অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ৩০

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ৩০
Mousumi Akter

জেলেপাড়ার নদীর পাড়ে একটা বড় বাঁশের মাচাল আছে। ফায়েক সেখানে বসে রাতে মাছ পাহারা দেয়। এলাকার ছেলে-পেলে দলবেঁধে এসে সেখান থেকে মাছ চুরি করে নিয়ে যায়। ওরা প্রফেশনালি চো’র নয়। কিন্তু দলবেঁধে ঘুরতে এসে মাছ পেলেই চু’রে নিয়ে যায়। ফায়েক গায়ে তীব্র জ্বর নিয়ে শিমুল তোলার মোটা লেপ গায়ে দিয়ে মাচালে সুয়ে মাছ পাহারা দিচ্ছে।কিন্তু এই লেপে তার শীত কমছে না। নদী থেকে ঠান্ডা বাতাস ভেষে এসে ফায়েকের শরীর যেন আরোও শীতল করে তুলছে। থর থর করে কাঁপছে ফায়েক। ফায়েকের স্ত্রী ফায়েকের মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে আর বিড়বিড় করে বলছে,

” আমি বুঝতাছি না, তুমি এহনো ক্যান এই মাছ ধরো।মাছ না ধরলে কি আমরা না খাইয়া মইরা যাবো। ”
ফায়েক জ্বরের ঘোরের নিজের স্ত্রীর হাতটা চেপে ধরে বলল,
” তুমি বোঝো না ক্যান? তোমারে যহন আনছিলাম এই মাছ ই আমারে খাওন জুগাইতো। পোলাডারে মাইনষের মত মানুষ বানাইতে পারছি। এই পেশা আমার র*ক্তে মিইশা গেছে।আমি ছাড়তে পারুম নাহ।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” তোমার পোলা তো এহন কাম কাজ করে। সে বড় চাকরিজীবী।তাও ক্যান তুমি এহনো এইসব করবা। বেতন পাইয়া সব গুলান টাহা তো তোমার হাতেই দিয়া দেয়।তাও তোমারে বলে -কয়েও সে এই কাম বাদ দেওয়াতে পারতাছে না।আমি নিজেও বুঝতেছি না কি দরকার এই মাছ ধরনের।”
” মাছ না ধরলে সময় কাটাবো কেমনে রে। মাছ তো আর বেঁচতেছি না।”

” ওই চৌধুরী বাড়ি থেইকা আহনের পর থেইকাই তো দেখতাছি মাছ বেঁচা বাদ দিয়া দিছো।ওই অ’মানুষের জাতগের সারাজীবন মাছ খাওয়ালে তাও তোমার গায়ে হাত তুলল।সেইখান থেইকাই জ্বর তোমার।আমি আমার পোলারে আর লুকাবো না।এইসব কথা কইয়া দিবো।ওই চৌধুরী তোমারে মা’র ‘ছে।”
ফায়েক তার স্ত্রীর হাত চেপে ধরে বলল, “খবরদার আমার পোলার কানে এইসব দিবানা।পোলা কষ্ট পাইবো। আমার পোলারে এইসব কইলে, আমার ম’রা মুখ দেখবা কইয়া দিলাম।”
ফায়েকের স্ত্রী রাগান্বিত হয়ে বলল,

“আমি কোনদিন সুযোগ পাইলেই এর প্রতিশোধ নিয়েই ফেলব।”
ফায়েক জ্বরের ঘোরে বলল, ” কার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিবা। ওরা কারা ভুইলা গেলা।”
” সে জন্যই বললাম, সুযোগ খান যেন একদিন পাই।”
” ওইসব ভুইলা যাও। এহন পোলাডারে বিয়ে দিতে হইবো। মেয়ে দেখন লাগবো না?”
” তোমার পোলা এক মাইয়ারে পছন্দ করে। আমারে বলছে।”
” মেয়ের বাড়ি কই, গায়ের রং পদ কেমন?”
” কিছুই কয়নাই। একটাই কথা কইছে মাইয়াডারে তার অনেক পছন্দ। ”

