাদরে গ্রহণ করলো। তারাও খুশি হয়েছে তাদের ছেলে ফিরে আসায়। নাতিকে পেয়েও তারা খুশি। কিন্তু তারা বৌমা চায় না। ইশান তো ওনাদের বংশের রক্ত তাই ইশানকে ফিরিয়ে দেয়নি। ইফাজ ইশানকে নিয়ে নিজের বেডরুমে চলে যায়। কত বছর পর এই রুমে পা দিয়েছে সে ভাবতেই চোখজোড়া ভিজে আসে তার।
ঘুটঘুটে অন্ধকার বিরাজ করছে রুমে। খাটের উপর গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে ছোট্ট মীরা। পিহু জানালার গ্রিল ধরে বাইরে তাকিয়ে আছে। ঘুম আসছে না তার। কি করে ঘুম আসবে??যার বুকে মাথা রেখে ঘুমাতো সেই তো নেই। তাই পিহুর চোখে ঘুম নেই। এর আগেও ইফাজের সাথে মনোমালিন্য হয়েছে পিহুর। কিন্তু পরে ইফাজই এসে পিহুকে জড়িয়ে ধরে বলেছে,’আ’ম সরি!!আর কখনও তোমাকে ভুল বুঝবো না।’

পিহু তখন অভিমানী কন্ঠে বলতো,’যদি ভুল বোঝো কখনো??’
ইফাজ তখন হেসে পিহুর গাল টেনে বলতো, ‘তুমি আছো না??আমি ভুল বুঝলে তুমি ভালোবাসা দিয়ে সেটা পুষিয়ে দেবে। তোমার ভালোবাসায় যে আমি বড্ড কাতর পিহুরানি। তোমার পবিত্র ভালবাসা যে আমার সব রাগ অভিমান ভুলিয়ে দেয়। সেটা কি জানো না??’
পিহু সেদিন লাজুক হেসেছিলো। এই লাজুক মুখখানি যে ইফাজের খুব ভালো লাগে। তাই সবসময় রোমান্টিক কথা বলে পিহুকে লজ্জায় ফেলতো। এইতো সেদিন পিহু রান্না করছিল হুট করে ইফাজ এসে তাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে,’তোমার ওই নরম ঠোঁটের উষ্ণ পরশ পেতে চাই দেবে কি??’

পিহু তখন লজ্জায় একাকার হয়ে গিয়েছিল। বিয়ের এতবছর হওয়ার পর ও এত লজ্জা কোথা থেকে আসে তা ইফাজ আজও বুঝতে পারলো না।
এসব ভাবতেই আনমনে পিহু হেসে উঠলো। পিহু ভাবলো কালকে গিয়ে তার সব ভালোবাসা উজাড় করে ইফাজকে সবটা বোঝাবে। ইফাজ নিশ্চয়ই বুঝবে। কারণ সে যে পিহুকে ভালোবাসে। পরে হয়তো ইফাজ নিজের ভুল বুঝতে পেরে সরি বলবে পিহুকে তখন সে আচ্ছা মতো বকে দেবে ইফাজকে।

কিন্তু যদি ইফাজ না বোঝে আর ওকে ছেড়ে চলে যায়??একথা ভাবতেই বুকটা ধক করে উঠল পিহুর। ইশানের কথা মনে পড়ে গেল তার। ইশান মা’কে ছাড়া থাকবে কিভাবে?? খাওয়া দাওয়া গোসল করা। স্কুলে যাওয়ার জন্য রেডি করা সবই তো পিহু নিজের হাতে করতো।

পিহু ঘাড় ঘুরিয়ে মীরার দিকে তাকালো। তাহলে কি তার ছেলের জীবন মীরার মতো হবে??বেচারি মীরা!! এটুকু বয়সে বাবা মা হারিয়ে সে নিঃস্ব। মীরার মা পুষ্পা পিহুর ছোটবেলার বন্ধু ছিলো। ওদের সব সময়কার চলাফেরা একইসাথে হতো। পুষ্পা বিয়ে করে মিলন নামের একটা ছেলেকে। লাভ ম্যারেজ ছিলো ঠিক পিহুর মতো। তবে মিলনের পরিবার বলতে কেউ নেই সে একাই। পুষ্পা কন্সিভ করাতে মিলন খুব খুশি হয়েছিলো। মিলন চেয়েছিল তার একটা সুন্দর পরীর মত রাজকন্যা হবে। নাম ও রেখছিলো মীরা।ঠিক তাই হলো। একটা পরী এলো পুষ্পার কোল জুড়ে। কিন্তু দূর্ভাগ্য যে সেই পরীকে একনজড় দেখতে পেলো না মিলন। হাসপাতালে আসার পথে গাড়ি এক্সিডেন্ট করে মিলন।

