রক্তক্ষরণ অপেক্ষা পর্ব ৫ || Golpo Bazar

রক্তক্ষরণ অপেক্ষা পর্ব ৫
নাফিসা মুনতাহা পরী

কবিরাজ মজিবরের একটা পরিচয় দেওয়া যাক। তার অশরী জগতে প্রবশের সূচনা যাকে বলে।
মজিবর তখন ৫ বছর বয়সী। হঠাৎ একদিন সে জ্বরে আক্রান্ত হয়। জ্বর এতই বেশি হয় যে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। আর কিছুক্ষন পর তাকে মৃত ঘোষনা করা হয়।
মজিবরের মা তো এক কান্নায় থাকে। তারপর তাকে গোসল করে জানাযা পড়ানো হয়। এরপর তাকে কবরেও নামানো হয়। এমন সময় কোথা থেকে এক পাগল টাইপের লোক এসে শিশু মজিবরের শরীরে সেই লম্বা তসবিহ্ ফেলে দিয়ে বললেন-
~” এই ছেলেতো বেঁচে আছে! ও এখনো মারা যায়নি তো! তাকে সকলে বাড়িতে নিয়ে যান।”
কথাগুলো বলেই পাগল লোকটি কোথায় যেন চলে যান। আর মজিবর কবর থেকে উঠে পড়ে। সেদিন চমৎকার কিছু ঘটেছিল মজিবরের সাথে।

তারপর থেকে ছোট খাটো বিষয়ে সে কাজ করতো। বড় হয়ে পুরো দমে কবিরাজের পেশাটা বেছে নেয়। মজিবরের হাতের তসবিহ্ টাই সেই পাগলের দেওয়া তসবিহ্। যার সাহার্য্য তিনি এখনো কাজ করেন।পরে সেই পাগলকে তিনি আর কোনদিনও দেখেননি।
[ ঘটনাটি সম্পূর্ন সত্য ঘটনা। ২০১৬ সালে এই মজিবর সবার সামনে চ্যালেঞ্জ করেন তার নাকি কখনো মৃত্যু হবেনা। কারন সে নাকি একবার মারা গিয়ে জীবিত হয়েছে। তাই তার মরন নেই। আমি পরীও অপেক্ষায় আছি ব্যাটা মরে কবে! সে শিশু থেকে যুবক হয়েছে, যুবক থেকে বৃদ্ধ হয়েছে তবুও বলে সে নাকি মরবেনা। ব্যাটা তোর যদি এতই শক্তি থাকতো তাহলে তুই তোর যৌবন ধরেই রাখতে পারতি। বুড়া হইছিস কিয়ের লায়!]
পরীর লাথি খেয়ে মজিবর শরীর ঝাড়া দিয়ে উঠেই রাগে গজগজ করতে করতে এসেই আসনে বসে পড়লো। তারপর শক্ত করে পরীর পা চেপে ধরেই সুইটা বসিয়ে দিল তার কনিষ্ঠ আঙ্গুলে। পরী জোড়ে একটা চিৎকার দিয়েই নিস্তেজ হয়ে যায়। কনিষ্ঠ আঙ্গুল থেকে খুব সামান্যই রক্ত ঝরে। ওটা তাবিজের মধ্য দিয়ে মোম দিয়ে বন্ধ করেই পরীর গলায় দিয়ে দেয়। তারপর হঠাৎই তিনি আবার জায়নামাযে পড়ে যান। জ্বীন তার কাছ থেকে চলে যায়। পরে কবিরাজ এমন ব্যবহার দেখান যে, মনে হয়না তার কাছে এতক্ষন কোন জ্বীনই ছিল! সে যেন কিছুই জানেনা। কাজ সে মোটামুটি ভাল ভাবেই শেষ করেছে। পরী এখন মোটামুটি স্বাভাবিক। কামরুল সাহেব যখন মজিবর কবিরাজের হাতে কচকচে ১২টা হাজার টাকার নোট দিলেন তখন তিনি মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন-

