রক্তক্ষরণ অপেক্ষা পর্ব ৪ || নাফিসা মুনতাহা পরী

রক্তক্ষরণ অপেক্ষা পর্ব ৪
নাফিসা মুনতাহা পরী

ইষৎ রক্তিম আভা পরীর মুখে যেন বিদ্যমান রয়েছে। নিজ মেয়েকে এক নজরে দেখে কামরুল সাহেবের বুকটা কেঁপে উঠলো। এটা সে কি দেখলো! চোখের নোনা জল তাকে জানান দিল সে বের হতে চলেছে। তাই কামরুল সাহেব নিজেকে সংযত করে তার মাকে আর দাড়োয়ানকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়ে পরীর পাশে টুল টেনে বসে পড়লো। মাথায় হাত ছুয়ে দিতেই পরী অচেতন অবস্থায় যেন কেঁপে উঠলো। কামরুল সাহেব দ্রুত হাতটা সরিয়ে নিয়ে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলেন। মেয়েটার এ হাল আর তিনি……! বাঁকিটা রাত তিনি মেয়ের পাশে বসেই কাটালেন।

সকাল ৯টায় পরী আলতো করে চোখ খুললো। বুঝার চেষ্টা করলো সে কোথায় আছে। এখনো কি সে বেঁচে আছে! কিন্তু ওর সামনে তুলিকে দেখে ও হচকিয়ে উঠলো।
তুলি! তুলি এখানে কি করে! ওরতো এখানে থাকার কথা নয়! তাহলে ও এখানে কেন?
এসব কথা ভাবতেই তুলি ফিকরে কেঁদে উঠলো। তুলি আমার হাত ধরে কেঁদেই চলছে আর পাশে বাবা কঠোর চোখে চেয়ে আছেন আমার দিকে। আল্লাহ্ তুলি শুভ্রর কথা বলে দেয়নিতো? ব্রেনের নার্ভগুলো মনে হয় ছুটাছুটি করছে মাথার ভিতর। তীব্র যন্ত্রনার মধ্যও আমি তুলির দিকে চেয়ে ইশারায় হাত জোড় করে বললাম-
~” আর যাই হোক, তুই যেন শুভ্রর নাম নেসনা বোন। তাহলে বাবা তাদের অবস্থা কি করবেন জানিনা। কিন্তু আমাকে আর কোনদিন ২য়বার সুযোগ দিবেন না। আমার পড়ালেখা বন্ধ করে দিবেন।”
তুলি হয়ত বুঝেছে আমি কি বলতে চাইছি তাই ও আর বেশিক্ষণ থাকলোনা। মিনিট সাতেকের মধ্যে চলে গেল সে। কিন্তু বাবাকে দেখে আমার বুকের হৃদপিন্ডটা আর থেমে রইলোনা। খারাপ কিছু হতে চলছে।
হঠাৎ বাবা কাকে যেন কল দিয়েই বাহিরে চলে গেলেন। তারপর একটা নার্স এসে সব কিছু গুছিয়ে দিয়ে বলল-

~” আপনাকে রিলিজ দেওয়া হয়েছে। এখন আপনাকে বাসায় নিয়ে যাওয়া হবে।”
অবশেষে বাবার সাথে বাসায় চলে এলাম। রাস্তায় তিনি একটা কথাও বললেন না। বাসায় এসে আমার সাথে তেমন কেউই কথা বললোনা। ব্যাপার কি! কিছুই বুঝতে পারছিনা। রুমের দরজায় দাড়াতেই আপুকে দেখলাম আমার রুমে। আমি কিছু ননা বলে রুমে এসে বসতেই মা এসে আমার চুলগুলো ভাল করে বেঁধে দিয়ে বলল-
~” আজ বিকালে তোকে কয়েকজন দেখতে আসছে। যদি পছন্দ হয় তবে বিয়ের কথা পাকা করা হবে।”
বিয়ে! কার বিয়ে বলে চেচিয়ে উঠলাম আমি। তোমরা মানুষ! একটা মেয়ে কেবলই হসপিটাল থেকে ছাড়া পেয়েছে আর তাকে বিয়ের কথা শুনাও! আমি কি বনের পশুদের সাথে বসবাস করছি!
পরীর কথাগুলো শুনে অবন্তী রেগে গিয়ে একদম পরীর গলা চিপে ধরে বলল-
~” শুভ্র ছেলেটার সাথে তুই আবার যোগাযোগ করেছিস কেন! তোর এই হাল কেন হয়েছে সেটা বুঝি আমরা জানিনা! তুলির মা ফোন করে সব বলেছে। বাবা যে তোকে এখনো কেটে নদীতে ভাসিয়ে দেয়নি সেটা তোর সৌভাগ্য। নেহাত তুই অসুস্থ বলে তোকে হয়ত কিছু বলছেননা। তাই যা বলছে তাই করে অন্তত সম্মানটা আমাদের বাঁচা।”
আপুর কথা শুনে মাথা আমার পুরোই বিগড়ে গেল। ধর্য্যর বাধ যেন ভেঙ্গে গেল। গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিয়ে বললাম-

