অনেক সাধনার পরে পর্ব ৬

অনেক সাধনার পরে পর্ব ৬
অরনিশা সাথী

–“নুহাশ ভাই?”
দ্রুত পায়ে নিজের ক্লাসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো নুহাশ। পেছন থেকে মেয়েলি কন্ঠে নিজের নাম শুনতে পেয়ে হাঁটা থামায় ও। পেছনে ঘুরে ফারিনকে দেখতে পেয়ে মুচকি হাসে নুহাশ। ফারিনের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ফারিনের মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বললো,

–“কেমন আছো?”
–“আলহামদুলিল্লাহ ভাই, আপনি?”
–“আমিও ভালো। আজ তুমি একা কেন? তোমার বান্ধবী কোথায়?”
–“ও ক্লাসে আছে। আমার আপনার সাথে কিছু কথা ছিলো নুহাশ ভাই।”
–“এখনই?”
–“এখন বললেই ভালো হয়।”
নুহাশ হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে বললো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

–“আচ্ছা বলো, কোনো সমস্যা? কিয়ানের সাথে কিছু হয়েছে?”
–“নাহ, কথাটা আসলে রুজবাকে নিয়ে।”
ফারিনের কথায় নুহাশ কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকালো। বললো,
–“রুজবাকে নিয়ে?”
ফারিন মাথা নাড়ালো। নুহাশ আশেপাশে তাকিয়ে বললো,
–“বসে কথা বলি?”
ফারিন সম্মতি জানাতেই নুহাশ বললো,
–“চলো।”

নুহাশের পিছু হাঁটা শুরু করলো ফারিন। নুহাশ একটা ক্যাফেতে নিয়ে এলো ফারিনকে। চেয়ার টেনে বসলো দুজনেই। নুহাশ বললো,
–“কি খাবে?”
–“আজ না, অন্যদিন___”
নুহাশ মৃদু হেসে বললো,
–“ক্যাফেতে এসে খালি মুখে বসে থাকাটা বেমানান লাগবে না? তার থেকে বরং কফি অর্ডার দিই?”
–“আচ্ছা।”
নুহাশ একটা ছেলেকে ডেকে দুটো কফি অর্ডার করে দিলো। তারপর ফারিনের দিকে ঘুরে দুহাত দিয়ে টেবিলে ভর রেখে থুতনি ঠেকালো। বললো,

–“এবার বলো।”
ফারিন আমতা আমতা করে বললো,
–“আপনি কি রুজবাকে সত্যিই ভালোবাসেন?”
ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে নুহাশ বললো,
–“তোমার বান্ধবী না হয় বুঝে না। কিন্তু তুমিও বুঝবে না? মুখে বলতে হবে আমার?”
ফারিন কি বলবে ভেবে পেলো না। নুহাশ নিজেই বললো,

–“হঠাৎ এই কথা জিজ্ঞেস করছো কেন?”
–“আমার মনে হয় রুজবা জারাফকে পছন্দ করতে শুরু করেছে।”
একটা ছেলে এসে কফি দিয়ে গেলো দুজনকে। নুহাশ কফিতে চুমুক দিয়ে কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে বললো,
–“জারাফ?”
–“আমাদের পাশের এলাকায় বাড়ি। ঢাকা ভার্সিটিতে পড়াশোনা করছে। নয়/দশ মাস ধরে পরিচয় ওদের। কাল জারাফ রুজবাকে আপনার বাইকে দেখে রাগারাগি করেছে। সেই নিয়ে ওর মন খারাপ ছিলো। জারাফের হাবভাবে মনে হয় ভালোবাসে। কিন্তু মনের মাঝে কি চলে জানি না। কাল দেখা করতে’ও এসেছিলো৷ আমার রুজবাকে দেখে যতদূর মনে হয় জারাফ ওকে প্রপোজ করলে ও রাজি হয়ে যাবে নুহাশ ভাই।”

নুহাশ মনোযোগ সহকারে ফারিনের কথা শুনে বললো,
–“হুম তারপর?”
–“তারপর মানে? আপনি এখনো ওকে ভালোবাসার কথা জানাবেন না?”
–“তোমার বান্ধবী তো জানে ফারিন।”
–“আপনি নিজে তো বলেন-নি কখনো। আপনি রুজবাকে খুব ভালোবাসেন রুজবা আশেপাশে থাকলে আপনার চোখ সেটা বলে দেয়।”

