রক্তক্ষরণ অপেক্ষা পর্ব ৩ || নাফিসা মুনতাহা পরী

রক্তক্ষরণ অপেক্ষা পর্ব ৩
নাফিসা মুনতাহা পরী

কচি কলা পাতার ওপর থেকে টুপ করে পানির ফোটাটা পড়ে গেল। কিছুক্ষন আগে হালকা বৃষ্টি পড়ছিল। বৃষ্টি শেষে জানালার ধারে বসে অনেকক্ষন পানির ঐ ফোটাকে লক্ষ্য করছিলাম। প্রাচীরের ওপার থেকে একটা মানিপ্ল্যান্ট গাছ উকি দিচ্ছে। এই ক’দিনের বৃষ্টিতে লকলকিয়ে বেড়েছে গাছটা। অনেকের ধারনা, এই গাছটি বাড়িতে থাকলে নাকি টাকা-পয়সা বৃদ্ধি পায়! কামিনীর গন্ধকেও ছাড়িয়ে আসছে হাসনাহেনার গন্ধ। খুব তীব্র গন্ধটা। আমার মায়ের ধারণা হাসনাহেনার গন্ধে নাকি সাপ খুবই আকর্ষিত হয় আর গাছের কাছে এসে পড়ে। যদিও আমি বাগানে কোনদিন সাপ-খোপ জাতীয় কোন কিছুরই দেখা পাইনি। তবে মনে হয় মায়ের জন্য ছোট ঝোঁপালো মসৃণ পাতার এই গাছটাকে তুলে ফেলতে হয়।
কথাগুলো ভাবছিলাম আর একমনে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিলাম। গতকাল রাতে খুব শান্তির ঘুম দিয়েছি। শুভ্রজ্বরের যে মেডিসিন পড়েছিল শরীরে। তাই ঘুমটা দারুন হয়েছিল। সামনে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা। তাই পড়ার চাপ একটু বেশিই পড়েছে। দ্রুত চা খতম করে রেডী হয়ে নিলাম। ৭টায় প্রাইভেট আছে। ব্যাগ ঘাড়ে নিতেই ফোনের রিংটন বেজে উঠল। বাসা হতে বের হয়েই কল রিসিভ করলাম। তুলির কল ছিল।

~” হ্যা তুলি বল!”
তুলি কাঁপাকন্ঠে বলে উঠলো,
~” তুই কোথায়?”
আমি ওর কথার জবাব না দিয়ে মুখে হাসি টেনে বললাম-
~” ওখানে একটু দাড়া, আমি প্রায় এসেই গেছি।”
আমি কিছু বলছি সেটা বুঝতে পারছিসনা কেন! তুই কোথায় আছিস বল বলেই জোড়ে একটা ধমক দিল তুলি। আমি অত্যান্ত রাগী মেয়ে। আমাকে যদি কেউ কটু কথা বলে তাহলে তার কাছ থেকে শত হাত দুরে থাকবো। আমি রাগান্বিত স্বরে বলে উঠলাম,
~” সমস্যা কি তোর? গাঞ্জা সেবন করেছিস নাকি! এককালে নওগাঁ গাঞ্জার জন্য বিখ্যাত ছিল। তার উপর তুই এই শহরের স্থানীয় মেয়ে। করলে করতেও পারিস! মেন পয়েন্ট বল, এত বনিবনা ছেড়ে।”
সামনে শুভ্রর মা শাকিলা ম্যাডাম বেশ রাগী লুক নিয়ে তুলির দিকে চেয়ে আছে। তুলি ভয়ে খানিকটা জমে গেছে। ভয়ে ভয়ে ঢোক চিপে পরীকে বলল,
~” আমার শরীর খুব খারাপ রে। একটু বাসায় এসে আমার খাতাটা নিয়ে গিয়ে স্যারকে দিবি! জানিসতো, স্যার…..।”
কথাটি শেষ না হতেই কলটা কেটে গেল। কল কেটে যাওয়াতে আমি বেশ রেগেই গেলাম। এমনি সময় নেই তার ভিতর উটকো ঝামেলা। একটা রিক্সা নিয়ে তুলির বাসার পথে রওনা দিলাম। ১০ মিনিট পর পৌছে ভাড়াটা মিটিয়ে ওদের বাসায় গেলাম। কিন্তু কপাল মন্দ, বাসায় তুলি নেই। ওর ছোট বোন আমাকে নিয়ে কিছুটা দুরে অন্য বাসার কাছে গিয়ে বলল,