আরও গল্প পরতে ভিজিট করুন

~” আগে নিজের চরকায় তেল দাও তারপর আমার পিছে লাগবা। তোমার ঢোল কি ভরা বাজারে বাজাতে হবে নাকি! আর তোমরা কেমন মানুষ যে বড় মেয়েকে ছেড়ে আমাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছ?”
পরীর কথা শুনে অবন্তী পরীর কাছ থেকে দুরে গেল। তারপর কিছু না বলে রুম থেকে বের হয়ে গেল। কিন্তু স্বপ্না কথা বলতে কোন রকম ক্রুটি করলোনা। বরং তিনি কঠোর শাসনে মেয়েকে বুঝিয়ে দিলেন, কোন চেঁচামেচিতে কাজ হবেনা! এই বাসার ভাত তার জন্য উঠতে শুরু করে দিয়েছে।
রুম থেকে সবাই বের হয়ে গেলে আমি প্রথমে আমার কলেজ ব্যাগটা খুঁজতে লাগলাম। শুভ্র হয়ত অনেকবার কল দিয়েছে ইতিমধ্যে। পাগলের মত তন্ন তন্ন করে পুরো রুম খুজতে লাগলাম। শেষে রুম থেকে উকি দিতেই দেখলাম ডাইনিং রুমে সোফার এক কোনায় ব্যাগ পড়ে আছে। আমি দ্রুত ব্যাগটা হাতে নিতেই মা এসে বলল-
~” বাসায় ঢুকতে না ঢুকতেই ব্যাগ নিয়ে পড়তে হবে! যা ফ্রেশ হয়ে নে। আমি নাস্তা দিচ্ছি।”
আমি কিছু না বলে দ্রুত পায়ে রুমে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিয়ে পাগলের মত হানতান হয়ে ফোনটা খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু কোথাও আমার ফোনটা খুঁজে পেলামনা। আমার ফোন বলেই নিজের চুল খামচি দিয়ে ধরে ফ্লোরে বসে পড়লাম। ওরা আমার ফোনটা সরিয়ে ফেলেছে।
চারদিকে নিচ্ছিদ্র নিঃস্তব্ধতাকে ছিড়ে খানখান করে কথাগুলো মুখ থেকে আমার বের হয়ে আসলো। বুকের মধ্য অদৃশ্য রক্তক্ষরনের দাপট যেন বেড়েই গেল। গায়ের শক্তি দিয়ে ব্যাগটা ফ্লোরে ছুড়ে মেরে ওখানেই মুখ দু’হাতে চেপে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। না পারি শুভ্রকে ছাড়া থাকতে, না পারি ওর সাথে নিজেকে জড়াতে।

এমন সময় দরজায় বার বার ধাক্কা পড়াতে দ্রুত চোখ মোছার চেষ্টা করলাম। কিন্তু যতই চোখ মুছি ততই চোখ দিয়ে ঝড়ঝড় করে পানি পড়ে যেতে লাগলো। অবশেষে দ্রুত দরজা খুলে দিয়েই ওয়াসরুমে দৌড়ে চলে গেলাম। শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে কাঁদতে লাগলাম। কাউকে না জানিয়ে লুকিয়ে কান্না করাটা মনে হয় সব থেকে কষ্টকর। ১৫ মিনিট ভিজে ঐ অবস্থায় বের হয়ে দেখি দাদী আর মা বসে আছে। আমি দ্রুত টাওয়াল হাতে নিতেই মা ধমক দিয়ে বললেন-
~” এই তুই কোন সাহসে এই অবস্থায় গোসল করেছিস? শরীরের তো একটা রেষ্ট আছে নাকি!”
মায়ের কথার তোয়াক্কা না করে একেবারে দাদীর দু’পা চেঁপে ধরে কাঁদতে লাগলাম। দাদী আমি বিয়ে করতে চাইনা। যদি তোমরা আমাকে জোড় করে বিয়ে দিতে চাও তাহলে সুইসাইড করা ছাড়া আমার উপায় থাকবেনা।
পরীর এমন কথা শুনে স্বপ্না বেগম ক্ষেপে গিয়ে চুলের গোছা ধরেই পরীকে টেনে তুলে বলল-
~” কি বললি! আর একবার বল? এই কথা শোনার জন্য কাল তোর বাবার সাথে অত ঝগড়া করলাম? তোর স্পর্দ্ধা দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি।”

