রক্তক্ষরণ অপেক্ষা পর্ব ৬ || নাফিসা মুনতাহা পরী

রক্তক্ষরণ অপেক্ষা পর্ব ৬
নাফিসা মুনতাহা পরী

শুভ্র সোফা থেকে উঠতেই পরীর হুস যেন ফিরে এল। পরী দ্রুত নিজের রুমের ভিতর ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিল।
ভ্যানিটিব্যাগটা ফ্লোরে ছুড়ে মেরে বোরখাটা খুলে চুপ করে খাটে বসে পড়ল। তারপর দু’পা উপরে তুলে হাটুর মাঝখানে মুখ গুজে চুপ করে রইলো। কতদিন পর সে শুভ্রকে দেখলো। এ যেন অপত্যাশিত চাওয়া পুরুন হওয়া।
পরী ১টা বছরের মধ্য- ১২ মাস, ৩৬৫ দিন, ৮৭৬০ ঘন্টা, ৫২,৫৬০০ মিনিট, ৩১৫৫৬০০ সেকেন্ড, প্রতিরাত, প্রতি সময়, প্রতিদিন একটু সময়ও নষ্ট করেনি। শুধু শুভ্রকেই পাগলের মত ভালোবেসেছে। আর সে!!!!
পরীর পুরো শরীর এখন কাপছে। মুখ গুজে সে কান্না করেই চলছে।
পরীর এমন ভাবে দরজা লাগানো শুভ্রের মোটেও ভালো লাগলোনা। তাছাড়া পরীর এমন ব্যবহারে নিলীমা পর্যন্ত হতবাক হয়ে গেল। কি এমন হল যে পরী এমন ব্যবহার করলো! শুভ্র কোন কিছু না ভেবে দ্রুত দরজার সামনে এসে দাড়িয়ে চুপ করে বুঝার চেষ্টা করলো রুমের ভিতর কি ঘটছে! খানিকক্ষণ চুপ থেকে শান্ত গলায় বলে উঠলো-

~” পরী তুমি ঠিক আছো?”
শুভ্রের কন্ঠ যেন আগুনে ঘি ঢালার মত কাজ করলো। পরীর মনে আগুনের পরিমান যেন বাড়িয়ে দিল। পরী মুখে দু’হাত চেপে ফিকরে শব্দ করে কেঁদে উঠলো। তারপর নিজের রাগকে কন্ট্রোল করতে না পেরে পাশে থাকা টেবিল লাম্পটি এক ঝটকায় হাত দিয়ে ছুড়ে ফেলে দিয়ে ফ্লোরে বসেই জোড়ে একটা চিৎকার দিয়েই হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। তারপর শব্দ করে বলতে লাগল-
~” ইউ আর লায়ার শুভ্র ইউ আর লায়ার……। তুমি আমাকে ভুলে কিভাবে অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করো! আমার কথা কি একবারও তোমার ভাবা উচিত ছিলোনা? আমি তোমাকে কোনদিনও ক্ষমা করবোনা, কোনদিনও না।”
টেবিল ল্যাম্পের ভেঙ্গে যাওয়া কাঁচ এদিক-ওদিক ছিটিয়ে আছে। পরী কাঁদতে কাঁদতে একটুকরো কাঁচ নিয়ে জামার হাতা টেনে তুলে কাঁপা কাঁপা হাতে বাম হাতের শিরা বরাবর শক্ত করে ঠেসে ধরলো। তারপর চুপ করে কিছুক্ষন বসে থেকে আবার ফিকরে উঠেই জোড়ে কাচটি টান দিলো। সাথে সাথে পরীর হাত থেকে ফিকনি দিয়ে রক্ত ছুটতে লাগলো। পরী আস্তে আস্তে ফ্লোরে সুয়ে পড়ল। পরী যেন ইচ্ছা মৃত্যুকে বরন করে নিল।

