অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ৪২

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ৪২
Mousumi Akter

(এলার্ট হার্টে প্রব্লেম থাকলে এড়িয়ে যাবেন।)
আজ তিনদিন ধরে পূর্ণতা কারো সাথে একটা কথা বলেনি, সামান্য পানিটুকুও স্পর্শ করেনি। জানালার গ্রিল ধরে সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে অন্ধকার বাগানটার দিকে। কারণ ওখানেই তার মায়ের দাফন হয়েছে। চোখ থেকে নির্গত হচ্ছে ক্রমাগত পানি। কেউ সান্ত্বনাটুকুও দিতে পারছে না ঠিকভাবে। ওদিকে পূজা বিগত তিনদিন ধরে নিঁখোজ। রাজন তার সমস্ত ফোর্স কাজে লাগিয়েছে। কিন্তু পূজার কোনো সন্ধান মিলছে না। পূজার কিছু হয়ে গেলে পূজার মা-বাবাকে দেওয়ার মত কোনো উত্তর থাকবে না। কারণ রাজনের বাবা-ই পূজাকে এ-বাড়িতে নিয়ে এসছিলো। রাজন রাত-দিন এক করে পূজাকে খুঁজে চলেছে।

তখন উত্তপ্ত দুপুর। রাজনের সাথেই কৃষ্ণ রয়েছে। মাথার উপর দুটো কাক কা,কা করছে। রাজন আর কৃষ্ণ যেদিকে যাচ্ছে কাক দু’টোও সেদিকে যাচ্ছে। কৃষ্ণ কাক দুটোর দিকে তাকাতে যেয়ে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। সাথে সাথে গাল কেটে র’ক্ত বেরোলো। রাজণ দ্রুত কৃষ্ণকে মাটি থেকে তুলল। পকেট থেকে রোমাল বের করে র’ক্ত মুছে দিতে দিতে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘ একটু সাবধানে কৃষ্ণ। চল কিছু খাবি। একদম দূর্বল হয়ে গিয়েছিস।’
কৃষ্ণ একদম বাচ্চাদের মত ফ্যালফ্যাল বদনে রাজনের দিকে তাকালো। আচমকাই হাউমাউ করে কেঁদে উঠে রাজনের পা-দুটো জড়িয়ে ধরল। পা জড়িয়ে ধরে বলল,

‘ দাদা শুধু পূজারে খুজে এনে দেন। ওর মুখটা দেখলে আমার আর খাওয়া লাগবেনা। আমি ওরে ছাড়া বাঁচব না রাজন দাদা। গত তিনদিন ধরে আমি যে যন্ত্রণা পাচ্ছি তা মৃত্যু যন্ত্রণাকে ছাড়িয়ে যাবে দাদা। আমার হৃদয় টা যদি আপনাকে চিরে দেখাতে পারতাম যদি। দাদা আমি কি আমার পূজারে খুজে পাবো। ‘
রাজন কৃষ্ণকে উঠালোম কৃষ্ণের চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,

‘ আমরা পূজাকে খুঁজে পাবো। পূজাকে হয়ত জীবিত পাবো। কিন্তু তোকেই তো পূজা এসে মৃত পাবে। এত ভালবাসিস কীভাবে কৃষ্ণ? ‘
কৃষ্ণ শুধু অঝোরে পানি ফেলল।

ওয়াজেদ দুপুরে বাড়িতে ফিরল। বাড়িতে ফিরেই ডায়নিং এ বসল। প্রভাত তখন পূর্ণতার জন্য খাবার তুলছিলো প্লেটে। ওয়াজেদ কে দেখে প্রভাত খাবারের প্লেট টা রেখে খুব শান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
‘ পূজা যে নিঁখোজ আপনি কি কিছু জানেন চাচা এ ব্যাপারে।’
ওয়াজেদ প্রভাতের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ আমি নিজেই তো খোঁজার চেষ্টা করছি। কিন্তু মেয়েটাকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছেনা।’
‘ আপনার তো চরিত্রে সমস্যা আছে। ওই বাচ্চা মেয়ের সাথে কিছু করেন নি’তো? যদি আপনি জড়িতে থাকেন, আমি আপনাকে খু’ন করে প্রয়োজনে জেলে যাবো। তাও আমি আপনাকে এইবার ছাড়ব না চাচা। ‘
ওয়াজেদ মোলায়েম কণ্ঠে বলল,

‘ আমি খারাপ সেটা আমি জানি, তাই বলে কি আমি বাড়ির মেয়েদের সাথে খারাপ কিছু করব। তুমি কি আমাকে এই গ্রাম বা বাড়ি কোথাও কিছু করতে দেখেছো? আমার তো অন্য সন্দেহ হচ্ছে। প্রায় প্রায় যে কা’টা মাথা পাওয়া যায়। পূজা তাদের হাতে পড়েনিতো?’