আরও গল্প পরতে ভিজিট করুন

~” জ্বীনগুলো আপনার মেয়ের কাছে থাকলে কোন সমস্যা হতোনা। তারা অনেক উপকারে আসতো!”
কামরুল সাহেব যেন কিছুটা ক্ষেপে যান কবিরাজের উপর। জ্বীন দরকার হলে আপনি নিয়ে গিয়ে পুষতে পারেন কিন্তু আমার মেয়ের শরীরে নয় বুচ্ছেন?
হুম বুঝেছি বলেই তিনি কিছু নিয়ম মেনে পরীকে চলাফেরা করতে বলে হাসিমুখে চলে যান। কিন্তু কবিরাজগুলো বড্ড খারাপ। তারা যদি একবার টাকার নেশা পায় তাহলে মনের ইচ্ছামত টাকা না খাওয়া পর্যন্ত ভুক্তভোগীকে ছাড় দেয়না। পরীর পরিবারেও এমন হয়। দীর্ঘ সময় আরও কয়েকগুন টাকা নিয়ে পরীর শরীর থেকে জ্বীন নামায় কিন্তু একেবারে জ্বীনদের মুক্ত করেনা। তিনি আরও টাকা দাবি করেন। তখন পরীর বাবা রেগে গিয়ে বলেন-
~” আপনার মত কবিরাজের আমার দরকার নেই। আপনি চলে যান।”
~” জনাব, ভেবে দেখেন! মেয়ের ক্ষতি হলে কিন্তু আমার দোষ দিতে পারবেননা।”
কবিরাজের কথা শুনে কামরুল সাহেব ক্রোধে ফেটে পড়েন। আমার মেয়ের যা মনে তাই হোক। আপনি এখুনি বাসা থেকে বের হোন। আপনার মুখও দেখতে চাইনা। শুধু টাকা নিতে আসেন! সমস্যা সমাধান করার কোন নাম নেই? ঢের আপনার চিকিৎসা হয়েছে বলে পরীর গলা থেকে তাবিজগুলো খুলে নিয়ে ওনার সামনেই ছুড়ে মারে। আপনি এখন যান এখান থেকে।
কবিরাজ অপমানিত হয়ে বলেছিল-
~” কাজটা আপনি ভাল করলেন না। নিজেই নিজেককে সর্বনাশের দিকে ঠেলে দিলেন। এরপর কিছু হলে কখনো আর আমাকে ডাকবেন না।”
~” আপনাকে আর কোনদিনও ডাকা হবেনা। আপনি যান এখন।”
সেদিন সারা জিবনের জন্য মজিবর কবিরাজ চলে যায় কিন্তু জ্বীনগুলোকে সে হয়ত মুক্ত করে দিয়ে যায়। কারন পরীর সমস্যাগুলো আবার শরীরে জানান দিতে লাগলো। তবুও সে নিজে নিজেই রুকাইয়া এবং দোয়া দরুদ পড়ে ফু দিত শরীরে।

৬ বছর পর,
পরী এখন গ্রাজুয়েশন কম্পলিট করেছে। অবন্তীর বিয়ে হয়েছে খুব ভালো ঘরে। রিলেশনের বিয়ে ছিল। ছোট ভাই কনকও অনেক বড় হয়ে গেছে। এতটা বছরে পরী শুভ্রকে ধরতে গেলে সম্পূর্ন মন থেকে মুছে ফেলেছে। স্বাভাবিক জিবন যাপন করে। কিন্তু সমস্যা বাঁধে আবার বিয়ে নিয়ে। স্বপ্না পরীকে বিয়ে দিতে চায় তার বোনের ছেলের সাথে আর বাবা বিয়ে দিতে চায় তার নিজের বোনের ছেলের সাথে। এ নিয়ে বাসায় ঝগড়াঝাঁটির কোন শেষ নেই। শেষে দুটোই কান্সেল। কামরুল সাহেব একদম অপিরিচিত একটা ছেলের সাথে পরীর বিয়ে ঠিক করে। আজ তারা পরীকে দেখতে আসছে। পরী চুপ করে সব শুনে বিড়বিড় করে বলল-
~” স্বামী থাকা অবস্থায় এক মেয়ের কয়বার বিয়ে হয়?”
কিন্তু কথাগুলো সে আর কাউকে জোড়ে বলতে পারেনা। মাঝে মাঝে শুভ্রর কথা প্রচন্ড মনে পরে। কিন্তু করার কিছু নেই। সে তার মাকে নিয়ে সুখে থাকুক। স্বামীহারা মা তার। ছেলেই তার অন্ধের যষ্টি। থাকনা তারা তাদের মত করে। আমি না হয় তাদের জিবনে নাই ঢুকলাম। সেদিনের পর থেকে পরী ওর ফোনটা আর খুজে পায়নি। সাহস করে কাউকে বলতেও পারেনি ফোনটা কোথায়।
পরীর প্যারানরমাল সমস্যা এখনো আছে। বরং সে এসব জিনিস বেশ উপভোগ করে। সে জানে কোন ভাবেই তার বিয়ে হবেনা। শুধু শুধু বাবা টাকা খরচ করে এতসব করছে। পরে যখন কিছু হবেনা তখন এমনি সোজা হয়ে যাবেন।

ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসে মা আমাকে সাজাতে ব্যস্ত। আমি মুচকি মুচকি হাসছি যেটা মার কাছে একদম বিরক্তিকর লাগছে। কারন আমিতো জানি যেভাবেই হোক বিয়েটা হবেনা। তারা যেভাবেই হোক আমার বিয়েটা নষ্ট করে দিবে।
ছোট ভাই কনক এসে পরীকে দেখে ভ্রুজোড়া নাচিয়ে বলল-
~” আপু ঠিকতো বলতে তুমি নাকি জিবনেও বিয়ে করবেনা! তাহলে এত সাজুগুজু কিসের জন্য! তবে তোমাকে দারুন লাগছে। এমন সাজে তোমাকে কখনো দেখিনাই তাই হয়ত আরও বেশি ভালো লাগছে।”
আমি উঠে শাড়ী ঠিক করে ওর নাক টিপে দিয়ে মাথার চুলে হাত চালিয়ে দিয়ে বললাম-
~” চল আজ রাতে রেস্টুরেন্টে যাব। আজ আমরা খুব মজা করবো?”
~” টাকা….?”
~” তুই দিবি!”
~” না দিতে পারবোনা। গার্লফেন্ডের পিছে টাকা খরচ করতে করতে আমি ফকির হয়ে গেছি। তোমায় শুধু বাইকে নিয়েই ঘুরতে পারি। নাহ্ সেটাও পারবোনা। তোমার সাথে কোথাও গেলে ফ্রেন্ড সার্কেলের সবাই তোমাকে আমার গার্লফেন্ড ভাবে। তাহলে দেখ, কত লজ্জায় আমাকে পড়তে হয়। তারচেয়ে বাবাকে নিয়ে যাও।”
~” ওকে, আমি একাই যাব। দরকার নেই তোকে।”

কনক আর কিছু না বলে চলে গেল। আমি অপেক্ষায় রইলাম আমার কারিশমা দেখানোর জন্য। ব্যাটা আজ তোকে দৌড়ানি দিয়েই ছাড়াবো। একটু পরে আমার ডাকও পড়ে গেল। সভ্য ভদ্র সব উপাধি নিয়ে আমি তাদের সামনে গিয়ে বসলাম। তারা আমাকে দেখলো। মনে হয় তাদের পছন্দ হয়েছি আমি। ধীরে ধীরে মনটা খারাপ হয়ে গেল। আল্লাহ্ আমিতো সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম জিবনেও বিয়ে করবোনা। কারন আমি এখনো শুভ্রর সাথে আবদ্ধ আছি। তার সাথে আমার ডির্ভোস হয়নি। তাছাড়া কোন পুরুষ মানুষকে আমার ভালোও লাগেনা। এখন আমি কি করবো! মনে মনে কথাগুলো বলতেই কেউ জানি বলে উঠলো, ছেলে-মেয়ে একান্তভাবে নিজেদের মধ্য কথা বলুক। সারাজিবনের একটা ব্যাপার। তাই তারা নিজেরা নিজেদের মত আলাপ করুক। ব্যস রাস্তা পেয়ে গেলাম। মনের ভিতর লাড্ডু ফুটলো। ছাদে ওনাকে যেতে বলে আমি বাবার রুমে গিয়ে একটা সিগারেট আর লাইটার হাতে নিয়ে ছাদে গিয়ে দেখি ব্যাটা পায়ের উপর পা তুলে বসে ফোন বের করে কি যেন করছে। টেবিলে নাস্তা দেওয়া দেখলাম। আমি ধীর পায়ে তার পাশের চেয়ারে বসে সিগারেট ধরিয়ে বললাম-