কুলসুম বেগম জোড়ে একটা ধমক দিয়ে পরীকে স্বপ্নার কাছ থেকে টেনে এনে কঠোর স্বরে বলল-
~” এতবড় মেয়ের গায়ে তুমি হাত তোল কোন সাহসে? তাও আবার আমার সামনে! তোমার বাবা-মা এই শিক্ষা তোমায় দিয়েছে?”
মা… বলতেই কুলসুম বেগম জোড়ে চিৎকার দিয়ে বলল-
~” এক্ষুনি আমার চোখের সামনে থেকে চলে যাও।”
স্বপ্না চলে গেলে পরী ফ্লোরে বসে পড়ে কাঁদতে লাগলো। মা বাবাকে এসব কথা বলে দিলে, বাবা আমার অবস্থা না জানি কি করে! যা রাগী উনি? আল্লাহ্ রক্ষা করো এই বিপদ হতে।
দাদী আর কতদিনই বা এই বাসায় থাকবে! তিনি তো দু’দিন পর চলেই যাবেন। তারপর! তারপর কি হবে?

প্রাকৃতির বিচিত্র শব্দে শরীরের মন অবশ হয়ে আসছে। বাইরে জমা জলের ভিতর থেকে ভেসে আসে ছপছপ, সড়সড় শব্দ। ঝিঁঝি পোকার ডাক, সাপে ব্যাঙ ধরার হাড় হিম করা আওয়াজ, আর রুমের ভিতর আগুনের শিখায় দেওয়ালের গায়ে চেনা জিনিসের কম্পমান অচেনা ছায়া। হঠাৎ করে মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে চোখ মেলে চাইতেই সেসব ছায়া আর শব্দে বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল। পরী খুব খারাপ স্বপ্ন দেখছিল এতক্ষন ধরে। কিন্তু সময় যেন ওর জন্য আরো কঠোর হয়ে উঠলো। বড়বড় শ্বাস ফেলছে পরী। কারন ওর চোখের সামনে খুব ভয়ানক ঘটনা ঘটে চলছে। দুইটা বিশাল বিশাল কালো সাপ নিজেদের সাথে গা ঘেঁষাঘেঁষি করেই চলছে। ভয়ানক নিঃস্তব্ধতার কারনে পরীর নিঃশ্বাসের শব্দ যেন সাপদের কানের দোড় গোড়ায় আঘাত করলো। কিন্তু সাপেরা তো শুনতে পায়না। তারপরও সাপদুটি হচকিয়ে উঠে পরীর দিকে তাকিয়েই স্থির চোখে ফোনা তুলে দাড়িয়ে রইল।
পরীর নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম এবার। কারন যেটা ও দেখতে পেল সেটা প্রায় অসম্ভব একটি ঘটনা। একটা মাঝারি ব্যাঙ এসে সেই দু’টো সাপকে একসাথে গিলে ফেলতে লাগলো। আজ শিকারই যেন শিকারীকে চাবিয়ে খাচ্ছে।

লোকে মুখে শোনা যায়, যেই জায়গায় যদি এমন দৃশ্য কখনো ভুলেও দেখা যায় যে, ব্যাঙ সাপকে ভক্ষন করছে তাহলে সেখানে বা তার আশেপাশে বহু ধনসম্পদ লুকায়িত থাকে। কিন্তু সেদিকে ভাবার মত সময় এখন হাতে নেই। কারন ইতিমধ্য পরীর চোখের রং পরিবর্তন হয়ে গেছে। চোখে খুব আবছা নীল রঙ্গের আবর্তন ঘটেছে। পরীর পাশে আজ অবন্তী ঘুমিয়েছিল। অবন্তী সাধারনত ভয়ে পরীর কাছে ঘুমায়না কিন্তু আজ মায়ের হুকুমে শুয়েছে। তারপাশে ওর দাদীও ঘুমিয়ে আছে।
জানালাটা হালকা খোলা রয়েছে। এমন সময় ডানা ঝাপটানোর শব্দে পরী জানালার দিকে তাকায়।বাগানের কাপড় শোকানোর দড়িতে বসে দোল খাচ্ছে কালো আর অনেক বড় বড় ৫টি পেঁচা। মুহুত্বেই রাগের ছটা চলে আসে পরীর চোখে-মুখে। বড় বোনের উপর যেন ঝাপিয়ে পড়ে।
অবন্তী চোখ খুলে আৎকে ওঠে। পরীর চেহারাটা স্বাভাবিক আর দেখাচ্ছেনা। পরী অবন্তীর গলা চেঁপে ধরে গড়গড় করে বলে উঠলো-
~” আমাকে বিয়ে দিবি! তোকে আজ ফ্লাস্কেটের শাওয়ারে গোসল করিয়ে ছাড়বো। তারপর একটু গরম গরম ছ্যাকা দিব। দেখি কতক্ষন সহ্য করতে পারিস!”