আরও গল্প পরতে ভিজিট করুন

~” তুলি আপুনি এই বাসায় আছে। আপনাকে এখানে দিয়ে যেতে বলেছে। আপনি যান আপু।”
কথাগুলো বলে আমার কথা বলার আগেই পিচ্চিটা চলে গেল। আমি কিছু মনে না করে বাসার ভিতর ঢুকলাম। তুলি কোথায় থেকে যেন এসেই আমাকে টেনে একদম ভিতরে নিয়ে গেল।
আমি ভিতরে গিয়ে অবাক হলাম। কারন সেখানে অনেকজন ছিল। সবথেকে বেশি অবাক হলাম শুভ্রের মামা আকন্দ মির্জাকে দেখে। এই লোকটাই বছর খানিক আগে আমাদের বাসায় গিয়ে বাবাকে শাসিয়ে এসেছিল। তারপরের ঘটনাতো সবারই জানা।
তারমানে এটা শুভ্রদের বাসা। বিপদের গন্ধ নাকে এসে সর্তক করে দিচ্ছে, কিছু একটা হতে চলছে। বুকের ভিতর হাতুরি পিটা শুরু হয়ে গেছে। আমার জানা নেই আজ কি ঘটতে চলছে। তবুও ভয়ে ভয়ে সবাইকে উদ্দেশ্য করে সালাম দিলাম। তারা সালামের জবাব দিল কিনা বুঝা গেলোনা। তুলি আমার বাম হাতটা শক্ত করে ধরে ভিত গলায় বলে উঠলো,

~” ম্যাম, এটাই পরী।”
শাকিলা বেগম বসা থেকে উঠে পরীর কাছে গিয়ে ওকে ভালো করো দেখলো। তারপর রুক্ষ কণ্ঠে বলে উঠলো,
~” এই মেয়ে, তোমার হিজাবটা খোলতো! দেখি তোমার রুপই কত আছে! যেই রুপ দিয়ে তুমি আমার ছেলেকে ঘায়েল করছে!”
ওনার কথা শুনে আমার গলা শুকিয়ে গেল। তারমানে এটা শুভ্রের মা। কিন্তু আমাকে এভাবে ডেকে এনে অপমান করার মানেটা কি? আমি মিনমিনিয়ে বললাম,
~” আপনি কি বলতে চাচ্ছেন! আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা।”
অদুরে এক বৃদ্ধা মহিলা পরীর কথা শুনেই হুংকার দিয়ে উঠলো-
~” এই শাকিলা, ওর সাথে এত ভদ্র ভাষায় কথা বলছিস কেন? বিয়াদপ মেয়ে, এখনো দেখছি শুভ্রর পিছ ছাড়েনি। তাইতো বলি, যে শুভ্র কোনদিনও মায়ের কথার উপর একটা কথাও বলেনা সে কিনা কাল অত রাতে মায়ের কাছে কৈফিয়ত চাইছে, কেন এই মেয়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করা হয়েছে! ভাবা যায় এগুলো? এই বিয়াদপ, তোকে কি তোর বাপ-মা শিক্ষা দেইনি! শিক্ষা যদি না দিয়ে থাকে তাহলে আজ আমরা তোকে শিক্ষা দিয়েই ছাড়বো।”