~” সিগারেট খান!”
ছেলেটি পরীর দিকে চেয়ে ভ্রু কুচকে বলল-
~” আপনি ধুমপান করেন?”
~” শুধু ধুমপান! একদম স্কয়ার মাতালি। তা আপনি এসব মেনে নিবেনতো!”
আমি সিগারেটে একটা টান দিতেই গলা যেন তিক্ত ধোয়ায় বন্ধ হয়ে এল। মুখটা অন্য দিকে করে দম ফাটিয়ে কাঁশতে লাগলাম। বেশি টান দেওয়া হয়েছে। পিয়াল একটা অট্টোহাসি দিয়ে পানির গ্লাস এগিয়ে দিতেই ওর শাহাদত আঙ্গুল মুচরে ধরলাম। ব্যাটা তোকে আমি বিয়ে করবোনা। এখুনি তল্পিতল্পা গুছিয়ে বাড়ির রাস্তা ধর।
ছেলেটির মধ্যে কোন পরিবর্তন দেখলামনা। তার আঙ্গুল মুচরাতে গিয়ে নিজের হাত তার হাতের মধ্য মুষ্টিবদ্ধ হয়ে গেছে। সে হাসি থামিয়ে বলল-
~” আপনার এই রাগী লুক আমার ভিষন পছন্দ হয়েছে। চিন্তা করবেন না, বিয়ে আটকে থাকবেনা। আমার কাছে তো আপনাকে নিয়ে আসবোই?”
এই আমি কিন্তু আপনার জিবন তছনছ করে ছাড়বো। মাওয়াশি জুকি, হীরাক্যান জুকি, ইপপন নুকেট সব স্টাইলে আপনাকে বাসর রাতেই পাঞ্চ মারবো কিন্তু! তখন কিন্তু আর চাইলেও আমাকে ছাড়তে পারবেননা হুমম! আগেই কিন্তু আপনাকে সাবধান করে দিলাম। কথা না মানলে, পরে কিন্তু পস্তাবেন আপনি নিজেই।
বাহ্ ক্যারাটে সম্পর্কে দেখছি আপনার অনেক অভিজ্ঞতা। আপনি কি জানেন, আমি ব্লাক বেল্ট হোল্ডার!

তাছাড়া আপনাকে ছাড়ার জন্য বিয়ে করছি নাকি! এখানে রাখার জন্য কাছে আনতে চাচ্ছি বলেই বুকের বাম দিকে হাত চেপে ধরলো। কথাগুলো বলে কিছুক্ষন চুপ করে রইলো। তারপর পিয়াল চিয়ার থেকে উঠে চলে গেল। কিন্তু সিড়ির কাছে গিয়ে থেমে পিছনে না তাকিয়েই আঙ্গুল উচু করে বলল-
~” আমিও দেখবো পরী, বাসর রাতে তুমি আমায় কেমন পাঞ্চ মারো! না আমারটা খাও।”
এমন কথা শুনে আমার মুখ ছুটে গেল। ব্যাটা নচ্ছার কোথাকার। তোর পা ভেঙ্গে দিব, আর একবার আমার কাছে যদি আসিস। রাগে আমার পুরো শরীর জ্বলে যাচ্ছে।
পিয়াল এবার পিছন ফিরে বলল-
~” মাতালি ম্যাডাম, সিগারেটা অযথা পুরে যাচ্ছে। টান দিয়েই না হয় সেটা শেষ করেন। চিন্তা করেননা, খাটের বদলে সিগারেটের কার্টুন দিয়ে আমাদের বাসর ঘরের খাট বানাবো। দেখি আপনি কতটা সিগারেট পান করতে পারেন।”
এবার ধর্য্য বাঁধ যেন ভেঙ্গে গেল আমার। জলন্ত সিগারেট তার দিকে ছুড়ে ফেলে দিতেই সে যেন ক্যাচ ধরে ফেলল। তারপর সিগারেটে একটান দিয়ে খুকখুক করে কাঁশি দিয়ে বলল-
~” বিয়ের আগে প্রিয়ার ঠোটের ছোয়া পাওয়া বড়ই সৌভাগ্যর ব্যাপার।”

