ভুলতে পারিনি তাকে পর্ব ১৫ || নীল ক্যাফের ডায়েরী

ভুলতে পারিনি তাকে পর্ব ১৫
Mahfuza Akter

—বাবা, আমি এখনি ধলা বিড়ালকে বিয়ে করতে চাই!
আরাফ আহসান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে শ্রুতির দিকে তাকিয়ে আছেন। আভাস শ্রুতির কথা শুনে মাথা তুলে তাকাতেই হিমশিম খাচ্ছে। সরাসরি কীভাবে মুখের ওপর বলে দিলো? তারওপর এই নামে সম্বোধন! আভাস ভেতরে ভেতরে মিইয়ে গেলেও শ্রুতি একদম ভাবলেশহীন ভাবে দাঁড়িয়ে আছে, যেন সে খুবই নরমাল একটা কথা বলেছে।
—কাকে বিয়ে করতে চাও???
আরাফ আহসানের বড়ো বড়ো চোখের দিকে তাকিয়ে তন্ময় ঠোঁট কামড়ে হাসি কন্ট্রোল করছে। শ্রুতি আভাসকে দেখিয়ে বললো,

—এই যে, এটাই আমার ধলা বিড়াল! ওকেই বিয়ে করবো আমি আর এখনি বিয়ে করবো।
আরাফ আহসান রাগত স্বরে বললো,
—তুমি আভাসকে বিয়ে করতে চাইছো? এই ছেলেটাকে কেন ভুলতে পারছো না? ও তোমাকে স্ত্রী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে নারাজ। লিগ্যাসি অনুযায়ী যেহেতু আমি তোমার বাবা, সেহেতু তোমায় এমন কারো হাতে কখনো তুলে দিতে পারবো না। এখন তুমি আমার কথা মানবে কিনা, সেটা একান্তই তোমার ব্যাপার।
শ্রুতি আরাফ আহসানকে আলাদা নিয়ে গিয়ে কিছুক্ষণ কথা বললো। ওনার মুখে রাগের আভা দেখা যাচ্ছে। আভাস বুঝতে পারছে, হয়তো শ্রুতি ওনাকে সব সত্য বলে দিয়েছে।
আরাফ আহসান আভাসের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,

আরও গল্প পরতে ভিজিট করুন

— তোমার বাবা আমার অনেক প্রিয় ও কাছের মানুষ ছিল। সেজন্য তিনি মারা যাওয়ার পর আমি তোমাকে আর স্নেহাকে নিজের সন্তানের মতোই দেখি। তাই স্নেহাকে নিজের পুত্রবধূ করতেও রাজি হয়েছি। কিন্তু তোমার মা………..! যাই হোক, এখন বলো অদ্রিতাকে তুমি সুখে রাখতে পারবে কি না?
আভাস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

—যেখানে আমার জন্মদাত্রী মা-ই শ্রুতির সবচেয়ে বড় শত্রু, সেখানে আমাদের বিয়ে হলে শ্রুতির জীবনে অনেক অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হবে। এজন্য সত্যটা শোনার পর ওকে আমি নিজের সাথে বাঁধতে চাইনি। ওর হাত ছেড়ে দেওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত এই দুটো মাস আমি কীভাবে কাটিয়েছি, সেটা শুধু আমিই জানি। তবে এতোটুকু বুঝতে পেরেছি যে, শ্রুতিকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না, এজন্যই সবসময় ওর আশেপাশে থাকতাম। কিন্তু আজ তো সবটা ক্লিয়ার হয়ে গেল, তাই আমিও শ্রুতির আবদার পূরণ করবো। আর দূরে ঠেলে দিবো না ওকে, ভালোবেসে আগলে রাখবো। কতটুকু রক্ষা করতে পারবো জানি না, তবে এটুকু বলতে পারি যে, শ্রুতিকে স্পর্শ করার আগে আমার মৃত্যু নিশ্চিত করতে হবে।
আভাসের কথা শুনে আরাফ আহসান একটা প্রসন্নের হাসি দিলেন।

আভাসের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ঢোকের পর ঢোক গিলছে শ্রুতি। এতো তাড়াতাড়ি আরিহা খানের মুখোমুখি হতে চায়নি সে। কিন্তু আরাফ আহসান শর্ত জুড়ে দিয়েছেন যে, বিয়ের পর শ্রুতিকে আগে আরিহা খানের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। আরিহা খানের সামনে নিজের স্ত্রী হিসেবে পরিচিতি দিতে হবে। আভাসও এতে কোনো আপত্তি জানায়নি।

