রক্তক্ষরণ অপেক্ষা পর্ব ২ || নাফিসা মুনতাহা পরী

রক্তক্ষরণ অপেক্ষা পর্ব ২
নাফিসা মুনতাহা পরী

শুভ্র চলে যাওয়াতে আমার মনের উপর এতটা ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে যা আমার লাইফটাই তছনছ করে দেয়। আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারিনা, শুভ্র আমাকে, এই পরীকে এমন একটা জায়গায় ছুড়ে ফেলে দিবে সেখান থেকে বের হওয়ার আমার ক্ষমতা থাকবেনা। দিন রাত শুধু চোখের সামনে নিজের ঝুলন্ত লাশ দেখতে পাই। মনে হত, আমি সুইসাইড করেছি আর আমার লাশ আমার সামনে পড়ে আছে। আমি বুঝতে পারছিলাম, আমার সাথে খারাপ কিছু ঘটতে চলেছে। আমার মন আর দেহ দুটাই আলাদা সত্ত্বায় পরিনত হয়েছে। দেহ বলে সুইসাইড কর আর মন বলে , জাহান্নামকে কিনে নেসনা। পৃথিবীতে কোন মানুষই সুখী নয়। প্রত্যককে এই কষ্টের দহন জ্বালা সইতে হবে। বেঁচে থাকলে নিজের পরিবর্তন আনতে পারবি কিন্তু সুইসাইড করলে, সমস্ত পথ বন্ধ হয়ে যাবে। কারো কোন ক্ষতি হবেনা। যা হবে শুধু তোরই ক্ষতি হবে।

আমার কাছে আস্তে আস্তে শয়তান জ্বীনগুলো আসতে লাগলো। মনে নানা ভাবনা জাগাতো। শুধু সুইসাইড করার কথা চিন্তা করতে লাগলাম মনে মনে। কোন কিছু দিয়েই কিছু হচ্ছিলনা। পরিবারের কথা মাথাতে আসতোই না। আমার সত্ত্বাকে কারা যেন তাদের আয়ত্বে রেখেছে। বাসায়ও কিছু বলতে পারতামনা। বাথরুমে পানির কল ছেড়ে দিয়ে চিৎকার দিয়ে কাঁদতাম।
মাঝে মাঝে শুধু আল্লাহর কাছে দু’হাত তুলে দোয়া করতাম, ” হে আমার প্রভূ আমাকে এমন যন্ত্রনাময় মৃত্যু দাও যাতে আমার লাশ যে দেখবে তার রুহু পর্যন্ত যেন কেঁপে ওঠে। আমার এমন ভাবে যেন মৃত্যু হয় যাতে আমার শরীরের একটুকরোও মাংসও যেন কবর দেওয়ার মত কেউ খুজে না পায়। সবচেয়ে ভয়ানক মৃত্যু ও যন্ত্রনাময় মৃত্যু দাও।
আমি ক্লান্ত তোমার এই পৃথিবীতে থাকতে থাকতে। আমার তোমার জান্নাতের দরকার নেই। শুধু আমাকে এই জিবন থেকে মুক্তি দাও। আমার অস্তিত্বটাই বিলীন করে দাও। পরী নামে কেউ যে পৃথিবীতে আসছিল তার কথা মানুষদের মন থেকে মুছে দাও।
এতকিছুর পরও সুইসাইড করতে পারছিলামনা এই কারনে যে, মরার পর আমার লাশ নিয়ে টানাহিচড়া হবে। আমার পুরো শরীর না জানি কোন পুরুষ মানুষ দেখে ফেলে। আমি আমার নিজের দেহের কথা চিন্তা করে আর কিছু করতে পারিনি। দিনগুলো আমার জন্য অত্যান্ত কষ্টময় হতে লাগল। সময় যেন থমকে দাড়ায়।