সিগারেটটা নিভিয়ে সে চলে গেল। আমাদের এমন কাহিনী কাজের মেয়ে কমলার মা দেখে ফেলেছে। পিয়ালরা যাওয়ার পরই শুরু হয় আমার উপর অত্যাচার। বাবার সামনেই মা আমায় ঠাশ ঠাশ করে কয়েকটা চড় বসিয়ে দিয়ে বলল-
~” আর কত জ্বালাবি আমাদের! মরতে পারিসনা? আজ যদি বিয়েটা ভেঙ্গে যায় তাহলে তোকে জান্ত মাটিতে পুতে ফেলব। যে সন্তান তার পিতার যোগ্য উত্তরসরী হতে পারেনা, তার থাকার চেয়ে না থাকায় উত্তম।”
বাবা একটা কথাও বললোনা। বাবা কিছু না বললেও ইদানিং মায়ের হাতে শাসন করে নেন। আমি কমলার মায়ের দিকে তাকাতেই ওনি চুপসে গেলেন।
মা সাথে সাথে আমার চুলের গোছা ধরে চিৎকার দিয়ে বললেন-
~” এই চোখ নামা! চোখ নামা বলছি! তুই কি ভেবেছিস! তোর এসব কুকর্ম আমরা জানতে পারবোনা? হয় তুই বিয়ে করবি না হয় আমাদের সবাইকে মুক্তি দিবি। তোকে আর সহ্য হচ্ছেনা।”
আরও কয়েকটা চড় পড়লো আমার গালে। আমি কোন রিয়াক্ট করলামনা। আমি চাই সবাই আমাকে আঘাত করুক। তাহলে এদের প্রতি আমার আর দয়া থাকবেনা। রুমে এসে শাড়ী, গহনা খুলে চির চেনা স্কার্ট আর ট্রীশার্ট গায়ে জড়িয়ে বুদ্ধি গোটাতে লাগলাম এদের থেকে কিভাবে নিজেকে রক্ষা করা যায়। বাবা-মা হয়েছে বলে আমার মাথা কিনে নিয়েছে নাকি! আমার মতামতের কোন দাম নেই! শেষে বুদ্ধি গোটালাম বাসা থেকে পালাবো। কিন্তু কার সাথে পালাবো? কার কাছে যাব? দাদী! হ্যাঁ দাদীর কাছে চলে যাই। তিনি কিছু একটা ব্যবস্থা করবেনই। আগে নিজে বাঁচি তারপর অন্য কিছু ভাবা হবে।

১০তলা বাসা। এত সুন্দর কারুকার্যময় বাসা খুব কমই দেখা যায়। বিদেশী পার্টি ছাড়া এত টাকা খরচ করে কেউ বাসা তৈরি করতে পারবেনা। গত বছর নীলিমার স্বামী স্টোকে মারা যান। এক ছেলে আর মেয়েকে নিয়ে রাজশাহীর মেন শহরে এই বাসার ৪তলায় তার বসবাস। ইদানিং এই পরীবারের সাথে ২ মাস যাবত বসবাস করছে পরী। এটা দাদীর আইডিয়া ছিল। নওগাঁ থেকে সে রাতে পরী ওর দাদীর কাছে গিয়েছিল তারপর দাদীর পরামর্শে পরেরদিন দাদী নিজেই এই বাসায় রেখে যান।
না বাবা এখানে আসতে পারেন, না মাকে আসতে দেন!আমার দিক থেকে সব থেকে সেফটি জায়গা এটা। আন্টি আমাকে প্রচন্ড ভালোবাসেন। আমিও ওনার একটা সন্তান হয়ে গেছি। পরের সন্তানকে কেউ এত ভালোবাসতে পারে সেটা নীলি আন্টিকে না দেখলে কখনো বুঝতে পারতামনা। আন্টি নিজেই আমাকে এখানে মাস্টার্সে ভর্তি করে দেন। নীল আমার ১ বছরের ছোট আর নিঝুম কেবল ক্লাস এইটে পড়ে। দিনগুলো ভালই কাটছে। দুঃখের পরে সুখ যাকে বলে। এখন একটা জব হাতে পেলেই বিন্দাস আমি। আমাকে আর পায় কে! টুরিষ্ট হবো টুরিষ্ট। সারাবিশ্ব আমি আমার দু’চোখে ক্যামেরা বন্দী করতে চাই। এখন আল্লাহ্ সহায় হলেই হয়।

একদিন সকালে পড়ছিলাম। সামনে একটা জবের এক্সাম আছে তাই প্রস্তুতি নেওয়া আর কি! এমন সময় আন্টি এসে বলল-
~” নাফিসা, তুমি আমার সাথে যাবে! আমার ভাসুরের ছেলে এসেছে ইংল্যান্ড থেকে। তাকে দেখতে যাব। খুব মিষ্টি একটা বউ নিয়ে এসেছে। আমরা সবাই দেখতে যাচ্ছি। ওরা ৫তলায় থাকে। তোমাকে বলেছিলাম না!”
ইংল্যান্ড! বলেই থেমে গেলাম। আন্টিকে কিছু বুঝতে না দিয়ে বললাম, অন্য কোনদিন যাব আন্টি! আজ আমার পড়া আছে, আপনি যান।
ওকে মা বলে উনি চলে গেলেন।
আমি দু’মাস যাবত এই বাসায় আছি কিন্তু আন্টির কোন ননদ বা জ্যা-দের সাথে দেখা হয়নি। আমিও কাজ ছাড়া বাহিরে যাইনা। তাছাড়া মনে হয়না জ্যাদের সাথে আন্টির খুব একটা মিল রয়েছে। কেউ কারো বাসায় যায়না কারন ছাড়া।
বাসায় নীল আর আমি ছাড়া কেউ নেই। খানিকক্ষণ পর আমি নিজেই নীলের রুমে গেলাম। দেখি ও বসে ম্যাথ করছে। ওর পাশে গিয়ে সোজাসাপ্টা প্রশ্ন করলাম-