আরও গল্প পরতে ভিজিট করুন

পরীর প্রতিটা কথা শুভ্র শুনতে পেয়েছে। শুভ্রর চোখ দু’টি ছলছল করছে। কিন্তু যখন পরীর আর কোন রেসপন্স আসলোনা তখন শুভ্র পাগলের মত দরজা ধাক্কাতে লাগলো। পরী কি হল তোমার! দরজা খোল, এভাবে কি সবকিছুর সমাধান হয়! আমরা সামনা সামনি কথা বলি। মাথা গরম করোনা পরী! তোমার রাগকে আমি প্রচন্ড ভয় পাই। দরজা খোল বলে আরও কয়েকবার দরজা ধাক্কালো শুভ্র। কিন্তু তাতেও পরীর কোন রেসপন্স পায়না শুভ্র। নিঝুম আর নীলিমাও এসে দরজা ধাক্কাতে লাগলো। শেষে যখন কোন কিছুতেই কিছু হচ্ছিলোনা তখন শুভ্র চিৎকার দিয়ে বলল-
~” কাকি, এখুনি রুমের চাবি আনেন। জলদি করেন। খারাপ কিছু একটা হয়েছে।”
চাবির কথা নিলীমার মাথায় ছিলোনা। সে দ্রুত দৌড়ে গিয়ে চাবি এনে শুভ্রর হাতে দিতেই শুভ্র দরজা খুলেই স্থির হয়ে গেল। পরীর হাত দিয়ে চুয়ে চুয়ে রক্ত পড়ে ফ্লোর ভেসে যাচ্ছে। এমন দৃশ্য দেখে নিঝুম, আপু বলেই গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলো।

শুভ্র দৌড়ে গিয়ে পরীর কাছে বসে ওকে বুকে নিয়েই পাগলের মত আচরন করতে লাগলো। তুমি এটা কি করেছ পরী! এতদিন পর তোমাকে পেয়েছি, এই অবস্থায় দেখার জন্য! তুমি যাতে এমন কোন কান্ড না করো এই জন্য আমি সবসময় তোমার কাছ থেকে দুরে দুরে থেকেছি। তোমাকে তোমার মত করে চলার স্বাধীনতা দিয়েছি এই দিন দেখার জন্য! শুভ্র কথাগুলো বলছিল আর পরীকে পাগলের মত করে কিস করে যাচ্ছিল। পরী নিথর চোখে শুভ্রের দিকে চেয়ে রইল শুধু।
এক সময় পরী নিস্তেজ হয়ে হাত-পা ছেড়ে দিতেই শুভ্র ওকে বুকের সাথে নিয়ে জোড়ে একটা চিৎকার দিল। তুমি কাজটা খুব খারাপ করেছ পরী, খুব খারাপ করেছ। আমি কখনো তোমাকে ক্ষমা করবোনা। তুমি এটা কেন করলে!

শুভ্রের পাগলামি দেখে নীলিমা দেয়ালের সাথে শরীর লাগিয়ে চুপ করে দাড়িয়ে রইলো। নীলিমার বুঝতে আর দেরী রইলোনা, শুভ্র আগে থেকেই পরীকে চিনে আর শুধু জানা-শোনেতেই সীমাবদ্ধ নেই। তাদের মধ্য খুব কঠিন একটা সম্পর্ক রয়েছে। শুভ্রতো বিবাহিত, তাহলে এদের সম্পর্ক কোন জায়গায় গিয়ে দাড়াবে! আল্লাহ্ এই মেয়েটাকে নিয়ে তুমি কোন খেলায় মেতেছো!
নিঝুম দ্রুত পরীর হাত চেপে ধরতেই নিলীমা একটা কাপড় নিয়ে এসে পরীর হাত বেঁধে দেয়। শুভ্রও আর দেরী করেনা, পরীকে ফ্লোর থেকে তুলেই রুম থেকে বের হয়ে গেল। জিবনের প্রথম পরীর চেহারা সরাসরি শুভ্র দেখল, আর আজকের দিনেই এমন ঘটনা ঘটতে হল! শুভ্র পরীকে নিয়ে লিফট্ থেকে বের হয়েই ওর গাড়ীর দিকে ছুটলো। পিছনে নীলিমা আর নিঝুমও দৌড় দিল। এদের ছোটাছুটি দেখে নিচ তলার ভাড়াটিয়াগুলো বের হয়ে ওদের কান্ডগুলো দেখতে লাগলো।
শুভ্র পরীকে নিয়ে গাড়ীতে উঠেই উত্তজিত কন্ঠে বলে উঠলো-
~” কাকি, আমি এই অবস্থায় কখনো ড্রাইভ করতে পারবোনা। প্লিজ আপনি ড্রাইভ করুন।”
নীলিমা শুধু মাথা ঝাকিয়ে গাড়ীতে উঠেই গাড়ী স্টার্ট দিল। সাথে নিঝুম উঠলো শুভ্রর সাথে। পরীর জ্ঞান নেই। শুভ্র পরীকে নিজের বুকের কাছ ছাড়া একদমও করছেনা। নিঝুম কেঁদেই চলছে। শুভ্র মুখে শুধু আল্লাহ্কে ডাকছে। আল্লাহ্ এতদিন পর পেয়েছি, ওকে আর আমার কাছ থেকে কেড়ে নিওনা। আমি আর জিবনে কিচ্ছু চাইনা ওকে ছাড়া। ওর যেন কিছু হয়না প্রভূ।

