খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ২৪

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ২৪
আভা ইসলাম রাত্রি

মেয়র শেহজাদ আয়ুষ্মানকে নিজ গ্রামে বরণ করা হল বিশাল আয়োজনে। প্রতাবপুর গ্রামে ইতিপূর্বে কেউ এত উচ্চ পদে নির্বাচিত হয় নি। নেতা বংশের উত্তরাধিকারী শেহজাদ আয়ুষ্মান এ গ্রামের ইতিহাস পাল্টে দিয়েছেন। গ্রামের মানুষের গর্বে বুক ফুলে। নতুন মেয়র শেহজাদ আয়ুষ্মানকে ঘোড়ায় চড়িয়ে, গলায় টাকার মালা জড়িয়ে, চারদিকে ফুলের পাঁপড়ি ছড়িয়ে ছিটিয়ে গ্রামে প্রবেশ করানো হয়েছে, সে কি হন্তদন্ত অবস্থা! শেহজাদ আয়ুষ্মান মহলের সামনে এসে ঘোড়া থেকে নামে। পাশে থাকা মর্তুজাকে ইশারা করে কাছে ডেকে বলে,

‘এখানে আসা সকল মানুষকে দুশো টাকা এবং চারটা করে মিষ্টি বিলিয়ে দাও। টাকা কম পরলে বাড়ি এসে নিয়ে যেও।’
মর্তুজা হাস্যমুখে সায় দেয়। দ্রুত ছুটে যায় ময়রার দোকানের দিকে। শেহজাদ গায়ের সফেদ রঙ্গা পাঞ্জাবি ঠিকঠাক করে বাড়ি প্রবেশ করে। শেহজাদ আজ বাড়ি আসবে বলে নওশাদ এবং সৌরভ সবাই ঘরেই ছিলেন।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মেহজাদ নিজেও গতকাল চিত্রাকে নিয়ে আয়ুষ্মান মহলে ফিরেছে। শেহজাদকে বরণ করতে নওশাদ এবং সৌরভ সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। শেহজাদ বিজয়ীর ন্যায় ঝলমল চেহারা নিয়ে আয়ুষ্মান মহলের সদর দরজা পেরিয়ে প্রবেশ করে বাড়িতে। নওশাদ এবং সৌরভকে দরজার সম্মুখে দেখে শেহজাদ এগিয়ে এসে পা ধরে দুজনকে সালাম করে। নওশাদ ছেলের হাতে উপহার স্বরূপ সোনার ন্যায় কারুকাজ করা একটি কোরআন শরীফ দেন। শেহজাদ কোরআন শরীফে আলতো করে চুমু খায়। ছোট কণ্ঠে নওশাদের উদ্দেশ্যে বলে,

‘পবিত্র উপহার দেবার জন্যে শুকরিয়া, আব্বাজান। আমি এর গুরুত্ব মাথায় রাখব।’
নওশাদ সামান্য হাসেন। ছেলের কাঁধে হাত বুলিয়ে নিজের গর্বিত অনুভূতি বোঝান। সৌরভ উপহার দেন, একটা কারুকাজ করা তজবি এবং জায়নামাজ। শেহজাদ খুশিমনে উপহার গ্রহন করে। সৌরভ শেহজাদের কপালে চুমু খেয়ে বললেন,
‘বড় হও, আরো বড়। দুনিয়ার আকাশ ছুঁয়ে ফেলার তৌফিক আল্লাহ তায়ালা যেন তোমাকে দান করেন।’
শেহজাদ শুনে, চাচার কথার প্রেক্ষিতে জবাব দেয়,

‘দোয়া করবেন।’
শেহজাদ ঘরে ঢুকে। নওশাদ এবং সৌরভ শেহজাদের দু পাশে হেঁটে আসছেন। শেহজাদকে এমন সজ্জিত অবস্থায় ঘরে প্রবেশ করতে দেখে চিত্রার বুক কিছুক্ষণের জন্যে ধ্বক করে উঠল যেন। চিত্রা চোখের সামনে থেকে পর্দা সরিয়ে আড়চোখে শেহজাদের দিকে চায়। মানুষকে কতদিন পর একটু চোখের দেখা দেখল চিত্রা। জয়ীর চেহারা বুঝি এমনই সুন্দর হয়? রেখা এদিকে তাকাতেই আবার চিত্রা পাকের ঘরের পর্দা টেনে দেয়। শেহজাদ এগিয়ে এসে রেখার পা ধরে সালাম করে। রেখা ছেলের কপালে চুমু খেয়ে বলেন,