‘ আপনি আর বাবা কি তাদের সাথেও জড়িত চাচা?’
‘ ছিঃ ছিঃ এসব কি বলছো প্রভাত। তুমি এত নিচু চোখে কেন দেখো আমাদের।’
‘ কারণ এর চেয়ে ভাল নজর আপনাদের প্রতি আমার আসেনা চাচা। ‘
প্রভাত খাবার নিয়ে ঘরে গেলো। পূর্ণতা তখনও চোখের পানি ফেলছে অনবরত। প্রভাত পূর্ণতার কাঁধে রাখল। পূর্ণতা অশ্রুসজল চোখে প্রভাতের দিকে তাকাল। প্রভাত মলিন কণ্ঠে বলল,

‘ কিছু খেয়ে নাও। না ‘হলে অসুস্থ হয়ে পড়বে তুমি।’
পূর্ণতা ঠোঁট ফুলয়ে কেঁদে উঠে প্রভাতকে জড়িয়ে ধরল। প্রভাত পূর্ণতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
‘ পূজার ব্যাপার’টা শুনেছো?’
‘ হ্যাঁ, আপনি পিচ্চি পূজাকে খুঁজে আনুন প্লিজ!প্লিজ খুঁজে আনুন। ‘
‘ আনব, ওর যেন কিচ্ছু না হয়।’

তখন রাত বাজে বারোটা। জেলে পাড়ার গহীন এক জঙ্গল আছে। যে জঙ্গলটা নদী টপকে, নদীর ওপারে। এপারের মানুষ ওপারে কখনো যায়না। এমন ভয়ঙ্গকর বাগান যেখানে দিনে-রাতে কেউ কখনো প্রবেশ করেনা।
সেখানে ছোট্ট একটা কুড়ে ঘর আছে। পূজাকে সেখানেই নিয়ে রাখা হয়েছে। এই তিনদিনে একটানা গণ ধ* র্ষ* ণ চলছে পূজার প্রতি। আঘাতে আঘাতে ফুলের মত মেয়েটার দেখার কিছু নেই। কথা বলার বলটুকুও নেই পূজার। কোনোওরকম নিঃশ্বাস চলছে। ওয়াজেদ এর গুরু আবারও পূজার ওপর ঝাপিয়ে পড়ল। পুজা কাতর কণ্ঠে বলল,

‘ আপনাকে আমি দেবতার মত জানতাম। আপনিও এমন। তাও আমার সাথে এমন করছেন।’
সেলোকটা হো’হো শব্দে হেসে উঠে নিসৃংসতা চালিয়ে গেলো। এরপর ই ওয়াজেদ গেলো। পূজা হাত জোর করে বলল,
‘ আপনারা আমার বাবা হন। আমার বাবা আপনারা। দোহাই লাগে আমাকে ছেড়ে দেন।’
তবুও অত্যাচার থামল না। এরপর ই পূজা দেখল, ওয়াজেদের গুরু একটা বিশাল ছুরি বের করল। ওয়াজেদ’কে বলল,

‘ এটা দিয়ে জবাই দিয়ে, নদীতে ফেলে দিই।’
ওয়াজেদ বলল,
‘ তাই করেন।’
কথাটা পূজার কানে যেতেই গায়ের সমস্ত বল হারানো মেয়েটির গায়ে বোধহয় ঐশ্বরিক বল পেয়েছিলো। সে এক লাফে উঠে বসল। নগ্ন অবস্থায় ওয়াজেদ আর তার গুরুরু পা জড়িয়ে ধরে বলল,

‘ আমি বাঁচতে চাই। আমাকে মারবেন না আপনারা। আমি কোনদিন কাউকে বলব না আপনাদের কথা। ‘
ওয়াজেদ বলল,
‘ তুই এখান থেকে গিয়েই সবার আগে প্রভাতের কাছে বিচার দিবি। তোর মাথা না কা’ ট’ লে প্রভাত আমাদের মা’থা আস্ত রাখবে না। ‘
‘ আমি বলব না। আমাকে বিশ্বাস করুন।’

ওয়াজেদ পূজার মুখে লা’ থি মেরে সরিয়ে দিলো। ওয়াজেদের গুরু ছুরি এনে পূজার দিজে চালাতে গেলেই পূজা ছুরি ধরে ফেলে। তাতে পূজার হাতের সব গুলো আঙুল কে’ টে র’ক্তে একাকার হয়ে যায়। এইটুকু মেয়ে এত শক্তি কোথায় পাচ্ছে কে জানে? জীবন মরণের সময় এখন পূজার। সে জীবনের সর্বশেষ চেষ্টাটা চালাচ্ছে। কিন্তু ওয়াজেদরা দু’জন। আরো পুরুষ মানুষ পূজার পক্ষে যুদ্ধ চালানো সম্ভব হলোনা। তবে পূজা ছুরি ছাড়েনি। কা’টা হাতে ছুরি ধরেই রেখেছে।