শুভ্রের বড় ফুফু আরিফা বেগম শুভ্রদের ফ্লাটে গিয়ে হন্তদন্ত হয়ে কলিংবেল চাপতে লাগলো। বার কয়েকবার চাপতেই শাকিলা বেগম দরজা খুলে দিয়ে অবাক হয়ে বলল-
~” আপা কি হয়েছে! এমন করছেন কেন?”
আরিফা বেগম এদিক ওদিক চাইতেই দেখলো, মারিয়া ওদের কাছে এগিয়ে আসছে। তিনি শাকিলাকে অন্যদিকে টেনে নিয়ে গিয়ে নিচু গলায় বললেন-
~” শুভ্র কোথায় রে! বাসার সবাই বলছে কোন এক মেয়েকে নিয়ে দৌড়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেল। সাথে নীলিমা আর নিঝুম গেছে। মেয়েটা কে বলতো! নীলিমার ভাইয়ের মেয়ে নয়তো?”
ননদের কথা শুনে শাকিলার বুকের ভিতর অজানা ভয় এসে জমতে লাগলো। সকালে নীলিমা এসেছিল। শুভ্রও ওদের বাসায় গেছে। কি এমন হল যে এত কান্ড হয়ে গেল! আর ঐ মেয়েটাই বা কে? তাকে তো কোনদিনও দেখি নাই আমি!
এমন সময় মারিয়া এসে বলল-
~” মাম্মা, হোয়াট’স হাপেন!”
~” না কোন সমস্যা হয়নি মা! তুমি না বললে সপিং এ যাবে? রেডি হয়ে নাও!”

শুভ্র কোথায় মাম্মা! কল দিচ্ছি কিন্তু রিসিভ করছেনা সে। ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় কথাগুলো বলল মারিয়া।
কোন এক কাজে হয়ত বিজি আছে। তুমি রেডী হয়ে নাও আমি ওকে ডেকে আনছি বলেই শাকিলা বেগম দ্রুত নীলিমাদের ফ্লাটে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। সিড়ি দিয়ে নামতেই নিচতলার ভাড়াটিয়া বেশ কৌতুহল নিয়ে বলল-
~” ভাবী, আপনার ছেলেকে কোথায় যেন দৌড়ে যেতে দেখলাম। গায়ে রক্ত, কোন কিছু কি হয়েছে?”
গায়ে রক্তর কথা শুনে শাকিলা বেগম দ্রুত শুভ্রকে কল দিল। কিন্তু কল রিসিভ হলোনা। শাকিলা নীলদের ফ্লাটে এসে দেখলো দরজায় চাবি দেওয়া। শাকিলা বেগম ভয়ে যেন ঘেমে একাকার হয়ে যাচ্ছেন। শুভ্রর কিছু হলোনা তো! আল্লাহ্ হেফাযতে রাখুন আমার ছেলেকে বলে একদম নিচে নেমে আসলো। গেটের দাড়োয়ানকে জিঙ্গাসা করতেই দাড়োয়ান বলল-
~” খালাম্মা, শুভ্র ভাইয়া ঠিকি আছে কিন্তু নীল ভাইয়াদের বাসার মেয়েটার মনে হয় সমস্যা হয়েছে তাই তারা জলদি করে তাকে নিয়ে গেল।”
শাকিলা এবার নীলিমাকে কল দিল। কিন্তু সেও ধরলোনা। এমন কথা শুনে কি ঠিক থাকা যায়! কি হল তাদের? নানান চিন্তায় চিন্তিত হয়ে শুভ্রকে বার বার কল দিতে লাগলো শাকিলা বেগম।

