খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৪

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৪
আভা ইসলাম রাত্রি

শাড়ির আঁচল মেঝেতে লেপ্টে আছে। চিত্রা ঘরের দখিনা জানালায় মাথা ঠেকিয়ে কেমন নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টিসীমা অদূরের বাগান বাড়ির দিকে। বাগান বাড়ি তো নয়, যেন সাক্ষাৎ রূপকথার প্রাসাদ। বাড়ির চতুর্দিকে ফুলের বহর। তাজা ফুলের ঘ্রাণ বয়ে আসছে এ বাড়ি অব্দি। ফলের গাছেও পাকা ফল ধরেছে। চিত্রা কখনও এমন বাড়ি দেখেনি। আগে শুনে এসেছে নেতা বাড়ির সৌন্দর্যের কথা। অথচ এখন, সব কেমন অবিশ্বাস্য বোধ হচ্ছে তার।

চিত্রার মাথার চুলে ঢিলে খোঁপা বাঁধা। এই বুঝি খুলে চুলের বহর গড়িয়ে পরল পিঠময়। শেহজাদ গোসলে গেছে। খানিক পর বেরিয়ে এল ফতুয়া-লুঙ্গি পরে। আনমনা চিত্রার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘কি হয়েছে? মন খারাপ করে আছো কেন?’
চিত্রা আচমকা এমন কথায় ভাবনার বিচ্ছেদ ঘটল। চট করে জানালার পাশ থেকে সরে এল। মাথায় ঘোমটা টানতে টানতে বলল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘ওমন কিছু না। আইজকের সকাল কি সুন্দর! ওটাই দেখতাছি।’
শেহজাদ কিছুটা উঁকি দিয়ে জানালার পাশে তাকাল। বাইরে কুয়াশা পরেছে। শীতের ঋতু আসার উপক্রম। কুয়াশা পরলে শেহজাদদের বাড়ি ভীষন নজর কাড়ে সবার। শীতের ফল-ফুলে ভরে যায় আয়ুষ্মান মহলের বাগান। তখন দিনের বেশিরভাগ সময় এ বাড়ির পুরুষরা সময় কাটায় বাগান বাড়িতে। শেহজাদও যায় মাঝেমধ্যে। শেহজাদ আলমারির দিকে এগিয়ে যায়। এতক্ষণ কথা চেপে রেখেছিল। শেহজাদ থেকে আশকারা পাওয়ায় চিত্রা পাশ থেকে কেমন মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বলল,
‘আজ দাওয়াতে কে কে আইবেন?’

শেহজাদ ততক্ষণে লুঙ্গি-ফতুয়া পাল্টে পাঞ্জাবি-পায়জামা পরে নিয়েছে। আলমারি ঘেঁটে আতর বের করল। নিজের শরীরে আতর মেখে আয়নায় চোখ রাখল। চিত্রার কথায় সে উত্তর দিল,
‘তোমার আব্বাকে আসতে বলা হয়েছে। তিনি বলেছেন আসবেন। তোমাকে যাওয়ার আগে দেখে যাবেন।’

এ কথা শুনে চিত্রার মুখখানা কেমন ঝলমলিয়ে উঠল। খুশির চোটে শরীর ঝাঁকিয়ে উঠল তার। ঝাঁকুনিতে চুলের খোঁপা খুলে এবার সত্য-সত্য কোমড় অব্দি ছড়িয়ে গেল। খোলা চুলে চিত্রাকে দেখতে কেমন যেন লাগল শেহজাদের। এমন করে চিত্রাকে দেখা হয়নি কখনও। চিত্রার এহেন রূপে বিব্রত হল শেহজাদ। চোখ ঘুরিয়ে অন্য পাশে ফাইল নিয়ে চলল। চিত্রা নিজের অবস্থা বুঝে দ্রুত হাত দিয়ে খোঁপা করল চুল। মাথায় ঘোমটা টেনে শেহজাদকে জিজ্ঞেস করল,

‘চা করমু?’
শেহজাদের ভ্রু কুঁচকে গেল। সে হাতে ফাইল রেখে ভ্রু কুঁচকে চিত্রার দিকে তাকাল। চিত্রা এমন চাওনিতে ভয়ে ছটফটিয়ে উঠল। কোণঠাসা হয়ে তাকাল শেহজাদের দিকে। শেহজাদ স্বাভাবিক হল। হাতের ফাইলটা বিছানার উপর রেখে আঙুল দিয়ে ডাকল চিত্রাকে,
‘এদিকে এসো।’
চিত্রা ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে শেহজাদের দিকে এগিয়ে গেল। বিছানার একদম কোণে বসল নত মুখে। শেহজাদ জিজ্ঞেস করল,

