অনেক সাধনার পরে পর্ব ৩৫

অনেক সাধনার পরে পর্ব ৩৫
অরনিশা সাথী

মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জারাফ আর নিদ্রা। নিদ্রাকে তো আজকাল পাচ্ছেই না জারাফ৷ আজও যদি আর একটু লেট করে ঢুকতো বাসায় তাহলে আজও পেতো না নিদ্রাকে। আজকাল নিদ্রা ফ্রেন্ডস ক্লাব এসব নিয়েই ব্যস্ত। জারাফকে তো প্রায় ভুলতেই বসেছে ও। নিদ্রা ছাদের রেলিঙের সাথে হেলান দিয়ে ফোন ঘাটছে। জারাফ এবার ভীষণ বিরক্ত। এই মেয়ে ওকে পাত্তা’ই দিচ্ছে না৷ থমথমে গলায় বলে,

–“ফোনটা রাখো, কথা আছে আমার।”
নিদ্রা ফোনে মনোযোগ রেখেই বলে,
–“শুনছি বলো।”
–“ফোন রাখো তুমি। আ’ম সিরিয়াস নিদ্রা।”
নিদ্রা বিরক্ত হয়ে ফোনটা রেখে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। জারাফ বলে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

–“সমস্যা কি তোমার? যতবার বিয়ের কথা বলছি ততবার তুমি বলছো আরো সময় লাগবে তোমার। হোয়াই নিদ্রা? আগে তো তুমি পাগল ছিলে আমায় বিয়ে করার জন্য। আজ যখন আমি রাজি আছি তখন তুমি এমন টালবাহানা করছো কেন?”
নিদ্রা বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,

–“বলা শেষ? আর কিছু বলার না থাকলে এবার যেতে পারি?”
–“আন্সার মি।”
–“আওয়াজ নিচে জারাফ৷ তুমি আমার উপর একদম চিৎকার করে কথা বলবে না৷ আমি রুজবা না। ভেবো না, বিয়ে আমি তোমাকেই করবো কিন্তু এখন না। আমার যখন ইচ্ছে হবে তখনই।”

এইটুকু বলে হনহনিয়ে চলে যায় নিদ্রা। জারাফ অবাক চোখে দেখছে নিদ্রার চলে যাওয়া। রুজবার কথা নিদ্রা জানে? কিন্তু কিভাবে? ভাবছে জারাফ৷ আজ ভীষণ করে মনে পড়ছে রুজবাকে। ও এখন হারে হারে বুঝতে পারছে রুজবাকে হারিয়ে সব হারিয়েছে ও। রুজবা ওর লাইফে ঠিক কতটা জায়গা জুড়ে ছিলো কতটা কাছের ছিলো সেসব আজ বেশ উপলব্ধি করে ও। লাইফে যদি দ্বিতীয় কোনো সুযোগ পেতো রুজবাকে পাওয়ার তাহলে ও কিছুতেই সেই সুযোগ হাতছাড়া করতো না।

লাল বেনারসিতে ভীষণ অমায়িক লাগছে ফারিনকে। চুলগুলো খোপা করে পুরো খোপা ভর্তি লাল গোলাপ গেঁথেছে৷ বিয়ের দিন বুঝি সব মেয়েদের সৌন্দর্য বহুগুণ বেড়ে যায়। জান্নাতের ঘরে বউ সেজে বসে আছে ফারিন। রুপশা, রিজা আর নির্ঝর ছাড়া আপাতত আর কেউ নেই ওর সাথে। ফারিনের ভীষণ অভিমান হচ্ছে রুজবার উপর। মেয়েটা এসেছে পর থেকেই লাপাত্তা৷ এসেছে পর একটু খানি পেয়েছিলো কাছে৷

তারপর তো লাপাত্তা এরপর আবার হলুদ ছোঁয়ানোর সময় এসেছিলো। এরপর তো ম্যাডামের আর খোঁজই নেই। অভিমানে গাল ফুলিয়ে বসে রয় ফারিন।
নুহাশের ঘরে একা একাই শাড়ি পড়ে রেডি হচ্ছে রুজবা। রুজবা দুপুরে পড়ার জন্য শাড়ি আর রুপশার জন্য গাউন নিয়ে এসেছিলো সাথে করেই। রুজবার পরণে গোলাপি রঙের জামদানী। ওর ভীষণ পছন্দের শাড়ি এটা। মেক-আপ আর্টিস্ট ফারিনকে সাজিয়ে যাওয়ার সময় আদিরা তাকে রুজবার কাছে নিয়ে এসেছিলো।

বলেছিলো রুজবাকে সাজাতে। রুজবা না সেজে শুধু চুলটা খোপা করে। তারপর শাড়ি পড়া টুকটাক সাজগোছ করা সব রুজবা একাই করে৷ ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চোখে কাজল দেয় ও। সাজ শেষে উঠে দাঁড়াতেই নজর যায় নুহাশের দিকে। লোকটাকে অফ হোয়াইট কালার পাঞ্জাবীতে খুব এট্রাক্টিভ লাগছে। সবেই দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে নুহাশ। আয়নায় চোখ যেতেই দেখে রুজবা আয়নার মধ্য দিয়েই ওকে দেখছে।

মুচকি হেসে সেদিকে এগিয়ে যায় নুহাশ। রুজবা দৃষ্টি সরিয়ে মাথা নিচু করে। নুহাশকে নিজের দিকে এগোতে দেখে বুক উঠানামা বেড়ে যায়৷ মনে পড়ে যায় ঘন্টা তিনেক আগের করা সেই পাগলামি গুলোর কথা। ইশ্! কি বাচ্চামি টাই না করেছিলো ও। লোকটা কি ভেবেছে ওর সম্বন্ধে?

