পূর্ণতায় অপূর্ণতা পর্ব ১৬

পূর্ণতায় অপূর্ণতা পর্ব ১৬
লেখিকা: সুরাইয়া ইসলাম ছোঁয়া

শীতের প্রকোপ শেষে ঋতুরাজ বসন্তের আগমন ঘটেছে। প্রকৃতির মতন কি মানুষের মনেও বসন্তের আগমন ঘটে?
হয়তোবা ঘটে।
মাঝে কেটে গেছে বেশ কিছুদিন।
এই কয়েকদিন ছোঁয়ার বেশ ভালো মতোই কেটে গেছে। জানুয়ারি মাসে তেমন ক্লাস না হলেও ফেব্রুয়ারি মাসের শুরু থেকেই ফুল ক্লাস হচ্ছে।
পড়াশোনা তামিমের কাছে প্রাইভেট ক্লাস আর মাঝেমধ্যে ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে রাদিফকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা।
এর মাঝে বেশ কিছু নতুন বন্ধু হয়েছে ছোঁয়া আর মাইশার। সব মিলিয়ে ভালোই কাটছে ওদের দিনকাল।

ফেব্রুয়ারি ২০ তারিখ।
কাল একুশে ফেব্রুয়ারি, সেই উপলক্ষে ছোঁয়াদের স্কুলে বেশ বড় করে অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে। দশম শ্রেণীর অনেকে শাড়ি পাঞ্জাবি পরে আসবে। তাতে ছোঁয়ার কি? সে তো প্রতিদিনকার মতই স্কুল ড্রেস পড়েই চলে আসবে।
কিন্তু একটু সেজেগুজে তো যাওয়াই যায়। হ্যাঁ আমি বরং একটু সেজেগুজে যাবো কাল।
এসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে গেলো ছোঁয়া।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

রাত ১০ টা রাদিফ বসে বসে পড়ছে। এখন ফেব্রুয়ারি মাস, লেখাপড়ার তেমন একটা চাপ নেই বললেই চলে। তবুও রাদিফ রাত জেগে পড়াশোনা করছে কারন সামনেই তার এসএসসি পরীক্ষা।
বই বন্ধ করে ঘড়ির দিকে তাকালো রাদিফ, দশটা বেজে গেছে। ৯ টার দিকে ডিনার কমপ্লিট করে আবার একটু পড়তে বসেছিলো। এখন, বই খাতা গুছিয়ে বিছানায় গেলো ঘুমানোর উদ্দেশ্যে।

সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে স্কুলের জন্য তৈরি হচ্ছে ছোঁয়া।
স্কুলড্রেস পরে মুখে সামান্য পাওডার দিয়ে চোখে হালকা কাজল দিয়েছে সে।
গতকাল বাগান থেকে ফুল ছিড়ে সে ফুল দিয়ে একটা তোরা বানিয়ে রেখেছে সহিদ মিনারে দিবে বলে।
রেডি হওয়া কমপ্লিট হলে ঘড়িতে তাকালো ৬:১০ বাজে। সকাল ৬:৪৫ প্রভাতফেরি। সে আর দেরি না করে আনিতা বেগমের ঘর থেকে মোবাইল এনে মাইশাকে কল দিলো।

কল রিসিভ হতেই ছোঁয়া সালাম দিলো।
আসসালামু আলাইকুম।
ওয়ালাইকুম আসসালাম। কে ছোঁয়া।
জি আন্টি। কেমন আছেন?
আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমি কেমন আছো।
আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আন্টি মাইশা কোথায়?

ও তো মাত্রই বের হয়েছে।
ওহ, আচ্ছা আন্টি ভালো থাকবেন রাখছি আমাকেও বের হতে হবে নয়তো ও আমার জন্য অপেক্ষা করবে।
আচ্ছা। আর বাসায় এসো একদিন।
জি আন্টি আসবো। আল্লাহ হাফেজ।
কল কেটে ছোঁয়া কোনো রকমে আনিতা বেগমকে বলে এক দৌড় দিলো।
ছোঁয়াদের গেইটের কাছেই বাগানবিলাস গাছ। নিচে অনেক ফুল পড়ে রয়েছে। ওইখান থেকে একটা ফুল নিয়ে কানে গুজে আবারও দৌড় শুরু করলো।

মোড়ের কাছে আসতেই দেখলো মাইশা দাঁড়িয়ে। ছোঁয়া ছুটে গেলো মাইশার কাছে।
মাইশা দৌড়ে আসতে দেখে বললো,
ঘুম থেকে উঠেটে দেরি করবি তারপরে রেডি হতেও লেট আর এভাবে দৌড়ে দৌড়ে আসবি।
মোটেও আমার দেরি হতো না,আমি তো রেডি হয়ে তোর জন্য অপেক্ষা করছিলাম কখন তুই কল দিবি আমি বের হবো।
তারপরে তোর কল না পেয়ে নিজেই কল দিলাম আন্টি কল ধরে বললো তুই নাকি বেরিয়ে গেছিস।
আমাকে বলে বের হলে তো এভাবে দৌড়ে দৌড়ে আসতে হতো না। একসাথে বের হলে একসাথে এখানে পৌঁছতে পারতাম।