আরও গল্প পরতে ভিজিট করুন

একদিন রুমের দরজা বন্ধ করে অযু করে এসে “কোরআন শরীফ” বুকে নিয়ে কাঁদতে লাগলাম। আল্লাহ্ আমাকে তুমি কিসের শাস্তি দিচ্ছ! আমাকে রক্ষা করো। আমি এই দুনিয়ার কষ্ট সইতে পারছিনা তাহলে আমি ঐ পরকালের কষ্ট কিভাবে সইবো? যেখানে আপনি আমার প্রভু ওয়াদা করেছেন, পাপীদের আপনি লাঞ্ছিত করবেন। না জানি সেই লাঞ্ছনা কতইনা লজ্জাজনক। আমি পারবোনা প্রভু। আমাকে শক্তি দিন। আমাকে সাহার্য্য করো প্রভু। আমি যে আর পারছিনা। সেদিন কোরআন আমার শিয়রে রেখে ঘুমালাম।
পরেরদিন সকাল থেকে মনে প্রশান্তি আসতে লাগলো। ঐ দিনের পর থেকে “কুরআন” বাংলা অর্থ সহকারে পড়তে লাগলাম। প্রতিটা কুরআনের আয়াত আমার বাঁচার স্বপ্ন জুগিয়েছে। আস্তে আস্তে সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে আসে। কিন্তু কথায় আছেনা, অভাগা যেদিকে যায় সেদিকেই সাগর শুখায়।
একদিন একটা লোক আসলো আমাদের বাসায়। দুর থেকে লোকটাকে দেখে রুমের ভিতর চলে গেলাম। লোকটি কে ছিল জানতামনা। জানার ইচ্ছাও জাগেনি।

পরীর বাবা কামরুল হাসান গম্ভীর মুখে ডাইনিং রুমের সোফায় বসে আছে। সামনের বসা লোকটি ছিল শুভ্রের মামা আকন্দ মির্জা। উনিও গম্ভীর হয়ে বসে আছেন। কোথা থেকে শুরু করবেন তিনি সেটাই ভাবছেন। এমন সময় ট্রেতে চা-নাস্তা দিয়ে গেল কাজের মেয়েটা। পরীর মা স্বপ্না কিছুটা দুরে দাড়িয়ে আছেন।
ভাই নাস্তা নিনি বলতেই আকন্দ মির্জা কামরুল হাসানের মুখের উপর বলল,” আমি এখানে নাস্তা খেতে আসিনি। আপনার মেয়ের বিরুদ্ধে রির্পোট দিতে এসেছি। আপনাদের মত বাবা-মায়েরা ঠিকমত সন্তান মানুষ করতে পারেননা। তার খেসারত আমাদের মত পরিবারের মানুষদের দিতে হয়।”
কামরুল হাসান কিছু বুঝতে না পেরে বলল,” আমি আপনার কোন কথাই বুঝতে পারলামনা। একটু ক্লিয়ার করে বলেন ভাই।”
~” আপনার মেয়েকে এক্ষুনি ডাকুন।”
কামরুল সাহেব বিস্ফোরিত চোখে বলল,
~” কোন মেয়ে!”
~” আপনার কয়টা মেয়ে আছে?”
~” কাকে চান সে কথা বলুন।”
আকন্দ মির্জা রেগে গিয়ে বলল,” থাক আপনার মেয়েকে ডাকার দরকার নেই। মেয়েকে জন্ম দিয়েছেন কিন্তু শিক্ষা দিতে পারেন নি। আপনার মেয়ে পরী! ওকে যেন না দেখি আমাদের বাসায় কল দিতে। আমার ভাগিনার পুরো লাইফটাই হেল হয়ে যেত যদিনা আমরা সেদিন ব্যবস্থা না নিতাম। এত কিছু হয়ে যাওয়ার পরও আপনার মেয়ে আমাদের বাসায় কল দেয় কোন সাহসে। এই আপনাদের মেয়ের শিক্ষা?”