ভাবতেই লজ্জায় কুঁকড়ে যায় ও৷ নিজের ঠিক পেছনে নুহাশের উপস্থিতি টের পেয়ে হৃদপিণ্ডের লাফঝাপ বেশ বেড়ে যায়৷ নুহাশ নিঃশব্দে হাসে রুজবার শরীরের কম্পন দেখে। আলগোছে রুজবার খোপায় গুজে দেয় বেলি ফুলের মালা। সম্পূর্ণ খোপায় বেলি ফুলের মালা খুব সুন্দর ভাবে আটকে দেয় নুহাশ। রুজবার দিকে হাত বাড়িয়ে বলে,
–“কালো ক্লিপ দাও।”

রুজবা ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে ক্লিপের পাতা হাতে নিয়ে কিছু ক্লিপ খুলে নুহাশের হাতে দিতেই নুহাশ ক্লিপগুলো চুল আর বেলি ফুলের সাথে আটকে দেয়৷ খোপায় ফুল লাগিয়ে সরে আসে ও। রুজবা স্বস্তির শ্বাস নেয়৷ ড্রেসিং টেবিলের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা নিজের সাজগোজের জিনিসপত্র দ্রুত হাতে গুছিয়ে ব্যাগে রাখতে গেলেই ফ্লোরে পড়ে যায় সব। সেগুলো তুলার জন্য বসতে গেলেই নুহাশ হাত ধরে আটকে দেয়৷ রুজবাকে সেখান থেকে সরিয়ে ও নিজে সবকিছু উঠিয়ে ড্রেসিং টেবিলের উপর সাজিয়ে গোছিয়ে রাখে। রুজবা আমতা আমতা করে বলে,

–“আমায় দিন, আমি ব্যাগে রেখে দিচ্ছি।”
–“থাক এখানে।”
–“ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তো। এলোমেলো লাগছে।”
–“লাগুক। আমার দেখতে ভালো লাগছে আমার ড্রেসিং টেবিলের উপর তোমার জিনিসপত্র রাখা। আজ এখানে তোমার সাজগোজের জিনিস। দুদিন বাদে আমার আলমারিতে তোমার শাড়ি, জামা। আর আমার বিছানায় তুমি____”

এইটুকু বলেই রুজবার দিকে দৃষ্টি তাক করে নুহাশ। রুজবা লজ্জায় হাঁসফাঁস করছে। লোকটা কি বুঝে না ওর লজ্জা লাগে এভাবে বললে? নুহাশ ঠোঁট কামড়ে হাসে। তারপর বলে,
–“আমার কাছে আসতে দুটো বছর লাগবে তোমার। আচ্ছা রুজবা দুটো বছর কি খুব বেশি হয়ে যাচ্ছে না? এত পাষান হলে চলে বলো? একটু নরম হও তোমার বরের প্রতি।”
রুজবা আমতা আমতা করে বলে,

–“আপনার ঘরে পার্মানেন্টলি আসতে আমার দুই বছর লাগবে কিন্তু আমার কাছে যেতে তো আর আপনার দুই বছর লাগবে না। আপনি তো যখন তখন যেতে পারেন আমার কাছে। যদি সেইটুকু অনুমতি না পেতেন তাহলে বলতে পারতেন আপনার প্রতি নরম হতে।”

–“তারমানে অনুমতি আছে কাছে যাওয়ার?”
নুহাশের ইঙ্গিত বুঝতে পেরে লজ্জায় মাথা কাটা যায় রুজবার। ইশ্! কি বিশ্রি! লোকটা এমন লাগামহীন কথা বলে কেন? নুহাশ দুই কদম এগিয়ে বলে,

–“বলো, অনুমতি আছে কাছে যাওয়ার?”
রুজবা লাজুক হেসে,
–“জানি না।”
বলেই দৌড়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। সেদিকে তাকিয়ে শব্দ করে হাসে নুহাশ।

কবুল বলার সময় কিয়ান এক মুহূর্ত দেরি করেনি। সব ছেলেরাই বুঝি এমন। কবুল বলতে সময় নেয় না একদমই। কতক্ষণে কবুল বলে বউ নিয়ে বাড়ি ফিরবে এই তাড়া’টাই বুঝি থাকে ওদের। অন্যদিকে ফারিনের প্রেমের বিয়ে হলেও কবুল বলার সময় কেঁদে কেটে একাকার অবস্থা। একা একা বিয়ে করছে। পরিবারের কেউ উপস্থিত নেই৷ কষ্ট তো হবেই। কিছুতেই কবুল বলছিলো না ও। জান্নাত, রুজবা বুঝিয়ে শুনিয়ে শান্ত করে ওকে। অনেক সময় নিয়ে শেষে ফারিনও কবুল বলে। অবশেষে আরো একটা ভালোবাসা পূর্ণতা পায়।