“জ্বর কমলেই পোলার বিয়া দিয়ে দিবো। চোখের সামনে দিয়ে নাতি-নাতনদের ঘুরাঘুরি দেখতে পারতাছি।”
রাত অলরেডি একটা বেজে গিয়েছে। পূর্ণতা, পুষ্প,পুজা গতদিনের ন্যায় আড্ডা দিয়ে যাচ্ছে।ইদানিং আড্ডা দেওয়াটা যেন ওদের কাছে নেশার মত হয়ে গিয়েছে।পূজা বলল, ” পূর্ণদি, পুষ্পদি কি করি বলুন তো!”
পুষ্প ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, “,আবার কি হয়েছে তোর।”
“ওইযে কৃষ্ণ আমাকে একটু রাস্তায় যেতে বলছে।ওর নাকি জলতেষ্টার মত তেষ্টা পেয়েছে আমাকে দেখার জন্য।বুক নাকি একদম ফেঁটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে।”

পূর্ণ পুষ্পের দিকে তাকিয়ে বলল, ” তোমার ভাই তো আমাকে কোনদিন এভাবে বলল না আপু।”
পুষ্প এক গাল হেসে বলল, ” আমার ভাই যা বলতে পারে তা পৃথিবীর কেউ পারবে না।”
এমন সময় পুষ্পের ফোন বেজে উঠল। স্ক্রিনে ভাষসে রাজনের নাম্বার। পূর্ণ বলল,
” আপু তোমার ভাই কিন্তু তোমাকে নিয়ে দুঃচিন্তা করেই যাচ্ছে।”
পুষ্প চিন্তিত মুখে বলল, ” কেন?”

“ওইযে বলেছিলাম না, তোমাকে রাজন ভাইয়ার সাথে দেখে ফেলছিলো।সেদিন থেকেই চিন্তায় আছে।”
“শোণ পূর্ণ তুই থাকতে যেন আমার আর রাজনের ভালবাসা আলাদা না হয়।”
“তোমার ভাই কোনদিন তোমার খারাপ চাইবে না আপু। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো।”
এমন সময় ছাদে প্রভাত প্রবেশ করল।সে শুকনো কাশি দিয়ে পূর্ণতার দৃষ্টি আকর্ষণ করল।ওরা তিনজন-ই ফিরে তাকাল।প্রভাত প্যান্টের পকেটে হাত গুজে দাঁড়িয়ে ব্যস্ত স্বরে ডাকল,

“পূর্ণতা।”
পূর্ণতা উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“হ্যাঁ বলুন।”
“আমি যে নীল রঙের ফাইল টা তোমায় দিয়েছিলাম ওটা দিয়ে যাও।”
পূর্ণতা অবাক হয়ে প্রশ্ন করল,
“কবে দিলেন?”
প্রভাত কপালের চামড়ায় কয়েকটা ভাজ ফেলে জিজ্ঞেস করল,

“কবে দিলাম মানে। এত ভুলে যাও কীভাবে তুমি।”
“আমি একটুও ভুলিনি। আমাকে দেন নি আপনি।”
“আমি দিয়েছি।রুমে এসে খুজে দেখো।খুব গুরুত্বপূর্ণ ফাইল ছিলো।”
পুষ্প আস্তে করে বলল,
“পূর্ণ যা। তোর হয়ত খেয়াল নেই।খুজে দিয়ে আয়।”
“আপু আমাকে দেয়নি উনি ফাইল।”

পুষ্প বলল, “যা তুই।রুমে যা মনে পড়বে।”
পূর্ণ যাওয়ার সময় বলল, “আমি না ফিরলে কিন্তু বাকি গল্প করবা না আপু।”
পুষ্প হেসে বলল, ” ঠিকাছে তুই যা।”
পূজা ভীষণ দুষ্টু প্রকৃতির মেয়ে।পূর্ণ উঠে যেতেই পূজা এগিয়ে গেল পিছ পিছ।প্রভাত আর পূর্ণ কিভাবে রুমে যাবে সেটা দেখার জন্যই পূজা এগিয়ে গেল।
প্রভাত কয়েক সিঁড়ি নিচে নেমে দাঁড়াল।পূর্ণতাও প্রভাতের সাথে সাথে কয়েক সিঁড়ি নিচে নেমে খানিকটা চিন্তা নিয়ে প্রশ্ন করল,