~”আমার মেয়ে পরী! আপনি কি জেনেশুনে কথাগুলো বলছেন? আমার মেয়ে অত্যান্ত ধার্মিক স্বভাবের। যে প্রয়োজন ছাড়া বাসা থেকে বের হয়না। যার কোন ফ্রেন্ড নেই তাকে এসব কথা বলছেন? আমার বড় মেয়ের সম্পর্কে এমন অভিযোগ করলে আমি মানতাম কিন্তু ছোট মেয়ে! কখনো না……। আপনার কোথায়ও ভূল হচ্ছে।”
ধার্মিক….! উপরে ধার্মিক সাজে আর নিচে নিচে ঘোমটা দিয়ে খেমটা নাচন নাচে। এবার খোঁজ নিয়ে দেখুন কত রের্কড বের হয়। আকন্দ মির্জা কামরুল হাসানকে যা না তাই বলে শাসাতে শাসাতে চলে গেল। আশেপাশের মানুষজন অবদি দেখলোনা। সমস্ত মান সম্মান আজ সব শেষ হয়ে গেল। আজ থেকে বাসা থেকে বের হওয়াই যেন দায় হয়ে পড়লো।
কামরুল সাহেব তার স্ত্রী স্বপ্নার দিকে কঠোর চোখে বলল,” মাকে যদি আমি উত্তম মাধ্যম দিতাম তাহলে সন্তান ঠিকিই মানুষ হত। এমন দিন কখনো দেখা লাগতোনা। ওকে এখুনি বাসা থেকে বের করে দাও। ওর মুখও আমি দেখতে চাইনা।”

স্বামীকে এত রেগে যেতে কোনদিনও দেখেননি স্বপ্না বেগম। ভয়ে পুরো শরীর কেঁপে উঠলো স্বামীর কথা শুনে। বড় মেয়ে “অবন্তী” এসে মায়ের সামনেই উচ্চস্বরে বলে উঠল,
~” নাও এবার ঠেলা সামলাও। মেয়েকে তো খুব আস্কারা দিতে। তোমার মেয়ের মত মেয়েই নাকি দুনিয়াতে নেই। তাহলে এগুলো কি? বাসা বয়ে এসে মানুষ শাসিয়ে যাচ্ছে। সম্মান আর কিছু রেখেছে?”
অবন্তীর কথা শুনে স্বপ্না বেগম আরো উত্তেজিত হয়ে গেল। বাহিরে গিয়ে কয়েকদিন আগে লাগানো আমগাছের ডালটা মুচড়ে ভেঙ্গে নিয়ে সোজা পরীর রুমে গেল। রুম অন্ধকার করে পরী বিছানায় চুপ করে সুয়ে ছিল। স্বপ্না বেগম লাইট জ্বালিয়েই পরীকে এলোপাথারি আঘাত করেই বললেন,” এই শুভ্র কে বল?”
এমন অচমকায় আঘাত আমি সইতে পারলামনা। তাছাড়া শুভ্রের কথা শুনে চমকে উঠলাম। মা শুভ্রের কথা জানলো কিভাবে?
মা কি হয়েছে, আমাকে মারছো কেন?
~” বাহিরে ফষ্টি নষ্টি করে বেরাস আর বাসায় হাজীবিবি! শুভ্র কে বল?”
মায়ের এমন কথায় আমি প্রচন্ড রেগে গিয়ে চুপ করে গেলাম। আমার মুখ দিয়ে আর একটা কথাও বের হলনা। এতটা কঠিন আমি কোনদিনও হইনি। শরীরে যতই আঘাত পড়ছে ততই আমার জেদ বেড়ে চলছে।

