মনের কোণে পর্ব ২৯

মনের কোণে পর্ব ২৯
আফনান লারা

মধ্য রাতের আকাশে ভাসা গুঞ্জন,মেঘে লুকানো চাঁদের কিঞ্চিত আলোর সাথে মিশে আছে নতুন প্রেম।বিবাহের পরের প্রেম।
দু শরীরের স্পর্শে কাতর হয়ে যাওয়া এক যুগল সৃষ্টি করে ফেললো তাদের দুজনের প্রথম ভাল লাগা।
খেলার ছল থেকে তারা অনেক আগেই বেরিয়ে গেছে তাও আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকতে যে ভীষণ ভাললাগে।এই অনুভূতি এত মধুর কেন মনে হয়?কেন সারাক্ষণ এভাবে থাকার প্রতিজ্ঞা করতে ইচ্ছে হচ্ছে?

চোখ বন্ধ করে ভাল লাগার শেষ সীমানা পেরিয়ে গেছে দুজন।সময় কেটে যাচ্ছে।পেঁচার ডাক শোনা গেলো তখন।সে যেন তাদের সতর্ক করে দিলো।তার ডাকে দুজনে আলাদা হয়ে দুদিকে ফিরে গেছে।
কি সুন্দর ছিল মূহুর্তটা।যদি আবারও জড়িয়ে ধরা যেতো।কিন্তু সামনের মানুষটা কি ভাববে ভেবে আর তাদের দুজনের জড়িয়ে ধরা হলোনা।
নাবিল পা চালিয়ে বললো,’চলো ফিরে যাই’
লিখিও দেরি না করে ওর পিছু চললো।বাসায় ফিরেও দুজনে দুদিকে ফিরেই ঘুমিয়ে পড়েছিল।আর একটি কথাও তাদের মাঝে হয়নি।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মজা করতে করতে তারা আজ অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে যার কারণে সেটা হজম করতে অনেককাল নিরবতা বয়ে যাচ্ছে সম্পর্কের মাঝে।
পরেরদিন খুব ভোরে নাবিল উঠে গেছে,আজান শোনা যায়।লিখি ওর বালিশে মুখ গুজে ঘুমাচ্ছে,তাকে জাগিয়ে তুলতে ইচ্ছে হলোনা তাও নামাজ পড়ার জন্য ডাকলো দুবার।তারপর সে নিজেই পড়তে গেলো।নাবিলের ডাকে লিখি জেগেছে ঠিক কিন্তু উঠতে পারছিলনা আলসেমির কারণে।বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে এপাশ ওপাশ করতে করতে দশ মিনিট নষ্ট করেছে।নাবিলের পড়া শেষ।সামনের রুমে পড়ে এসে দেখলো লিখি হাত পা নাড়াচ্ছে এখনও।

‘জাগছো যখন,নামাজটা পড়ে নাও’
‘হুম’
নাবিলের কথায় জোর পেলো উঠার।মাথায় হাত দিয়ে চললো ওয়াশরুমের দিকে।চোখে ছিল ঘুমের রেশ, সামনে ঝাপসা দেখছিল বলে ঠাস করে নাবিলের গায়ের সঙ্গে লেগে গেছে এক ধাক্কা।নাবিল ওর কাঁধ ধরে ঝাঁকিয়ে বললো,’এত ঘুমালে হয়?’
এবার পুরোপুরি হুশ ফিরে এসেছে ওর।চোখ বড় করে সে সত্যি সত্যি ওয়াশরুমে ঢুকেছে এবার।
নাবিল আর ঘুমাবেনা ঠিক করে ল্যাপটপ নিয়ে বসলো।হাজারটা কাজ এসে জমে আছে।এই সব কাজ কমপ্লিট করতে করতে দুপুর বারোটা বাজবে।
লিখি নামাজ পড়ে এবার পুরো বাসায় ঘুরঘুর করছে।নাবিল ঘুমাবেনা বলে সেও ঘুমাবেনা ঠিক করেছে।
কাজ নেই তো খৈ বাজতে হবে।খৈ নেই তো নাবিলকে জ্বালানো ছাড়া আর কোনো কাজ নেই।