পরীর চিকিৎসা চলছে। শুভ্র নানা ফর্মালিটি পুরুন করতে ব্যস্ত আর নিঝুম ও নীলিমা বাহিরে ভালো একটা খবরের আশায় দাড়িয়ে আছে। শুভ্র সব কাজ কমপ্লিট করে এসে ফোন বের করে দেখলো, ও মা বার বার কল দিচ্ছে। একটু দুরে সরে গিয়ে কলটা রিসিভ করতেই ওর মায়ের কান্নাময় কণ্ঠ শুনতে পেল।
~” শুভ্র ভালো আছিস আমার বাবা?”
শুভতো ভালো নেই। তবুও মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল-
~” মা, আমিতো ভাল আছি। নিশ্চয় আপনাকে সবাই বলেছে আমার কথা! একটা সমস্যা হয়েছে, আমি সব কাজ শেষ করেই বাসায় যাব।”
ছেলের কথা শুনে শাকিলার দেহে যেন প্রান ফিরে এল। তাই সে খানিকটা শান্ত হয়ে বলল-
~” মারিয়া যে রেডী হয়ে আছে, তোর সাথে শপিং এ যাবে বলে।”
শুভ্রর প্রচুর কষ্ট হচ্ছে। এখন এসব কথা শুনতে মোটেও তার ভালো লাগছেনা। এমন পরিস্থিতিতে এসব কথা যেন ওর কানে বিষের ধোয়ার মত লাগছে। শুভ্র নিজেকে স্বাভাবিক করে শান্ত গলায় বলল-
~” ওকে আপনি নিয়ে যান। এই অবস্থায় কাউকে বিপদে রেখে যাওয়াটা আমার জন্য মোটেও শোভা পায়না মা! আমি একটু ব্যস্ত আছি। পরে আপনাকে কল দিব ।”

আচ্ছা ঠিক আছে বাবা। সাবধানে থাকিস বলে কল কেটে দিল শাকিলা বেগম। আর এদিকে শুভ্র জলদি ওর কাকির কাছে আসতেই শুনলো, ওর কাকি পরীর বাবাকে কল দিয়ে এখানে আসতে বলবে। এমনকি কল দিয়েও ফেলে। শুভ্র দ্রুত গিয়ে ফোনটা কেড়ে নিয়ে বন্ধ করে দিল। তারপর অনুরোধের স্বরে বলে উঠলো-
~” প্লিজ কাকি, এসব কথা কাউকে জানান না। আগে ও সুস্থ হোক তারপর ধীরে সুস্থে সবাইকে জানিয়েন।”
নীলিমা আর কোন কথা না বাড়িয়ে চুপ করে রইলো। মনে তার নানান প্রশ্ন ঘোরপ্যাঁচ খাচ্ছে। এদের মূলত সম্পর্কটা কিসের?
পুরোটা দিন অপেক্ষার পর সন্ধ্যার দিকে পরী কিছুটা স্বাভাবিক হল। পরী চুপ করে সুয়ে আছে। শুভ্র এসে পরীর কাছে দাড়াতেই পরী অন্যদিকে মুখ ঘুড়িয়ে রইলো।
আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। শুভ্রের মুখটাও আমার দেখতে ইচ্ছা করছেনা। আমি কেন বাঁচলাম? কেন ওর সাথে দেখা করালেন আল্লাহ্।
শুভ্র এসে আমার পাশে বসে হাতটা ধরে কিস করতেই আমি চোখ বন্ধ করলাম। শুভ্রের প্রথম স্পর্শ। আমি আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলাম কেউ আছে কিনা! নাহ্ কেউ নেই। আমি হাত সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলাম কিন্তু পারলামনা। শুভ্র ছাড়তে দিলোনা। বরং ও আমাকে অচমকায় তুলেই ওর বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলো। শুভ্রের স্পর্শে আমি কোন রেসপন্সই পেলামনা আমার শরীরের। বরং প্রচন্ড বিরক্ত লাগতে লাগলো।