‘কোন ক্লাস অব্দি পড়াশোনা করেছ?’
চিত্রা উত্তর দিল, ‘অষ্টম কেলাশ।’
‘ক্লাসে শুদ্ধ ভাষা শেখায় নি?’
‘শিখাইসে। ওত কঠিন ভাষা আমি বলবার পারি না। দাঁতে লাগে।’
‘শুদ্ধ ভাষায় কথা বলা সুন্দর। একবার শিখলে আর কঠিন লাগবে না। শিখতে চাও?’
চিত্রার মনে পরল, এ বাড়িতে থাকার আরো একটা নিয়ম হচ্ছে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলা। তাই সে উত্তর দিল, ‘হ, শিখমু।’
শেহজাদ শেখানো শুরু করল, ‘শিখমু না, বলো শিখব।’

চিত্রা তোতাপাখির ন্যায় বলল, ‘শিখব।’
শেহজাদ বলল, ‘কেলাশ নয়, বলো ক্লাস।’
চিত্রার এবার মুখে কথা বাধছে। সে কষ্ট করে এটুকু বলল, ‘ক্লেলাশ।’
শেহজাদ শুধরে দেবার চেষ্টা করে বলল, ‘ ক্লেলাশ না, ক্লাস। ক্লা-স।’
চিত্রা চোখ মুখ খিচে বলল, ‘ক্লাশ।’
‘ক্লাশ না, ক্লা-স।’
‘ক্লাস।’

শেষ অব্দি চিত্রা শিখতে সক্ষম হল। শেহজাদ এতে আশ্বস্ত হল। পুনরায় বলল, ‘বলো, আপনি কেমন আছেন।’
চিত্রা মুখে বুলি পড়ানোর মত করে আবারও বলল, ‘আফনি কেমন আছেন?’
চিত্রার এমন শব্দের উচ্চারণ দেখে যে কেউ স্থানে বসে হাসতে বাধ্য। অথচ শেহজাদ হাসল না। বরং ভীষন ধৈর্য্য নিয়ে শেখাল,

‘আফনি না, এটা হবে আপনি। বলো আ-প-নি।’
‘আপনি?’
‘হয়েছে। বলো, আমি ভালো আছি।’
‘আমি বালো আছি।’
‘না, এটা হবে ভালো। ভাল্লুকের ভা। ভালো আছি। বলো?’
‘ভালো আছি।’
‘আজকের মত এটুকু। এখন যাও, চা বানাও সবার জন্যে। আমি বসার ঘরে যাচ্ছি। ওখানেই চা পাঠিও।’

গ্রামের মানুষকে দাওয়াত দিয়ে এনে আয়ুষ্মান পরিবার বিপাকে পরলেন যেমন। কেউ নেতার পরিবারের মান রক্ষার্থে ভালো কথা শুনালেও, কেউ কেউ পশ্চাতে চূড়ান্ত অপমান করতে ছাড়ছে না। চিত্রা রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে প্রথমবারের মত শ্বশুরবাড়িতে গরুর মাংস রান্না করছে। রেখা পাশে দাঁড়িয়ে তরকারিতে মশলার বিষয়টা দেখিয়ে দিচ্ছেন। চিত্রার রান্না করা শেষ হলে, রেখা চামচের আগা দিয়ে তরকারির স্বাদ পরীক্ষা করেন। রেখার মুখের আদল দেখে চিত্রা বুঝতে পারল, তার রান্না সুস্বাদু হয়েছে। এতেই যেন তৃপ্তিতে উচ্ছল হয়ে উঠল চিত্রা। রেখা রান্নার স্বাদ ভালো লাগলেও, মুখে সেট স্বীকার করলেন না। বরং বললেন,

‘ভালোই। তবে এমন রান্না এ বাড়ির বউরা রাঁধে না। এ বাড়ির বউদের রান্না তাজা তাজা রাধুনীকেও হার মানায়। তোমাকেও তেমন করেই রাঁধতে হবে, সুভা বউ। মনে রেখো। এখন আমার সঙ্গে আসো। মেহমানদের জিগাবালা করতে হবে।’