নাবিলকে ইদানিং জ্বালানোর ইচ্ছা করেনা।সে কেমন দুষ্টু হয়ে গেছে।এ কথা ওর মনে পড়লো এক মগ পানি নিয়ে নাবিলের মুখে ঢালার পর।
হুশ আসলো নাবিল এখন আর ঐ নাবিল নেই যে বালিশের মা/র খেয়ে আবার বালিশ দিয়ে মা/রবে।সে এখন বালিশের সাথে চেপে ধরবে, তার মাথায় যে পরিমাণ দুষ্টু বুদ্ধি ঢুকেছে।
পানি ঢালার পর নাবিল হাত দিয়ে ল্যাপটপ টাকে শান্তভাবে সরিয়ে রাখলো,এরপর হাত দিয়ে আবার মাথার চুল থেকে পানি চিপে ফেললো নিচে।তারপর সে মাথা তুলে লিখির দিকে তাকালো।লিখি সরি বলে এক দৌড়ে অন্য রুমে ঢুকে ভেতর দিয়ে দরজা লাগিয়ে ফেলেছে।
নাবিল ওকে ধরতে পিছু পিছু এসেছিল,দরজা বন্ধ দেখে তাতে হাত রেখে বললো,’বের হবেনা ভাবছো?আমি সারাদিন এখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করবো তোমার,দেখি কতক্ষণ না বেরিয়ে থাকতে পারো।আজ তোমার একদিন কি আমার একদিন’

লিখি ভয়ে নিচে বসে দরজার নিচ দিয়ে দেখছে নাবিলের পা দেখা যায় কিনা।নাবিল গোল হয়ে দরজার সামনে বসে আছে দেখে লিখির আরও ভয় হলো।গলাটা নামিয়ে বললো,’আপনি এক মগ ঢেলে দিয়েন।ইকুয়েল হবে তাহলে’
‘সকাল সকাল পানি দিয়ে ভেজানো কত বিরক্তিকর তার পরেও সবসময় তুমি সকালেই আমাকে ভেজাবে, এর শাস্তি তোমায় এক মগ দিয়ে দেওয়া যাবেনা।তোমাকে কোলে তুলে বাথটাবে চুবালে শাস্তি পূর্ণ হবে’
লিখির গলা শুকিয়ে গেছে ভয়ে।ঢোক গিলে সেও নিচে বসলো।নাবিলকে বোঝানোর জন্য কত কি সান্ত্বনা দেওয়া শুরু করলো, একটার পর একটা।
একটা সময়ে নাবিল মিষ্টি করে বললো ছুঁয়েও দেখবেনা।লিখি যেন দরজাটা খোলে।লিখির কাছে কথাটা একবার সত্যি মনে হলো তো আরেকবার মিথ্যে।
তাও মনকে বুঝিয়ে সে দরজা আলতো করে খুললো।ওপারে নাবিল নেই বলে দম ফেলে বাইরে পা রাখলো সে।

সেই মানুষটার গায়ের গন্ধ তীব্র আকারে বাতাসে বইছে।লিখি সামনে দেখে যেইনা পেছনে তাকালো ওমনি নাবিল দুহাত খপ করে ধরে ফেললো ওর।সে তো ভয় পেয়ে তোতলাতে তোতলাতে বলছে যেন এক মগেই কাজ সারে।
নাবিল হলো নাছোড়বান্দা,টেনে হিঁচড়ে ওকে নিয়ে গেছে ওয়াশরুমে।সেখানে বালতি থেকে যত মন চাইছিল তত পানি নিয়ে নিয়ে লিখির মাথায় ঢেলেছে।মনমত পানি দিয়ে নাকানিচোবানি খাইয়ে তারপর ক্ষান্ত হলো সে।
লিখি ভেজা বেড়ালের মতন সে আছে নিচে।
নাবিল খিলখিল করে হেসে বললো,’তোমার এই দুষ্টামিতে তালা মে/রে দিলাম।আর জীবনে আমার গায়ে পানি ঢালার আগে হয়ত দশবার ভাববে।’

সকাল সকাল ভিজলে সর্দিটা জলদি ধরে ফেলে।নাবিল দিচ্ছে একটা হাঁচি আর লিখি দুইটা করে।নাবিলের হয়ত সর্দি লাগেনি তবে লিখির লেগে গেলো।নাক মুছতে মুছতে ঘুরেফিরে সেই নাবিলের পাশেই এসে শুয়েছে।নাক টানছে আর বিড়বিড় করে বকা দিচ্ছে ওকে।নাবিল টাকা ঠেলে দিয়ে বললো গিয়ে হিসটাসিন কিনে আনতে।লিখি রাগ করে মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে ফেলেছে।এখন ঔষুধ না খেলে তো এই সর্দি আরও বেড়ে যাবে।বাধ্য হয়ে ল্যাপটপ সরিয়ে নাবিল বের হলো ঔষুধ কিনতে।রাগের চোটে লিখি একটা কথাও বলেনি ওর সাথে।