ঐ রুম থেকে অবন্তী আপু এসে মাকে শক্ত করে ধরলো। মা তুমি পাগল হয়ে গেছ! ওকে এভাবে মারলে তো ও মরে যাবে। চল রুম থেকে বলে টেনে নিয়ে চলে যেতেই আমি আমার হিতাহিত বোধটুকু হারিয়ে ফেললাম। আমাকে আঘাত করা থামলো কেন বলেই বেড থেকে উঠেই দেয়ালের সাথে নিজের মাথা দিয়ে কয়েকবার আঘাত করলাম। মাথাটা যেন ঘুরে এল। বুঝতে পারলাম, গাল আর কান দিয়ে গরম রক্ত বেয়ে পড়ছে। তারপর ধপ করে ফ্লোরে পড়ে গেলাম। আর কিছুই মনে নেই।
স্বপ্না আর অবন্তী দরজা পেরিয়েই থমকে গেল। পিছন ফিরে পরীকে ওভাবে পরে থাকা দেখে অবন্তী চিৎকার দিয়ে ওঠে। পরী তোর কি হল?
অবন্তীর চিৎকারে কামরুল হাসান সহ কাজের মেয়েটা দৌড়ে এসে দেখে পরী রক্তাত্ব অবস্থায় ফ্লোরে পড়ে আছে। কামরুল সাহেব হুংকার দিয়ে উঠলো,
” স্বপ্না, আমার মেয়ের সাথে তুমি কি করেছ! আজ যদি ওর কিছু হয় তাহলে তোমার নিস্তার নেই।”
সবাই ধরাধরি করে পরীকে বিছানায় সুয়ে দিয়ে ফ্যামিলি ডাক্তারকে জরুরি ডাকা হল। পরীদের বাসা যেহেতু মেন শহরে তাই ডাক্তার আসতে বেশি সময় নেয়নি। কপালের একটু উপরে বেশ ক্ষত হয়েছে। সেখানে চারটা সেলাই পড়লো।

ডাক্তার চলে যাওয়ার কিছুক্ষন পর পরীর সেন্স ফিরলো কিন্তু কারো সাথে আর কথা বললোনা। পরীর এমন আচরন কামরুল সাহেবকে ভাবতে বাধ্য করলো। সেদিন মাগরিবের নামায মসজিদে আদায় করলো। তারপর ফিরার পথে মসজিদের ঈমাম সাহেবকে ডেকে আনলো।
পরী খাটে আধাশোয়া অবস্থায় বসে আছে। চোখদুটি ভিজা। দেখে বোঝাই যাচ্ছে এতক্ষন ধরে মেয়েটা কাঁদছিল।
ঈমাম সাহেব বেশ তদবিরের সাথে জিঙ্গাসা করলো, ” বাবা তোমার নাম কি!”
পরী কঠিন চোখে ঈমামের দিকে চেয়ে বলল,” কুয়াশা।”
~” তোমার নাম কুয়াশা!”
~”হুম।”
পরী, কি বলছো! তোমার নাম কুয়াশা হতে যাবে কেন? তুমি তো পরী। কথাটি ধমক দিয়ে বলে উঠলো কামরুল সাহেব।
পরী ওর বাবার কথাকে পাত্তা না দিয়ে বলল,” আমি কুয়াশা।”
কামরুল সাহেব কেবল পরীকে জোড়ে একটা ধমক দিবে এই সময় ঈমাম সাহেব ওনার হাত চেঁপে ধরে বলল, ” আপনার মেয়ে আর ওর মধ্য নেই। ও সম্পূর্ন অন্যর দখলে। আমি যেহেতু এসব চিকিৎসা করিনা তাই আপনার মেয়েকে আমি ঠিক করতে পারবোনা। তবে আমি একজনকে দেখিয়ে দিতে পারি। ওনি আমার বড় ওস্তাদ। আমি কি তার সাথে যোগাযোগ করবো?”