বলে একটা ভেংচি কাটলো ছোঁয়া।
যাই হোক তোর সুন্দর লাগছে।
তা তো তোরেও লাগছে।
হুহ…
হয়েছে এখন চল তারাতারি।
তারপর একটা রিক্সা ডেকে দুইজন উঠে পড়লো।
স্কুলে পৌঁছে ওরা দেখলো সবাই শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে এসেছে। একটু পরেই প্রভাত ফিরে বের হবে। তাই তাড়াতাড়ি করে দুইজনে শহীদ মিনারের কাছে জুতা খুলে ফুল দিয়ে আসলো।

এর মাঝেই ছোঁয়া বারবার আশেপাশ নজর বুলাচ্ছে।
নাহ আসেনি হয়তো,
আসতেও পারে কিন্তু এতো করে খুজলাম আসলে তো অবশ্যই দেখতে পেতাম।
তখনই মাইশা ওকে টেনে নিয়ে গেলো প্রভাত ফেরির লাইনে দাঁড়ানোর জন্য।

রাদিফ স্কুলে আসবে নাহ আজ।
সাব্বির দের বাড়িতে ছিলো রাতে।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই ফ্রেস না হয়ে বাইক নিয়ে ছুটছে বাড়িতে যাবে সে।
স্কুলেস সামনে দিয়ে রাদিফদের বাড়ি যাওয়া লাগে। সে স্কুলের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ করে স্কুল গেইটের দিকে চোখ পড়ে।
কাজল কালো এক জোড়া মায়াবি চোখ দেখে থমকে যায় রাদিফ।
সে বাইক থামিয়ে তাকায় মেয়েটার দিকে। মেয়েটা আর কেও না ছোঁয়া। রাদিফ গভীরভাবে তাকালো ওর দিকে। হাল্কা সেজেছে মেয়েটা। ওর চোখ এমনিতেই খুব মায়াবী যদিও হালকা ডার্ক সার্কেল আছে তবুও চোখ ভর্তি মায়া। তার ওপর কাজল দিয়েছে। কানে গোজা বাগানবিলাস ফুলটার জন্য যেনো একটু বেশিই সুন্দর লাগছে।

রাদিফ মনে মনে বললো,
অসম্ভব মায়াবী চোখ। সাথে মেয়েটার অনেক কিউট। ক্রাস খেলাম।আজ থেকে এই মেয়ে আমার ক্রাস। তাইতো বলি ওরে দেখলে অদ্ভুত ফিলিংস হয় কেনো৷। মেয়েটারে বোধহয় আমার ভালো লাগে।
এই বলে মুচকি একটা হাসি দিয়ে বাইক নিয়ে চলে গেলো রাদিফ।
ছোঁয়া দেখতে পায়নি রাদিফকে। ও ব্যস্ত ছিল প্রভাত ফেরির লাইন নিয়ে।

সকাল ৯ টা।
ফুলের মাঠে দাঁড়িয়ে আছে মাইশা আর ছোঁয়া।
একটু পরেই বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হবে।
ছোঁয়ার সেইদিকে মন নেই। রাদিফ স্কুলে আসেনি তাই ওর মন ভালো না।
সে মনে মনে বলছে,

উফ একুশে ফেব্রুয়ারিতে নাকি মানুষ চলে আসে না। কেমন মানুষ রে বাবা।
অনুষ্ঠান শুরু হতেই ছোঁয়া আর মাইশা গিয়ে স্টেজের সামনে চেয়ারে বসে পরলো।
দুজনেই কিছুক্ষণ অনুষ্ঠান দেখলো। ছোঁয়ার আর ভালো লাগছে না এখানে বসে থাকতে।
সে মাইশার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,
দোস্ত আর ভালো লাগছে না। চল বাইরে যাই। বাসায় যাবো।

তোর কি শরীর খারাপ করছে?
হ্যাঁ! খুব মাথা ব্যথা করছে।
আচ্ছা তাহলে চল বাসায় ফিরে যাই।
ওরা স্কুল গেইটের সামনে দারিয়ে আছে রিক্সার জন্য। দুপুর ১২ টা বাজে এই সময় রিক্সার দেখা মিলে খুব কম। তখনি ঝাল মুরি নিয়ে ভিতোরে যাচ্ছিলো লাবনি আর তানিয়া। কিছু দিন হলো ওদের সাথে ফ্রেন্ডসিপ হয়েছে ছোঁয়া আর মাইশার।
ছোঁয়া আর মাইশাকে গেইটের কাছে দেখে তানিয়া বললো,

কিরে কই যাচ্ছিস তোরা?
মাইশা: বাড়িতে ফিরে যাচ্ছি।
লাবনি বললো,
এখনো তো অনেক পারফরম্যান্স বাকি তোরা চলে যাচ্ছিস কেনো?
আসলে ছোঁয়ার মাথা বেথা করছে তাই বাসায় যাবো, এখন রিক্সা পাচ্ছি না।