ঔষুধের দোকান একেবারে মামার বাসার ওপারে।বাবার রাখা লোকগুলো তাকে না চিনলেই হয়।ভয়ে ভয়ে সে পথ এগোলো,আসার সময় মাস্কটাও আনতে ভুলে গেছে। মামার বাসার সামনের দোকানটায় বসা ছিল নীল শার্ট পরা সেই গার্ড।বসে বসে চা খাচ্ছিল বিসকুট চুবিয়ে।তিনি নাবিলকে পেছন থেকে দেখেই চিনে ফেলেছেন।নাবিল যখন এসএসসি পরীক্ষা দেয় তখন থেকে তিনি জনাব অনাবিলের হয়ে কাজ করে আসছেন।নাবিলকে কতবার কলেজে নামিয়ে দিয়েছেন গাড়ী করে।ওকে না চিনলে কাকে চিনবেন?
ফোন বের করে সোজা অনাবিলকে কল করলেন তিনি।
অনাবিল মর্নিং ওয়াকে গিয়েছিলেন বলে ফোনটা রুমেই ফেলে রেখে গেছেন।কলটা ধরলো সামিয়া।

কিন্তু ঐ লোকটা সামিয়াকে কিছু বললোনা।শুধু বললো স্যার আসলে যেন জানায়।
সামিয়াও কিছু বুঝতে পারেনি।অনাবিল ফেরার পর তার হাতে ফোন দিয়ে বললেন একজন কল করেছিল।অনাবিল নাম্বার দেখে বুঝতে ওেরেছে কোনো ইনফরমেশন আছে।তাই তিনি দেরি না করে কলব্যাক করলেন।সঙ্গে সঙ্গে লোকটা জানিয়ে দিলো নাবিল এই এলাকাতেই আছে,এবং কোন বাসাতে আছে সেটাও তিনি ধরে ফেলেছেন।
লিখির শরীর মোটামুটি যা ছিল এখন আরও খারাপ।নাবিল আসার পথে নাস্তাও কিনে এনেছে।সর্দির ঔষুধ খেতে খেতে নাবিলকে আবারও বকলো সে।
নাবিল চুপ করে বকা শুনে গেছে।কলিং বেল বাজলো সেসময়ে।
সে তাই লিখিকে রেখে গেলো দরজা খুলতে।দরজা খোলার পর দেখলো অনাবিলের পাঠানো দুজন লোক এসে হাজির।নাবিলকে না জিজ্ঞেস করেই তারা দুজন ভেতরে ঢুকে গেছে।লিখি লুকিয়ে দেখছিল সব।লোকগুলোর মধ্যে একজন লিখিকে দেখে ফেলেছে এবং চিনেও ফেললো।তারপর সব তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে,লিখি নাবিলের কিছু তো হয়।

নাবিল তাদের বের হয়ে যেতে বললো ঠিক সেসময়ে জনাব অনাবিল আসলেন।তাকে দেখে নাবিল আশ্চর্য হয়ে গেছে,তার মুখের কথা হাওয়া হয়ে গেছে সব।তিনি বাসায় ঢুকলেন হনহনিয়ে।এরপর নাবিলের দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে থাকলেন।রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে তার।ইচ্ছে করছিল চড় মে/রে দিতে।কিন্তু নিজেকে সংযত করলেন।
হঠাৎ লিখিকে রুমের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন,’বাসায় একা এই মেয়েটার সাথে থাকো নাকি তুমি?’
‘হুম’
‘এই শিক্ষা দিয়েছিলাম?’
‘না’
‘তাহলে কেন করতেছো?’
‘ও আমার স্ত্রী ‘
‘কি বললে? স্ত্রী? বললেই মেনে নিতে হবে?’