চিত্রার কিন্তু এ কথা শুনে এটুকু কষ্টও হল না। বরং সে বুঝতে পারল, তার শাশুড়ি অন্যের প্রশংসা করার চেয়ে নিজের প্রশংসা করতে বেশি ভালোবাসেন। এ বাড়ি নিয়ে তার গর্বের অন্ত নেই তাও চিত্রার বুঝে এল। চিত্রা মৃদু হাসল। মাথায় ঘোমটা টেনে বাধ্য বউয়ের মত পেছনে পেছনে চলল রেখার।
‘এই হচ্ছে আমাদের বাড়ির নয়া বউ, শিউলির মা। সুভা বউ, উনাকে পায়ে ধরে সালাম করো।’
চিত্রা ঠিক তাই করল। হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল,

‘আপনি কেমন আছেন?’
রেখা বিস্মিত হলেন। চিত্রা তো সবসময় ‘আপনি’-কে ‘আফনি’ বলে এসেছে। এখন হঠাৎ এমন শুদ্ধ করে কথা বলছে কিভাবে তা তিনি বুঝতে পারলেন না। তবে তাতে কিছু না হলেও, মনেমনে নিজের সম্মান টিকে আছে বলেই খুশি হলেন। যার কাছেই শিখুক, শিখেছে যে সেই ঢের। শিউলির মা হেসে বললেন,

‘ওমন রাজার মত পোলার লাইগা এ কালা বউ আফনার মনে ধরল গো, নেতা বউ?’
যেটুকু খুশি ছিলেন রেখা, সেটুকু যেন পানির ঢেউয়ে ভেসে গেল। মুখ কালো করে আড়চোখে চিত্রার দিকে চেয়ে বললেন,
‘মেয়ের বিয়ে ভেঙে গিয়েছিল। তাই খোকা বিয়ে করে এনে মরণের দোয়ার থেকে বাঁচিয়েছে। নাহলে এমন কালো বৌ এ বাড়িতে রুচে না, জানোই তো শিউলির মা।’

চিত্রার মুখখানা অপমানে নীল হয়ে গেল। থমথমে চেহারার চেয়ে শুনল ওসব তীক্ষ্ম বুলি। শিউলির মা হেসে হেসে তাল মেলালেন রেখার সঙ্গে। তার সঙ্গে কথা বলা শেষ হলে রেখা চিত্রাকে টেনে এক পাশে নিয়ে গেলেন। ঝরঝরে গলায় বললেন,

‘শুনো মেয়ে, এমন কালো থাকলে আমাদের মান সম্মান আর কিছুই থাকবে না। দেখো নি সবাই কি যা তা বলছে? আমার তো কাউকে মুখ দেখাতেই ইচ্ছে করছে না। ছিঃ, ছিঃ।’
চিত্রা অসহায় কণ্ঠে বলল, ‘ আল্লাহর দেওয়া গা’র রং কেমনে বদলামু, আম্মাজান?’

রেখা উত্তর দিলেন, ‘কেমনে কি? কিভাবে বলবে। আর বদলানো যাবে। আজকাল অনেক ক্রিম আছে। খোকাকে বলব, তোমাকে এনে দিতে। মাসের মধ্যে সাদা হতে হবে তোমাকে। খোকাকে আজকেই বলব আমি। শহরে গেলে এনে দিবে।’
চিত্রা মাথা নাড়িয়ে সায় দিল। যদি গায়ের শ্যামা রঙ পরিবর্তন করে সাদা হয়ে এ বাড়ির সম্মান থাকে, তাহলে তাই সই। চিত্রাকে নিয়ে একে একে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন রেখা।

তবে চিত্রার ভেজা চোখ তার বাবাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। নিশ্চয়ই পুরুষদের মহলে বসে চিত্রার জন্যে অপেক্ষা করছেন বাবা? বাবার চিন্তায় চিত্রার মন কেমন করছে। ছুটে যেতে ইচ্ছে করছে বাবার কাছে। বাবা যাবার আগে দেখা করে যাবেন বলেছেন। খাওয়া তো শেষ, তাহলে এখনো কেন কেউ তাকে ডাকছে না?

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৩

আজকে একবার অন্তত বাবার সঙ্গে দেখা করতে চায় চিত্রা। নিজের দুঃখের গল্প শোনাতে চায় তাকে। বুকের কষ্ট যে আর বুকে ধরে না। উপচে পরতে চায়। কার কাছে পাতবে তার দুঃখবুলি? কাকে বুঝাবে যন্ত্রণার একাংশ? কে শুনবে, বাবা ছাড়া? কেউ যে শোনার নেই।

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৫