এমন সময় নিঝুম রুমে আসতেই আমি ওর বুকের ভিতরই ছটপট করতে লাগলাম। কিন্তু ওর ছাড়ার নাম নেই। শেষে ফুফিয়ে কাঁদতে লাগলাম। তবুও শুভ্র ছাড়লোনা আমায়। নিঝুমের উপস্থিতি কোন তফাতই পড়লোনা শুভ্রর মাঝে। এভাবে কিছুক্ষন থেকে তারপর শুভ্র পরীকে ছেড়ে দিয়েই বলল-
~” আমাকে কেন এত কষ্ট দাও? তুমি এত বড় ডিসিশন কিভাবে নিতে পারলে? আমাকে তুমি কেন এত ঘৃনা করো? আমার অপরাধটা কোথায়?”
ডাক্তার সহ নীলিমা আসলে শুভ্র কিছু না বলে উঠে গেল। এরপর রাত ৮টার দিকে ওরা বাসায় ফিরলো। পুরো রাস্তায় শুভ্র পরীকে বুকের মধ্য জড়িয়ে ধরে ছিল। এমন কি ওর কাকির সামনেও কোন সংকোচবোধ করেনি। মনে হচ্ছিল পরীকে ছেড়ে দিলেই ও সারা জিবনের জন্য ওর কাছ থেকে হারিয়ে যাবে। রাস্তায় পরীও কোন সিনক্রিয়েট করেনি। ক্লান্ত শরীর আর মন নিয়ে শুভ্রর বুকে মাথা রেখে আশ্রয় নিয়েছিল।
গাড়ীর ডোর খুলে পরীকে শুভ্র বলল-
~” একা চলতে পারবা? না আমি তোমায় সাহার্য্য করবো?”

পরী কোন কথা না বলে গাড়ী থেকে নেমে একটু চলতেই পড়ে যেতে লাগলো। সাথে সাথে শুভ্র এসে ধরে ফেলল পরীকে। তারপর পরীকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই কোলে নিয়ে ফ্লাটে চলে এল। পরীর রুমে ঢুকে নিঝুম তাড়াতাড়ি কাচের টুকরো গুলো সাফ করতেই শুভ পরীকে নামিয়ে দিতেই পরী শুভ্রকে জোড়ে একটা ধাক্কা দিয়ে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে দিয়ে বলল-
~” নিঝুম তাকে এখান থেকে চলে যেতে বল। আমার কিন্তু তাকে একদমই সহ্য হচ্ছেনা।”
নিঝুম পরীর কথা শুনে নিরুপায় হয়ে একবার পরীর দিকে চাইছে আবার শুভ্রর দিকেও চাইছে। কিন্তু কিছু বলতে পারছেনা।
শুভ্র মুখ দিয়ে পরীর নাম উচ্চারন করতেই পরী চিৎকার দিয়ে বলে উঠল, নিঝুম তাকে এখানে থেকে চলে যেতে বলো। আমি বলছি তাকে চলে যেতে বলো। কথাগুলো বলেই চিৎকার দিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো পরী।
সে আমার জিবনটা নষ্ট করে ফেলেছে। সে একজন মিথ্যাবাদী, সে কথা দিয়ে কথা রাখেনি। আমি তার কাছে কখনো যাইনি কিন্তু সে এসে আমার সব কিছু শেষ করে দিয়েছে। আমার বাঁচার শেষ আশাটুকুও মেরে ফেলেছে। তাকে এখুনি চলে যেতে বল।
হাতে আঘাত পাওয়ায় ওখান থেকে আবার ব্লিডিং হতে লাগলো। সেটা দেখে নিঝুম কাঁদতে কাঁদতে বলল-

~” ভাইয়া আপনি চলে যান। আপু কষ্ট পাচ্ছেতো?”
শুভ্র রুম থেকে বের না হয়ে নিঝুমকে চলে যেতে বলল। নিঝুম নিরুপায় হয়ে চলে যেতেই শুভ্র এসে পরীকে পিছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরে গলায় একটা কিস করে আদুরে গলায় বলল-
~” আমার জন্য শুধু মাত্র এই শুভ্রর জন্য তোমায় বাঁচতে হবে বুঝছো!”
তুমি যাবা বলেই পরী ফিকরে কাঁদতে লাগলো।
শুভ্র আর দেরী না করে ঐ অবস্থায় রুম থেকে বের হয়ে গেল। কিন্তু নীলিমা ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল-
~” শুভ্র, এই অবস্থায় বাসায় যেওনা। ভাবী তোমাকে কি বলতে কি বলে? তাছাড়া উনি টেনশন করবে।”
না কাকি আমি ঠিক আছি বলে শুভ্র চলে গেল। শুভ্রর চলে যাওয়া দেখে নীলিমা ধপ করে সোফায় বসে পড়লো। বাবার কর্মের শাস্তি মেয়ে পাচ্ছে। যতটা কষ্ট নীলিমা পেয়েছে তার থেকে হাজারগুন কষ্ট পরী তিলে তিলে পাচ্ছে। প্রকৃতি কাউকে ছাড় দেয়না। হয়ত এভাবেই মানুষের মাঝে সে বার বার ফিরে আসে। নীলিমার দু’চোখ বেয়ে অশ্রু ঝড়ে পড়লো।