কামরুল সাহেব ভ্রু কুচকে বললেন,” আপনার সন্দেহ, আমার মেয়ের উপর কোন আছড় রয়েছে?”
~” সন্দেহ না জনাব। আমি হলফ করে বলতে পারি আপনার মেয়ে খুব বিপদে আছে। ওর সঠিক চিকিৎসা দরকার। বিলম্ব করে ওর বিপদ আর বাড়াবেন না।”
মিসেস. স্বপ্না দড়জার আড়াল থেকে বলে উঠলো, আপনি দয়া করে ওনাকে ডাকুন এখানে। আমি বুঝতে পারি আমার মেয়ের জটিল সমস্যা রয়েছে। ওনাকে অনেকবার বলেছি কিন্তু কথাটি উনি কানে নেননি।
~” আচ্ছা আমি এখুনি কল দিচ্ছি ওনাকে। দেখি উনি কোথায় আছেন।”
ঈমাম সাহেব কল দিয়ে জরুরি ভিত্তিতে ওনাকে এখানে আসতে বলল। তারপর ঈমাম সাহেব রাত দশটার দিকে আসবেন বলে চলে গেলেন।
ঈমাম সাহেবের কথা শুনে প্রচন্ড দুঃশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন কামরুল সাহেব। মেয়ের ব্যবহারে কোন দিনও এমন কিছুর অস্তিত্বর খুঁজে পাননি। কোথা থেকে কি হয়ে গেল।
এর মধ্য পরী কারো সাথেই আর কথা বলেনি কিংবা খাবারও খায়নি। রাত নটার দিকে পরী ঘুমিয়ে পড়ে।

রাত দশটার দিকে ঈমাম সাহেব তার ওস্তাদ জামাল মৌলবীকে নিজের সঙ্গে করে নিয়ে আসলেন। অনেকটা বৃদ্ধ মানুষ তবে চলাফিরা সুন্দর স্বাভাবিক ভাবেই করতে পারেন। উনি এসে পরীর কপালে হাত দিতেই পরী দু’চোখ মেলে তাকালো। আর সাথে সাথে মৌলবী সাহেবের গলা চেঁপে ধরে বলল,” তুই এখানে কেন এসেছিস? মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা কি তোর খুব সখ? কেন এসেছিস বল?”
তাছাড়া পরী বিভিন্ন ভাষায় কথা বলতে লাগলো।
ঈমাম সাহেব দ্রুত এসে মৌলবী সাহেবকে ধরতেই মৌলবী সাহেব নিষেধ করলেন হাত দিয়ে ইশারা করে। তারপর তিনি জোড়ে জোড়ে দোয়া পড়তে লাগলেন। একপর্যায়ে পরী দুর্বল হয়ে পরে। মৌলবী সাহেবের গলা ছেড়ে দিয়ে বেডে পরে যায় আর ঘন ঘন শ্বাস নিতে থাকে। পরীকে ঐ অবস্থায় রেখে মৌলবী সাহেব বলে উঠলো,
~” আপনার মেয়েতো সাংঘাতিক বিপদে রয়েছে। এর আগে কয়েকবার আত্বহত্যার চেষ্টা করেছে। এর শরীরে একাধিক জ্বীনের বসবাস। তার ভিতর আপনার বড় মেয়েকে কুফুরি করা হয়েছিল যার প্রভাব সম্পূর্ন আপনার মেয়ের উপর পড়েছে। শুধু তাই নয় আরো অনেক কাহিনী আছে। আপনার পরিবারকে যারা কফুরি বিদ্যা দিয়ে যতবারই আঘাত করতে চায় ততবারই আপনার মেয়ে ঢাল হয়ে দাড়ায়। তাই তার সম্পূর্ন প্রভাব আপনার মেয়ের উপর বারবার পরে।”
কামরুল সাহেব অবিশ্বাসের সাথে বলল,” কি বলছেন এসব। আমি এগুলো বিশ্বাস করিনা।”
~” মেয়ে মারা গেলে কি বিস্বাস করতেন? আমাদের জানার বাহিরেও অনেক কিছু থাকে। আল্লাহর সৃষ্টির শেষ নেই।”

