অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ৩১

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ৩১
Mousumi Akter

পুষ্প সন্দিহান হল, তবে সে সিওর হতে পারছে না। কারণ রাজনের চলাফেরা, কথাবার্তা কোনো কিছুই জেলেপাড়ার মানুষদের মত নয়। তাছাড়া রাজন তো শহরে থাকে।তার বাড়িতো জেলেপাড়ায় নয়। হলেও তো রাজন তাকে জানাত।তাছাড়া জেলেপাড়ায় তো সবই হিন্দু।হাতে গোনা কয়েকঘর মুসলিম আছে।

যেমন ফায়েক চাচা একজন।পুষ্পকে গভীর চিন্তায় মগ্ন থাকতে দেখে পূজার দুষ্টু বুদ্ধি মাথায় চাপল। মুখের সম্পূর্ণ অবয়বে দুষ্টুমি।পূজা আচমকা পুষ্পর গালে চুমু দিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠল।মধ্যরাতে সম্পূর্ণ ধরণী ঘুমের রাজ্য ডুব দিয়েছে।চারদিকে পিনঃপতন নিরবতা।শুধু শোনা যাচ্ছে ষোড়শী এক কিশোরীর প্রাণখোলা হাসির শব্দ।বাতাসে রাতের নিরবতায় সে হাসির শব্দ কতদূর ভেষে গেল তা অজানা।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

পুষ্প গাল হাত রেখে যেন স্তব্ধ হয়ে গেল।তার শরীরে ঠান্ডা অনুভব হল। শিরশির করে উঠল।তার জীবনে এমন ঘটনা এই প্রথমবার ই ঘটল।সে নিষ্পলক তাকিয়েই রইলো পূজার মুখপানে।পূজা কি সুন্দর মন খুলে হাসছে।যেন এই পৃথিবীতে তার চেয়ে সুখী মানবী দ্বিতীয়টি নেই। পূজার এই হাসি বলে দেয় সে কতটা সহজ-সরল।পূজা হাসতে হাসতে বলল,

“জামাই বাবুর আগে আমিই তোমাকে আদর করে ফেললাম পুষ্পদি। জামাইবাবুকে যেন একথা বলোনা।তাহলে আবার রেগে -মেগে যাবে।”
পুষ্প ভ্রুঁ উঁচিয়ে তাকিয়ে রইলো পূজার দিকে।সব সময় এমন দুষ্টামি কীভাবে করতে পারে।এত দুষ্টুবুদ্ধি মেয়েটার মাথায়।পুষ্প কিছু বলার আগেই পূজা আবার-ও বলল,

“আমিতো মেয়ে।তাছাড়া তুমি আমার দিদি।দিদিকে চুমু দেওয়ায় জামাই বাবুর রাগের বা কি আছে? এমন হলে কিন্তু এটা বাড়াবাড়ি ছাড়া আর কিচ্ছুই না পুষ্পদি।আমি ঠিক বলছি না পুষ্পদি?”
পুষ্প ভ্যাবাচেকা খেয়ে পূজার দিকে তাকিয়ে রইলো।পূজার ভাবসাব এমন যেন পুষ্পর বর সত্যিই রাগ করেছে।পুষ্প সিঁড়ির দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে বলল,

“তুই এমন করছিস যেন সত্যিই তোর জামাই বাবু রাগ করেছে।”
পূজা পুষ্পের পিছ পিছ সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বলল,
“না মানে কল্পনা করলাম আরকি।আমার একটা কল্পনার পৃথিবী আছে পুষ্পদি।সেই পৃথিবীতে কোনো খারাপ ভাবনা নেই।আমি সব ভালো ভালো জিনিস ভাবতে থাকি।এই ধরো,আমার আর কৃষ্ণের ঘর-সংসার, বাচ্চা কাচ্চা সব নিয়ে সেই পৃথিবী। ”