শুভ্র ছাদে ৩ঘন্টা যাবত বসে থেকে রাত ১১টায় নিচে নেমে গেল।
শুভ্র বাসায় আসতেই শাকিলা বেগম অস্থির হয়ে শুভ্রর কাছে এসে ওকে জড়িয়ে ধরেই কাঁদতে কাঁদতে বললেন-
~” শুভ্র, তোর কি হয়েছে? গায়ে এত রক্ত কেন? কোথায় কি করিস না করিস কিছুই বলিসনা। আমার টেনশন হয়না?”
মা,, মা এত টেনশন করছেন কেন? আমি ঠিক আছিতো! এগুলো আমার রক্ত না। মারিয়া কোথায়? ও ঠিক আছেতো? ওকে সপিং এ নিয়ে গিয়েছিলেন?
শাকিলা বেগম শুভ্রকে ছেড়ে দিয়ে ওর মাথায় হাত নাড়িয়ে বলল-
~” তোকে ছাড়া ও কোথাও যাবেনা। বললাম কিন্তু যাবেইনা। আমাদের মনে হয় ও ইজি ভাবে নিচ্ছেনা।”
আচ্ছা সমস্যা নেই, বাঁকিটা দেখছি আমি বলেই শুভ্র দ্রুত রুমে গেল। রুমে এসে আয়নার সামনে দাড়িয়ে বার বার নিজেকে দেখে সে। শার্টে রক্তগুলো শুকিয়ে গেছে। রক্ত মাখা শার্টে বার বার হাত বুলিয়ে তার ঘ্রান নিতে লাগলো। পরীর কথা মনে হতেই খুশিতে ওর হৃদয়ে যেন একটু খানি প্রশান্তির ছোয়া পেল। আমার পরী, ও আমার কাছেই আছে। কথাগুলো ভাবতেই মারিয়া পিছন দিক থেকে শুভ্রের ঘাড়ে হাত দিতেই শুভ্র চমকে উঠলো। ও দ্রুত পিছন ফিরে দেখলো মারিয়া দাড়িয়ে আছে মনে অনেক প্রশ্ন নিয়ে।

শুভ্র নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে মুখে হাসি টেনে বলল-
~” মারিয়া, তোমার শরীর ভালো আছে? দুঃখিত আমি একটা জরুরী কাজে আটকে ছিলাম। তোমাকে নিয়ে তাই বের হতে পারিনি।”
~” নাহ্ ঠিক আছে। তোমার গায়ে এত রক্ত কেন?”
~” ও কিছুনা…….। তুমি ঘুমিয়ে পড়ো। অনেক রাত হয়ে গেছে। এমনি তোমার শরীর খারাপ।”
মারিয়া আর কথা না বলে চলে গেল। শুভ্র শার্টটা খুলে ওভাবেই আলমারিতে তুলে রাখলো দেন ওখানে চাবিও দিল। তারপর ফ্রেস হয়ে এসে ব্যালকোনিতে দাড়ালো। শুভ্র আজ যেন স্থির হয়ে থাকতে পারছেনা। একের পর এক সিগারেট খতম করে ফেলছে। সিগারেটের ধোয়ায় ব্যালকোনিতে নিঃশ্বাস নেওয়ার মত বিশুদ্ধ বাতাস পাওয়া যেন দায়। পরীর যা মনোভাব অন্তত ওর সাথে দেখা করা একদম যাবেনা। কখন যে কি করে ফেলে তার কোন গ্যারিন্টি দেওয়া যাবেনা। এখন আপাতত ওকে একা থাকতে দেওয়ায় বেটার।

