অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ৪১ (২)

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ৪১ (২)
Mousumi Akter

মানুষের ভীড় দেখে পূর্ণতার হৃদয়ের তোলপাড় ক্রমশ বাড়তে শুরু করল। সে খেয়াল করল প্রভাতের মুখ পুড়ে ধুলোর মত হয়ে আছে সাথে গভীর টেনশন। এখনো পূর্ণতা সঠিক ঘটনা বুঝে উঠতে পারল না। মন কেমন যেন কু গাইছে। ভীড় ঠেলে আস্তে ধীরে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করছে। প্রভাত পূর্ণতার হাতের কব্জি চেপে ধরে একসাথে পা বাড়াচ্ছে। পূর্ণতার আগমণ দেখে বাড়িভর্তি মানুষ বিষাদভরা মুখে পূর্ণতার দিকেই তাকিয়ে আছে।

খানিকটা এগিয়ে যেতেই দেখল, একটা লাশের খাটিয়া রাখা। পূর্ণতার বুকের মাঝে ছ্যাঁৎ করে উঠল। পাশেই মেরি আর পুষ্প গড়াগড়ি করছে আর কাঁদছে। মেরি আর পুষ্পের গড়াগড়ি করা কাঁন্না দেখে পূর্ণতার বুকের মাঝে আরো ছ্যাঁৎ করে উঠল। সত্যিই কি তার দাদী আর নেই। একবার ও নিজের অসুস্থ মায়ের কথা পূর্ণতার মনে আসছেনা। পূর্ণতার আর প্রভাতের হাঁটার গতি বাড়ল। খাটিয়ার কাছে যাওয়ার আগে পূর্ণতা আরেকবার থমকে দাঁড়ালো। সে দাঁড়ানোতে প্রভাত ও দাঁড়ালো। প্রভাত পূর্ণতার চোখে চোখ রাখতে পারছে না। পূর্ণতা জড়ানো কণ্ঠে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘ দাদী কি সত্যিই নেই?’
পূর্ণতার প্রশ্নে প্রভাত ভয় পেলো। এখনি পূর্ণতা জেনে যাবে তার আম্মু আর নেই। তখন পূর্ণতাকে সামলাবে কীভাবে সে। প্রভাত পূর্ণতাকে কথা দিয়েছিলো তাদের বাড়ির কাজ শেষ হলেই সে পূর্ণতার আম্মুকে নিয়ে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। সে কথা আর রাখতে পারলো কই। পূর্ণতার কথার কোনো জবাব প্রভাত দিলোনা। সে আবার ও পা বাড়ালো। খাটিয়ার কাছাকাছি যেতেই পূর্ণতার সর্বাঙ্গ কাঁপতে শুরু করলো। চারদিকের মানুষ পূর্ণতাকে দেখে ফিসফিস করছে। তাছাড়া খানিকটা দূরেই পূর্ণতার দাদী বসে আছে। তাহলে? তাহলে এখানে কার লাশ। পূর্ণতার আত্মা কেঁপে উঠল। সে প্রভাতের হাত ঝাড়ি মেরে ফেলে এক দৌঁড়ে খাটিয়ার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। মেরি আর পুষ্প পূর্ণতাকে দেখে থেমে গেলো। তারা কিছু বলার আগেই পূর্ণতা লাশের উপর থেকে সাদা কাপড়টা সরিয়ে ফেলল। সাথে সাথে নিজের মমতাময়ী মায়ের ফোলা মুখটা ভেষে উঠল। দৃশ্যটা দেখেই পূর্ণতার মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে এলো। মনের মাঝে এমন যন্ত্রণা শুরু হলো এখনি হৃদয়টা ফেটে চৌচির হয়ে যাবে। পূর্ণতা একটা চিৎকার দিয়ে জাহানের বুকের উপর পড়ল। গলা কা’ টা মুরগীর মতো ছটফট করছে আর বলছে,

‘ আমার আম্মুর কি হয়েছে? আমার আম্মু চুপ আছে কেন? আমার আম্মু এখানে সুয়ে আছে কেন?’
মেরি আর পুষ্প পূর্ণতাকে জাহানের বুকের উপর থেকে জোর করে উঠালো। পূর্ণতাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে প্রবল কান্নায় ভেঙে পড়ল। কিন্তু পূর্ণতাকে সামলানো যাচ্ছেনা।ড় সে ছটফট করছে আর হাত -পা ছুড়াছুড়ি করছে। মুখ দিয়ে শুধু উচ্চারণ করছে,

‘ আমার আম্মু, আমার আম্মু। আমার আম্মুকে কথা বলতে বলো।’
মেরি, পুষ্প ওরা নিজেরাই ভেঙে পড়েছে পূর্ণতাকে সামলাবে কিভাবে। পূর্ণতা মেরিকে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ আমাকে ভালবাসার মত আর কেউ রইলো না চাচী। এই পৃথিবীতে যার ভালবাসার জন্য বেঁচে ছিলাম সে নেই। আমি কেন বেঁচে থাকব? আমি আমার আম্মুকে একটু সুখ দিতে পারিনি। ছোটবেলা থেকে শুধু দুঃখ পেতেই দেখলাম। একবুক দুঃখ নিয়েই আমার আম্মু চলে গেলো। আমি আম্মু ছাড়া কীভাবে থাকব, আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। ‘