~” নীল, তোমার কোন কাজিন এসেছে?”
নীল খাতা থেকে মাথা উঠিয়ে মুখে মিষ্টি হাসি টেনে বলল-
~” শুভ্র ভাইয়ার কথা বলছেন নাফিসা আপু!
শুভ্র! গলা শুকিয়ে এল আমার। পুরনো ক্ষতটা একমুহুত্বেই জেগে উঠলো। বুকের ভিতর ঢিপঢিপ আওয়াজ শুরু হয়ে গেছে। চোখ ছলছল করার জন্য চট করে মাথা নিচু করে বললাম-
~” তোমার ভাইয়ার ফুল নেম কি!”
~” শাহরিয়া আদনান শুভ্র। বড় কাকায়েই এই একটাই ছেলে। আর দু’টি মেয়ে, আতিকা আর আনহা। তুমি জানো নাফিসা আপু! এই বাসাটা শুভ্র ভাইয়া বানিয়েছে। তারপর ফুফু সহ সব চাচাদের একটা করে ফ্লাট দিয়েছেন। উনি প্রচন্ড একজন ভালো মানুষ আর দেখতেও চমৎকার। কাল সন্ধ্যায় লাল টুকটুকে একটা বিদেশী বউ নিয়ে এসেছে। ভাবী দেখতে যা কিউট না! কি বলবো আপনাকে? তার উপর বাঙ্গালী শাড়ীতে ওনাকে জাষ্ট ওয়াও লাগছিল। কাল দেখা করে এসেছি।”
অহ্ বলেই দ্রুত নিজের রুমে এসে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে খাটে স্থির হয়ে বসে পড়লাম। নিঃশব্দে চোখ উপচে গাল বয়ে পানি ঝড়ছে। শুভ্র, আমার শুভ্র বলেই ফিকরে উঠলাম। আর নিজেকে থামাতে পারছিনা। অনেকক্ষন ধরে কেঁদেই চলছি। তারমানে আমি এতদিন শুভ্রের বাসায় আছি। নীলিমা আন্টির ভাসুরের ছেলে শুভ্র! এখন আমি এখানে থাকবো কি করে? শুভ্র নাকি বিয়েও করেছে। আমার কথা কি ওর একবারও মনে পড়েনি! ও বিয়ে করতে পারলো কিভাবে? হঠাৎ মাথাটা ব্যাথা করতে শুরু করলো।

এমন অবস্থায় শুভ্রর বউটাকে খুব দেখতে মন চাচ্ছে। ও কি শুভ্রকে খুব ভালোবাসে! যেমনটা আমি ভালোবাসি?
নিজের মাথায় নিজেই একটা চটকানি মেরে কাঁদতে কাঁদতে নিজেকে বুঝালাম, পরী কি ভাবছিস? ৭ বছর আগে সম্পর্কের ইতি তুই নিজেই ঘটিয়েছিস। তাহলে আজ কেন ওর কথা ভাবছিস? নাহ্ এভাবে আর বাসায় থাকতে পারবোনা, একমুহুত্বেও থাকতে পারবোনা বলে চোখ মুছে আবার নীলের কাছে গিয়ে বললাম-
~” নীল আমায় একটু ভার্সিটিতে রেখে আসবা?”
পরীর ধরে আসা কন্ঠ শুনে নীল ভালো করে পরীকে পা থেকে মাথা অবদি দেখে কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করলো। কিন্তু নীল আরও গভীরে না গিয়ে মৃদু স্বরে বলল-
~” এত সকালে ভার্সিটিতে গিয়ে কি করবেন? আমার ৯টায় ক্লাস আছে। তখন না হয় আপনাকে নিয়ে যাই?”
যাইতে হবেনা বলেই হনহন করে ওর রুম থেকে বের হয়ে আসলাম। ওর সাহস দেখে আমি অবাক হয়ে যাই। ওকে আমার কৈফিয়ত দিতে হবে নাকি! আমি কেন যাব না যাব সেটা আমার একান্ত ব্যাপার! পরী কাউকে কৈফিয়ত দেয়না। রুমে এসে দ্রুত বোরখাটা পড়ে ব্যাগ নিয়ে একপ্রকার ছুটেই রুম থেকে বের হলাম। এই বাসায় থাকা আমার পক্ষে কঠিন। ডাইনিং রুমে আসতেই নীল জোরে চিৎকার দিয়ে বলল-
~” আরে বাবা, আমাকে রেডী হতে দিবেন তো?”
নীলের কথার কোন জবাব না দিয়ে সদর দরজা খুলতেই কারো সাথে খুব জোড়ে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে যেতেই কেউ একজন আমাকে ধরে ফেলল। আমি সেদিকে না তাকিয়ে বেশ জোড়েই তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে সিড়ি বেয়ে নিচে নামতে লাগলাম। লিফট্ আছে কিন্তু কোথাও এক ভাবে স্থির হয়ে দাড়িয়ে থাকলেই যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে। নীল প্রায় দৌড়ে এসেই বলল-