“কি ব্যাপার কবে দিলেন আপনি ফাইল? আমার ব্রেন এতটাই খারাপ হয়ে গিয়েছে যে সব ভুলে যাবো।”
প্রভাত সাথে সাথে পূর্ণতাকে কোলে তুলে নিয়ে বলল,
“ফাইলের কথা ভোলোনি কিন্তু নিজের বরকে ঠিকই ভুলে বসে আছো।”
“কি করছেন পড়ে যাবো।নামান আমাকে।”
“গলা জড়িয়ে ধরো। রোমান্টিক একটা ভাব আসবে।”
“না ধরব না।”

“আমি তো তোমাকে ছাড়ছি না। শুধু শুধু ঝুলে থেকে কষ্ট না দিয়ে জড়িয়ে ধরে একটু শান্তি দেও।”
পূর্ণতা জানে প্রভাত যখন বলেছে ছাড়বে না, তার মানে ছাড়বে না।উপায় না পেয়ে প্রভাতের গলা জড়িয়ে ধরল।
প্রভাতের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
” কাহিনী কি আপনার? আপনার কোন ফাইল আমাকে দিয়েছেন?”
প্রভাত পূর্ণতার গালে একটা চুমু দিয়ে বলল,
“মিথ্যা না বলে তোমাকে আনা যাচ্ছেনা।তুমি কি সহযে আসতে ওখান থেকে। এত রাতে নিজের এত সুন্দর সুদর্শন রোমান্টিক বর রেখে কীভাবে ছাদে গিয়ে বসে থাকো।”

” ছাদের হাওয়া ভাল লাগে।”
” আমার ভালবাসার হাওয়ার চেয়েও ছাদের হাওয়া ভাল লাগে তোমার।”
” হ্যাঁ লাগে। এইবার ছাড়ুন আমাকে।”
প্রভাত আবারও পূর্ণতার গালে চুমু দিয়ে বলল,
“আমার ঘুম পাচ্ছে পূর্ণ। ”
“আপনার ঘুম কি আমি ঘুমিয়ে দেব।”
“না,তোমাকে জড়িয়ে না ধরলে ঘুম আসবে না।”
বলেই প্রভাত পূর্ণতাকে কোলে নিয়ে নিজের রুমে চলে গেল।রুমের সিটকিনি লাগিয়ে পূর্ণতাকে বিছানায় সুইয়ে দিয়ে বলল,

” একটুও নড়বে না কিন্তু।আমি লাইট অফ করে দিয়ে আসি।”
পূর্ণতা চট জলদী উঠে বসে বলল, ” লাইট অফ করবেন মানে?”
পূর্ণতার কথার কোনো জবাব না দিয়ে প্রভাত লাইট অফ করে ডিম লাইট জ্বালিয়ে দিল।গায়ের টি-শার্ট খুলে কোর্ট স্ট্যান্ডে ঝুলিয়ে বিছানায় গেল।প্রভাত বিছানায় আসতেই পূর্ণতা বলল,
” আ ‘ আপনি খালি গায়ে কেন? টি-শার্ট খুললেন কেন?”
প্রভাত দুষ্টু হেসে জবাব দিল, ” তুমিও খুলে ফেলো। আমি ছাড়া অন্য কেউ নেই এখানে।”

পূর্ণতা বিড়বিড় করে বলল, ” লজ্জা শরম কিছুই নেই।” বলেই বিছানা ছেড়ে উঠতে গেল।তখন ই প্রভাত পূর্ণতাকে টেনে ধরে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে ধরল।খুব আদুরে কন্ঠে বলল, ” কোথায় পালাচ্ছো পূর্ণ? আমার বুকের চেয়ে স্বস্তিদায়ক জায়গা আর কোথাও পাবেনা তুমি।” বলেই প্রভাত পূর্ণতার কপালে চুমু দিলো।
পূর্ণতার তপ্ত নিঃশ্বাস প্রভাতের বুকে আঁচড়ে আঁচড়ে পড়ছে। সেই সাথে প্রভাতের সর্বাঙ্গে উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ছে।প্রভাত কিছুটা নেশাক্ত হয়ে পড়েছে। পূর্ণতাকে আরো আদর, ভালবাসা, যত্নের সাথে জড়িয়ে ধরে বলল,