কথাগুলো শুনে আমার হাত-পা কাঁপতে লাগলো। এতগুলো মানুষের সামনে আমাকে যে যেইভাবে পারছে অপমান করেই চলছে। আমি আমার বাক শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। এত কষ্ট আমি জিবনেও পাইনি। শুভ্র যেদিন আমায় ছেড়ে চলে গিয়েছিল সেদিনও মনে হয় এত কষ্ট হয়নি। মুখ দিয়ে কথা বের না হলেও চোখ তার স্বভাব দেখাতে লাগলো। নোনতা জল বেয়ে হিজাবে এসে মিশে যেতে শুরু করলো। জানিনা তারা কতক্ষণ ধরে আমার উপর কথার তান্ডপ চালালো। এক পর্যায়ে তুলি আমার হাত ধরে টেনে বাহিরে নিয়ে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করতে লাগলো। ততক্ষনে আমার অবস্থা শেষ করে ফেলেছে এরা। আমি তুলির হাত ছিটকে ফেলে আঙ্গুল উচু করতেই ও বুঝে গেল আমি কি করতে চলছি।
মিসেস শাকিলা দেখলো, পরীর চোখদুটো লাল রক্তবর্ন ধারন করেছে। মনে হচ্ছে চোখের শিরা উপশিরাগুলো রক্তে রঞ্জিত হয়েছে। পরী এসে শুভ্রের মায়ের সামনে হাত দু’টো জোড় করে কিছু বলতে যাবে এমন সময় শুভ্রের নানু এসে পরীর গালে ঠাশ্ করে একটা চড় বসিয়ে দিয়ে বলল,
~” দোষ করে আবার আমার মেয়েকে চোখ রাঙ্গানো হচ্ছে! আমার স্বামীহারা মেয়েটি তার সন্তানকে বুকে আগলে রেখে বাঁচার স্বপ্ন দেখে আর তুই সেই সন্তানকে ওর কাছ থেকে কেড়ে নিতে চাস? তোর মুখ যেন আমাদের না দেখাস। ভুলেও যদি আবার শুভ্রের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করিস তাহলে তোর বাপকে ১৪ শিকের ভাত খাওয়াই ছাড়বো।”

শেষের আঘাতটা হয়ত আমার জন্য যথেষ্ঠ ছিল শুভ্রর কাছ থেকে দুরে সরে যাওয়ার জন্য। আমি ইচ্ছা করলে বলতে পারতাম, আমি শুভ্রের বিবাহিত স্ত্রী। কিন্তু………
কোন কথা না বলে বাসা থেকে বের হয়ে এলাম। বের হতেই শুধু তুলির কান্না জড়িত কণ্ঠ কানে ভেঁসে এল। ম্যাম, পরী অনেক অসুস্থ। তার সাথে এমন ব্যবহার করা ঠিক হয়নি।
বাসার বাহিরে এসে প্রতিজ্ঞা করলাম, এই জিবনে তুলির সাথে কোন সম্পর্ক রাখবোনা। যা হারার সব হারিয়ে ফেলেছি। কোন রিক্সা না নিয়ে রাস্তায় হাটতে লাগলাম। মাঝ পথে অঝড়ে বৃষ্টি এসে গেল। শুভ্রের নিষেধ ছিল, রাস্তায় বৃষ্টি হলে যেন কোন সেভ জায়গায় দাড়ায়। কারন ভিজা শরীরে রাস্তায় হাটা বা অন্যকে শরীর দেখানো শুভ্রের একদম পছন্দ না। যদিও আজ থেকে সব সম্পর্ক শেষ তবুও ওর পছন্দের দাম আমার কাছে সবার উপরে। তাই একটা রিক্সা নিয়ে বাসায় এলাম।
বাসায় ঢোকার সাথে সাথে বুকটা যেন ভারী হয়ে গেল। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হতে লাগলো। দ্রুত মায়ের সামনেই হিজাব আর বোরখা খুলে ছুড়ে ফেলে দিলাম। চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝড়েই চলছে। বুকে হাত দিয়ে ওখানেই বসে পড়লাম। চোখ আর মেলে রাখতে পারলাম না।