মৌলবী সাহেব অনেকগুলো ছোট ছোট কাগজের টুকরোর মধ্য বিভিন্ন আরবি ভাষায় দোয়া লিখলেন আর সব কাগজের টুকরোগুলো কোনটা পরীর বালিশের নীচে, কোনটা বিছানার মধ্য সহ সাড়া বাসায় গুপ্ত জায়গাতে রাখলেন। এমনকি পরী ব্যাগ সহ ব্যবহার্য সমস্ত জিনিসে দোয়াগুলো রাখলেন। তারপর চলে গেলেন। যাওয়ার আগে বলল,” আমার সব অভিঙ্গতা দিয়ে কাজ করলাম। এর উপর বড় কোন চিকিৎসা হতে পারেনা। আশা করি ভালো ফলাফল পাওয়া যাবে।”
দশ দিন পর,
পরী মোটামুটি সুস্থ। ওকে আর একা রুমে থাকতে দেওয়া হয়না। খুব নজরে রাখা হয় ওকে। মা নিয়ম করে দোয়া পরে মাথা সহ পুরো শরীর মাসেহ্ করে দেয়।
আজ অনেক দিন পরে কলেজ যাচ্ছে পরী। অবন্তী পরীকে কলেজে রেখে আসে।
দুইটা ক্লাস করে শহীদ মিনারের কাছে বসে পড়ল। কিছু ভালো লাগছেনা। শুভ্রর কথা বড্ড মনে পড়ছে। মনে করে আর কি হবে ভাবতেই রুপম এসে হাজির হল পরীর কাছে।
~” এই পরী কেমন আছিস?”
রুপমের কথা শুনে গা জ্বলে উঠলো পরীর। সেদিন ওমন ব্যবহারের পর আবার কোন লজ্জায় কথা বলতে এসেছে। উঠে দাড়াতেই রুপম হাত ধরে আবার বসালো। এত রাগ কেন তোর হুম?
~” তোর কি লজ্জা বলতে কিছুই নেই? আর তুই কিভাবে ভাবলি আমি তোর সাথে স্বাভাবিক ব্যবহার করবো?”

~” দেখ, সব ঝামেলা মিটে গিয়েছে। আমিও তোর জন্য কম মাইর খাইনি। শুভ্র ভাই আমাকে সেদিন প্রচন্ড মেরেছিল। বাবা রাগে কেস করে দিয়েছিল ওনার নামে। এখন সব মিটমাট। বাদ দেনা ওসব।”
পরী জানতোনা এত কিছু হয়েছে। চুপ করে রুপমের সব কথা শুনলো। শুভ্র আর রুপমের ভিতর কোন পার্থক্য দেখলোনা পরী। দুইজনকেই একই কাতারে রাখা যায়।
এক বছর পরে,
পরী সম্পূর্ন স্বাভাবিক জিবনে ফিরে এসেছে। অতীত মনে করে আর নিজেকে কষ্ট দেয়না। একদিন পরী গভীর রাত পর্যন্ত রুমে বসে পড়ছিল। এমন সময় ফোনে কল আসলো। পরী চেক করে দেখলো তুলি কল দিয়েছে। এতরাতে তুলি কল দিয়েছে? কেন কল দিয়েছে বলে ফোন রিসিভ করতেই তুলি বলে উঠলো,” পরী তুই কি রুমে একা?”
পরী সন্দেহ প্রবন হয়ে বলল,” হঠাৎ এই কথা বলছিস?”
~” না মানে, শুভ্র ভাইয়া তোর সাথে একটু কথা বলত।”
শুভ্রর কথা শুনে পরী অত্যন্ত রেগে গেল। দাঁতে দাঁত চেঁপে বলল, ” শুভ্রর চ্যালা হয়েছিস তুই?”
পরীর কথা শুনে তুলি অত্যন্ত লজ্জা পেয়ে গেল। কারন শুভ্র কনফারেন্সে ছিল। তুলি মন খারাপ করে বলল,” ভাইয়া লাইনে আছে। তাই এমন কোন কথা বলিসনা যে ভাইয়া বা আমার জন্য সেটা লজ্জাজনক হয়।”
তোর সাহস কি করে হয় অন্য ছেলের সাথে আমাকে এই রাতে কথা বলতে বলিস! ফোন রাখ্ বলেই একটা ঝাড়ি দিয়ে পরী কল কেটে দিল।