পুষ্প পূজার দিকে তাকিয়ে একটা ফ্রেশ হাসি দিয়ে বলল,
“তুই সত্যি অনেক সুখি মানুষ পূজা।”
“এখন কি ঘুমাতে যাচ্ছো?”
“আরোও রাত জাগতে বলছিস নাকি।”
“রাজন দার সাথে দেখা করবা না।”
“না।”

“কেন?”
“বাড়ির কেউ দেখলে ঝামেলা হবে।”
“কি ঝামেলা হবে।”
“ওসব তুই বুঝবি না।চল ঘুমোতে হবে।”
পূজা মিনমিনিয়ে বলল, “আমি এখন ঘুমাতে যেতে পারব না পুষ্পদি।”
পুষ্প সন্দিহান হয়ে পূজার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “রাত প্রায় শেষ। তুই এখনো ঘুমোবিনা।”
“কৃষ্ণ এসছে আমার সাথে দেখা করতে।আমি ওর সাথে দেখা করব।”

পুষ্প আবার ও চরম অবাক হয়ে প্রশ্ন করল,
“কৃষ্ণ এসছে মানে? কোথায় এসছে?”
“পাচিলের ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে।আমি গেলেই পাচিল টপকে ভেতরে আসবে।!
পুষ্প খানিকটা ধমকের স্বরে বলল, ” এসব মোটেও ঠিক নয় পূজা।এত রাতে একটা ছেলের সাথে দেখা করা।”
পূজা হঠাৎ শান্ত হয়ে গেল।শীতল কণ্ঠে বলল,

“ও একটা ছেলে নয় আমার কাছে।ও আমার বুকের পা পাশে থাকা হৃদপিন্ড। হৃদস্পন্দের গতিবগের সাথে আমি ওকে ফিল করতে পারি।তোমাকে বুঝাতে পারব না পুষ্পদি আমি কৃষ্ণকে কত ভালবাসি।কৃষ্ণ ছাড়া আমি কত অসহায়।”
পুষ্প পূজার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।মেয়েটা যখন ভালবাসার কথা বলছে তখন কেমন যেন অসহায় এর মত দেখাচ্ছে।এত ভালবাসাও সম্ভব কাউকে।পুষ্প পূজার কাঁধে হাত রেখে বলল,
“এত রাতে কেউ দেখলে ঝামেলা হবে পূজা সোনা।”
“কি ঝামেলা?”

“তোদের মা’র’তে পারে কেউ দেখলে।এত রাতে অবিবাহিত দু’জন ছেলে-মেয়ে।বুঝিস তো।”
“জানো পুষ্পদি আমরা দু’জন-দুজনকে না দেখে থাকতে পারিনা।এখানে কাজে এসছি শুধু মাত্র টাচ ফোনের টাকা জোগাড় করতে।যেন আমি ওকে সব সময় দেখতে পারি।অনেক দিন তাকে দেখিনা আমি।দেখার তৃষ্ণায় কেমন যেন ম’রে যাচ্ছি।ওকে এক নজর দেখার জন্য যদি আমি মরণ হয় তবে তাই সই।”

পুষ্প এবার যেন আরোও চমকালো।এত ভালবাসা, এত আবেগ,এত প্রেম দুজনের মাঝে।এই পৃয়হিবীতে এত ভালবাসাও আছে।সে কি রাজন কে এতটাই ভালবাসে।নাকি এর চেয়েও বেশী।ভাবতে ভাবতে পুষ্প ঘরে গেল।আর পূজা ভয়-ভিতী বিসর্জন দিয়ে গেল কৃষ্ণর সাথে দেখা করতে।

খানিকটা বেলা হলে ঘুম ভাঙল পূর্ণতার। আজ সে গভীর ঘুমে মগ্ন ছিলো।ঘুম ভাঙতেই আরামদায়ক অনুভূতি হল।আড়মোড়া দিয়ে সোয়া থেকে উঠতেই সে চমকে উঠল।তাকিয়ে দেখল তার পরণের পোশাক পরিবর্তন। গতরাতে তার জরজেটের থ্রী-পিছ পরা ছিলো।এখন পরণে টকটকে লাল রঙের নাইটি।পূর্ণতার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল।তার পরণের পোশাক পরিবর্তন কীভাবে হল।মুহুর্তের মাঝে পূর্ণতার মাথায় এল প্রভাতের কথা।এ কাজ প্রভাত ছাড়া আর কারো নয়।