আজ ৩দিন হয়ে গেল শুভ্র বা পরী একে অপরের সাথে কোনা রকম যোগাযোগ হয়নি। পরীকে শুভ্রর ব্যাপারে নীলিমা কোন প্রশ্নও করেনি। ও নিজে জানে এই ব্যাথার কষ্ট কতটুকু। নিঝুমকেও চুপ থাকতে বলেছে সে। মেয়েটা এমনিতেই অনেক কষ্টে থাকে।
রাত ১১টা বাজে। ফোনের ওপাশের কিছু কথা আমার হৃদয় ছিন্ন-বিন্ন করে দিল। বাবার ফোন ছিল। তিনি এমন সব কথা বললেন যে আমি আর কোন কথায় বলতে পারিনি। আমার সাথে তিনি কোন সম্পর্কই রাখতে চাননা। তার কাছে পরী নামের যে কোন সন্তান ছিলো সেটা তিনি কখনো স্বীকার করেননা। সব থেকে খারাপ লেগেছে তিনি নীলিমা আন্টি কে এত অপমান করেছেন যে উনি ফোন আমাকে দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে অন্যরুমে চলে গেছেন। বাবাই কলটা আগে কেটে দিয়েছেন। আমার মাথা প্রচুর ব্যাথা করছে।
বর্ষাকাল তাই বৃষ্টির কোন কমতি নেই। আজ সকাল থেকেই গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। এখন বেশ জোড়েই বৃষ্টি হচ্ছে। আকাশেরও জল ঝড়ছে সাথে আমারও চোখের জল ঝড়ছে। বাবা কোনদিনই আমাকে বোঝার চেষ্টা করেননি আর আজ বুঝবে? এটা আশা করাটাও যেন এক চরম মাত্রার ভুল ছাড়া কিছুই নয়।

বিছানা থেকে উঠে দাড়ালাম। ঘড়িতে ১১.১৫ বাজে। নীলের রুমে আলো জ্বলছে। নিঝুম ঘুমিয়ে পড়েছে। ওয়্যারড্রপ থেকে ছাদের চাবিটা নিয়ে বের হলাম ছাদের উদ্দেশ্য। বৃষ্টিতে ভিজবো আজ। খুব করে ভিজবো। আজ বাবাকে যে কারনে কল দিয়েছিলাম সেটার কোন মূল্যই নেই বাবার কাছে। বরং নীলিমা আন্টিকে আমাকে দিয়ে ডেকে নিয়ে অপমান করলো। কি ভাগ্য আমার! যে আমার সাথে থাকে তাকেই বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। আমি কি এতটাই হতভাগ্য মেয়ে?
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ছাদে চলে এলাম। আকাশ চিরে কয়েকবার বিদ্যুৎ চমকালো। পানির দাপট যেন বেড়েই চলছে। ছাদের একাংশ জুড়ে মোটামুটি বড় একটা সুইমিংপুল রয়েছে। সেটাকে ক্রস কেটে উত্তর দিকে গিয়ে রেলিং ঘেষে দাড়িয়ে পড়লাম। নিচে একবার তাকাতেই মনে হতে লাগলো-
~” আচ্ছা, এখান থেকে ঝাঁপ দিলে কি খুব ব্যাথা পাবো? মাত্র কয়েক সেকেন্ডের অপেক্ষা। তারপরে চিরতরে মুক্তি। বাবা তো চায়না। শুভ্রও চায়না, যদি চাইতো তাহলে সে কখনো বিয়ে করতে পারতোনা। আমাকে তো কেউ চায়না। আমি সবার বোঝা ছাড়া কিছুই নয়। আমার জিবনটাই একটা ব্যার্থ ছাড়া কিছু নয়।”

কথাগুলো ভেবেই কিনারায় আর একটু এগিয়ে গেল পরী।
এমন সময় আদুরে গলায় কেউ পরী বলে ডেকে উঠলো। এমন ডাকে চমকে উঠে পিছন ফিরে তাকাতেই দেখলাম, কেউ ছাতা মাথায় দাড়িয়ে আছে। হাতে তার মাঝারি একটি কেক।
কেকটা দেখেই পরী কেকের ভিতরের কান্ডেলগুলো গুনতে লাগলো। এক এক করে ২৫টা ক্যান্ডেল টিমটিম করে জ্বলছে। ওর মুখ দিয়ে বের হয়েই গেল, “শুভ্র”।
শুভ্র একটু এগিয়ে গিয়ে বসার ছাতার নিচে কেকটা রেখে হাতের ছাতাটা বন্ধ করেই পরী দিকে চেয়ে বলল-
~” ওখানে কি করছো তুমি! আবার মনে উল্টাপাল্টা চিন্তা ভাবনা করছোনা তো?”
তুমি! তুমি এখানে কেন? তোমাকে না বলেছি আমার কাছে একদম আসবেনা! কেন এসেছ বল কেন বলেই পরী একটা জোড়ে চিৎকার দিল। তারপর পাগলের মত এদিক ওদিক চাইতে লাগলো।
পরীর এমন অস্থির চাহোনি দেখে শুভ্রই ভয় পেয়ে গেল। আল্লাহ্ ও কি করতে চাচ্ছে বলেই শুভ্র পরীর দিকে দৌড়ে গেল।
এই থামো বলছি থামো! আমি কিন্তু এখুনি এখান থেকে ঝাপ দিব নিচে। একদম আমার কাছে আসবেনা বলে নিচে তাকালো পরী।