মিসেস স্বপ্না বেগম চোখের সামনে নিজের মেয়েকে ঢলে পড়তে দেখে অস্থির হয়ে চিৎকার দিয়ে সবাইকে ডাকতে লাগলো। বাসায় কোন ছেলে মানুষ নেই। আজ কাজের মেয়েটাও আসেনি। অবন্তীও ভারর্সিটিতে গেছে। ছেলেটা স্কুলে আর কামরুল হাসান অফিসে। মিসেস স্বপ্না পাগল প্রায় হয়ে ডাইনিং রুম থেকে দৌড়ে বের হয়ে বাসার দাড়োয়ানকে চিৎকার দিয়ে ডাকতে লাগলো। ভাই আমার মেয়েটা বলেই মিসেস স্বপ্নার কথা আটকে গেল। দাড়োয়ান কোন কিছু না ভেবেই ডাইনিং রুমে গিয়ে দেখল পরী নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে।
কামরুল সাহেবকে অনেক দিন পর কল দিয়েছে তার কাজিন নীলিমা। নাম্বারটা এখনো সেভ করে রেখেছে কামরুল সাহেব। নামটা উচ্চারন করতেই বুকের ভিতর না পাওয়ার এক বেদনায় বুকটা টনটন করে ওঠে। এক সময় তাদের গভীর প্রনয় ছিল। কিন্তু স্বপ্নার জন্য সেই প্রনয়ের বৈধতা আর হয়নি। বাধ্য হয়েই স্বপ্নাকে বিয়ে করতে হয় কামরুল সাহেবের। বাবার কথার উপর না বলা তার জন্য অত্যন্ত কঠিন ছিল। বাবা তার সব জেনেও স্বপ্নার সাথে বিয়ের পিড়িতে বসাতে বাধ্য করে। তার একটাই কথা, আত্বীয়র ভিতর আত্বীয়তা আর তিনি করবেন না। সেই কারনে আজ তারা বিচ্ছিন্ন। তিনি আজও স্বপ্নাকে ক্ষমা করতে পারেননি। হয়তোবা নয়-ছয় করে সংসার জিবনটা কাটিয়ে যাচ্ছে। সেদিন যদি স্বপ্না নিলজ্জর মত বাবাকে বিয়ের কথা না বলতো তাহলে আজ সে নীলিমার কাছে থাকতো। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে গম্ভীর মুখে কামরুল সাহেব বলে উঠলো-

~” কেমন আছিস নীলি!”
কত বছর পর প্রিয় মানুষটার কথা শুনে নীলিমা বেগম চুপ থাকে। তারপর কাঁপা কণ্ঠে বলে উঠলো-
~” ভালো আছি। আপনি ভাল আছেন?”
কামরুল সাহেব কথা বলার ফাঁকে সিগারেটটা ধরিয়ে ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল-
~” এইতো চলছে।”
হঠাৎ নীলিমা ফুফিয়ে কাঁদতে লাগলো। তারপর খানিকটা সময় নিয়ে নিজেকে সংযত করে বলে উঠলো-
~” মা মারা গেলেন। আপনিতো তাকে মাটিও দিতে এলেন না। তিনি কি আপনার ফুফু ছিলেন না! তিনি কি একদিনও আপনাকে কোলে নেননি!”
নীলিমার কথা শুনে কামরুল সাহেব চুপ করে রইলেন। এমন সময় স্বপ্নার কল আসলো ফোনে। কামরুল সাহেব বেশ বিরক্ত হলেন। কথা বলার ফাঁকেই স্বপ্নাকে মাসেজ করলেন, আমি বিজি আছি। তাই ডিসর্টাব করোনা। ফোনে আর কল আসলোনা। কামরুল সাহেব সস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন-
~” আমি ইচ্ছা করেই যাইনি। তাছাড়া পুরনো স্মৃতি আর মনে করতে চাইনা। যা হয়েছে সেখানে আমার বা তোর হাত নেই। এটাই হয়তো আমাদের কপালের লিখন ছিল। বাদ দে…..!”