~” আপু হয়ে গেছেতো! আমিতো এমনি এমনি কথাটি বলেছি। এত রাগ দেখানোর কোন মানে হয়!”
পরী ওর কথা না শুনে দ্রুত সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেছে। নীলিমা উপর তলা থেকে নিজেদের ফ্লাটে এসে দেখলো, শুভ্র দরজার সামনে দাড়িয়ে আছে। কিন্তু ওর দৃষ্টি সিড়ির দিকে ছিল। সেই একই রাগ, একই চলার ধরন, একই তেজ। শুভ্র রিতিমত অবাক হয়ে কথাগুলো ভাবছে। কাকিকে দেখে নিজেকে সামলিয়ে বলল-
~” কাকি, মেয়েটা কে? কেউ এত জেদী হয়?”
মা তোমার ভাতিজী কি মানুষ! না বনের পশু? উনি কিন্তু খুব বড্ড বাড়াবাড়ি করেন। এত রাগ মেয়ে মানুষের ভাল নয়। আমি শুধু একটু বলেছি কেন এত সকালে ভার্সিটিতে যাবেন! এতটুকু বলাতেই তিনি প্রচন্ড রেগে গিয়ে একা একা চলে গেলেন। ওনার এই একরোখা জেদের কারনে না জানি, নিজেই নিজের ক্ষতি না করে ফেলে! ওনাকে নিয়ে আমার টেনশন দিনকে দিন বেড়েই চলছে।
ছেলের কথা শুনে নীলিমা বেগম চিন্তিত হয়ে বললেন-

~” একদম ওর বাবার মত স্বভাব পেয়েছে। রাগটাকেই তারা প্রাধান্য দেয়।”
~”কাকি, বললেননা মেয়েটা কে?”
আমার ভাতিজী নাফিসা। তোমার নানু বাসার কাছেই বাসা। তুমি হয়ত চিনবে তাকে। ২মাস হল আমাদের সাথে থাকে।
কাকির কথাটি শুনতেই শুভ্রের বুকটা ছাৎ করে উঠলো। তারপর বিড়বিড় করে বলল-
~” কাকি, ওর নিক নেম কি পরী!”
~”বাহ্, আপনাদের মধ্য দেখছি বেশ মিল। নাফিসা আপুও একটু আগে আপনার পুরো নাম শুনলো আর আপনিও। আপনারা কি একে অপরকে আগে থেকে চিনেন নাকি!”
শুভ্র নীলের কথার কোন জবাব না দিয়ে ডাইনিংরুমে এসে সোফায় বসতে বসতে বলল-
~” আমাদের নিম বুড়ি কই! তাকে তো দেখছিনা যে?”
টিউশানিতে গেছে বলে নীলিমা শুভ্রকে এককাপ কফি দিল। শুভ্র কফি পান করছে আর ওর কাকির প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে। কিন্তু মনে মনে পরীকে নিয়ে ভিষন চিন্তা করছে। ও আমারই বাসায় আছে কিন্তু আমি তাকে পাগলের মত এই আটটি বছর ধরে খুঁজেছি।

দুইটা বান্ধবীকে কল দিয়েছি আসতে। ওরা ক্যাফেটেরিয়ার সামনে দাড়িয়ে আছে। ওদের নিয়ে ভিতরে ঢুকলাম। চেয়ারে বসতেই আরও দু’জন আসলো। আমিতো এদের আসতে বলিনি তাহলে এরা কি ওদের আসতে বলেছে! আমি কৌতুহল হয়ে তনুর দিকে তাকালাম। তনু ভ্রু নাচিয়ে বলল-
~” আরে দোস্ত, আমরা কেন ফাও ফাও টাকা খরচ করবো! আজ রুনার বার্থডে। ট্রিট দিচ্ছে……!”
ইমতি রুনার ঘাড়ে চাপর মেরে বলল-
~” কিরে মামুর বেটি! আজ কিন্তু যেই সেই খাওয়ালে চলবেনা। দামী একটা গিফট্ পেতে চলছিস আমাদের কাছ থেকে তাই ভাল কিছু চাই। পাসতে পারছোস!”
আমি চুপ করে বসে আছি। ওরা তুমুল মজা করছে। খানিকক্ষণ পর আরো দুটা ছেলে এল। এরা কারা চিনিনা আমি। ওরা নাকি রুনার ফ্রেন্ড। এখানেও কিছু ভালো লাগছেনা।
কিরে চুপ কেন বলতেই পরী চমকে উঠলো। যেটা দেখে ইমতি বলল-
~” এই কি হয়েছে তোর! কি নিয়ে ভাবছিস এত?”