তার মানে কী? প্রভাত তার সাথে অন্য কিছু করেছে।রাতে কি তাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়েছিলো।না হলে এত কিছু হয়ে গেল আর সে কিছুই টের পেলনা।পূর্ণতা ঘরের চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখল প্রভাত কোথাও নেই। ঘরের সিটকিনি ও লাগানো।তাহলে প্রভাত কোথায়? পূর্ণতার দৃষ্টি গেল ওয়াশরুমের দরজার দিকে।ভেতরে পানি পড়ার শব্দ হচ্ছে।তার মানে প্রভাত ভেতরে।এই মুহুর্তে পূর্ণতার ইচ্ছে হচ্ছে প্রভাত গি- লে খে- য়ে ফেলতে।পূর্ণতা বিছানা ছেড়ে নামতে যাবে তখন ই ওয়াশরুমের দরজা খুলে বেরিয়ে এল প্রভাত।

সাত সকালে পূর্ণতা যতটা রেগে গিয়েছিলো তার চেয়ে বেশী অভিভূত হল প্রভাতকে দেখে। সাত সকালে প্রভাত কে ভীষণ স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে।গোসলের পর কোনো পুরুষকে এত সুন্দর দেখায় পূর্ণতা আগে পরে দেখেনি।প্রভাতের সর্বাঙ্গে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি।গায়ে কিছুই নেই, পরণে সাদা টাওয়াল নাভির নিচে গিট দেওয়া।লম্বা, ফর্সা, মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে খালি গায়ে প্রভাতকে পৃথিবীর সব চেয়ে সুদর্শন পুরুষ দেখাচ্ছে।পূর্ণতা যে চরম ক্রাশ খেয়েছে তা তার চোখ-মুখে দৃশ্যমান।প্রভাত হাত দিয়ে মাথার পানি ঝাড়তে ঝাড়তে পূর্ণতার দিকে তাকাল। প্রভাত বিচক্ষণ পুরুষ মানুষ। পূর্ণতার নেশাতুর চাহনির মানে চোখের পলকেই বুঝে গেল।ঠোঁটে দুষ্টু হাসি চেপে পূর্ণতার দিকে তাকিয়েই বাম চোখ টিপল প্রভাত। চোখ টিপে বলল,

“ওভাবে তাকিয়ে কি দেখছো? আমাকে খালি গায়ে দেখে লোভ হচ্ছে তোমার? আদর করতে চাও? দেখো আমার গোসল করা শেষ।যদি কিছুক্ষণ আগেও বলতে ভেবে দেখতাম।”
প্রভাতের এতগুলা অসভ্যমার্কা প্রশ্ন শুনেই পূর্ণতা তার চোখ মুখের চাহনির পরিবর্তন করে ফেলল।মুহুর্তের মাঝে ফুঁশে উঠে বলল,

“অসভ্যতার একটা লিমিট থাকা উচিৎ। ”
প্রভাত পূর্ণতাকে রাগিয়ে দিতে পুনঃরায় বলল,
“রেগে যাচ্ছো? আচ্ছা তুমি যা চাও তাই হবে।আসছি আমি।” বলেই প্রভাত বিছানায় গেল।বিছানায় বসে পূর্ণতার দিকে ঝুঁকল।তাতে এক গোছা দলা পাকানো চুল প্রভাতের কপালে পড়ল।এই মুহুর্তে প্রভাতকে আরোও বেশী সুন্দর দেখাচ্ছে।পূর্ণতা যতই রেগে থাকুক।ভেতরে ভেতরে মুহুর্তে মুহুর্তে পূর্ণতাকে দেখে মুগ্ধ হচ্ছে।এই মুগ্ধতার শেষ কোথায় সে অনুমান করতে পারছে না।প্রভাতকে এভাবে ঝুঁকতে দেখে পূর্ণতা ফোঁস করে উঠে বলল,