সত্যিই আপনার করার কিছু ছিলোনা বলেই নীলিমা ডুকরে কেঁদে উঠলো। আপনি পারতেন না আমাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে! আপনি সেটা না করে মামার কথায় বিয়ের পিঁড়িতে বসে পড়লেন! আমি আপনাকে কোনদিনও ক্ষমা করবো না। আপনি জানেন! আজ আমার স্বামী আমাকে কতটা আঘাত করেছে? আপনাকে যদি আমার শরীরের সেই সব শাস্তির চিহ্ন দেখাতে পারতাম তাহলে বুঝতেন আমি কতটা কষ্টে আছি। আমাকে কেউ বোঝেনা আপনি ছাড়া। সেই আপনি আমাকে অন্যর হাতে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করছেন। আমি ভালো নেই।
নীলিমার কথা শুনে বেশ জোড়েই ধমক দিয়ে উঠলো কামরুল সাহেব। খানিকটা মুখ শক্ত করে রুষ্ঠ ভাষায় বলে উঠলেন-
~” নিশ্চয় তোর দোষ ছিল। তুই আমাকে এখনো ভুলতে পারিসনি তাই তোর স্বামীকে মানতে পারছিস না। আমার স্পষ্ট মনে আছে, একদিন তোর ভুলের জন্য আমি সবার সামনে তোর গায়ে হাত তুলেছিলাম। কৈ সেদিনতো কোন অভিযোগ করিসনি! বরং এসে আমার পা ধরে ক্ষমা চেয়েছিস। তাই আমাকে ভুলে সংসারে মনযোগ দে। আমি জানি তোর স্বামী অত্যাধিক একজন ভদ্র মানুষ। তোর অবহেলায় সে যদি কোনদিন তোর কাছ থেকে চলে যায় তখন বুঝবি তার মূল্য কত! এসব সব বাদ দিয়ে সংসার করে স্বাভাবিক জিবনে ফির। বাচ্চা হয়েছে তাদের সময় দে। আর আমাকে এভাবে ফোন দিসনা। কারন, আমারও সংসার আছে, সন্তান আছে। তাদের কাছে আমি কালার হতে চাইনা। আমি আমার অতীতকে মাটি চাপা দিয়েছি। তুই নিজেও মাটি চাপা দে।”

একশ্বাসে কথাগুলো বলেই কামরুল সাহেব ফোন কেটে দিলেন। শুধু কল কেটে দিয়েই ক্ষান্ত হলেন না। বরং নীলিমার নাম্বার ব্লক লিষ্টে রাখলেন। কামরুল সাহেবের মনটা প্রচন্ড খারাপ হয়ে গেল। হয়ত স্বপ্না আবার ফোন দিয়ে বলবে এতক্ষন কার সাথে কথা বলছিলে! এত উত্তর দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই শেষে ফোনটাই সুইচ অফ করে রাখলো। অফিস করতে ভাল লাগছেনা। অফিস থেকে বের হয়ে গাড়ীতে উঠে আজ নিজেই ড্রাইভ করে অজানা পথে রওনা দিলেন।

পরীর অবস্থা খুবই খারাপ। চোখের সামনে মেয়েটা মরতে বসেছে আর মিসেস স্বপ্না তার স্বামীকে বার বার কল দিয়েই চলছে। আগে তাও ওয়েটিং ছিল। এখন বন্ধ দেখাচ্ছে। কি করবে একা সে। শেষে শাশুড়িকে কল দিল স্বপ্না বেগম। একই শহরে বাসা হওয়াতে পরীর দাদী কুলসুম বেগম দ্রুতই প্রাইভেট হসপিটালে চলে এলেন। মহিলাটি বেশ চৌকশ ধরনের। অনেক পুরনো আমলের ম্যাট্রিক পাশ তিনি। শাশুড়িকে দেখে স্বপ্না একটু সাহস পেল মনে। শাশুড়িকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষন কাদলো সে। মা, আমার মেয়েটা কথা বলছেনা। ভালো মেয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেল। কিন্তু এভাবে কেন ফিরলো?
কুলসুম বেগম শক্ত হয়ে বললেন-
” কামরুলকে খবর দিছ! সে কই?”