পরী কল কেটে দিতেই শুভ্র তুলিকে বলল,” স্যরি তুলি! আমার জন্য আপনাদের ভিতর ঝামেলা হয়ে গেল।”
~” কি বলেন ভাইয়া! আপনার জন্য এইটুকু করতে পেরে আমার নিজেরই খুব ভালো লাগছে। আপনি যে আমার সাথে কথা বলছেন আমিতো বিশ্বাসই করতে পারছিনা। ওয়েট আমি পরীর নাম্বার দিচ্ছি।”
শুভ্র এটাই চাইছিল। কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারছিলনা। আল্লাহ্ সহায় হয়েছেন বলে না চাইতেই নাম্বারটা পাওয়া গেল।
তুলির কাছ থেকে নাম্বারটা নিয়ে শুভ্র পরীর নাম্বার ডায়েল করলো।
পরী জানতো, শুভ্র কল দিবে। অনেকটা অপেক্ষায় ছিল। কল আসতেই পরী চট করে কল রিসিভ করতেই শুভ্র বলে উঠলো,
~” I Love you Bow.”
শুভ্রের এই বউ ডাকটা শুনে পরী চোখ বন্ধ করতেই চোখ দিয়ে পানি ঝড়ে পড়ল। কত অপেক্ষা করেছে এই মানুষটার মুখের কথা শোনার জন্য। পরী কান্না কন্ঠেই বলে উঠলো,” আপনি কে! আর কি উল্টাপাল্টা সব কথা বলছেন?”
~” আমি কে, সত্যই কি তুমি তা জানোনা?”
~” না আমি সত্যিই আপনাকে চিনিনা। আমি ফোন রাখছি।”
~” পরী, কেন মিথ্যা বলছো! আমার কন্ঠও কি তুমি চিনতে পারছোনা?”
পরী এবার ডুকরে কেঁদে উঠলো। আমি আপনাকে চিনিনা। আপনি কেন আমাকে বিরক্ত করছেন?
শুভ্রর গলা ধরে আসছে। নিজেকে কঠিন স্থানে রেখেই গম্ভীর গলায় বলে উঠলো,” I’m srry, আমার উচিত ছিল তোমাকে বলে আসা। কিন্তু সময় বা পরিস্থিতি আমাকে সেই সুযোগ দেয়নি। আর তাছাড়া তুমিও সুযোগ দাওনি। আমার মনে হয় তুমি সিমটা সেদিনই নষ্ট করে ফেলেছ।”
~” আপনার কথা শেষ! আমার সামনে এক্সাম। তাই আমাকে পড়তে হবে।”
~” প্লিজ, আমাকে এক্সকিউজ দেখাবানা। আমি যা বলছি তার জবাব দাও।”
~” আমি বিবাহিত, তাই আমাকে ডির্স্টাব করবেন না। আমার ভালো লাগছেনা। আমি রাখলাম।”
~” পরী I love you….”