রক্তক্ষরণ অপেক্ষা পর্ব ৫

শুভ্র পরীর কথা না শুনে দৌড়ে গিয়ে ওকে টেনে এনেই বুকের সাথে জাপটে ধরলো। শুভ্রর দম যেন বের হয়ে গিয়েছিল। অনেকক্ষন পরীকে জড়িয়ে ধরে থেকে
শুভ্র ওকে পরপর কিস করতে লাগলো। তারপর চিৎকার দিয়ে বলতে লাগলো-
~” কতবার বুঝাবো, কতবার জানাবো আমার জিবন তোকে ছাড়া চলবেনা। কেন বুঝিসনা? কেন তোকে বার বার বলতে হয় এসব কথা হুম?”
তুমি আমাকে ছাড়বা? শুভ্র তোমাকে ছাড়তে বলেছি আমি। আমায় ছাড়ো বলতেই শুভ্র ওকে আর কথা বলার সুযোগ দেয়না। পরীর ঠোট সহ সব কিছু গ্রাস করে ফেলে শুভ্র। পরী শুভ্রের বুকের ভিতরই ধস্তাধস্তি করা শুরু করে দেয়। শুভ্রও কম না। যা এতদিনও করেনি তাই আজ করে ফেলতে চায়। পরীকে দ্রুত কোলে তুলে নিয়েই পা বাড়ালো ছাদের কোনার রুমটার দিকে………
শুভ্র ভালো হচ্ছেনা কিন্তু বলেই পরী শুভ্রের বুকে আঘাত করতে লাগলো।

এর থেকে ভালো আর কিছু হতেই পারেনা তোমার জন্য। কথাগুলো বলেই দরজার কাছে এসে পরীকে নামিয়ে দিয়ে এক হাতে ওকে শক্ত করে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে অন্য হাতে পকেট থেকে চাবিটা বের করে দরজা খুলেই পরীকে এক প্রকার জোর করে টেনে নিয়ে গেল রুমের ভিতর। তারপর একএক করে সব লাইট জ্বালিয়ে পরীর দিকে চেয়েই বলল-
~” শুভ জন্মদিন আমার মায়াপরী। আমার সেবা-যত্ন করার জন্য হলেও তোমাকে ভালো থাকতে হবে। আমার প্রতিটা নির্ঘুম রাত্রির সমাপ্ত ঘটাতে তোমাকে আমার পাশে থাকতে হবে। আমাকে ভালো রাখার দায়িত্ব তোমাকে নিতে হবে। আমার সুস্থভাবে পৃথিবীতে বাচার জন্য তোমাকে বেঁচে থাকতে হবে। আমার সমস্ত কাজে তোমাকে থাকতে হবে।”
এবার পরী থেমে যায় শুভ্রর কথা শুনে। পরীর চোখমুখে রাগ যেন চুয়ে চুয়ে পড়ছে। পরী চোখমুখ শক্ত করে বলল-

~” আর যদি আমি না..ই থাকি তখন?”
যাতে তুমি থাকো সেই ব্যবস্থায় আজ করবো। তোমার ভালো চাইতে চাইতে আজ আমি তোমাকে হারাতে বসেছি। আর পারবোনা তোমাকে হারাতে। শুভ্র যাতে পরীর অক্সিজেন হয়ে যায় সেই ব্যবস্থায় করবো। অনেক হয়েছে, এর সমাপ্তি হওয়া দরকার বলেই শুভ্র ওর শার্টের বোতাম খুলতে লাগলো। তারপর কঠিন চোখে পরীর দিকে প্রশ্ন ছুড়লো শুভ্র………
নিশ্চয় তুমি বুঝতে পারছো আমি এখন কি করতে চলেছি…..

রক্তক্ষরণ অপেক্ষা পর্ব ৭