অনেক সাধনার পরে পর্ব ১৯

অনেক সাধনার পরে পর্ব ১৯
অরনিশা সাথী

–“আমরা খুব ভালো করে জানি, আজ হ্যাঁ বললে কাল বিয়ে করতে এমন মানুষ এক না, একাধিক আছে আমাদের জীবনে। কিন্তু সমস্যা’টা কোথায় জানেন নুহাশ ভাই?”
রুজবার কথায় নুহাশ প্রশ্ন চোখে তাকালো রুজবার পানে। রুজবা ঈষৎ হেসে বললো,

–“আপনি যাকে পেলে খুশিতে কাঁদবেন তাকে আপনি পাবেন না, আবার যে আপনাকে পেলে খুশিতে কাঁদবে আপনি তার হবেন না।”
রুজবার কথায় তাচ্ছিল্য হাসলো নুহাশ। এই যে, রুজবা জারাফকে চায় কিন্তু জারাফ চায় না। অপরদিকে ও রুজবাকে ভালোবেসে যাচ্ছে গত পাঁচটি বছর ধরে। কিন্তু রুজবা ওর হতে চায় না। পাঁচ পাঁচটা বছর যাবত এক তরফা ভাবে ভালোবেসে যাওয়াটা কি চারটে খানি কথা? পাঁচটা বছর ধরে এই একটা মেয়ের প্রেমের অনলেই তো পুড়ে ছাঁই হচ্ছে ও।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মেয়েটা কি আদেও বুঝবে না এটা? চোখে আঙুল দিয়ে বোঝালেও কি বুঝবে? ক্লাস নাইনে তখন রুজবা। সেই যে পিচ্চি একটা মেয়ের মায়ায় বাঁধা পড়লো নুহাশ আর নিজেকে ছাড়াতেই পারলো না। এইটুকুন একটা মেয়ের এত ক্ষমতা? ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো নুহাশ। রুজবা নুহাশের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,

–“জগতের যোগসূত্র’টা আসলে সবার ক্ষেত্রে মিলে না, তবু’ও আমরা একে অপরকে ভালোবাসি, ভীষণ ভাবে ভালোবাসি।”
নুহাশ উপলব্ধি করলো ওর বুকে চিনচিন ব্যাথা হচ্ছে। নিজের ভালোবাসার মানুষ’টার মুখে অন্যকাউকে ভালোবাসার কথা শুনতে কারোই ভালো লাগে না। নুহাশের’ও ভালো লাগছে না। চিনচিন ব্যাথাটা যেন ক্রমশ বাড়ছে। বুকের বা পাশটা যেন এক অসহনীয় যন্ত্রণায় ঝলসে যাচ্ছে।

যেন আগুন জ্বলছে দাউদাউ করে। নুহাশের বুকের মধ্যে যেন তান্ডব চলছে, ঝড় বইছে। তবুও এর টিকিটা’ও ওর চোখমুখে ফুঁটে উঠছে না। আগের মতোই সুস্থ, স্বাভাবিক, গম্ভীর চোখমুখ করে বসে আছে রুজবার পাশে। দৃষ্টি তখনো সামনের ওই পুকুরের পানি তে। নুহাশ তপ্ত শ্বাস ফেলে শুধায়,

–“উত্তর’টা তাহলে ‘না’ ধরে নিবো?”
ঠিক সেই মূহুর্তেই রুজবার ফোন বেজে উঠে। ব্যাগ থেকে বের করে দেখে স্ক্রিনে ‘সাহিল ভাই’ নামটা জ্বলজ্বল করছে। রুজবা এক পলক নুহাশের দিকে তাকাতেই নুহাশ মৃদু হেসে বললো,
–“কথা বলে এসো।”
বিনিময়ে রুজবা নিজে’ও হাসে। ব্যাগটা নুহাশের পাশেই ফেলে রেখে ফোন হাতে ক্ষানিকটা দূরে গিয়ে দাঁড়ায়।

কিয়ান আর ফারিন আড়চোখে বারবার দেখছিলো নুহাশ আর রুজবাকে৷ মূলত ওদের দুজনের দেখা করানোর জন্যই কিয়ান আর ফারিন দেখা করতে এসেছে। রুজবা উঠে যেতেই ফারিন কপাল কুঁচকায়৷ অন্যপাশে গিয়ে কার সাথে এত হেসে হেসে কথা বলছে ও? ভেবে পেলো না ফারিন। কিয়ান অস্ফুট স্বরে বললো,