—কী হলো? এতো কাপাকাপি করছো কেন? ভয় করছে?
নিজের কানে আভাসের ফিসফিসানি শুনে শ্রুতি ভীত দৃষ্টিতে আভাসের দিকে তাকালো। শ্রুতির ডান হাতের পাঁচ আঙুলের ফাঁকে নিজের বাঁ হাতের আঙুলগুলো গুঁজে দিয়ে শক্ত মুঠোয় আঁকড়ে ধরে বললো,
—কালরাতেও তো কেমন বাঘিনীর রূপ দেখালে! আমায় মেরেছো, গলা টিপে ধরেছো! এখনো ভুলিনি কিন্তু! বিয়ে যেহেতু হয়ে গেছে, সেগুলোর উশুল কড়ায়-গণ্ডায় আদায় করে নেব।
শ্রুতি করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
—মানে??? কী করবেন আপনি?
আভাস শ্রুতির হাত ধরে টেনে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললো,
—আমাদের তো এখনো বাসর হয়নি, তাই না?
শ্রুতি নিজের মুখে হাত দিয়ে বললো,

—কী বাজে আপনি!!! এই আপনি না একজন প্রফেসর? আপনার কাছ থেকে লোকে ভদ্রতা শিখবে কীভাবে? আপনি তো নিজেই একটা অভদ্র লোক!
আভাস হাঁটা থামিয়ে শ্রুতির দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,
—কী বললে? আমি অভদ্র?
—তা নয়তো কী? দেখলে তো মনে হয়, ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানেন না! লোকে তো আর জানে না, আপনার মুখের কোনো ব্যালেন্স নেই!
—সামান্য বাসরের কথা বলেছি বলে আমি খারাপ হয়ে গেলাম? এটা তো সাধারণ একটা ব্যাপার! এখানে ব্যালেন্স-ইমব্যালেন্স থাকার কী আছে?

—হয়েছে, হয়েছে। এমনিতেই রাজশাহী টু ঢাকা জার্নি করে ক্লান্ত লাগছে আমার। আপনার গাড়িতে একটুও শান্তি পাইনি। এখন ভেতরে যেতেও কেমন কেমন লাগছে!
আভাস শ্রুতির দিকে কিছুক্ষণ নির্বিকার ভাবে তাকিয়ে রইলো। হুট করেই ওকে কোলে তুলে নিয়ে রাগী স্বরে বললো,
—তোমার টায়ার্ড লাগছে এই কথাটা আমায় আগে বলবে না? আমি কি তাহলে এতোক্ষণ তোমায় দাঁড় করিয়ে রাখতাম?
—আরে, আরে! আপনি আমায় কোলে নিয়ে ভেতরে যাবেন নাকি? নামান! নামান! আমার পা আছে, হেঁটে যেতে পারবো।
—নো ওয়ে। পরে যদি আবার অসুস্থ হয়ে পড়ো, তখন! আমি তোমাকে নিয়ে কোনো রিস্ক নিতে পারবো না। এক্সট্রিমলি সরি ফর দ্যাট!
শ্রুতি অবাক হয়ে বললো,
—হাঁটলে অসুস্থ হয়ে যাবো?
—হতেও পারো। ঠিক নেই।

বলেই বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল আভাস। বাড়িতে তেমন কাউকে দেখা যাচ্ছে না। ডাইনিং টেবিলের দিকে নজর দিতেই দেখে আরিহা খান বসে বসে ব্রেকফাস্ট করছে। শ্রুতি তাকে দেখে আভাসের বুকে মুখ লুকিয়ে ফেলে। চোখ দিয়ে অঝোরে পানি ছেড়ে দিলো সে। আরিহা খানকে দেখেই সেদিন তার ওপর ঘটে যাওয়া হিংস্রাত্মক কার্যকলাপের কথা মনে মনে গেছে তার। কীভাবে পারলেন তিনি মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়েকে এভাবে খুন করার চেষ্টা করতে।
আভাস নিজের বুকের দিকের পাঞ্জাবি ভেজা ভেজা অনুভব করছে। এমনিতেই আরিহা খানকে দেখে মেজাজটা বিগড়ে গেছে, এখন শ্রুতির কান্না দেখে পায়ের রক্ত মাথায় উঠে যাওয়ার উপক্রম।

—আমার দিকে তাকাও।
আভাসের কথা শুনে কান্না থেমে গেল শ্রুতির। এতোক্ষণ তার মনেই ছিল না সে কারো কোলে চড়ে বসে আছে।
—কী হলো? আমি তোমাকে আমার দিকে তাকাতে বলছি না?
আভাসের ধমক খেয়ে শ্রুতি কেঁপে উঠে চট করে অশ্রুভেজা চোখে তাকাতেই তার দুচোখ দিয়ে দ্বিগুন গতিতে পানি ঝড়তে থাকে। মুখের বাঁ পাশটা শাড়ির আঁচল দিয়ে ঢাকা থাকায় সেই আঁচল টাও ভিজে গেছে অনেকটা। আভাস শ্রুতির দুচোখের কার্ণিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়া পানিগুলো নিজের ঠোঁট দিয়ে পরম আবেশে মুছে দিলো। শ্রুতি তার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। আভাস শ্রুতির কপালে ঠোঁট ছুইয়ে দিয়ে বললো,