নাবিল রুম থেকে খুঁজে এনে রেজিস্টারি কাগজপত্র দেখালো।অনাবিল তো অবাক।এতবড় ঘটনা কিনা তার অজানা রয়ে গেলো এতদিন।কাগজটা চেক করে দেখলেন আসল কাগজ।মাথা তুলে তিনি লিখিকে ধমকে বললেন সামনে আসতে।লিখি ভয়ে ভয়ে নাবিলের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।
‘তোমার বাবা কি চাকরি করে?’
‘ব্যবসা করে’
‘কেমন ব্যবসা?মাসিক আয় কত?’
‘তা তো জানিনা আমি’
‘গাড়ী আছে তোমাদের?জানো ও কার ছেলে?ওর বাড়িঘর দেখছো?জানো নিশ্চশ? নাহলে তো এত জলদি কেউ বিয়ের পিড়িতে বসেনা।আমার নাম শুনেই তো মনে হয় আমার ছেলেকে বিয়ে করে নিছো এক লাফে’

লিখি চুপ করে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।নাবিল তখন বললো,’আমরা কেউই জানতাম না আমাদের বিয়েটা সত্যি সত্যি হচ্ছে।আমার ভেবেছিলাম নকল’
‘তুমি কোনো কথা বলবেনা,আমাকে অনেক ঘুরিয়েছো আর এখন যে বিয়ের নাটক শুরু করেছো সেই নাটক এখনই বন্ধ করবে।এই মেয়েটা কোনো মতেই আমার বাসায় পা রাখতে পারবেনা।আমি তোমার বিয়ে দিব একমাত্র আমার পছন্দে,আমাদের স্টেটাসের সাথে মিলিয়ে’
‘বাবা তুমি হয়ত জানোনা, ওর বাবা তোমার বরাবরি ‘
‘তা হলেও এই বিয়ে আমি মানিনা।আমার পছন্দ হয়নি ওকে।আমার বড় ছেলের বউ হবে চোখ ধাঁধালো সুন্দরী।তাছাড়া ওর আশে-পাশে চাকরবাকর ভর্তি থাকবে।কই কাউকেই তো দেখছিনা।আর তোমরা এটা কিসের ফ্ল্যাটে উঠেছো?মেয়ের পরিবারের দেওয়া নাকি?’

‘ওর পরিবারের কেউ জানেনা এখনও’
‘জানার দরকারও নেই।এই সম্পর্ক আমি মানিনা।তুমি এই মূহুর্তে আমার সাথে বাড়ি ফিরে যাবে তা নাহলে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাবো।বিয়ের ভূত কিভাবে নামাতে হয় তা আমার জানা আছে’
‘বাবা আমি গেলে ওকে নিয়ে যাবো’
‘তোমরা দাঁড়িয়ে দেখছো কি?ওকে ধরে নিয়ে আসো আমার সাথে। দরকার হলে বলো করিমকে কল করে ডাকতেছি।ওর বাড়াবাড়ি আজ শেষ দেখে ছাড়বো’

নাবিল হাত ছাড়িয়ে আঙ্গুল তুলে বললো,’যত যাই বলেননা কেন আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে।এটা অস্বীকার করলেই অস্বীকার হয়ে যাবেনা।কাগজে কলমে বিয়ে হয়েছে আমাদের।আমি নিজের খরচ নিজে চালাতে পারবো।আপনারা যেতে পারেন এখন’
‘তোমার পেছনে কোটি কেটি টাকা ব্যয় করে এতদূর এনেছি,এখন তো তুমি নিশ্চয় নিজের খরচ চালাতে পারবে কিন্তু আমার ও তো চাহিদা আছে।

মনের কোণে পর্ব ২৮

এতদূর কেন পড়িয়েছি তোমাকে?যাতে তুমি আমার মানসম্মান ধরে রাখতে পারো।আর আজ দেখলাম মানসম্মান এর কি ছিরি করেছো।আমি এই কথা জীবনেও পাঁচকান হতে দিব না।তোমাকে আমি ধুম-ধাম করে আমার পছন্দের মেয়ের সাথে বিয়ে দিব।এই মেয়েটার সাথে তোমার ডিভোর্স করাতে আমার পাঁচ মিনিট সময় লাগবেনা।
তার জন্য যদি তার পরিবারকে খবর দিতেও হয় তাও করবো,তাদের যদি টাকা দিয়ে মুখ মা/রতে হয় তাও করবো কিন্তু তোমায় আমি অবিবাহিত রুপে ঘরে ঢোকাবো। বাসায় আজ আমার কিছু কলিগ আসবে।আমি কিছুতেই এই টপিক সামনে আনতে দিব না’

মনের কোণে পর্ব ৩০