–“রুজবা বুঝে না তো।”
–“বোঝান আপনি।”
–“উঁহু।”
–“চোখের সামনে রুজবাকে জারাফের সাথে দেখতে পারবেন? কষ্ট হবে না? ওই যন্ত্রণা সহ্য করার ক্ষমতা আছে?”
নুহাশ তখনই কিছু বললো না৷ কফিতে শেষ চুমুক দিয়ে বললো,
–“চলো এবার উঠি।”
কথাটা বলে নুহাশ উঠে গিয়ে কফির বিল দিয়ে আসলো। তারপর বেরিয়ে গেলো ক্যাফে থেকে। ফারিন নুহাশের পিছু নিয়ে বললো,

–“আপনার কোনো প্রতিক্রিয়া দেখছি না নুহাশ ভাই। আপনার মনের মাঝে কি চলছে সেটা’ও বুঝতে পারছি না। শুধু বুঝতে পারছি কিছু একটা তো অবশ্যই চলছে আপনার মনে।”
–“সম্পর্কের সমীকরণ বদলাতে কতক্ষণ ফারিন? মাঝে মাঝে এমন’ও হয় যাকে আমরা চাই না তার সাথেই সারাটা জীবন কাটাতে হয় আমাদের।”
কথাটা বলে আর এক মূহুর্ত না দাঁড়িয়ে নিজের ক্লাসের দিকে চলে গেলো নুহাশ। ফারিন অবাক নয়নে নুহাশের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। কথাটার মানে খুঁজে পেলো না ফারিন। ফারিন কাঁধে স্পর্শ পেয়ে পেছনে ফিরে রুজবাকে দেখলো৷ রুজবা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,

–“কোথায় ছিলি তুই? কখন থেকে খুঁজছি তোকে।”
–“এদিকেই ছিলাম। চল ক্লাসে যাই।”
–“হুম চল।”
দুজনেই ক্লাসের দিকে চলে গেলো। ফারিনকে চিন্তিত দেখাচ্ছে। এটা অবশ্য রুজবার চোখের আড়াল হয়নি। কিন্তু ও এই মূহুর্তেই কিছু জিজ্ঞেস করলো না ফারিনকে।

নুহাশের পুরো পরিবার দুপুরে খেতে বসেছে একসাথে। চুপচাপ সকলেই খাচ্ছে৷ নুহাশ ওর বাবা নোমান ফারদিনকে বললো,
–“আমার কিছু কথা আছে বাবা।”
নোমান সাহেব খাওয়ায় বিরতি টেনে বললো,
–“বলো।”

কথাটা বলে ভাতের লোকমা মুখে দিলো নোমান সাহেব। শাহানা ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো নুহাশ কি বলতে চাইছে। কিন্তু ওর মুখ দেখে কিছুই অনুমান করা যাচ্ছে না। নুহাশ কোনো ভণিতা ছাড়াই বললো,
–“আমার একজনকে পছন্দ বাবা, আর ওকে বিয়ে করতে চাই আমি।”
নুহাশের কথা শুনে ওর বড় ভাই নিবির ফারদিন কেশে উঠলো। নিবিরের বউ আদিরা দ্রুত এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলো নিবিরের দিকে। শাহানা বেগম ধমকের স্বরে বললো,

–“ধীরে সুস্থে খাবি তো নিবির।”
নিবির কিছু বললো না। ভাবলো নুহাশ কত ফাস্ট। অথচ আদিরাকে বিয়ে করার কথা বাসায় জানাতে ছয় মাস লেগে গেছিলো ওর। আর নুহাশ অকপটে বাবার সামনে বসে বিয়ের কথা বলে ফেললো। তার উপর ওর এখনো স্টাডি শেষ হয়নি। নোমান সাহেব বললো,
–“তোমার স্টাডি এখনো শেষ হয়নি নুহাশ। আর তাছাড়া তোমার মতো বেকার ছেলের হাতে কোনো মেয়ের বাবা কেন তার মেয়েকে তুলে দিবে?”

