পূর্ণতায় অপূর্ণতা পর্ব ১৫

পূর্ণতায় অপূর্ণতা পর্ব ১৫
লেখিকা: সুরাইয়া ইসলাম ছোঁয়া

১ জানুয়ারি ২০১৯।
এই বছরটাই বোধ হয় এই জেনারেশনের কাটানো শেষ সুন্দর একটা বছর।
ছোঁয়া তৈরি হচ্ছে স্কুলে যাবে বলে। সকাল থেকে মায়ের কানের কাছে ঘেন করছে ওর সাথে স্কুলে যেতে।

আনিতা বেগম বিরক্ত হয়ে বললেন,
তুই কবে বড় হবি বলতো আমায়, ক্লাস নাইনের মেয়ে কিনা ভর্তি হতে মাকে নিয়ে যাবে। কই তুই আরো নিজের ছোট বোনটাকে ভর্তি করিয়ে দিয়ে আসবি তা না নিজের সাথেই আমায় যেতে বলছে।
আমার কাজ আছে তুই তোর বাবাকে গিয়ে বল।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তোমার কি কাজ আবার?
মায়ের কাজ চোখে পড়বে কেনো,, সারাদিন রান্নাবান্না করি বাসার সকল কাজ করি ওগুলা তোমার চোখে পড়ে না। তাছাড়া সুফিকে নিয়ে স্কুলে যেতে হবে সাফিটা ছোট বেশি মানুষ দেখলেই কান্নাকাটি করে।
তুই না তোর বাবার মেয়ে তাহলে আমায় বলছিস কেনো যা না এখন বাবাকে নিয়ে যা।

আব্বুর অনেক জরুরি মিটিং আছে নাহয় জীবনেও তোমাকে বলতাম না হুহ।
সুফি এসে সয়তানি হাসিতে বললো,
দেখছো আপু আম্মু আমায় বেশি ভালোবাসে তাইতো আমার সাথে যাবে।
আম্মু দেখো সুফি আমায় চেতায় 🥹

আনিতা বেগম বিরক্তির সুরে বললেন,
ওইটুক মেয়ে তোরে চেতায় তুই চেতোস কেন? তোরা দারা দুইটাই মার খাবি আজকে।
সুফি দৌড়ে গিয়ে সোফার পিছনে লুকিয়ে পড়লো। ছোঁয়া মুখটা কাচুমাচু করে নিজের রুমের দিকে গেলো।
শহীদ মিনারের সামনে বসে আছে ছোঁয়া। বসে বসে মাইশার জন্য অপেক্ষা করছে। আজ সে বাবার সাথে স্কুল এসেছে। সে বায়না করেছিলো তাকে ভর্তি করে দিয়ে যেতে যেহেতু জরুরি মিটিং আছে এতটা সময় থাকা সম্ভব না তাই সাহেদ চৌধুরী স্কুলের সামনে নামিয়ে দিয়ে গেছে ওকে। তাই মাইশার সাথে একসাথে আসেতে পারেনি। আর মাইশাও আজ ওর আন্টির বাসা থেকে স্কুলে আসবে।

শহীদ মিনারের পাশেই ইয়া বড় একটা গাছ, গাছটা থেকে দুটো পাতা কুরিয়ে নিয়ে সেগুলো দিয়ে খেলছে ছোঁয়া।
গাছটার নাম কি ছোঁয়া জানেনা, কিন্তু পাতাগুলো বেশ সুন্দর বড় আকৃতির গরমের দিনে খেলতে খেলতে বাতাসও করা যায়। ছোঁয়া নিজের মতন করে গাছটির নাম দিয়েছে রাবার পাতা গাছ। এসব হাবিজাবি ভাবতে ভাবতে সামনে তাকিয়ে দেখলো মাইশা গেট দিয়ে ঢুকছে।
মাইশা গেট দিয়ে ঢুকে সোজা স্কুল ভবনের দিকে যাচ্ছে, ওকে স্কুল ভবনের দিকে যেতে দেখে ছোঁয়া বসা থেকে উঠে দৌড়ে ওর কাছে গিয়ে বললো,