—হাত দুটোকে তো তোমার কাজে এনগেজড বানিয়ে দিয়েছো! এখন কি ঠোঁট আর চোখ দুটোও দখল করতে চাও? কান্না থামাও জলদি! নয়তো আরিহা খান আর কাজের মানুষগুলোর সামনে ভয়ংকর অভদ্রতা করে ফেলবো।
শ্রুতি ভয়ে কাচুমাচু হয়ে আবার আভাসের বুকে মুখ গুঁজে দিলো। আভাস শ্রুতির কান্ড দেখে নিঃশব্দে হাসলো। কিন্তু সেটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না, কারণ খাওয়া শেষে সামনে এগুতেই আরিহা খান আভাস আর শ্রুতিকে দেখে তাদের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তিনি আকাশ ছোয়া বিস্ময় নিয়ে বললেন,
—এসবের মানে কী আভাস? তুমি এই ভোর-সকালে কাকে কোলে তুলে বাড়িতে নিয়ে এসেছো? বউ সাজের এই মেয়েটি কে?
আভাস নির্লিপ্ত ভাবে বললো,

—আপনার কি মনে হয় আমি অন্যের বউকে কোলে তুলবো? আমার পোশাক দেখে কি বরের মতো লাগছে না?
আরিহা খান যেন আকাশ থেকে পড়লেন। তার ছেলে শ্রুতিকে ভুলে অন্য কাউকে বিয়ে করেছে ভাবতেই মনটা পুলকের আবেশে ভরে উঠছে তার! মুখে হাসির ঝিলিক ফুটিয়ে বললেন,
—সত্যিই তুই বিয়ে করেছিস? তোর অন্য কোথাও পছন্দ আছে সেটা আমাকে বললেই পারতি। আমাকে বললে কি আমি মানা করতাম নাকি?
আভাস আরিহা খানের কথায় পাত্তা না দিয়ে শ্রুতির দিকে তাকিয়ে বললো,
—তোমার কি খুব বেশি খিদে পেয়েছে, মিষ্টিপাখি? আগে কি খেয়ে নিবে নাকি ফ্রেশ হয়ে খাবে? আমি তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছি, শ্রুতি?
আরিহা খান অবাক হয়ে বললো,

—মিষ্টিপাখি, শ্রুতি, এসব কী আভাস? একটা মরা মানুষকে বারবার টেনে আনিস কেন তুই?
আভাস চোখ মুখ শক্ত করে বললো,
—মিসেস খান, আমি অনেকবার আপনাকে ওয়ার্নিং দিয়েছিলাম ঐ ওয়ার্ড দুটো শ্রুতির ব্যাপারে ইউজ না করতে! শ্রুতি তো আপনার সামনে আমার কোলে বসে আছে!
বলেই শ্রুতিকে বললো আরিহা খানের দিকে তাকাতে। কিন্তু শ্রুতি একভাবেই মুখ লুকিয়ে আছে। আভাস আর কোনো উপায় না পেয়ে শ্রুতিকে কোল থেকে নামিয়ে আরিহা খানের দিকে ঘুরিয়ে একবার দেখিয়ে আবার কোলে তুলে নিলো।
আরিহা খানের মাথায় যেন বাজ পড়লো। অস্ফুটস্বরে বললো,

ভুলতে পারিনি তাকে পর্ব ১৪

—শ্রুতি!!!
আভাস তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
—অবাক হচ্ছেন? বিশ্বাস হচ্ছে না, তাই না? অবশ্য সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কী বলুন তো? যার জুড়ি উপর থেকে সেট করা, তাদের মিল হবেই। মাঝখানে কোনো শকুনের দৃষ্টি পড়লেও কিছু বিগড়ে যাবে না।
আরিহা খান রাগী স্বরে বললেন,
—আভাস, এসব কী বলছিস তুই? এই মেয়েটা কীভাবে বেঁচে আছে, সেটা আমি জানি না। কিন্তু তুই ওকে কোন আক্কেলে বিয়ে করেছিস? ওর চেহারা দেখেছিস? এই মেয়ের কোনো যোগ্যতা নেই তোর পাশে দাঁড়ানোর। ও আরিহা খানের পুত্রবধূ হতে পারে না, আর না পারে আরহাম খানের বউ হতে।
হঠাৎ আভাসের পেছন দিকে থাকা মেইন ডোর দিয়ে আরাফ আহসান, তানিয়া আহসান ও তন্ময় বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো। আরাফ আহসান মুখে হাসি ঝুলিয়ে বললেন,

—আমার ছেলে-মেয়ে দুটোকেই তো আপনার ছেলে-মেয়ে দখল করে নিল! আমরা তো পাকাপোক্ত সম্পর্কে আবদ্ধ হয়ে গেলাম!
আরিহা খান কথার মর্মার্থ না বুঝে বললেন,
—আপনার ছেলে-মেয়ে মানে?
তানিয়া আহসান দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
—শ্রুতি আমাদের একমাত্র মেয়ে। আমার কলিজার একটা অংশ। রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও আত্মার সম্পর্ক আছে, সেটা মনে রাখবেন। এই বাড়িতে ওর যদি কোনো অমর্যাদা হয় বা ক্ষতি হয়, তাহলে আমি যে কী করতে পারি সেটা কল্পনাও করতে পারবেন না!

ভুলতে পারিনি তাকে পর্ব ১৬