–“বিয়ের পরেও স্টাডি শেষ করা যাবে। আর আমি তো বলছি না বিয়ে করিয়ে এখনই বউ ঘরে তুলে নিয়ে আসো। আপাতত কাবিন করে রাখলেই হবে। আমার স্টাডি শেষ হোক, নিজে কিছু একটা করি তারপর বউ ঘরে তোলা যাবে।”
কথাগুলো বলে নুহাশ আবারো খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। এদিকে চার জোড়া চোখ অবাক চোখে নুহাশের দিকে তাকিয়ে আছে। নিরবতা ভেঙে আদিরা বললো,
–“মেয়ের ছবি দেখাও আমাদের।”
–“নেই।”

সোজাসাপটা জবাব নুহাশের। নিবির ভ্রু কুঁচকে বললো,
–“একটা মেয়েকে তোর পছন্দ তাকে বিয়ে করতে চাইছিস অথচ তার ছবি নেই তোর কাছে? ব্যাপারটা অদ্ভুত না?”
–“প্রেম করলে ছবি থাকতো। প্রেম করিনি তাই ছবি নেই।”
নুহাশের কথার আগামাথা কিছুই কারো মাথায় ঢুকছে না। আদিরা বললো,
–“ক্লিয়ার করো, এরকম ছাড়া ছাড়া ভাবে কথা বলছো কেন?”
নুহাশ খাওয়া শেষ করে বললো,

–“ওকে আমার পছন্দ, সহজ ভাবে বললে ভালোবাসি। আরো তিন বছর আগে থেকে।”
–“আর মেয়েটা, মেয়েটা ভালোবাসে না?”
নিবিরের কথায় নুহাশ বললো,
–“নিজ মুখে জানাইনি কখনো, তবে জানে ওকে ভালোবাসি আমি৷ ওসব প্রেম টেম আমার দ্বারা হবে না। তাই সরাসরি বিয়ে করতে চাইছি।”
নিবির খেতে খেতে বললো,

–“গুড ডিসিশন।”
এতক্ষণে শাহানা বললো,
–“মেয়ের বাড়ি কোথায়? বাবার নাম কি?”
–“রিয়ান ভাইয়ের শালী৷ জান্নাত ভাবীর মামাতো বোন আর কি। উমম বাবার নাম রায়হান আজাদ।”
এবার সবাই চট করেই রুজবাকে চিনে ফেললো। নোমান সাহেব বললো,
–“যদি উনারা রাজি না হোন?”
–“তোমরা রাজি করাবে। আর কিভাবে রাজি করাবে সেটা তোমাদের বিষয়। রুজবাকে ছাড়া আমি অন্য কাউকে বিয়ে করছি না।”

কথাটা বলেই খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে নিজের ঘরে চলে যায় নুহাশ। নোমান সাহেব তার ছোট ছেলের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো৷ এই ছেলেটা তার ছোট থেকেই বড্ড একরোখা আর জেদী। যখন যা বলেছে সেটাই করেছে। নোমান সাহেব এবার ভাবতে বসলো রায়হান সাহেব কি রাজি হবে বেকার ছেলের হাতে মেয়ে তুলে দিতে? শাহানা বললো,
–“আমি যাই দেখি জান্নাতের সাথে কথা বলে দেখি, ওর তো মামাতো বোন। তুমি বরং কিয়ানের বাবার সাথে কথা বলে উনাকে বলো রুজবার বাবাকে প্রস্তাব দিতে।”

–“দেখি বড় ভাই কি বলে। তোমার এই ছোট ছেলে আমাকে হারে হারে জ্বালিয়ে মারলো জন্মের পর থেকে।”
কথাটা বলেই নোমান সাহেব উঠে চলে গেলেন৷ নোমান সাহেবের বড় ভাই রুমান ফারদিন অর্থাৎ কিয়ানের বাবার সাথে কথা বলতে। নোমান সাহেব চলে যেতেই আদিরা খুশি মনে বললো,
–“রুজবাকে কিন্তু আমার ভীষণ ভালো লাগে। খুব মিশুক মেয়ে ও। নুহাশের পছন্দ আছে।”
শাহানা ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
–“তোর দেবরের মাথায় কখন কি যে চাপে আল্লাহ জানে।”
কথাটা বলেই শাহানা টেবিল গোছাতে শুরু করলো। আদিরা আর কথা না বাড়িয়ে এঁটো বাসন নিয়ে কিচেনে চলে গেলো।