–“শালায় বিয়ের কথা বলতে পারলো কিনা কে যানে। এ কোন হাঁদারাম ভাই? পাঁচ বছর ধরে ভালোবাসা বুকের মধ্যে চেপে রেখে মুখ বুঝে দেখে তার ভালোবাসার মানুষ অন্য একজনকে ভালোবেসে কেঁধে কেটে মরতে যাচ্ছে। আবার যখন সুযোগ মিললো তাকে নিজের করে পাওয়ার তখনো মনে হয় মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে। মানে ও ক্যান ফেরত আসছে আমেরিকা থেকে? বাসায় বাবা ভাইয়ের সামনে ‘আমি রুজবাকে বিয়ে করবো’ বললেই হলো? যাকে বিয়ে করতে চায় তার সামনে মুখ ফুঁটে বলতে হবে না?”

একদমে কথাগুলো বলে শ্বাস নিলো কিয়ান। ফারিন চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। কিয়ান বোকা সোকা ভাবে দাঁত কপাটি বের করে হাসলো। ফারিন বিরক্তিতে ’চ’ বর্গীয় শব্দ করলো মুখে। বললো,
–“নুহাশ ভাইয়ের ভালোবাসা প্রকাশের মাধ্যম’টাই অন্যরকম। আর উনি মোটেও হাঁদারাম না। যথেষ্ট বিবেক বুদ্ধি সম্পন্ন একজন মানুষ। ইমম্যাচিউর দের মতো ভালোবাসি বলে বলে মুখে ফ্যানা তুলবেন না উনি। কাজে করে দেখাবেন। যা তোমার মতো হাঁদারাম বুঝবে না।”

–“ওহ___”
এইটুকু বলতেই কিয়ানের হুশ ফেরে। চকিত তাকায় ফারিনের দিকে। মেয়েটা ওকে হাঁদারাম বললো? ফারিন মুখ টিপে হাসলো কিয়ানের দিকে তাকিয়ে৷ ছেলেটাকে তালগোল পাকিয়ে ফেললো। কিয়ান কপাল কুঁচকে বলে,
–“আমাকে তোমার হাঁদারাম মনে হয়?”
ফারিন দাঁত বের করে হেসে জবাব দেয়,

–“তা নয়তো কি? চারটে বছর ধরে শুধু প্রেম করেই গেলে। এখনো বাবার ভয়ে বাসায় আমাকে বিয়ের কথা জানাতে পারলে না। সেখানে নুহাশ ভাই এক তরফা ভালোবেসে দুই দুইবার আংকেল’কে বলেছে রুজবাকে বিয়ে করবে উনি। তাহলে এখানে হাঁদারাম’টা কে শুনি?”

কিয়ান ফাঁটা বেলুনের মতো চুপসে গেলো। রোমান সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে ও আসলেই বিয়ের কথা বলতে পারছে না। যতবার বলতে চেয়েছে ভয়ে বুক দুরুদুরু করেছে। এই বুঝি ওর বাবা টেনে একটা থা/প্প/ড় বসায় গালে এই ভেবে। কিয়ান নিজেকে সামলে নিলো, মনে সাহস জুগিয়ে বুক ফুলিয়ে বললো,

–“এত বড় ইনসাল্ট আমি কিয়ান মেনে নিবো না। আজই বাসায় গিয়ে বাবা’কে বলবো বিয়ের কথা।”
ফারিন বাদাম ছিলে মুখে দেয়। পা দুলিয়ে বলে,
–“সেটা তো সময় বলে দিবে।”
–“প্রস্তুত থাকো মেরি জান, দু/একদিনের মধ্যে তোমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবো। বাবাকে আমি বলতে না পারলে নুহাশ’কে দিয়ে বলাবো। আফটার অল নুহাশ আমার জিগেরি দোস্ত প্লাস ভাই।”

