পূর্ণতায় অপূর্ণতা পর্ব ১১

পূর্ণতায় অপূর্ণতা পর্ব ১১
লেখিকা: সুরাইয়া ইসলাম ছোঁয়া

চার তলা বিল্ডিং এর সামনে এসে ছোঁয়াদের গাড়িটি থামলো।
প্রথমে সাহেদ চৌধুরী গাড়ি থেকে নামলেন। তারপরে এক এক করে সবাই গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াতেই দেখতে পেলো বাসার গেট দিয়ে নুরজাহান বেগম আসছেন তার পিছে ছোঁয়ার দুই চাচি এবং মেজো চাচাও রয়েছেন।
নুরজাহান বেগম এসেই ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলেন। সাহেদ চৌধুরীও মমতাময়ী মা কে আগলে নিলেন। খানিকক্ষণ পরে ছেলেকে ছেড়ে দারাতেই আনিতা বেগম নুরজাহান বেগমকে জড়িয়ে ধরে বললেন,

কেমন আছেন আম্মা?
নুরজাহার বেগম পরম মমতায় তার পিঠে হাত রেখে বললেন,
আলহামদুলিল্লাহ ভালো মা,, তুই কেমন আছিস?
আলহামদুলিল্লাহ আম্মা। আব্বা কই?
আর বলিস না সুলাইমানের সাথে বাজারে গেছে সে নিজে হাতে বাজার করবে নাতি নাতনিদের জন্য।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তারপরে আনিতা বেগমকে ছেড়ে দিয়ে বল্লেন কই দেখি আমার নাতি নাতনিরা,, বলে ওদের তিন ভাই বোনকে এক সাথে জড়িয়ে ধরলেন।
ছোঁয়ার ২ চাচি গিয়ে আনিতা বেগমকে আলিঙ্গন করলেন।
ছোঁয়ার মেজো চাচা আকবর সাহেব বলে উঠলেন,

হয়েছে হয়েছে ওদের এবার ভিতোরে আসতে দাও জার্নি করে এসেছে নিশ্চয়ই ক্লান্ত।
আকবর সাহেবের কথায় নুরজাহান বেগম ওদের ছেড়ে দিলেন। তারপর বললেন, তোরা ভিতোরে আয়।
আনিতা বেগম সাফিকে কোলে নিয়ে তার দুই জা এর সাথে কথা বলতে বলতে এর ভিতরে চলে গেলেন।
ছোঁয়া আর সুফি ২ বোন দাদিকে দুই পাস থেকে জড়িয়ে ধরে দাদির সাথে যেতে লাগলো।
সাহেদ চৌধুরী আকবরের কাঁধে হাত রেখে দুই ভাই ভিতরে
গেলেন।

বাসায় প্রবেশ করতেই নুরজাহান বেগম সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
কথাবার্তা সব পরে হবে, অনেক পথ জার্নি করে এসেছো তোমরা, আগে রুমে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে খাবার খেয়ে নাও।
ছোঁয়ার সেজো চাচি মনিরা বেগম আনিতা বেগমকে নিচ তলার ডান দিকের একটা রুম দেখিয়ে বললেন,
আপা সাফি আর ভাই কে নিয়ে ওই রুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে নিন আমি ওই রুম আপনাদের জন্য পরিষ্কার করে রেখেছি।

তারপরে আবার ছোঁয়াকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
ছোঁয়া সুফিকে নিয়ে তুই মিথির রুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে নে।
আচ্ছা কাকি মা।
এই বলে সুফিকে নিয়ে উপরে চলে গেলো ছোঁয়া।

মিথি ছোঁয়ার চাচাতো বোন ওর মেজো চাচার মেয়ে ছোঁয়ার সমবয়সি এবার ছোঁয়ার সাথেই জেএসসি দিয়ছে।
ছোঁয়ার বাবা রা চার ভাই।
দুই ভাই গ্রামে এই বাসায় থাকে। সাহেদ চৌধুরী বড়। সাহেদ চৌধুরী আর ছোঁয়ার ছোট চাচা মিহান চৌধুরী কাজের সূত্রে ঢাকায় থাকে।
ছোঁয়ার মেজো চাচার এক ছেলে এক মেয়ে সেজো চাচার এক ছেলে আর ছোঁট চাচার এক মেয়ে।