‘তোমার পছন্দের সকল খাবার আজকে রান্না হয়েছে। হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসো।’
মেহজাদ পাশ থেকে একেকজনের একেক উপহার দেওয়া দেখে যারপরনাই বিরক্ত। সে লম্বা এক হামি তুলে শেহজাদের পাশে এসে দাঁড়াল। শেহজাদের কাঁধে একহাত রেখে বলল,
‘ভাইয়া মেয়র না হয়ে, প্রধানমন্ত্রী হয়ে যদি বাড়ি ফিরত। তাহলে বোধহয় তোমরা তার নামে পুরো সম্পত্তি করে দিতে! তাইনা আম্মাজান?’
রেখা হালকা হাসেন।বলেন,

‘নেতাবংশের সমস্ত সম্পত্তির উপর তোমার ভাইয়ের একা অধিকার নেই। এসব সম্পত্তির কয়েকজন হকদার আছে। তাই তোমার ভাইকে সেটা একা দেওয়া হবে না, বুঝেছ?’
মেহজাদ উদাস ভঙ্গিতে মায়ের দিকে চেয়ে ভ্রু উঁচু করে। দু ছেলেকে একা রেখে রেখা পাকের ঘরে যান খাবার তৈরি করতে। রেখা চলে গেলে এক ফাঁকে মেহজাদ শেহজাদকে প্রশ্ন করে,
‘সবাই তোমাকে এত উপহার দিল, আমি কি দিব চিন্তায় পরে গেলাম।’

শেহজাদ নিজের ঘরের দিকে এগুল। মেহজাদ পেছনে পেছনে চলল। শেহজাদের ঘরে প্রবেশ করার আগে একবার উঁকি দিয়ে দেখে নিল চিত্রা ঘরে আছে কি না। নেই দেখে মেহজাদ জুতো খুলে শেহজাদের ঘরে ঢুকে। শেহজাদ গায়ের পাঞ্জাবি খুলে আলনায় রাখে। ফতুয়া গায়ে দেবার চেষ্টায় শেহজাদ। মেহজাদ বিছানায় পা ছড়িয়ে বসে শেহজাদের উদ্দেশ্যে বলে,
‘সবাই যা দেবার দিয়েছে। আমি তোমাকে সবার চেয়ে দামী উপহার দেব। বলো তো সেটা কি?’
শেহজাদ লুঙ্গি ফতুয়া পরে ইজি চেয়ারে গিয়ে বসল। হাতে বই রেখে উত্তর দিল,

‘তুমি আবার আমাকে কি দিবে?’
মেহজাদ কুটিল হাসল। শেহজাদের দিকে কিছুটা ঝুঁকে এসে ফিসফিস করে বলল,
‘তোমার জীবনের সবচেয়ে দামী উপহার, যা তুমি কখনো হাত ছাড়া করবে না, কাউকে তার ভাগ দিবে না, সবাইকে এর ব্যাপারে হিংসা করবে, এমন উপহার।’
শেহজাদ ভ্রু কুঁচকে তাকাল। বাংলাদেশ কেন পুরো পৃথিবীতে এমন কোনো উপহার বানানো হয়নি, যাকে নিয়ে শেহজাদ এতটা হিংসায় মজে যাবে। শেহজাদ যা চায়, চাইলে তা একসঙ্গে অনেকটা কিনে ফেলতে পারে। শেহজাদ মাথা ঝাঁকিয়ে বই খুলল। বলল,

‘বাজে কথা না বলে কাজে যাও।’
শেহজাদ পাত্তা দিচ্ছে না দেখে মেহজাদ হাত বাড়িয়ে শেহজাদের বই নিজের হাতে নিয়ে নিল। শেহজাদ ভ্রু কুঁচকে তাকাল। মেহজাদের এমন হেয়ালিপনায় সে যারপরনাই বিরক্ত। বাড়ি ফিরে রোজ রোজ এ ছেলেটা নাটক করতে বসে যায়! এত শক্তি কোথা থেকে আসে তার? শেহজাদ রেগে যাচ্ছে দেখে মেহজাদ এবার থামল। গলা উঁচু করে ডাকল,
‘ভাবিজান, ভাবিজান। একটু শুনে যান!’
শেহজাদ এখনো চেয়ে আছে মেহজাদের দিকে। মেহজাদের ডাক শুনে শেহজাদের ঘরে এল চিত্রা। আঁচল মাথায় তুলে প্রশ্ন করল,