–“যাকে হাঁদারাম বললে এখন তাকেই কাজে লাগবে তোমার? তাকে ছাড়া তো কিচ্ছুটি করতে পারো না। চার বছর আগে আমায় প্রপোজ’ও করতে পারোনি ঠিকঠাক। নুহাশ ভাই ছিলো বলেই সম্পর্ক এতদূর। নয়ত তোমার সাথে আমি প্রেম করতাম?”
কিয়ান এবারে’ও চুপসে যায়। আসলেই ফারিনকে ভালোবাসার কথাটা অব্দি তখন সাহস করে বলতে পারেনি। নুহাশ’ই করেছে যা করার। নুহাশের অবদান আছে অনেক ফারিনকে নিজের করে পাওয়ায়। কিয়ান বাইরে বাইরে চোটপাট করে বলে,

–“একদম হাঁদারাম বলবা না। দুদিন বাদে যাকে বিয়ে করবে যার সাথে ঘর সংসার করবে যার বাচ্চাকাচ্চা পালবে তাকেই হাঁদারাম বলছো লজ্জা করে না মেয়ে?”
–“কে বলেছে তোমায় বিয়ে করবো? বিয়ে করবো না তো তোমাকে।”
কিয়ান মুখটাকে একটুখানি করে পাশ ফিরে তাকিয়ে রয়। তা দেখে ফারিন হু হা করে হেসে উঠে। ফারিনের ঝংকার তোলা হাসির শব্দে কিয়ানের বুকে ঝড় তুলছে। মেয়েটা হাসলে এত সুখ সুখ অনুভূত হয় কেন ওর?

–“বলো সাহিল ভাই।”
–“কি করছিস?”
–“বেরিয়েছি একটু। কেন কোনো দরকার ছিলো?”
–“না এমনি, কে আছে সাথে?”
–“ফারিন, কিয়ান ভাই আর নুহাশ ভাই।”
–“তোকে এখনো ভালোবাসে ছেলেটা?”
রুজবা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,

–“হু___”
এই বলে একটু আগের বলা নুহাশের সব কথা বললো সাহিল’কে। সাহিল সব শুনে কিছুক্ষণ চুপ থেকে জিজ্ঞেস করে,
–“কি বললি তুই?”
–“কিছুই না।”
–“আমি একটা কথা বলি রুজবা? মনোযোগ দিয়ে শুনবি।”
–“হু বলো।”

–“ছেলেটা নিঃসন্দেহে তোকে ভালোবাসে রুজবা। চোখ বন্ধ করে ওর সাথে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারবি তুই। এতগুলো বছর এক তরফা কেউ ভালোবেসে যেতে পারে বল? পারে না, একটু হলেও সেই ভালোবাসায় খাদ থাকে। কিন্তু নুহাশ ছেলেটা তোকে সত্যিই ভালোবাসে ওর নিখাদ ভালোবাসা ফিরিয়ে দিস না। তোর খুশির জন্য কিন্তু সেদিন নুহাশ বিয়েটা করেনি রুজবা। ও কিন্তু চাইলেই পারতো তোর কথা না ভেবে জোর করে তোকে বিয়ে করতে।

কিন্তু ও সেটা করেনি। তোর সুখের জন্য বিয়ে ভেঙেছে৷ নিজের দেশ ছেড়েছে। অন্যদিকে যাকে তুই ভালোবাসিস সে তার সুখের জন্য তোকে ছেড়েছে। নুহাশ তোকে নিজের করে নেওয়ার একটা সুযোগ পেতেই নিজের ক্যারিয়ার ফেলে ছুঁটে এসেছে তোর কাছে, ও কিন্তু এখানেও ক্যারিয়ারের কথা চিন্তা না করে তোর কথা ভেবেছে। অন্যদিকে জারাফ নিজের ক্যারিয়ারের জন্য তোকে ওর লাইফ থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। এখানেই দুটো মানুষের মধ্যে তফাৎ’টা দেখ রুজবা। এখানেই বুঝতে পারবি কে তোকে সত্যিকারের ভালোবাসে। তুই ভাব, জারাফের জন্য কষ্ট পেয়ে দুমড়ে মুচড়ে মরবি? নাকি নুহাশের ভালোবাসায় নিজেকে নতুন করে রাঙাবি।”

একদমে এতগুলো কথা বলে থামলো সাহিল। রুজবা ধীর স্বরে বলে,
–“কিন্তু___”
–“আমি তোকে জোর করছি না রুজবা। এটা সম্পূর্ণ তোর ব্যাপার। কিন্তু একটা কথাই বলবো, জীবন তোকে দ্বিতীয় বার সুযোগ করে দিয়েছে খাঁটি মানুষ’টাকে চেনার। খাঁটি ভালোবাসা সবার কাছে ধরা দেয় না রুজবা, তোর কাছে ধরা দিয়েছে দুই, দুইবার। সে ভালোবাসা তুই পায়ে ঠেলে দূরে সরাস না। আফসোস করে কূল পাবি না পরে।”