” আমার পূর্ণতা, তুমি সত্যিই আমার পূর্ণতা। তুমি দূরে গেলেই আমার পুরো পৃথিবী থমকে যায়, শব্দরা ভাষাহীন হয়ে পড়ে,হৃদস্পন্দন থেমে যায়। আবার যখন ই তুমি সামনে আসো হৃদস্পন্দন ভয়ানক গতিবেগে চলতে থাকে।কেন এমন হয় তুমি কি তা জানো পূর্ণ? ”
পূর্ণ ভারী কন্ঠে জবাব দিল, ” না।”
” তোমার ও কি আমাকে দেখলে এমন হয় পূর্ণ? হৃদস্পন্দনে কিছু এলোমেলো হয়?”
” জানিনা।”

প্রভাত পূর্ণতাকে আরোও আদর ভালবাসার মিশ্রিত কণ্ঠে বলল,
” জানিনা কথাটা হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত করে তুলছে। দহন হচ্ছে তীব্র ভাবে।একবার কি ভালবাসি বলে হৃদয়ের যন্ত্রণা নেভাবে না।তোমার সামান্য একটু স্পর্শ আমাকে শীতল করে দেয়। যেদিন ভালবাসি বলবে ওইদিন মনে হয় পুরোপুরি শান্ত হয়ে যাবো।””
পূর্ণতা অস্ফুটে স্বরে বলল,

” আপনাকে অশান্ত ই ভাল লাগে। ” কন্ঠে ছিলো প্রবল লজ্জা। সেই লজ্জায় প্রভাত যেন স্পষ্ট ভালবাসা অনুভব করল।
প্রভাত পূর্ণতার মুখটা তুলল। প্রভাতের বুকে পূর্ণতার থুতনি।ডিম লাইটের কৃত্তিম আলোয় দু’জন ভালবাসার মানুষের চোখ -মুখে গভীর লজ্জা ফুটে উঠেছে।প্রভাত কন্ঠ খাঁদে নামিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
” তোমার এমন চাহনিই যথেষ্ট আমাকে বিনাশ করার জন্য। অস্ত্রবিহীন এক কিলার তুমি। কি সুন্দর চোখের দৃষ্টি মেলে আমাকে বিনাশ করে দিলে।”

” কতদিন থাকবে এমন ভালবাসা।”
” দিনের হিসাব আমার কাছে নেই। আগের জন্মে তোমাকে ভালবেসেছি, এ জন্মে তোমাকে ভালবাসব,পরজন্মে তোমাকেই ভালবাসব।”
পূর্ণতার কাছে দেওয়ার মত আর কোনো জবাব নেই। সে আবার ও মুখ গুজল প্রভাতের বুকে। প্রভাত পূর্ণতাকে জড়িয়ে ধরে বলল,

” একটা সারপ্রাইজ আছে আগামিকাল।আমি সিওর তুমি কি খুশি হবে।”
” কি সারপ্রাইজ।”
” এখন না, শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। ”
পূর্ণতার ভাল লাগছে। প্রভাত কাছে এলেই তার ভাল লাগে। কিন্তু লজ্জায় প্রকাশ করতে পারেনা।

পূজা হাসতে হাসতে পুষ্পের কাছে এসে বলল, “জানেন পুষ্পদি।”
“কি?..”
“প্রভাত দা পূর্ণ দিকে কোলে তুলল। আর কি বলল জানেন।

“শুনব না।”
“আরে শুনুন না।”
” তুই এত ইচড়ে পাকা কেন?”
” না আপনাকে শুনতেই হবে।”

এমন সময়ে পুষ্পের ফোনে আবার ফোন এল।পূজা উঁকি দিয়ে বলল,
“কে ফোন দিয়েছে রাজন?”
“আমার ফোনের দিকেও চোখ গিয়েছে তোর।”
“আমার পাড়ায় রাজন নামে এক দাদা আছে।”
পুষ্প কিছুটা কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল,

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ২৯

“তোর পাড়ায়?”
“হ্যাঁ,কৃষ্ণের দাদা।”
পুষ্পের মনে সন্দেহ হল।তাহলে কি রাজনের সাথে সে থাকে সেই পূজার প্রেমিক।হ্যাঁ কৃষ্ণ ও তো বলে তার প্রেমিকার নাম পূজা।

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ৩১

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here