‘কিছু লাগবে, দেবরজি?’
শেহজাদের তীক্ষ্ম চোখ এবার মেহজাদের থেকে সরে নিক্ষেপ হল সরাসরি চিত্রার টালমাটাল নয়নে। নয়নে নয়ন মেলে। চিত্রা বরাবরের মত সম্মোহনে আটকে চোখ সরায়। মেহজাদ চিত্রাকে টেনে এনে শেহজাদের পাশে বসায়। শেহজাদের চোখ চোখ রেখে হেসে বলে,

‘ইহা হইলেন আপনার সেই অতি মূল্যবান উপহার আমার পক্ষ থেকে। ইহাকে আপনি হিংসা করিবেন বলিয়াই আমি মানি। ভাবিজানের জান যায়, তবে মুখ যায় না। বারবার ঘুরেফিরে তোমার দিকেই তাকাচ্ছেন। তাই এখানে নিয়ে এলাম। এখন উনাকে কিছুটা সময় দাও। আমি বাইরে যাচ্ছি। গুড বাই অ্যান্ড গো এহেড।’
মেহজাদ সত্য সত্য দরজা ভিড়িয়ে বাইরে চলে গেল। শেহজাদ উদাস ভঙ্গিতে গা ঝাঁকাল। ছেলেটা পারেও বটে। এত নাটক যে কার থেকে শিখেছে!

মেহজাদ তো চিত্রাকে শেহজাদের গা ছুঁই-ছুঁই করে বসিয়ে দিয়ে গেছে। এবার যে চিত্রার অস্বস্তিতে কিছুটা জমে আছে। হাতের তালু ঘেমে যাচ্ছে। এমন সদা হয়। যতবার শেহজাদের কাছাকাছি থাকে সে, ততবার চিত্রার বুক অত্যাচার করে তাকে। বারবার স্পন্দিত হতে থাকে, হাত কাঁপে, শরীর ঘামে। এতবার কাছে আসা সত্ত্বেও শেহজাদের একটু স্পর্শ চিত্রা সহ্য করতে পারে না, বুক কাঁপে। চিত্রা বসে আছে ঠাই।

কত কথা জমিয়ে রেখেছিল শেহজাদ এলে বলবে করে। অথচ আজ শেহজাদের তাকানোতে সকল কথা ফুরিয়ে গেছে। জন্ম নিয়েছে সুন্দর–অসহ্য কিছু অনুভূতির। শেহজাদ ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল। বই পাশে রেখে চিত্রার দিকে পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে তাকাল। চিত্রার এবার পালাই পালাই অবস্থা। শেহজাদের চোখের নেশায় যে মেয়ে ডুবে, সে মেয়ে স্বেচ্ছায় নিজের সর্বনাশ ডেকে আনে। ওমন নেশালো নয়নে চিত্রা একবার নয়, বারংবার মরে যায়। এমন তীক্ষ্ম চোখে সে সর্বদা তাকান কেন? একটু কি দয়া হয় না তার চিত্রার মনের প্রতি?
চিত্রাকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে শেহজাদ। শেহজাদ চুপ, কি বলবে, কোথা থেকে শুরু করবে ভেবে চিত্রা একফাঁকে মিনমিন করে প্রশ্ন করে,

‘কেমন কেটেছে দিন আপনার?’
শেহজাদ শুনে। উত্তর দেয় চিত্রার দিকে চেয়েই,
‘ভালো।’
চিত্রা আবার প্রশ্ন করে,
‘খাওয়া দাওয়া হয়েছিল ঠিকঠাক?’
‘দুবার গ্যাস্ট্রিক হয়েছিল।’