–“হু ভেবে দেখছি।”
–“হ্যাঁ ভাব, যত সময় লাগে নিয়ে ভাব। আর একটা কথা সামনে মাসে জারাফ আর নিদ্রা’র বিয়ে। আমি চাই ওর আগে তুই বিয়ে করে দেখা ওকে ছাড়া’ও তুই ভালো আছিস। তোর ভালো থাকার জন্য জারাফ’কে প্রয়োজন নেই।”
থমকালো রুজবা। এত তাড়াতাড়ি বিয়ের ডেট’ও ফিক্সড করে ফেললো ওরা? রুজবা বুঝলো ওর প্রতি জারাফের ভালোবাসা কোনো কালেই ছিলো না, যা ছিলো তা শুধুমাত্র আবেগ, ভালো লাগা আর মোহ।

তপ্ত শ্বাস ফেললো রুজবা। সামলে নেয় নিজেকে। দূর্বল হলে চলবে না। দূর্বলতা দেখাতে নেই কাউকে, দূর্বলতা জেনে গেলে অপর পাশের ব্যক্তি মজা লুফে নেয়৷ তাই রুজবা কাউকে নিজের দূর্বলতা দেখাতে চায় না আর। যে ঠকিয়েছে সে ভালো থাকতে পারলে ও কেন পারবে না? ওকে দেখাতে হবে ও ভালো আছে, জারাফের থেকে খুব বেশি’ই ভালো আছে। ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,

–“আচ্ছা সাহিল ভাই রাখি আমি, নুহাশ ভাই অপেক্ষায় আছে।”
–“আচ্ছা, আর আমার কথাগুলো ভেবে দেখিস, আমি তোর খারাপ চাই না।”
–“জানি আমি, আর সেজন্যই তো তোমাকে এত্তটা ভালোবাসি আমি।”
সাহিলের ঠোঁটের কোনে হাসি দেখা গেলো। ঠোঁটের কোনে হাসি রেখেই বললো,
–“পাগলি একটা, রাখছি আমি।”
রুজবা হেসে সম্মতি জানাতেই সাহিল ফোন রেখে দেয়।

রুজবা ধীর পায়ে এগিয়ে যায় নুহাশের দিকে। নুহাশের পাশ থেকে ব্যাগটা তুলে বুকে জড়িয়ে বসে। নুহাশ এক পলক তাকায়। আবার দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বলে,
–“কথা শেষ হলো তাহলে? আমি তো ভেবেছিলাম আজ আর কথা শেষ হবে না।”
–“এই তো শেষ। আসলে সাহিল ভাইয়ের সাথে কথা বলে শুরু কর____”
রুজবাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে নুহাশ জিজ্ঞেস করে,

–“সাহিল কে?”
–“জারাফের বন্ধু, আপনি আর কিয়ান ভাই যেমন ঠিক তেমনটা।”
কথাটা রুজবা হাসিমুখে বললেও নুহাশের মুখে যেন আঁধার নেমে এলো। যা রুজবার চোখে পড়েনি। নুহাশ পড়তে দেয়নি। স্বাভাবিক ভাবে বললো,

–“ওহ, আচ্ছা তাহলে এবার বাসায় ফেরা যাক।”
বলেই উঠে দাঁড়ায় নুহাশ। আচমকা রুজবা বললো,
–“আব্বু রাজি থাকলে এবার আর আমার কোনো আপত্তি নেই নুহাশ ভাই।”

অনেক সাধনার পরে পর্ব ১৮

তড়িৎ তাকালো নুহাশ। নুহাশের ওই দৃষ্টির সাথে চোখ মেলানোর সাধ্য রুজবার নেই। তাই সন্তর্পণে চোখ নামিয়ে নেয়। অবিশ্বাস্য আর অপ্রত্যাশিত কথা শুনে নুহাশের বক্ষপটে শীতল হাওয়া বয়ে যায়। অধরে ফুঁটে এক চিলতে প্রশান্তির হাসি।

অনেক সাধনার পরে পর্ব ২০