অবন্তীর চিৎকারে কুলসুম বেগম লাফ দিয়ে উঠে পরীকে ঐ অবস্থায় দেখে জোড়ে জোড়ে নিজের ছেলেকে ডাকতে লাগলো। তারপর পরীকে অবন্তীর উপর থেকে সরানোর চেষ্টা করতেই পরী তাকে জোড়ে ধাক্কা দিল। কুলসুম বেগম ছিটকে পড়ে যেতেই কামরুল সাহেব এসে মাকে ধরেই পরী দিকে চেয়ে তার চোখ যেন কপাল ফেড়ে আকাশে উঠে গেল। অবন্তীর অবস্থা তখন প্রায় শেষ।
কামরুল সাহেব পরীকে জোড়ে একটা হ্যাচকা টান মেরে অবন্তীর কাছ থেকে ছেড়ে এনেই নিজের বুকের সাথে মেয়েকে চেঁপে ধরে হাত দুটো পিছন দিক থেকে জোড়ে শক্ত করে ধরেই অস্থির স্বরে বলে উঠলেন-
~” মা, তুমি এমন করছো কেন! শান্ত হও মা। কি হয়েছে তোমার?”
পরী ছটপড়িয়েও নিজেকে ছাড়াতে না পেরে শেষে বাবাকেই গায়ের শক্তি দিয়ে ট্রীশার্টের উপর দিয়ে কামড় বসিয়ে দিল। সাথে সাথে কামরুল সাহেব পরীর হাত ছেড়ে দিল। পরী ওর বাবাকে জোড়ে ধাক্কা দিয়েই ওখানে সেন্সলেস হয়ে পড়ে যায়।

ঘটনাগুলো এতদ্রুত ঘটলো যে বাসার কেউই স্বাভাবিক অবস্থায় থাকতে পারলোনা। কুলসুম বেগম অনেক কষ্টে উঠে গম্ভীর গলায় ছেলেকে প্রশ্ন করলেন, কবে থেকে এমন সমস্যা হচ্ছে।
কামরুল সাহেব নিজের বুকের দিকে চেয়ে দেখলেন, সাদা ট্রীশার্ট রক্তে ভিজে গেছে। সেখানে চিনচিনে ব্যাথা করছে। উনি আর নিজের কথা না ভেবে মেয়েকে ফ্লোর থেকে তুলে খাটে সুয়ে দিতেই অবন্তী ভয়ে লাফ দিয়ে উঠলো খাট থেকে। বাবার পাশে দাড়িয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগলো। সে মনে হয়না পরীর সাথে এই জিবনেও কোনদিনও লাগতে যাবে বা ওর সাথে ঘুমাবে।
পরীর আর জ্ঞান ফিরলোনা। অনেক চেষ্টা করে কামরুল সাহেব ব্যার্থ হলেন। এখন কাকে ডাকবে এই রাতে। পরীর শরীরে হুহু করে জ্বর চলে আসলো। ক্রমেই শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে গেল। কুলসুম বেগম সব শুনে কাকে যেন কল দিল। তারপর বলল-
~” ওর এত সমস্যা আর তোরা হাত-পা গুটিয়ে বসে আছিস? এতদিন না আমাকে বলেছিস, না এর কোন ব্যবস্থা নিয়েছিস!”

~” এক বছর আগে এমন সমস্যা হয়েছিল। তারপর ভালয় ছিল। হঠাৎ আবার কেন এমন হচ্ছে কিছু বুঝতে পারছিনা। হুযুর তো বলেছিল আর কোন সমস্যা হবেনা।”
রাখ তোর হুযুরের কথা। হুযুর যেগুলো কাগজ দিয়েছিল সেগুলো কি ঠিক জায়গায় আছে! ভাল করে দেখ কিছুই নেই। সব কিছু নষ্ট হয়ে গেছে বলতেই স্বপ্না দ্রুত সবকিছু চেক করে দেখলো, ঐ দোয়ার কাগজগুলো সেখানে নেই। একটা না হয় পাওয়া যাবেনা! তাই বলে একসাথে সব গায়েব হয়ে যাবে? মেয়ের বিয়ের কথা উঠালেই মেয়ের এমন পাগলামো উঠে যায়। তাই বিকেলে ছেলে পক্ষকে আসতে নিষেধ করা হয়েছিল। কিন্তু এখন যা পরিস্থিতি তাতে বিয়ের কথা তোলা একদম উচিত হবেনা।
একটা লোক পরীকে পরীক্ষা করছেন। ভোরের আলো ফুটতেই সে চলে এসেছে। কুলসুম বেগম জরুরি তলব করেছেন তাকে।
বয়স ষাট পেরোলেও কলপ করা চুল, শৌখিন লুঙ্গি-পাঞ্জাবি, ঠোটের পাশে জর্দাপানের কষ লাগা হাসি আর ঘোলাটে স্থির দৃষ্টি লোকটির।
পরীকে পরীক্ষা করে বলল-