রক্তক্ষরণ অপেক্ষা পর্ব ৪

নাহ্ কিছু নয় বলে উঠে দাড়ালাম। এই তোরা থাক আমি আসছি বলেই ওয়াসরুমে চলে এলাম। হিজাবের মুখ খুলে আয়নার দিকে চেয়ে নিজেকে দেখতে লাগলাম। অটোমেটিক চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগলো। কলের পানি ছেড়ে বার বার মুখে পানির ঝাপটা দিলাম তবুও চোখ দিয়ে গরম নোনা জল পড়তে লাগলো। শুভ্রজ্বর যেন আমার স্মৃতি থেকে সরছেই না!
আরো কিছুক্ষন লাগলো নিজেকে সামাল দিতে। তারপর দ্রুত চোখ মুছে বের হয়ে আসতেই তনু বলল-
~” তোর আন্টি কল দিয়েছে, তোকে জলদি বাসায় যেতে বলেছে।”
আমার ফোন তনুর হাত থেকে নিয়ে ইমতির হাতে ৫শত টাকার একটা নোট দিয়ে বললাম, তোরা নাকি ওকে গিফট্ করবি! টাকাটাও ওর সাথে যোগ করিস। আমি যাচ্ছি, আবার একদিন আসবো বলেই বের হয়ে আসলাম।
আন্টি কেন কল দিল! বাসা থেকে ঐ ভাবে বের হয়ে আসার জন্য নয়তো! ব্যাগে মাত্র ত্রিশ টাকায় আছে। একটা রিকশা নিয়ে বাসায় এসে নামলাম। পুরো টাকাই ভাড়া দিলাম। গেটে ঢুকতেই দেখলাম নীল বাইক নিয়ে বের হয়ে গেল। আমার দিকে একবার আড় চোখে চেয়েই দ্রুত চলে গেল। আমি কিছু না বলে বাসায় চলে এলাম।

শুভ্র পরীর জন্য এতক্ষন ওয়েট করে ছিল। শুভ্র ওর কাকিকে দিয়ে পরীকে কল করে বাসায় আনিয়েছে। পরীকে দেখা মাত্রই শুভ্র নিঝুমের দিকে চেয়ে বলল-
~” একটা কবিতা শুনবি নিম বুড়ি?”
নিঝুমের জবাব দেওয়ার আগেই শুভ্র বেশ জোড়ে জোড়ে কবিতাটা পাঠ করতে লাগলো,
“যদি একবার যাওয়ার আগে বলে যেতে
কি ছিল আমার অপরাধ,
যে কারনে তোমার জিবন থেকে
তুমি আমাকে দিয়েছ বাদ!
তুমিতো অনেক দিন হল, অনেক দিন হল
আমাকে গেছ ভুলে,
আজও তোমার নাম লেখা, দেখি মনের খাতা খুলে।
তোর কি আমায় মনে পড়ে!
আজও কি আমার কথা ভেবে তোর দু’নয়ন ঝরে?
একা রাত আজও তোর কথা বলে..
এই ঘুমহীন চোখও শুধু তোকে ডাকে,
ফিরে আয়!
হাতে কাটা আচড়ের দাগ,
আজও যে তোকে ভুলতে দেয়নি,
দেয়নি তোকে ভুলতে…..।”

শুভ্রের কবিতা পাঠ থামতেই পরী ওর রুমের দরজার সামনে থমকে দাড়ায়। পিছন ফিরে চেয়ে শুভ্রকে দেখে ওর হুস যেন উড়ে যায়। ছলছল চোখে শুভ্রর দিকে চেয়ে বিড়বিড় করে বলল-
~” তারমানে সকালে আমি শুভ্রর সাথে ধাক্কা খেয়েছিলাম…….!”

রক্তক্ষরণ অপেক্ষা পর্ব ৬