পূর্ণতার কান্না দেখে কেউ সহ্য করতে পারছে। ওদিকে কবর তৈরি হয়ে গিয়েছে। পূর্ণতা বেসামালভাবে কাঁদতে কাঁদতে সেন্সলেস হয়ে পড়ে গেলো। পূর্ণতাকে ধরে সবাই মাথায় পানি ঢালছে। প্রভাত পূর্ণতার একটা হাত ধরে বসে আছে। চেয়ে আছে তার অচেতন প্রিয়তমার মুখের দিকে। প্রভাত জানেনা সে পূর্ণতাকে কীভাবে সামলাবে। চারদিকে এত এত মানুষের ভীড় অথচ ওয়াজেদ বাড়িতে নেই। তার স্ত্রী আজ দুনিয়া ছেড়ে চলে গিয়েছে খবর তার কানে পৌছেছে তবুও বাড়িতে আসেনি। ওয়াসেল ক্রামাগত ফোন দিয়ে যাচ্ছে, তবুও ওয়াজেদের এখনো খবর নেই।
চৌধুরী বাড়িতে শোকের ছায়া নেমেছে। এইদিকে কৃষ্ণ কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারছে না পূজা কোথায়? এত মানুষের ভীড়ে সে একটবারের জন্যও পূজাকে দেখতে পায়নি। কারো কাছে জিজ্ঞেস ও করতে পারছে না। নিজের মত করে খুঁজে চলেছে। সকাল থেকে দুপুর গড়ালো কিন্তু পূজাকে কোথাও খুঁজে পেল না। এইদিকে পূজার মা-বাবা ও জানেনা পূজা নিঁখোজ। চৌধুরী বাড়ির কিছু কাজের লোকের কাছে জিজ্ঞেস করেও কোনো উত্তর খুজে পেলোনা কৃষ্ণ। তাও একবার রাজন কে বলেছে,

‘ দাদা পূজাকে তো কাল থেকে পাচ্ছিনা।’
রাজন এত ঝামেলার মাঝে বলেছে আছে হয়ত কোথাও।
কৃষ্ণর মন কেমন খারাপ কথা বলছে। পূজার কিছু হলোনাতো। চৌধুরী বাড়িতে এত বড় ঘটনার পরেও পূজা সেখানে উপস্থিত নেই।
এইদিকে পূর্ণতার সেন্স ফিরলেই কেঁদে উঠছে আবার কিছুক্ষণ পরেই সেন্স হারাচ্ছে। প্রভাত পূর্ণতাকে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে রেখে বলল,
‘ কাঁদো, যত খুশি কাঁদো পূর্ণ। ‘
পূর্ণতা প্রভাতের শার্ট খামছে ধরে বেসামালভাবে বলল,
‘ আমি এমন এতিম হয়ে গেলাম কেন? আমাকে কে আর ভালবাসবে বলুন। আমি আমার আম্মু ছাড়া থাকতে পারব না। ‘

‘ সবাইকেই এভাবে চলে যেতে হবে।’
‘ আমার আম্মুর মত এত কষ্ট নিয়ে কেউ পৃথিবী ছাড়েনি। আমাকেও দাফন করে দিন। ‘
‘ এসব বলেনা পূর্ণ, দোয়া করো আম্মুর জন্য।’
এরই মাঝে ওয়াজেদ এলো। লাশ দাফনের জন্য নিতে হবে। সবাই ওয়াজেদ কে বলছে খাঁটিয়া ধরতে। ওয়াজেদ খাটিয়া ধরতে যাবে তখনই পূর্ণতা চিৎকার দিয়ে উঠে বলল,
‘ ও যেন আমার আম্মুকে স্পর্শ না করে। আমার আম্মুর কোনো কাজে যদি ও থাকে আমি এখনি খু’ন করে দিবো। আমার আম্মুর ত্রিসীমানা থেকে দূর হতে বলেন।’

প্রভাত রাগি চোখে ওয়াজেদ এর দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ সরেন আপনি। বাড়াবাড়ি করতে চাইনা। তাহলে কবর দু’টো খুড়তে হবে।’
এইদিকে পূর্ণতা বাজেভাবে মাতলামি করছে। প্রভাত নিজের চোখ দিয়ে পানি ছেড়ে বলল,
‘ নিজেকে বড্ড অপরাধি লাগছে। তোমার স্বপ্ন তো পূর্ণ করতে পারলাম না। এটা আমার হাতে নেই। আল্লাহ’র ইচ্ছা। কিন্তু তোমার যন্ত্রণা আমি সহ্য করতে পারছিনা।’

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ৪১ 

‘ আমাকে শান্ত দেখতে চান, আমাকে শান্তি দিতে চান।’
‘ হ্যাঁ, চাই। বলো কি করলে তুমি শান্তি পাবে।’
‘ আমার আম্মুর লাশ সামনে রেখে আমাকে কথা দিন, ওই জঘন্য মানুষের জন্য সারাজীবন আমার আম্মু কষ্ট পেয়েছে। তাকে আপনি কঠিন শাস্তি দিবেন।আমার আম্মুর আত্মা যেন একটু শান্তি পায়।’
প্রভাত পূর্ণতার চোখে চোখ রেখে বলল,
‘ তোমার শান্তির জন্য আমি খু’ ন ও করতে পারি।’

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ৪২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here