~” তেনারা মেয়েটির আসেপাশেই রয়েছে। যার জন্য মেয়েটির সেন্স ফিরছেনা। এখন তার সেন্স যদি ফেরাই তাহলে সে উন্মাদ হয়ে যাবে। যাকে ইচ্ছা তাই বলবে।”
যা হয় হোক, আপনি আমার নাতনীকে স্বাভাবিক করেন মজিবর ভাই। হুম বলে মজিবর কবিরাজ চোখ বন্ধ করলেন। এই মজিবর কবিরাজের অপ্রাকৃতিক ক্ষমতার সাথে বেশ সম্পর্ক রয়েছে। জিবনে তার কাছে কেউ গিয়ে খালি হাতে ফিরে আসেনি। তবে তিনি প্রচন্ড টাকার লোভী। মন ভরে টাকা পেলেই কাজ করেন। সে আর কি করবে! তার ৩টা বউ। তাদের সংসার টানতেই টাকার প্রতি লোভী না হলে যে চলেনা।
কবিরাজ একটা জায়নামায, একমুঠো চাল, তিনটা আগরবাতি, একটা অদ্ভুদ ধরনের বিশাল তসবিহ আর লাল হাজি রুমাল বের করলো তার ব্যাগ থেকে। তারপর ভালো করে পবিত্র হয়ে এসে জায়নামাযে বসে পুরো মুখটা লাল বড় কাপড়ের টুকরা দিয়ে ঢেকে রেখে তসবিহ্ তেলায়াত করতে করতে সেজদাহর মত করে পড়ে গেলেন। তারপর জোড়ে জোড়ে অদ্ভুদ শব্দ করতেই কবিরাজের সহযোগী বলল-

~” বড় হুযুর এসেছেন। আপনাদের যা বলার তা জলদি বলেন। কারন আজ জুম্মার দিন। তিনি বগুড়ার মহাস্তানগড়ের সেই বিখ্যাত মাজারের খাদেম সহ জ্বীনদের ঈমাম। তিনি আযান দেওয়ার আগেই চলে যাবেন। কারন তিনি জ্বীনদের ঈমামতি করবেন।”
কুলসুম বেগম কিছু বলার আগেই কবিরাজের মুখ দিয়ে জ্বীনটি তাকে সালাম দিয়ে হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডসেক করলো। তারপর বলল-
~” এবার বলেন আপনার কি সমস্যা!”
কুলসুম বেগম পরীকে হাত দিয়ে ইশারা করে দেখিয়ে দিতেই কবিরাজ হাত ইশারা করে চুপ করতে বলল। তিনি পরীর শরীরে তাসবিহ্ ছোয়াতেই পরী চোখ খুলল ঝট করে। যেটা দেখে কামরুল সাহেব অবদি ভয় পেয়ে গেলেন। পরী সোজা উঠে বসে মাথা নিচু করে রইলো। কিন্তু মুখ দিয়ে কিছু বের করলোনা। কবিরাজ রুপী জ্বীনটি বলল-
~” কিরে এই মেয়ের শরীর থেকে তোরা যাবি, না আমাকে অন্য ব্যবস্থা করতে হবে! আমার এত সময় নাই জলদি মেয়েকে মুক্তি দে। না হলে তোদের বোতলে তুলে সারা জিবনের জন্য বন্দী করে রাখবো।”
পরী কবিরাজের দিকে চেয়ে তাচ্ছিল্য সহকারে হেঁসে বলল-