মনিরা বেগম আর ফাহিমা বেগম ব্যস্ত হয়ে পরলেন খাবার টেবিল সাজাতে। নুরজাহান বেগমও তাদের মানা করা সত্ত্বেও সাহায্য করছে।
কিছুক্ষণ পরে ছোঁয়া ফ্রেস হয়ে সুফিকে নিয়ে নিচে নামলো।
ততক্ষণে ছোঁয়ার সেজো চাচা সুলাইমান আর ওর দাদা বাজার থেকে চলে এসেছেন।
ছোঁয়া সুফি দৌড়ে গেলো দাদার কাছে দাদা ওদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন কেমন আছো তোমরা?

আলহামদুলিল্লাহ ভালো দাদু।
তুমি কেমন আছো?
তোমাদের দেখেছি এখন ভালো না থেকে উপায় আছে।
বিনিময়ে ছোঁয়া মুচকি হাসলো। সুফি দৌড়ে সেজো চাচার কাছে গেল পিঁছু পিঁছু ছোঁয়াও গেলো। ওদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন সুলাইমান।
ছোঁয়া তার মেজো চাচি ফাহিমা বেগমকে রান্না ঘরে যেতে দেখে প্রশ্ন করলেন,
কাকি মা মিথি কই?

ফাহিমা বেগম বললেন,
মিথি তো পাসেই রাইসা দের বাড়িতে গিয়েছিলো তোরা আসার কিছুক্ষণ আগেই তোর আসার খবর দিতে। এই মেয়েটা কে নিয়ে আর পারি নাহ গল্পে গল্পে বাড়িতে আসার কথাই ভুলে গেছে দেখ গিয়ে অথচ কাল সারা দিন জালিয়ে মেরেছে আমায় কখন তোরা আসবি বলতে বলতে পাগল করে দিয়েছে অথচ এখন দেখ ওর খবর নেই।

ছোঁয়া কিছু বলতে যাবে তখনই ঝড়ের বেগে কেউ একজন ওকে জাপটে ধরেছে। ছোঁয়া বুঝলো এটা মিথি। মিথি ওকে আবার সাথে সাথে ছেড়ে দিয়ে বলতে লাগলো,
কখন চলে এলি, এই রে আমি তো গল্প করতে করতে ভুলেই গিয়েছিলাম তোকে সবার আগে দেখা হলো না। বলেই মন খারাপ করে ফেললো।
ছোঁয়া ভেবেছিলো মিথির সাথে রাগ করবে কিন্তু বেচারির মুখ দেখে রাগ করতে পারলো নাহ উল্টে ওকে জড়িয়ে ধরে বললো,

আগে দেখতে পারিসনি তো কি হইছে আমরা অনেক দিন থাকবো তো অনেক আড্ডা দিবো ঘুরবো আর পরের বার আসলে মাস্ক পরে আসবো যাতে তোর আগে আমায় কেও না দেখতে পারে এবার খুসি।
মিথি ছোঁয়ার কথায় হেসে দিলো। বললো তুই আসবি তাই নানু বাড়িতে যাইনি জানিস।
ছোঁয়া কিছু বলবে তখন ফাহিমা বেগম বললেন হয়েছে পরে গল্প করা যাবে এখন টেবিলে গিয়ে বসো যাও।
ছোঁয়া দেখে মিথির পিঁছনে তাইয়েব আর তাহিন দারিয়ে।
তাইয়েব মিথির ভাই আর তাহিন ছোঁয়ার সেজো চাচার ছেলে। চার বছর ওদের। ওরা প্রায় সমবয়সী কিছু দিনের ছোট বড়।