বিয়ে বাড়ি এখন সম্পূর্ণ ফাঁকা। কিয়ানের নানার বাড়ির, ফুপ্পিরা সকলেই চলে যায়। রায়হান সাহেব যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে সবে। রুজবাকে ইশারা করতেই রুজবা বোঝালো ও প্রস্তুত আছে। রায়হান সাহেব বললেন,
–“এবার তাহলে আমরা আসি বেয়াই সাহেব। সন্ধ্যা হয়ে গেছে।”
–“আজ সবাই থেকে গেলে ভীষণ খুশি হবো।”
–“দুই পরিবারে সম্পর্ক যখন হয়েছে এখন তো আসা-যাওয়া লেগেই থাকবে৷ আজ আসি ভাই, থাকার সময় সামনে অনেক পড়ে আছে। রুজবা, রাফাত? আসো।”

নুহাশের হাসিখুশি মুখটা নিমিষেই ছোট হয়ে যায় রুজবার চলে যাওয়ার কথা শুনে। তবে সেটা বাইরে প্রকাশ করে না ও। চুপচাপ বসে আছে যেখাবে কিয়ান, রাফাত রুপশা ওরা একসাথে বসে আড্ডার আসর জমিয়েছে। ফারিন ঘুমাচ্ছে। ওর মাথা ধরেছিলো ভীষণ, তাই সবাই ওকে একটু স্পেস দিয়েছে। কিয়ান আদিরার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ইশারা করতেই আদিরা আস্বস্ত করে কিয়ানকে। হাসিমুখে এগিয়ে যায় নোমান সাহেবের দিকে। ধীর স্বরে বলে,

–“বাবা, এখানে তো এখনো ফারিন আর কিয়ানের কিছু রিচুয়্যালস বাকী আছে। ফারিনের পরিবারের কেউ তো উপস্থিত ছিলেন না। কারো মত নেই এই বিয়েতে। এ নিয়ে ফারিনের এমনিতেই মন খারাপ। তাই বলছিলাম কি, রুজবা রাফাত ওরা যদি আজ থেকে যেতো তাহলে ফারিনের একটু ভালো লাগবে৷ ফারিন আর রুজবা তো বেস্ট ফ্রেন্ড। ও থাকলে___”
নোমান সাহেব সহমত জানায় আদিরার কথায়। রায়হান সাহেবকে বলে,

–“রুজবা ওরা বরং আজ থাকুক এখানেই___”
রুজবার বুক ধক করে উঠে। রায়হান সাহেব বলে,
–“ওদের সবারই এ ক’দিন ক্লাস মিস গেছে অনেক। অন্যসময় এসে থাকবে।”
–“আর একদিন ক্লাস মিস দিলে কিছু হবে না”
নোমান সাহেবের কথায় রায়হান সাহেব রুপশা আর রাফাতের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,

–“থাকবে তোমরা?”
রুপশা মাথা নাড়ায়, যার অর্থ না৷ রাফাত বলে,
–“কাল আমার প্র‍্যাক্টিক্যাল ক্লাস আছে আব্বু।”

রায়হান সাহেব তাকালেন রুজবার পানে। প্রশ্ন ছুঁড়লো ও থাকতে চায় কিনা? রুজবা কি উত্তর দিকো ভেবে পায় না। এক পলক তাকায় নুহাশের দিকে। নুহাশ রুজবার দিকেই তাকানো ছিলো রুজবা তাকাতেই ফোন বের করে ফোন দেখায় মনোযোগ দেয়। রুজবা দৃষ্টি সরায়। ও থাকবে না এখানে। লোকটা আজ যা সব বলেছে। এখানে থাকা মানে বাঘের গুহায় থেকে যাওয়া। নুহাশ ছাড়বে না আজ ওকে। এটা ও নিশ্চিত। রুজবা না বলার জন্য মুখ খুলতেই আদিরা গিয়ে রুজবাকে জড়িয়ে ধরে বললো,

অনেক সাধনার পরে পর্ব ৩৪

–“রুজবা আজ থেকে যাক প্লিজ আংকেল।”
নোমান সাহেব আর শাহানা বেগমেরও একই প্রস্তাব। মুখের উপর রায়হান সাহেব আর না করতে পারলেন না। সম্মতি দিলেন রুজবাকে থেকে যাওয়ার। রুজবা করুন চোখে তাকায় সবার দিকে। নুহাশের দিকে চোখ যেতেই দেখলো নুহাশের ঠোঁটের কোনে বাঁকা হাসি। রুজবা স্পষ্ট বুঝতে পারছে নুহাশ ফোন দেখে হাসছে না। রুজবার থেকে যাওয়ার অনুমতি পেয়ে হাসছে। রুজবা অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলো নুহাশের সেই হাসির দিকে।

অনেক সাধনার পরে পর্ব ৩৬