“আমার ড্রেস চেঞ্জ কীভাবে হল জানতে পারি?”
প্রভাত খুব শান্ত কন্ঠে জবাব দিল, “আমিই চেঞ্জ করে দিয়েছি।”
প্রভাত কেমন সংকোচ ছাড়া জবাব দিল।এটা যেন আহামরি তেমন কোনো ঘটনা নয়।পূর্ণতা খিটখিটে কণ্ঠে বলল,
“আপনি চেঞ্জ করে দিয়েছেন মানে? আমার পারমিশন ছাড়া আপনি এসব করবেন? আপনি জানেন না নিজের বউ হলেও তার পারমিশনের প্রয়োজন আছে।”

প্রভাত পূর্ণতার মুখের দিকে তাকাল।কিছু একটা ভেবে উত্তর দিল,
“তুমি কি ইন্টিমেন্ট এর কথা ভাবছো?”
পূর্ণতার সরাসরি এটা বলতে মুখে বাঁধছিলো।প্রভাত যখন নির্লজ্জের মত কথাটা বলেই ফেলেছে তখন পূর্ণতা সিরিয়াস কণ্ঠে বলল,

“কেন করেছেন?আমি আপনার থেকে এমনটা আশা করিনি।”
প্রভাত পূর্ণতার কপালের দিকে ওষ্ট এগিয়ে নিয়ে কপাল বরাবর একটা আলতো চুমু দিয়ে বলল,
“এসব হলে কি তুমি টের পেতে না।যতই ঘুমিয়ে থাকো টের পাওয়ার কথা।”
“ঘুমের ফায়দা নিয়েছেন আপনি।”

“ফায়দা নিবো কেন? আমি কি নারী খেকো পশু।যে ঘুমন্ত বউ এর প্রতি অত্যাচার চালাব। শারিরীক সম্পর্ক বলো আর যায় বলো এসব ভালবাসার গভীরতা থেকে আসে।অনুভূতির জিনিস।এসব জোর করে হয়না। জোর করে, সুযোগ নিয়ে এসব করব কেন? তোমাকে বিয়ে করেছি ভালবাসি বলে।ভালবাসা মানেই কি শুধুই শারিরীক মিলন।মনের ক্ষুদা মিটাতে বিয়ে করেছি, শারিরীক ক্ষুদা নয়।আমি মানুষ। শারিরীক ক্ষুদা যে নেই তা নয়।তবে ওটা না হলেও প্রভাত চৌধুরীর জীবন চলবে।শুধু তুমি থেকে যাও আমার সাথে আমার আর কোনো সমস্যা হবেনা।”

“তাহলে কাপড় চেঞ্জ কেন করেছেন?”
“জরজেট জামায় ভাল ঘুম হতনা তোমার।শান্তিতে যেন ঘুমোতে পারো তাই করেছি।”
বলেই প্রভাত উঠে গেল।আলমারি খুলে একটা গ্রে কালারের শার্ট বের করল।পূর্ণতা প্রভাতের দিকে তাকিয়ে ভাবছে এই মানুষটা তার প্রতি এত যত্নশীল কেন? সব কিছুতে এত খেয়াল। প্রভাত পূর্ণতার দিকে তাকিয়ে বলল,

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ৩০

“কি ভাবছো? আমি কিছু দেখেছিলাম কীনা? সত্য বলা যাবেনা। তাহলে চাকরি থাকবে না।”
পূর্ণতা লজ্জা পেল।কথা ঘুরাতে বলল,
“কি সারপ্রাইজের কথা বলেছিলেন।”
“পুষ্পর জন্য ছেলে দেখেছি।সেখানে আজ পাকা কথা দিতে যাচ্ছি।”

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ৩২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here