ছোঁয়া হাত বাড়িয়ে ওদের আদর করে কোলে তুলে নিলো।
সাহেদ চৌধুরী ড্রয়িং রুমে এসে বাবা ভাইকে দেখে আলিঙ্গন করলেন। আনিতা বেগম শশুর দেবরের সাথে কুশল বিনিময় করলে। তারপরে বাড়ির সবাই এক সাথে খেতে বসলেন।
নুরজাহার বেগম আক্ষেপ নিয়ে বললেন ছোটটা থাকলে পরিবার পরিপূর্ণ হতো।
সাহেদ চৌধুরী বললেন,
আমার কথা হয়েছে ওর সাথে অফিসে ছুটি নেই কি আর করার।
নুরজাহান বেগম একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।

খাওয়া দাওয়া শেষে ভর দুপুরবেলা তিন ভাই মিলে বাবার সাথে আড্ডা জমিয়েছে পাসেই বাচ্চারা বসে আছে দাদির সাথে।
আনিতা বেগম ফাহিমা বেগম আর মনিরা বেগমকে কাজে সাহায্য করতে গেছে। কিন্তু উনারা আনিতা বেগমকে কিছুই করতে দিচ্ছে না বলছে,
আপা আপনি গিয়ে বিশ্রাম নিন কতো পথ এসছেন এইগুলা আমরা করে নিতে পারবো।
কিন্তু আনিতা বেগম মানতে নারাজ।
ওই দিকে ড্রয়িং রুম কাপিয়ে হাসির আওয়াজ কতো দিন পর একসাথে তারা। সুলাইমান বললেন
মিহান থাকলে আরো ভালো হতো আড্ডা জমতো।
কি আর করার ছুটি পেলে চলে আসতো বেচারা গ্রামে আসার জন্যে মুখিয়ে থাকে।

অনেকক্ষণ এভাবে আড্ডা দেওয়ার পর নুরজাহান বেগম বললেন,
বাকি আড্ডা পরে দিও এখন সবাই বিশ্রাম নিতে যাও।
ওরা কতো পথ পারি দিয়ে এসছে বিশ্রাম প্রয়োজন।
আর আপনি এখন রুমে গিয়ে ঘুমান নয়তো পরে দেখা যাবে সরির খারাপ করবে।
বিকেলে আবার বসে আড্ডা দিয়েন ছেলেদের সাথে।
এই বলে তিনি সবাইকে রুমে যেতে বল্লেন।

সাহেদ চৌধুরীর মনে হলো তার মা ছোট বেলার মতো বকছে ছোট বেলা যেমন পড়তে না বসে গল্প করলে এভাবেই বলতো।
মুচকি হেসে সে রুমের উদ্দেশ্যে গেলেন।
ফারজানা বেগম আর মনিরা বেগমকে বললেন তোমারও কিছুক্ষণ বিশ্রাম নাও সকাল থেকে অনেক খাটাখাটনি গিয়েছে তোমাদের উপর।

ছোঁয়া সুফিকে নিয়ে মিথির রুমে এসেছে। গ্রামে এলে ওরা এক সাথেই ঘুমায়। সুফি বিছানায় সুতেই কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমে তলিয়ে গেলো।
ছোঁয়া আর মিথি গল্পে মেতে আছে এতো দিনের সব কথা যেনো একদিনে বলে শেষ করবে।
গল্প করতে করতে ক্লান্ত থাকায় ছোঁয়া এক সময় ঘুমিয়ে গেলো।

মিথি হঠাৎ ছোঁয়ার দিকে তাকিয়ে দেখলো ও ঘুমিয়ে গেছে। ছোঁয়াকে ডাকতে গিয়েও ডাকলো নাহ ভাবলো একটু ঘুমাক ক্লান্ত বোধহয় রাত্রে গল্প করবোনি।
সে তো আর এখন ঘুমাবে নাহ তাই রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।
সন্ধ্যা থেকে একটানা পড়ে চলছে রাদিফ। এর মাঝে রাইদা এসে কয়েকবার ডিস্টার্ব করে গেছে। তাই সে এখন রুমের দরজা আটকে পড়ছে।