শাশুড়ির মুখে স্বামীর নাম শুনে চটে গেল স্বপ্না। আমার মেয়ে যদি আজ মরেও যায় তবুও তাকে আমি আর কল দিবোনা। আমি তাকে এতবার কল দিয়েছি তবুও সে না রিসিভ করেছে না ব্যাক করেছে। আমি আপনার ছেলেকে ছাড়বোনা। আজ যদি পরীর কিছু হয়ে যায়। একদম খুন করে ফেলবো বলেই আবার ফিকরে কেঁদে উঠলো স্বপ্না।
একটা নার্স ছুটে এসে বলল-
~” ম্যাম, পেসেন্টের অবস্থা খুবই খারাপ। ওনাকে মনে হয় রাজশাহীতে শিফর্ট করতে হবে। উনি কাউকে খুঁজছেন।”
নার্সের কথা শুনে স্বপ্নার পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে গেল। আল্লাহ্ আমাকে এতবড় শাস্তি দিওনা। আমার মেয়েটাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিওনা। কুলসুম বেগম ধড়পর করে ওটিতে চলে গেলেন। পরীর বেডে যেন আছড়ে পড়লেন তিনি। দিদিভাই এমন করছিস কেন তুই?
পরী ছটপটিয়ে চলছে। বার বার অক্সিজেনের মাস্ক খুলতে চাচ্ছে। এক নার্স দ্রুত পরীর হাত চেপে ধরে বলল-
~” স্যার কি হবে এখন! পেসেন্টের অবস্থা তো খুবই খারাপ। তাকে কি এই অবস্থায় শিফর্ট করা ঠিক হবে?”
ডাক্তার সাহেব গম্ভীর মুখে বলল-

~” এই লোকগুলো বড় ঘরের মানুষ। কিছু হলে আমাদের ব্যবসা লাটে তুলবে। হার্ট সম্পন্ন ব্লক হয়ে গেছে। তাছাড়া শরীরে আরো প্রবলেম দেখা দিয়েছে। এই ছোট্ট শহরে ভালো চিকিৎসাও নেই। এমনি তারা দেরীতে এনেছে। ওকে এখুনি রাজশাহীতে শিফর্ট করার ব্যবস্থা করতে হবে। না হয় অন্য হসপিটালে।”
৩’জন ওয়ার্ড বয় এসে পরীকে স্ট্রেচারে নিতেই স্বপ্না জোড়ে ধমক দিয়ে বলল-
~” এই আমার মেয়েকে তোমরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছো? ওকে ছাড়ো বলছি।”
দুইটা নার্স এসে স্বপ্নাকে শক্ত করে ধরে আর কুলসুম বেগম পরীর সাথে আধা দৌড়ে চলে গেল। শেষে আম্বুলেন্সে তুলে অন্য হসপিটালে শিফট্ করলো। সেখানে নিয়ে গিয়ে পরীকে নিবিড় পর্যবেক্ষনে রাখা হল। অনেক চেষ্টার পর পরীর অবস্থার একটু উন্নতি হল।
এদিকে বেলা গড়িয়ে কখন যে রাত ১০টা বেজে গেল সেটা কারও খেয়ালেই এলোনা। স্বপ্না এক ঠাই হয়ে বসে আছে। শেষে খুব কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে শাশুড়ি আর দাড়োয়ান কে হসপিটালে রেখে বাসার পথে রওনা দিল।

কামরুল সাহেব কিছুক্ষন আগে বাসায় এসেছেন। গেটে দাড়োয়ান ছিলোনা। তাই অবন্তী আর কিরন গিয়ে গেট খুলে দিয়েছে। বাসায় ঢুকেই জিঙ্গাসা করলো-
~” তোমাদের মা কোথায়?”
জানিনা বাবা, দুপুর থেকে গেটে দাড়িয়ে ছিলাম। বাসায় কেউ ছিলোনা। শেষে পাশের বাসার রুমি আন্টি এসে চাবি দিয়ে বললেন, দাড়োয়ান কাকা ওনাকে চাবি দিয়েছেন আমাদের দেওয়ার জন্য। মাকে ফোনে ট্রাই করছি কিন্তু নাম্বার বন্ধ দেখাচ্ছে। আপনাকেও কল দিয়েছিলাম। আপনাকেও পাইনি।
এবার কামরুল সাহেব বেশ চিন্তায় পড়ে গেলেন। কারন স্বপ্না তাকে ফোন দিয়েছিল। অজানা ভয়ে নিজেই নিজেকে কাঠগড়ায় দাড় করালেন। কেন সে পরে কল দিলোনা। এসব কথা ভাবতেই স্বপ্না বাসায় চলে আসলো। কামরুল সাহেবকে দেখেই সে চটে গেল। ছেলে মেয়েদের সামনেই ব্লেজারের গলা খামচে ধরে চিৎকার করে বলে উঠলো,
~” সারাদিন কোথায় ছিলে তুমি? তোমার ফোন কোথায়? আমি তোমার ফোন দেখতে চাই।”
নিজ স্ত্রীর এমন ব্যবহারে খানিকটা অবাক না হয়ে পারলেননা তিনি। তার মধ্য ছেলে-মেয়ের সামনে এমন আচরন বেশ লজ্জায় ফেলে দিল তাকে। স্বপ্না….! ভাষা সংযত করো বলছি। লিমিট রেখে কথা বলো। কথাগুলো বলেই ছেলে-মেয়েদের দিকে কঠোর চোখে তাকালেন তিনি।
বাবার ওমন চাহোনি দেখে অবন্তী আর কিরন রুমের ভিতর চলে গেল। আর স্বপ্না কামরুলের ফোন পকেট থেকে বের করেই চেক করতে লাগলো। সে যখন কল দিয়েছিল তখন ওয়েটিং দেখিয়েছিল তাই সেই সময়ের আসা কলের নাম্বারটা কালেক্ট করেই নিজের ফোন থেকে কল দিল।
কয়েকবার রিং হতেই এক মহিলা রিসিভ করলো। স্বপ্নাও সাথে সাথে বলে উঠলো-