~” তুই কেমন ঈমাম সেটা আমাদের জানা আছে। নচ্ছার মৌলবী তুই। কুফুরি আর কোরআন দুটাই ব্যবহার করিস। তুই যদি এতই পবিত্র হতিস তাহলে ঐ মহিলার সাথে হাতে হাত মিলাইতিসনা। পরনারীর গায়ে হাত দিয়ে আবার আমাদের ভয় দেখাস? এ শরীর থেকে আমাদের নামিয়ে দেখা।”
কবিরাজ এবার রেগে গেল। সে একটা খাতা আর লাল কালির কলম বের করে দুটি বিকৃত মানুষের ছবি আকিয়ে অনেকটা আরবি ভাষায় কিছু একটা লিখতে লাগলো। লেখাগুলো আরবি মনে হলেও সেগুলো আরবি অক্ষর ছিলোনা। তারপর তিনটা তাবিজের খোল বের করে কাগজ গুলো ভরে তাতে বড়শির সুচালো ৩টা আগা, সেলাই করা সুচের তিনটা ভাঙ্গা অংশ, সরিষার দানা দিয়ে ভরলেন। বাঁকি আর দুটা কাজ। পরীর রক্ত এর ভিতর দিয়ে মোম দিয়ে বন্ধ করে দিবে তাবিজের খোল। তিনি কেবল পরীর পা ধরে লম্বা একটা সুচ বের করে পরীর বৃদ্ধা আঙ্গুলে ফুটে দিবেন এমন সময় পরী গায়ের শক্তি দিয়ে কবিরাজকে এত জোড়ে একটা ওনার বুক বরাবর লাথি বসিয়ে দেন যে ওমন একটা হোমড়া-চোমড়া লোকটাও দেয়ালের সাথে ধাক্কা খেয়ে গড়াগড়ি খেতে লাগলেন। পরীর মুখে শুধু বিশ্রী হাসি সহ একটা কথায় ভেসে উঠলো-
~” কিরে এক লাথিতেই কুপকাত হয়ে গেলি! এখনোও তো আমাদের রুপ তোকে দেখাইনি। আয় এবার! একেবারে তোর বংশ নির্বংশ করে ছাড়বো। এতদিন দুর্বলদের সাথে তোর খেলা চলতো। এবার আমদের সাথে তোর খেলা চলবে। দেখি কতক্ষন সহ্য করতে পারিস!”

রক্তক্ষরণ অপেক্ষা পর্ব ৪

(সত্যকাহিনী)
বিদ্রঃ আমার দাদা মসাই মসজিদের ঈমাম সহ
প্যারানরমাল জনিত চিকিৎসা করতেন। একবার নাকি উনি নিজের বাসা বন্ধ না করে আমাদের পাশের বাসার একটা ছেলেকে অশরী থেকে বাঁচিয়েছিলেন তার কারনে তিনি বাসায় ফিরে আসার আগেই আমার চাচা মারা যান পানিতে ডুবে।
আমার নানা মসাইও অত্যাধিক একজন আলেম মানুষ ছিলেন। কিন্তু ওনার একটা বদ অভ্যাস ছিল, উনি চোখের সামনে কোন সাপকে দেখলেই সেটা মেরে ফেলতেন। জিবনে এত সাপ মেরেছেন যে তার হিসাব তিনি দিতে পারবেননা। পানিতে কোন সাপ থাকলেও তিনি প্রয়োজনে পানিতে নেমে ঐ সাপকে মেরেছেন। সাপ মারা নাকি তার নেশার মত কাজ করতো। কারো বাসায় সাপ দেখা গেলে তাকে ডেকে নিয়ে যেত।
এর মূল্য আমার ছোট্ট মামাকে তার জিবন দিয়ে দিতে হয়। ক্লাস থ্রীতে পড়ুয়া আমার ৮ বছর বয়সী মামা সাপে কেটে মারা যান। যদিও তার শরীরে বিষাক্ত সাপের দুই দাতের চিহ্ন ছিলোনা। কি যেন একটা কামড় দেয় আর সেই ক্ষতের আসেপাশে অনেক দাঁতের চিহ্ন ছিল।
মামা মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে নানা মসাই একটা সাপকে মারেন আর সেদিন থেকেই শুরু হয় বিপদ। রাতে রুমের দরজা খুললেই দেখতেন কিছু একটা সড়সড় করে নেমে যাচ্ছে পাগাড়ের ধারে। মামা যেদিন মারা যায় সেই রাতেই নানা স্বপ্ন দেখেন, কতগুলো লোক এসে তাকে বলে একটা জানাজা পড়াতে হবে। তিনি ধড়পর করে ঘুম থেকে উঠেই ওযু করে তাহাজ্জুদের নামায পড়ে ডানদিকে সালাম ফিরাতেই এমন সময় মামাকে কিছু একটা কামড় দেয় আর নানী চিৎকার দিয়ে বলে ওঠেন তোকে কি কামড়িয়েছে বাবা!