আচমকা পূজা উঠেই ওয়াজেদের গুরুর হাতে কামড় বসিয়ে দেয়। সাথে সাথে ছুরিটা ছেড়ে দেয়। পূজা তখন ই ছুরিটা নিয়ে অনেক দূরে ছুড়ে মারে। ওয়াজেদ আর ওর গুরু দু’জনেই ছুরি খুঁজতে গেলো। ওরা জানে পূজার গায়ে সে বল নেই কোথাও পালাবে। আর ছুরিটাও বেশী দূর পড়েনি। তবে জঙ্গল অন্ধকার ঝোপঝাড়ের মাঝে খঁজে পেতে সমস্যা হচ্ছে। পূজা ততক্ষণে বড় একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। ওয়াজেদ বলে গুরু, পূজাকে তো পাচ্ছিনা। এ গেলো কই?

গুরু বলল, ‘ দেখ কোন গাছের আড়ালে, ঝোপ ঝাড়ের নিচে লুকাইছে। খোঁজ।’
পূজার হৃদয় টা কেঁপে উঠল।সে তার সৃষ্টিকর্তাকে ডেকেই যাচ্ছে। তখন কাঁদতে কাঁদতে মনে মনে বলল,
‘ কোথায় তুমি কৃষ্ণ? আমাকে বাঁচাও। আমাকে বাঁচানোর মত কেউ নেই। ‘

এরই মাঝে গুরু ছুরিটা পেয়ে গেলো। সে ওয়াজেদ কে ডেকে বলল, ছুরি পেয়েছি, টর্চ নিয়ে দেখ সে কই।’
ওয়াজেদ টর্চ আনতে যেতেই পূজা উঠে দৌঁড় দিলো। সাথে সাথে ওয়াজেদ আর তার গুরু পূজার পেছন পেছন ছুটলো। পূজা ছুটতে ছুটতে নদীর কীনারায় চলে এলো। ওর থেকে পাঁচ-সাত হাত দূরেই ওয়াজেদরা। এখন পূজাকে হয় ওদের ছুরির আঘাতে ম’র’তে হবে, নয় নদীতে ঝাপ দিতে হবে। পূজার হাতে আর অপশন নেই, সে নদীতে ঝাপ দিলো। ঝাপ দেওয়ার সময় বলল,

‘ আমি বাঁচব কীনা জানিনা, কিন্তু তোরাও বাঁচবি না। ‘
পূজার গায়ে আর সাঁতারের শক্তি নেই। নদীর অথৈ পানিতে তার জীবনের নিঃশ্বাস টা নিভু নিভু করছে। কিছুক্ষণ সাঁতার কেটে ক্লান্ত হয়ে গেলো। আর পেরে উঠছে না। আস্তে আস্তে ডুবে যাচ্ছে। এখন কেবল ই পানির উপর তার চুলগুলো ভাষছে আর দুই হাতের দশটা আঙুল দেখা যাচ্ছে।
মৃত্যুর কয়েক সেকেন্ড আগেও সে মনে মনে বলল,
‘ তোমার অর্ধাঙ্গী হওয়ার স্বপ্নটা স্বপ্নই থেকো গেলো কৃষ্ণ। ‘

নদীর ঠিক ওপাশেই অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে কৃষ্ণ। সে পানিতে কিছু একটা পড়ার শব্দ শুনেছে। পূজার চিন্তায় অতটা গুরুত্ব দেয়নি। তবে আচমকা ওই শব্দটার জন্য কৃষ্ণের হৃদয় কেঁপে উঠল। সে কি জানত যার জন্য পা’গ’ল হয়ে যাচ্ছে, সেই অপরপ্রান্তে জীবন বাঁচানোর জন্য ছটফট করছে। এইজন্য হয়ত জীবনের সব ছোট খাটো ঘটনাগুলো গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ। কৃষ্ণ একটু গুরুত্ব সহকারে দেখলেই হয়ত পূজা বাঁচতেও পারত।

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ৪১

এখন আর পূজার চুলগুলো ও দেখা যাচ্ছেনা। আস্তে আস্তে সে ডুবে তলিয়ে গেলো নদীর তলদেশে। পানিতে একটু নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য ছটফট করছিলো। ভয়ানক, কষ্ট, আর যন্ত্রণা নিয়ে পূজার মৃত্যু হলো।

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ৪৩

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here