শেহজাদের ছোট উত্তর শুনে চিত্রা দমে যায়। কথার প্রেক্ষিতে আর কি বলবে খুঁজে পায় না। কথা তো হারাবেই। এমন তীক্ষ্ম চোখে চেয়ে আছে চিত্রার দিকে, যেন এই খেয়ে সাফ করে দেবে!
চিত্রার কন্ঠ কথা বললেও, গা শক্ত হয়ে আছে দেখে শেহজাদ। খানিক পর ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে কিছুক্ষণ পর শেহজাদ আওড়ায়,

‘বহুবার কাছাকাছি আসার পরও তোমার অস্বস্তি কমে না, লজ্জা কমে না, ভয় কমে না। শেহজাদ আয়ুষ্মান দরজার বাইরে সবার জন্যে ত্রাস হলেও, স্ত্রীর জন্যে সে মাটি দিয়ে গড়া। নিজের অনুভূতি আয়ত্বে আনো দ্রুত, নাহলে আমাকে পদক্ষেপ নিতে হবে।’
চিত্রা মাথা তুলে তাকায়।শেহজাদের কথার অর্থ ধরতে না পেরে বোকার মত প্রশ্ন করে,
‘আপনি কেমন পদক্ষেপ নিবেন?’

শেহজাদ খানিক চেয়ে থাকার পর ভ্রু কুঁচকে কিছুটা ঝুঁকে এল। চিত্রার কানের কাছে ঠোঁট এনে নিঃশ্বাস ফেললে আবেশে চিত্রা পায়ের আঙ্গুল দিয়ে কার্পেট খামচে ধরে হাপরের মত নিঃশ্বাস নেয়। শেহজাদ অনেকক্ষণ চিত্রার কানের কাছে কতগুলো কথা আওড়ায়। চিত্রা শুনে আঁতকে উঠে যেমন। সঙ্গেসঙ্গে দু কদম পিছিয়ে যায়। নাক মুখ খিঁচে সুধায়,
‘ছিঃ, ছিঃ!, এসব—-এসব কি বলছেন? লজ্জা নেই? আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। এসব —-‘
শেহজাদ হালকা হাসল যেমন। পুনরায় ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে বই হাতে নিল। বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে বলল,

‘স্ত্রীর কাছে লজ্জা থাকলে পুরুষের চরিত্র রক্ষা করা কঠিন! আমার জানানোর কথা আমি জানিয়ে দিয়েছে। না চাইলে, তুমি নিজে থেকে শুধরে গেলেই হয়।’
চিত্রা এখনো অস্বাভাবিক হয়ে শেহজাদের দিকে চেয়ে আছে। এমন পবিত্র মুখখানা এমন নির্লজ্জ এর ন্যায় কথা বলতে পারে, তা চিত্রার জানার বাইরে ছিল এতদিন। চিত্রা আর একটু সময় এখানে থাকলে শেহজাদের গায়ে লুটিয়ে পরবে এমন অসভ্য কথার দরুন। শেহজাদ চিত্রার অস্বস্তি বুঝতে পারে যেমন। তাই সে আদেশ করে,

‘আমি খেতে বসব। আম্মাজান ভাত বাড়ছেন, সাহায্য করো যাও।’
চিত্রা আর দেরি না করে গায়ের আঁচল ঠিক করে দ্রুত ছুটে পাকের ঘরে চলে যায়। শেহজাদ চিত্রার যাবার দিকে চেয়ে আবারও বই পড়ায় মন দেয়।
শেহজাদের মুঠোফোনে বারবার একটি অজানা নাম্বার থেকে কল আসছে। শেহজাদ সাধারণত অচেনা নাম্বারে কল এলে ধরে না। আজও তেমন করে ধরে নি। মুঠোফোন একসময় কেঁপে থেমে গেল। হঠাৎ একটা বার্তা এল। শেহজাদ বার্তা খুলে দেখে সেখানে লেখা,

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ২৩

‘শেষবারের ন্যায় সতর্ক করে দিচ্ছি মেয়র সাহেব, ‘জ্ঞানী স্বজন থেকে মূর্খ স্বজন উত্তম’ —রামায়ণে মেঘনাদের ন্যায় মহাবীরের পরাজয় বরণ করার পেছনে তার জাত স্বজন বিভীষণ ছিলেন। চোখ বন্ধ হয়ে যাবার আগে, চোখ খুলে দেখা বুদ্ধিমানের পরিচয়।’

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ২৫