নানাভাই বাম দিকে সালাম ফিরেই ততক্ষনাৎ শুধু একটাই কথা বলেছিলেন, স্বপ্নে যা দেখলাম তাই হল! এত জলদি হুকুম হলো! কথাগুলো বলে তিনি ঐ অবস্থায় ডুকরে কেঁদে ওঠেন। সেদিন মামা চলে যায় সারা জিবনের জন্য। সময়টা রমযান মাস ছিল। আমার আম্মু আজও ছোট্ট ভাইটার জন্য আমাদের সামনে কান্নাকাটি করেন। আমি যখন ছোট বেলায় মামার শার্ট গায়ে দিয়ে একবার ঘুরেছিলাম সেদিন পাশের বাসার এক মহিলা ডুকরে কেদে উঠছিল আমার গায়ে মামার শার্ট দেখে। তিনি নাকি মামাকে খুব ভালোবাসতেন। বাধ্য হয়ে শার্টটা খুলে নেয় আমার আম্মু। আমার জন্মের ৯মাস আগে আমার নানাভাই মারা যান। সেটাও রহস্য ছিল।

আমার আম্মুর কাজিন আছে, যার পরপর তিনটা স্বামী মারা গেছেন প্যারানরমাল জনিত কারনে। উনি প্রচন্ড সুন্দরী মহিলা ছিলেন। ১ম স্বামী মারা যান বিয়ের ৪/৫ দিনের মধ্য। ২য় বার বিয়ে হলে অষ্টমঙ্গলাতে তার ২য় স্বামী মারা যান। কারন ছিল অবাক করার মত। তখন নতুন 7up নেমেছিল। যা পান করার সাথে সাথে মারা যান তিনি। অন্যরাও পান করেছিল কিন্তু তাদের কিছুই হয়নি। সেটাও স্বাভাবিকই সবাই মনে হয়। কিন্তু যখন তার ৩য় স্বামী ৬ মাসের মধ্য মারা যায় তখন সেটা আর স্বাভাবিক থাকেনা। ওনার স্বামী এশারের নামায শেষে বাসায় ফিরার পথে এক বিশাল সাপ তার একপা পেচিয়ে ধরে। সাপের ওজন এতই ছিল যে উনি নাকি পা তুলতেই পারেননি। সেই সাপের কামড়ে তার মৃত্যু হয়। ঘটনাটি ২০০৪ সালের ঘটনা। আমি তখন ছোট ছিলাম। তাকে আর বিয়ে দেওয়া হয়নি।
এই কাহিনীগুলো সব সত্য ঘটনা। যা আমার পরিবারের সাথে ঘটেছে। আর একটা কথা, আমার নানা মসাইয়ের মৃত্যুও স্বাভাবিক ছিলোনা। ওনাকে কারা জানি মেরে ফেলে অনেক দুরে গলায় দড়ি বেঁধে রেখে দেয়। আমার নানার মত সাপ মারার হাত পেয়েছে আমার একটা মামাতো বোন আর আমার আম্মু। তাদের সামনে সাপ আর যাই থাকুকনা কেন, একটা বারিই যথেষ্ট।

৪/৫ মাস আগে আমার সাথে একটা ঘটনা ঘটে। আমাদের গ্রামের বাসায় বাথরুম রুমের সাথে এট্রাষ্ট না। রুম থেকে বের হয়ে যেতে হয়। আমি যখনই গোসল করতে বা অন্য কাজে বাহিরে যাই তখনই আমার মনে হয় আমার আসেপাশে কোন সাপ জাতীয় কিছু আছে। একদিন দুপুরে বাথরুমে গিয়েই দরজার দিকে তাকিয়ে দেখি আমার পায়ের নিচে সাপ ছিল। যা পেরিয়ে আমি বাথরুমে ঢুকেছি। সাপ দেখে আমি প্রচন্ড ভয় পেয়ে যাই। সাপটা চুপ করে আমার দিকে চেয়ে ছিল। তারপর সে যখন অন্যদিকে চলে গেল আমি দ্রুত আমার আম্মুকে ডাকি। সবাই বের হয়ে দেখলো সাপ আর নেই। কিন্তু আমার আম্মুও নাকি একদিন দেখেছিল কিছু একটা সড়সড় করে চলে যেতে। তাই উনি আসেপাশে চেক করতে লাগলেন। আমিতো ভয়ে রুমের ভিতর দৌড়। পুরো শরীর আমার কেঁপেই চলছে। আম্মু একটু এদিক ওদিক খোচাতেই সাপ দ্রুত বের হয়ে আসলো। সাপটি নাকি এতদ্রুত দৌড়াইছিল যে সাধারন মানুষ সেখান থেকে দৌড়ে পালিয়ে যাবে। ঐ যে বলেনা বংশের হাত! কয়েকটা বারিই যথেষ্ট ছিল সাপটি মরার জন্য। আমার আম্মু আর মামাতো বোনটা সাপ মারতে ওস্তাদ।
আমি নানু বাসায় ছিলাম। তখন ৬/৭ বছর বয়স। মাটির বাড়ী। ভর সন্ধ্যা। সেই সময় ধান মাড়াইয়ের কাজ চলছিল। প্রচন্ড গরমের দিন।