ছোঁয়া বললো,
চল আমরা এগিয়ে যাই রিক্সা পেলে উঠে যাবোনি।
তুই হাটতে পারবি
হুম পারবো।
ছোঁয়া মনে মনে বললো,
মাথা ব্যথা না ছাই ভালো লাগছে না এগুলা শুনতে।

লাবনি: আচ্ছা তাহলে কাল সময় মতো স্কুলে চলে আসিস যায়গা রাখবো আমরা আগে আসলে।
আচ্ছা বাই।
ছোঁয়া আর মাইসা দুই জন খুনসুটি করতে করতে রাস্তা দিয়ে হাঁটছে।
ওরা প্রায় সময়ই এই রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে বাসায় ফিরে। হয়তোবা যাওয়ার সময় হেঁটে হেঁটে যায় নয়তো বাসার ফেরার সময়, সাথে দুইজনের গল্প তো আছেই। এই রাস্তা দিয়ে হাঁটতে নাকি ওদের ভালো লাগে।
এই যে এখনো দুজন হাঁটছে গল্প করছে আবার মারামারি করছে।

মোড়ের কাছে আসতেই দুইজন একে অপরের থেকে বিদায় নিয়ে নিজেদের বাসার উদ্দেশ্যে চলে গেলো।
বাসার সামনে এসে কলিং বেল চাপতে দরজা খুলে দিলেন আনিতা বেগম।
ছোঁয়া বাসায় ঢুকেই ব্যাগটা রেখে ধপাস করে সোফায় বসে পড়লো। ছোঁয়ার এহেনো কান্ড দেখে আনিতা বেগম বকতে লাগলেন।
স্কুল থেকে ফিরেই ব্যাগ ফেলে ধপাশ করে বসে পড়লি, কেনো রে ফ্রেস হয়ে খেয়ে দে এসে আস্তে ধীরে বসতেও তো পারিস।

সাহেদ চৌধুরী সোফায় বসে ছিলেন। আনিতা বেগমের কথা শুনে বললেন,
আহা মেয়েটা সবে বাসায় ফিরেছে ক্লান্ত লাগছে তাই একটু বসেছে এমন করছো কেনো একটু জিরিয়ে নিক তারপর ফ্রেশ হবে।
হ্যাঁ হ্যাঁ লাই দিয়ে তো তুমি মেয়েদের মাথায় তুলছো। দুটো মেয়েই একি রকম হয়েছে। ছোট টা এই ভর দুপুরে ছাদে উঠে বসে আছে।
এদের মতো যেনো আমার ছেলেটা না হয়। না হলে তো এখন আমার জীবনটা অর্ধেক শেষ হয়েছে তখন পুরোপুরি শেষ।

আনিতা বেগম এরকম আরো অনেক কথা বলতে বলতে ছাদে চলে গেলেন সুফিকে আনতে।
ছোঁয়া করুন চোখে বাবার দিকে তাকালো।
সাহেদ চৌধুরী মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
যাও আম্মু রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও নয়তো তোমার আম্মু এসে আবারো ঝাড়ি দেওয়া শুরু করবে।
বাবার কথাই ছোঁয়া মিষ্টি করে হাসলো। তারপরে ব্যাগ নিয়ে রুমে চলে গেলো।

আনিতা বেগম সুফির কান টেনে ধরে বাসায় ঢুকলো। আনিতা বেগমকে সুফির কান টানতে দেখে সাহেদ চৌধুরী উঠে গিয়ে মেয়েকে ছাড়িয়ে নিলেন।
আর বললেন,
আহা মারছো কেনো ছোট মানুষ ভুল করে গিয়েছে আর যাবে না দুপুরবেলা।

হ্যাঁ, এই বলে বলেই মেয়েদের আসকরা দাও আরো বেশি করে তারপরে বাঁদর বানাও। বড়টা কই? ও আচ্ছা রুমে চলে গেছে, তুমি বলছো তাই গেছে তাইনা। আমি তো হাজার বার বললেও যেতো না অথচ বাবা একবার বলেছে অমনি সে দৌড়ে রুমে চলে গেছে। এগুলো কি আসলেই আমার পেট থেকে হয়েছে, বলতে বলতে আজহারি করতে লাগলেন তিনি।
তখন সাফি এসে বলল আম্মু কাঁদে না ওরা পচা আমি তোমার সব কথা শুনবো আমি তোমার ছেলে।

পূর্ণতায় অপূর্ণতা পর্ব ১৫

হ্যাঁ বাবা তুই তো আছিস একমাত্র আমার কথা শুনে। আর এই বাড়িতে অন্য কেউ কি আছে যে আমার কথা শুনবে সব তো একজোট।
এই বলে তিনি সাফিকে কোলে নিয়ে রুমে চলে গেলেন।
সাহেদ চৌধুরী একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।

পূর্ণতায় অপূর্ণতা পর্ব ১৭