রক্তক্ষরণ অপেক্ষা পর্ব ১

পরী অচমকায় এবার ওর নিজের কয়েকটা নুড পিক ফটাফট তুলে শুভ্রের আইডিতে পাঠিয়ে দিয়ে বলল,” আপনার আইডি চেক করেন।”
~” আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড তুমি?”
~” চেক করেন।”
শুভ্র ওর আর একটা ফোন দিয়ে আইডিতে লগইন করলো। কুয়াশা বলে একটা আইডি থেকে কয়েকটা পিক সেন্ড করা হয়েছে। এই মেয়ে এখানে! এটাই কি পরীর আইডি! মাঝে মাঝে এই আইডি থেকে মাসেজ আসতো। শুভ্র ভুলেও চেক করতোনা। কে জানতো সে তার প্রিয়তমাই ছিল।
শুভ্র মাসেজ চেক করতেই ওর চোখ কপালে উঠলো। একবার চেয়েই চোখ বন্ধ করে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
” এই পিক গুলোকি তুমি পাঠিয়েছ! আর এসব পাঠানোর মানে কি? কে এই মেয়ে!”
উফ্ স্যরি, আপনি তো আমাকে কোনদিন দেখেননি। ওটা আমি ছিলাম। আমার বয়ফ্রেন্ড আছে আর তার সাথে আমি এমনই খোলামেলা ভাবে চ্যাট করি। তাই আমাকে ফোন দিয়ে ডির্স্টাব করবেননা।”
~” অহ্ মাই গড, এটা আমার সেই মিষ্টি বউ! আজ আমি এত সারপ্রাইজড হব ভাবতেই পারিনি।”
শুভ্র দ্রুত ফোন অন করে মনযোগ সহকারে গভীর ভাবে পরীর পাঠানো পিকগুলো দেখতে লাগলো। আর পরী রেগেই চুপ করে আছে।
~” পরী, তুমিতো সেই লেভেলের কিউট। তোমার শরীরের প্রতিটা ইঞ্চি ইঞ্চি রুপের ঝলক। আমিতো বিমোহিত হয়ে গেলাম।”

~”হুমহ্ আমি কিউট! আগেতো জানতামনা। আপনার কথা শুনে জানলাম।”
~” কেন, তোমার বয়ফ্রেন্ড তোমাকে এই কথাটি বলেনি! তুমি কত সুন্দর?”
পরী মনে মনে প্রমোদ গোনে। মনে মনেই বলে,
পরী কন্যা আপনি বোধহয় শুভ্রর কাছে ধরাই পড়ে গেলেন। গুছিয়ে মিথ্যা কথাটাও বলতে শিখেননি এতদিনে। পরী কথা পাল্টিয়ে বলল,” আমার একাধিক বয়ফ্রেন্ড আছে। আপনার সাথে কথা বলে মনে হল, আমার আরো থাকা উচিত। আজ থেকে মাঠে নামবো। পড়াশোনা শেষ করার আগে মিনিমাম শত খানেক রিলেশন করবো। তারপর এক বুড়োকে দেখে বিয়ে করে “গোল্ড ডিগার” হব।
শুভ্র পরীর অহেতুক কথাবার্তা গুলোকে পাত্তা না দিয়ে বলল,” এই নুড পিক যে দিলে আমায়, তার জন্য কি আমাকে তোমার ভয় হচ্ছেনা?”
পরী তাচ্ছিল্য সহকারে বলল,” কিসের ভয়?”
~” যদি আমি এগুলো সোশাল মিডিয়াতে প্রকাশ করি?”

পরী শুভ্রর কথা শুনে অবিলায় বলে উঠলো, চরিত্রবান পুরুষেরা কোনদিন তার বউয়ের পিক মানে নিজের জিনিস কারো সাথে শেয়ার করেনা। যারা করে তাদের পুরুষের কাতারে ধরা যায়না। হিজরা বললেও কম হবেনা। আর তাছাড়া সোশাল মিডিয়াতে প্রকাশ হলে আপনারই ইজ্জত যাবে। বউ বলে কথা। শুভ্র এর মধ্য পরীকে কথায় কথায় অনেকটা স্বাভাবিক করে ফেলেছে।
এবার শুভ্র উচ্চস্বরে হেঁসে উঠলো। তারপর চোখ বন্ধ করে তৃপ্তি সহকারে বলে উঠলে,
” চোখের পিপাসা মেটানোর জন্য শুকরিয়া আমার বধু। আর হ্যাঁ আমি অপেক্ষায় রইলাম…।”

রক্তক্ষরণ অপেক্ষা পর্ব ৩