কারেন্টের আলোয় ব্যাঙের ছোট ছোট বাচ্চারা এদিক ওদিক দৌড়াদৌড়ি করছে। আর দেয়ালের ফাটল থেকে সাপের ছোট বাচ্চাগুলো বের হয়েই ব্যাঙগুলোকে ধরছিল। আমি হঠাৎই একটা ব্যাঙ এর ঠাং ধরে টান দেই। সাথে সাথে প্রায় একবিগ সাপের মাথা সহ শরীর বের হয়ে আসে ফাটল থেকে। সাপটি ব্যাঙটির ঠাং কামড়ে ধরেছিল। মামাতো বোনগুলো দেখে ফেলায় আমার আম্মুকে বলে দেয়। যার ফলাফল কেলানি খাওয়া। সেদিন আমার নাকমুখ ফাটিয়ে দিয়েছিল আম্মু। আর বলেছিলেন, বল এমন কাজ আর করবি! ওরা আহার করছে আর তুই তাদের আহার কেড়ে নিস! তোর সাহস কি করে হল সাপের মুখ থেকে ব্যাঙ কেড়ে নেওয়া। এখুনি কি হয়ে যেত! ব্যস ঐ এক উত্তম-মাধ্যমই আমার জন্য যথেষ্ঠ ছিল। ভুলেও কোনদিন ওমন কাজের মূখ্য দর্শনও করিনি।
২০১২ সালে নানুর বাসায় গোসল করে কাপড় নেড়ে দিতেই দেখি বিশাল একটা সাপ খড়ের গাদা থেকে আমার দিকে সড়সড় করে আসছিল। যেটা দেখে আমি দৌড়ে বাসায় গিয়ে বলতেই আমার মামাতো বোনটা এসে এদিক ওদিক চেক করেই সাপটাকে দেখে মেরে ফেলে। পাকা হাত যাকে বলে। যথেষ্ট সাহসী আমার ঐ কাজিনটা। একটা ছেলেরও এত সাহস থাকেনা। মাঝ রাতে শুধু একটা টর্চ নিয়ে তালগাছ তলায় যায় তাল কুড়াইতে। ভাবেন তাহলে সে কি জিনিয়াস। ভুতেরও অবশ্যই ধাড়ানি খেয়েছে সে! মামা না থাকলে হয়ত এতদিনে কবরের বাসিন্দা হয়ে যেত।

২০০৫/৬ সালের ঘটনা। তখন বাসায় নতুন সিডি এনেছে। রোযার ঈদের আগের দিন। সবাই হাতে মেহেদি দিয়ে গান শুনছিল। শ্রী দেবির বিখ্যাত গান “মে তেরা দুশমন ” বিনের মিউজিক সহকারে চলছে। আমার খালাতো বোন কাকলি রুম থেকে বের হতেই দেখলো জানালার শিখ পেঁচিয়ে ধরে একটা বিশাল গোমা সাপ( পদ্ম গোখরা) যাকে বলে। ফোনা তুলে মিউজিক শুনছে। যদিও সাপ শুনতে পায়না কিন্তু এই বিনের সাথে তাদের কিছুতো একটা সম্পর্ক আছে যা সেদিন আমরা দেখেছিলাম। আমার মামা ভয়ে দু’হাত পিছনে চলে যায়। কিন্তু আমার কিশোরী মামাতো বোন প্রথমে সাপের চোখে লাইট ধরতেই সাপ স্থির হয়ে যায়। আর সে একহাতেই সাপের মাথা বরাবর বারি বসাই। এতেই সাপের কোমর ভেঙ্গে যায়। তারপর সাপকে ধীরে সুস্থে মারে। আমার নানার বংশে এই দুই মেয়েই নানাজানের হাত পেয়েছে। আম্মু আর সে।

ঘটনাগুলো একদম সত্য। এতে কোন মিথ্যা কথা যুক্ত নেই। আজ গল্পে পরীর সাথে যেগুলো ঘটনা ঘটেছে সেটাও বাস্তবতার ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। এমন অনেক ঘটনার সাক্ষী আমি নিজেই।
অশরী জগৎ বড়ই ভয়াভয়। যা একটা মানুষের সমস্ত জিবন শেষ করার জন্য যথেষ্ট।

রক্তক্ষরণ অপেক্ষা পর্ব ৫