তারপর সাতদিন হসপিটালে ভর্তি থেকে মারা যায়। এই সাতদিন মিলনের হিতাহিত জ্ঞান ছিল না বললেই চলে। শুধু চোখদুটো খোলা রেখেছিল। মিলনের মৃত্যু তে সবচেয়ে বেশি ভেঙে পড়েছিল পুষ্পা। পিহুই সামলেছে পুষ্পাকে। তাছাড়া দুজনে একসাথে চাকরি করছিল একই স্কুলে। কিন্তু মীরা মেয়েটা বোধহয় পোড়া কপাল নিয়ে জন্মেছে। পাঁচ মাস আগে পুষ্পা পিহুর কাছে মীরাকে রেখে ব্যাংকে যায় একটা কাজে। কিন্তু সেখান থেকে পুষ্পা ফিরে আসেনি। এসেছিল ওর ডেডবডি। এক্সিডেন্টে স্পটডেড হয় পুষ্পার। একইভাবে সে পৌঁছে যায় মিলনের কাছে।

আর মীরাকে রেখে যায় পিহুর কাছে। ছোট মীরা এখন ও জানে না তার মায়ের মৃত্যুর খবর। তার মা যাওয়ার সময় এটা বলে গিয়েছে যে সে যেন মনি’মার কাছে থাকে এবং কোন দুষ্টুমি না করে। মা তার জন্য অনেক খেলনা আনতে যাচ্ছে। সহজ সরল মীরা সেটাই বুঝে নিয়েছে। সে ভাবছে অনেক খেলনা কিনতে তো সময় লাগে তাই তার মায়ের আসতে দেরি হচ্ছে। কিন্তু মীরা তার মায়ের জন্য প্রতিদিন অপেক্ষা করে।
পিহু আস্তে করে মীরার পাশে গিয়ে বসলো। ঘুমন্ত মুখটাতে আলতো করে চুমু খেলো সে। তারপর একধ্যানে তাকিয়ে রইল মীরার দিকে। যদিও অন্ধকার কিছুই দেখা যাচ্ছে না তবুও সে তাকিয়ে থাকলো।

গভীর রাতে ওযু করে তাহাজ্জুদের নামায আদায় করলো পিহু। মোনাজাতে কেঁদে কেঁদে সে খুব করে ইশান আর ইফাজকে চাইলো। তারপর ও ঘুম আসলো না পিহুর। ফজরের নামাজ পড়ে সে উত্তেজিত হয়ে পড়লো। কখন যাবে ইফাজের কাছে আর কখন ওদের ফিরিয়ে আনবে??
সকাল হতেই মুক্তা সামির কে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো পিহু। সাথে মীরাকেও নিলো। পিহুর ধারণা ওরা খান ম্যানশনে গিয়েছে। তাই আগে ওরা খান বাড়িতে যাবে।

কিন্তু ওদের খান বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হলো না। গেটের সামনে দারোয়ান আটকে দাঁড়ায় বলে,’আপনারা কারা?? কাকে চাই??’
পিহু কথা বলতে পারলো না। গলা আটকে আসছে তার বারবার বাড়ির ভেতরে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে সে। সামির এগিয়ে এসে বলে,’আমরা ইফাজ খানের সাথে দেখা করতে এসেছি। উনি কি এখানে এসেছেন??’

অপ্রিয় সেই প্রিয়জন পর্ব ১

দারোয়ান জবাব দিলো,’হ্যা কাল রাতেই এসেছেন।’
‘তাহলে ওনাকে বলুন যে সামির আর পিহু এসেছে ওনার সাথে দেখা করতে।’
দারোয়ান সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে বলে,’কিন্তু আজ তো বাসায় কেউ নেই।’
কপালে ভাঁজ ফেলে সামির বলল,’কোথায় গেছে??’
‘স্যাররা আজ পুরো পরিবার সহ লন্ডন চলে যাচ্ছে। একটু পরেই তাদের ফ্লাইট। সকালেই সবাই ইয়ারপোর্ট চলে গেছে।’

সামির আর কিছু বলল না। দারোয়ানের কথাগুলো পিহুর কানে বাজতেছে। নাহ এভাবে ইফাজ তাকে ছেড়ে যেতে পারে না। পিহুর মাথাটা ঘুরে এলো। পড়ে যেতে নিলেই সামির ওকে ধরে ফেললো। সামির বলল, ‘ভেঙে পড়ো না পিহু শক্ত হও। রাতারাতি এসব হয় না কখনো। ইফাজ দেশের বাইরে যায়নি।’

পিহু কম্পিত কন্ঠে বলল,’দারোয়ান যে বলল।’
‘আমাকে ভাবতে দাও পিহু। তুমি এখনই ইফাজকে ফোন করো তাড়াতাড়ি।’
পিহুর হাত পা কাঁপছে তবুও সে কাঁপা হাতে ফোন করলো ইফাজকে

অপ্রিয় সেই প্রিয়জন পর্ব ৩