মাগরিবের নামাজের পর রায়হান সাহেব আর রুমান সাহেব বাজারের এক চায়ের দোকানে বসে চা পান করছে। কথাবার্তা বলার এক পর্যায়ে রুমান সাহেব বললো,
–“বেয়াই রুজবা মা’য়ের বিয়ে নিয়ে কিছু ভাবছেন নাকি, বিয়ে-শাদি দিবেন এখন?”
রায়হান সাহেব চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললো,
–“এখনো ওর বিয়ে নিয়ে ভাবছি না। সবে তো কলেজে পড়ে, ইন্টার পাশ করুক তারপর ভেবে দেখা যাবে।”
–“আসলে আমি রুজবা মা’য়ের জন্য একটা সম্বন্ধ এনেছিলাম।”
রায়হান সাহেব চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বললো,

–“মেয়েকে তো এখন বিয়ে দিচ্ছি না বেয়াই।”
–“উনারা এখনই বউ ঘরে তুলবে না। আপাতত কাবিন করিয়ে রাখতে চাইছে। আপনি চাইলে ভেবে দেখতে পারেন একবার। আজকালকার যুগে কখন কি হয় বলা তো যায় না। বাজে ছেলেদের পাল্লায় পড়ে যেতে পারে। তার থেকে ভালো না সেরকম কিছু হওয়ার আগেই মেয়েকে কারো সাথে বেঁধে ফেলা?”

–“আমার মেয়ের উপর আমার বিশ্বাস আছে বেয়াই। ও এরকম কিছু করবে না যাতে আমার মানহানি হয়। আর তাছাড়া বিয়ের পরেও স্বামী সংসার ফেলে অনেকে চলে যাচ্ছে। তাদেরকে তো তার স্বামী সংসারের মায়া বেঁধে রাখতে পারছে না।”
–“আমি রুজবার কথা বলছি না। আমি তো শুধু উদাহরণ দিলাম। আর তাছাড়া ছেলের পরিবারকে’ও আপনি চিনেন। চেনাজানার মধ্যেই।”
রায়হান সাহেব কিছুক্ষণ ভেবে বললো,

–“আমার চেনাজানা?”
–“হ্যাঁ, আমার ছোট ভাই নোমানের ছোট ছেলের জন্য। নুহাশ’কে তো চিনেন আপনি। নুহাশ আর কিয়ান তো মাঝে মাঝেই রিয়ান আর জান্নাতের সাথে জান্নাত দের বাড়ি আসা-যাওয়া করেছে।”
–“হ্যাঁ চিনতে পেরেছি।”
–“নোমানের পরিবারের সকলেরই রুজবাকে ভীষণ পছন্দ হয়েছে। আজ দুপুরেই নোমান আমাকে এই বিষয়ে জানিয়েছে, আমি যাতে আপনার সাথে একটু কথা বলি। আপনি চাইলে নোমানের সাথে’ও সরাসরি কথা বলতে পারেন।”

–“যতদূর শুনেছি ছেলে পড়াশোনা করছে। কোনো বাবা কি তার মেয়ে কে বেকার ছেলের হাতে তুলে দেয়?”
–“সেজন্যই তো ওরা এখন শুধু কাবিন করে রাখতে চাইছে। ছেলে যখন নিজের লাইন-ঘাট ধরবে তখন বউ ঘরে তুলবে। আমি নোমানকে আসতে বলছি আপনি ওর সাথেই সরাসরি কথা বলে দেখুন।”
–“না না বেয়াই তার দরকার নেই। আমি এখন মেয়ে বিয়ে দিবো না।”
–“আহা একবার কথা বলেই দেখুন না।”

অনেক সাধনার পরে পর্ব ৫

রায়হান সাহেবের কথার তোয়াক্কা না করেই রুমান সাহেব তার ছোট ভাইকে ফোন করে এখানে ডাকলো। রুমান সাহেব হেসে বললো,
–“নোমান বাজারেই আছে, দুই মিনিটের মাঝেই এসে পড়বে।”
রায়হান সাহেব সামান্য হাসলো। কিছুক্ষণের মাঝেই নোমান সাহেব এসে উপস্থিত হলো চায়ের দোকানে। রায়হান সাহেবকে সালাম দিয়ে রুমান সাহেবের পাশে বসে পড়লো। রায়হান সাহেব আরো তিন কাপ চা দিতে বললো এখানে। অতঃপর তিনজনে আবারো তাদের আলোচনা শুরু করে।

অনেক সাধনার পরে পর্ব ৭