~” নীলিমা!”
~” ইয়েস! আপনি কে বলছেন?”
স্বপ্না দ্রুত কল কেটে দিয়ে স্বামীর দিকে চেয়েই দু’টো ফোনই গায়ের শক্তিতে আছাড় মারলো। তারপর আঙ্গুল উঁচু করে চিৎকার দিয়ে বলল-
~” মেয়ে মৃত্যুর সাথে লড়ছে আর তিনি পরকীয়ায় মেতে উঠেছেন!”
লাষ্টের কথা শুনার আগেই কামরুল সাহেব হনহন করে রুমের ভিতর ঢুকে পড়লো। তারপর ব্লেজারটা ছুড়ে মেরে টাইটা খুলে ঐ অবস্থায় বিছানায় সুয়ে পড়লো।
স্বপ্না দ্রুত রুমে এসে দেখলো কামরুল সাহেব শুয়ে পড়েছে। এতে স্বপ্না আরও রেগে গেল। সোজা কামরুল সাহেবকে এ্যাটাক করলো। পেটের উপর উঠে আচড়ে খামচে শার্টের বোতাম ছিড়ে একাকার করে বলল-
~” শুনেছি সুন্দর মানুষদের চরিত্র বেশিভাগ খারাপ হয়ে থাকে। তোমাকে দেখে আজ তা বিশ্বাস হল। কিসের এত তোমার দেমাগ! সুন্দর বলে? আমি তোমাকে ঘৃনা করি। তোমার ঐ সুন্দর চেহারাকে আমি প্রচন্ড ঘৃনা করি। তুমি একটা চিরিত্রহীন বাজে মানুষ। তোমার সাথে আমার সংসার করার আর ইচ্ছা নেই।”
কামরুল সাহেব স্বপ্নার করা আঘাত সব মুখ বুজে সহ্য করে নিচ্ছে। কারন আজ সে অপরাধী। তার ধবধবে ফর্সা বুকের অনেক জায়গায় স্বপ্নার নখের আচড় লেগে চিড়ে গেছে। কয়েক জায়গা থেকে রক্তও বের হচ্ছে। তবুও তিনি চুপ হয়েই রইলেন।
স্বপ্নার কাছে মনে হল কামরুল তাকে সত্যই ভালোবাসেনা। সে তাদের সন্তানদেরও ভালোবাসেনা। পরীর ভাবনায় ওর মাথায় আজেবাজে সব চিন্তা ঢুকে গেল। বুকের আচল খুলে কামরুলের উপর চড়াও হয়ে দ্রুত বলে উঠলো,