পড়তে পড়তে হঠাৎ সকালে সাব্বিরের বলা কথাটা মাথায় এলো। সাব্বিরের ছোঁয়াকে ভালো লাগার কথাটা মনে পড়তেই রাদিফের মনটা বিষন্ন হয়ে গেলো। তারপরে আবার ভাবলো,
সাব্বিরের ওকে ভালো লাগে তাতে আমার কি আজব আমি কেনো এইসব ভাবছি আর সকালেই বা অমন রিয়েক্ট কেনো করলাম। ভালো লাগতেই পারে স্বাভাবিক ব্যাপার।
মুখে এটা ভাবলেও মনে সে মানতে নারাজ।
মন আর মস্তিষ্কের দ্বন্দ্বে সে বিরক্ত হয়ে উঠে একটু জোরে বলে ফেললো,,

উফ চুলোয় যাক ওরা আমার কি আমি এতো ভাবছি কেনো।
সাহেলা বেগম তখনি রাদিফেকে খাবার খেতে ডাকতে আসছিলেন ওর কথা সুনে দরজার বাইরে ভ্রু কুচকে দারিয়ে গেলেন। তারপর বললেন,
কি বলছিস রাদিফ। কাল না তোর পরিক্ষা পড়া বাদ দিয়ে দরজা আটকে কি আবোল তাবোল বকছিস।

মায়ের গলা সুনে রাদিফ দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মনে মনে বললো,
উফ আম্মু আসার আর সময় পেলো না।
তারপরে গিয়ে দরজা খুলে দিলো।
রাদিফ দরজা খুলতেই সাহেলা বেগম রাদিফকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

কি বলছিলি আবোল তাবোল।
আরেহ আম্মু একটা পড়া বুঝতে পারছিলাম না তাই রাগে বলেছি চুলোয় যাক।
ওহ তা দরজা কেনো আটকেছিলি?
রাইদা একটু পরে পরে এসে দুষ্টুমি করছিলো পড়তে পারছিলাম নাহ তাই দরজা আটকে পড়তে বসেছিলাম।
আচ্ছা,, পড়া না বুঝলে স্যার কে কল করে বুঝে নে। আর খেতে আয় খেয়ে এসে আবার পরতে বসবি।

আচ্ছা আম্মু তুমি যাও আমি আসছি।
সাহেলা বেগম চলে যেতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো রাদিফ।
রাত এগারোটা।
বিছানায় শুয়ে আছে ছোঁয়া।
তখন ঘুমানোর পরে একেবারে সন্ধায় ঘুম থেকে উঠেছিল সে। তারপর দাদি কাকি মা দের কাছে কিছুক্ষণ বসে ছিলো। রাতের খাবার খেয়ে মিথির সাথে ঘুমোতে এসেছে। প্ল্যান ছিলো সারারাত গল্প করবে, অথচ ১০ টার একটু পরেই মিথি ঘুমিয়ে গেছে। তারতো আর ঘুম আসছে না।

আসবেই বা কি করে সারা বিকেল ঘুমিয়েছে। সারা বিলেক ঘুমোলে এখন রাত্রি বেলা কারিবা ঘুম আসবে ভেবেই শ্বাস টানলো। কিন্তু এখন সুয়ে সুয়ে কি করবে সে। এতো রাত্রে বাসার কেও নিশ্চয়ই জেগে নেই। এমনিতেও গ্রামে সবাই তারাতারি ঘুমায়। বাসায় হলে বসে বসে গল্পের বই পড়া যেতো।
এসব হাবিজাবি ভাবতে ভাবতে ছোঁয়ার হঠাৎ মনে পড়লো কাল থেকে ওদের স্কুলে পরিক্ষা সুরু হবে।
মানে রাফিফেরও পরিক্ষা।

ইস একটা বার যদি শুভকামনা জানাতে পারতাম।
ছোঁয়া এটা ভাবলেও সে নিজেও জানে রাদিফের সামনে গিয়ে সে কখনই ওর সাথে কথা বলতে পারবে নাহ।
সে লজ্জাবতী কিনা।

পূর্ণতায় অপূর্ণতা পর্ব ১০

কিন্তু একটা বার তাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে ছোঁয়ার।
সে কি আর সম্ভব। সে তো এখন বহুদূর। দেখা হতে বহু দিন বাকি।
এসব উল্টোপাল্টা ভাবতে ভাবতে এক সময় ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেলো ছোঁয়া।

পূর্ণতায় অপূর্ণতা পর্ব ১২