রক্তক্ষরণ অপেক্ষা পর্ব ২

~” আমার ভিতর কি এমন নেই যা ঐ নীলিমার ভিতর আছে! রুপ,গুন কোন জিনিসটা নেই আমার ভিতর হ্যা? তুমি কেন বার বার তার কাছে ছুটে যাও? কেন তার সাথে যোগাযোগ করো?”
এবার কামরুল হাসানের ধৈর্য্যর বাঁধ ভেঙ্গে গেল। স্বপ্নার হাত দু’টো শক্ত করে ধরে রাগী কণ্ঠে বলল,
~” যথেষ্ঠ বলেছ! আমি যেন এমন কথা ২য়বার না শুনি।”
~” কেন, শুনতে খারাপ লাগে! বার বার বলব আপনি একটা বাজে আর চিরিত্রহীনও বটে। আপনার সাথে ভালো মেয়ে কখনো সংসার করতে পারবেনা। যারা দেহ ব্যবসা করে, একমাত্র তারাই আপনার যোগ্য।”
স্বপ্নার কথা শুনে স্বপ্নার গালে ঠাশ্ করে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিল কামরুল সাহেব। ধৈর্য্য বলেও তো কিছু আছে নাকি! মেয়েটা বড্ড কথা বলছে। যা না তাই বকে যাচ্ছে। সবকিছু সহ্য সীমার বাহিরে চলে গিয়েছে।
স্বপ্না গালে হাত দিয়ে দ্রুত উঠে পড়তেই কামরুল ওর হাতটা চেঁপে ধরে নিজের বুকের ভিতর টেনে নিয়ে ছোট ছোট আলিঙ্গন করতে লাগলো। তারপর ফিসফিস গলায় বলল-
~” আমিতো জানি, আমি আমার স্ত্রী-সন্তানদের কতোটা ভালোবাসি।”
কথাগুলো বলে স্বপ্নার মাঝে তিনি ডুবে যেতে লাগলেন। কিন্তু স্বপ্না নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করেও কামরুলের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়াতে পারলেননা। কামরুল স্বপ্নার রাগ ভাঙ্গানোর জন্য আপ্রান চেষ্টা করতে লাগলো। এবার স্বপ্না শেষ আঘাতটা করেই ফেলল। সে কামরুলকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠে বলল-
~” পরীর অবস্থা খুব খারাপ। ও ICU তে আছে। আমি তোমাকে কতবার কল দিয়েছি তুমি সেটা জানো!”
কামরুল সাহেব যেন থমকে গেলেন কথাটি শুনে। স্বপ্নাকে ছেড়ে দিয়েই শুধু হসপিটালের নামটা শুনলেন। তারপর ঐ অবস্থায় ছুটে বের হয়ে গেলেন বাসা থেকে।

রাত দু’টো বাজে। মায়ের সাথে আজ দফায় দফায় কথা হয়েছে। মা যেন আজকে একটু বেশিই খোঁজ খবর নিচ্ছে। শুভ্র বলেই ফেলল,
~” মা, অনেক রাততো হল, এবার ঘুমিয়ে পড়েন। আমার কিছু এসাইমেন্ট তৈরি করে সাবমিট করতে হবে।”
মিসেস. শাকিলা আর কথা না বলে ফোনেই ছেলেকে কয়েকটা চুমা খেয়ে কল কেটে দিলেন।
শুভ্র যেন হাফ ছেড়ে বাচলো। এমনি অনেক রাত হয়েছে। পরী কি জেগে আছে! গতকাল কথা হয়েছে। অনেকটা স্বাভাবিক করে নিয়েছি ওকে। বরং আজ যদি ফোন না দেই তাহলে রানীটা আমার উপর রেগে যাবে। শুভ্র প্রথমে পরীর নাম্বারে ১হাজার টাকা লোড দিল। যাতে পরী অন্তত ওকে একটা কল দিতে পারে। কারন শুভ্রকে একটা মিসকল দিতে গেলেও পরীর ফোনের টাকা কাটবে। আজ ওর জন্য সারপ্রাইজ আছে। কথাগুলো মনে করতেই শরীরে সুখের স্রোত নেমে গেল। শুভ্র পরীকে কল দিল। কিন্তু রিসিভ হলোনা। এভাবে কয়েকবার কল দিল। পরীর কোন রেসপন্স নেই। সময় যতই গড়িয়ে চলছে শুভ্রের বুকের ভিতরের অপেক্ষার রক্তক্ষরণ যেন ততই বেড়ে চলছে।

রক্তক্ষরণ অপেক্ষা পর্ব ৪