কিরে তুই ভেতরে যাচ্ছিস আমি যে এতক্ষন ধরে তোর জন্য শহীদ মিনারে কাছে বসে বসে অপেক্ষা করছিলাম।
তুই ওখানে ছিলি আমি খেয়াল করিনি আমি ভেবেছি ক্লাসরুমে থাকবে হয়তো তাই আমি ওইখানেই যাচ্ছিলাম।
কোন ক্লাসরুমে যাব আজব আজকে তো সবে ভর্তি হতে এলাম আন্দাজে কোথায় যাবো?
তুই আসলেই এক নম্বর গাঁধী।
আমরা তো মানবিকে ভর্তি হবো তাই না, তাহলে অবশ্যই তিন তলার বাঁ দিকের পাঠাগারের সাথে কর্নারের রুমটা হবে।
তা অবশ্য ঠিক, সেটা আমিও জানি কিন্তু স্যাররা তো এখনো যায়নি আমি একা একা গিয়ে কি করবো।

আররে বলদ স্যাররা তো তাদের টাইম মতোন যাবে কিন্তু যাবে তো ওখানেই তাই না। এতক্ষণ কি বাইরে বসে থাকবি নাকি, তুই আসলেই একটা বলদ চল।
মাইশা ছোঁয়ার হাত ধরে তিন তলার উদ্দেশ্যে হাটা ধরলো।
ওরা ক্লাস রুমে গিয়ে ফাস্ট বেঞ্চে নিজেদের ব্যাগ রেখেই রুম থেকে বেরিয়ে ক্লাসরুমের সামনে দাঁড়ালো।
ব্যাগের মধ্যে বই খাতা তেমন কিছুই নেই শুধু ভর্তি হওয়ার জন্য দরকারি কিছু কাগজপত্র ছাড়া।
ছোঁয়াতে পেছনে ঘুরে পুরো ক্লাসরুমটা দেখে নিলো, এখনো তেমন কেউই আসেনি।

তারপর আবার সামনে ঘুরে নিচে তাকালো। সে ভাবছে, এখান থেকে পড়ে গেলে কি মরে যাবে?
ভাবতে ভাবতে প্রশ্নটা মাইশাকে করেই ফেললো।
আচ্ছা মাইশা এখান থেকে পড়ে গেলে কি আমরা মরে যাবো?
মরবি না তবে হাড়গোড় ভাঙবে আর কি।
এসব বলদা বলদা চিন্তা তুই ছাড়া আর কারো হতেই পারে না বলদ একটা।

ছোঁয়া রেগে মাইশাকে কিছু বলতে যাবে তখনই তার চোখ গেলো ডান পাশে সিঁড়ির সাথে ক্লাস রুমটার দিকে রাদিফ দাঁড়িয়ে সাথে ওর বন্ধুরাও আছে।
তখনই সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলো প্রেয়সী।
সে রাদিফদের দেখে ওখানেই দাঁড়িয়ে ওদের সাথে কথা বলতে শুরু করলো।
ছোঁয়া ওদের থেকে চোখ ফিরিয়ে সামনে তাকালো। সে ওদিকে তাকিয়ে আছে মাইশা বা ওখানকার কেউ যদি দেখে ফেলে তাহলে সে লজ্জা পাবে এই ভেবে।

প্রেয়শী ওদের সাথে কথা বলতে বলতে হঠাৎ ছোঁয়া আর মাইশার উপর চোখ পরলো।
সে ডেকে উঠলো,
মাহিশা, ছোঁয়া না!
প্রেয়সীর দৃষ্টি অনুসরণ করে রাদিফ তাকালো, দেখলো ছোঁয়া আর মাইশা দাঁড়িয়ে আছে।

কারো ডাক শুনে মাইশা, ছোঁয়া তাকালো ওইদিকে। দেখলো প্রেয়সী ডেকেছে।
প্রেয়সী আবারো ডেকে উঠলো,
এদিকে আয় তোরা।
মাইশা ছোঁয়ার হাত ধরে ওদের দিকে এগিয়ে গেলো।

ওরা যেতে প্রেয়সী প্রশ্ন করলো, কি অবস্থা তোমাদের?
ছোঁয়া বললো,
আলহামদুলিল্লাহ ভালো আপু, তুমি কেমন আছো।
এইতো আছি।
তা রেজাল্টের কি অবস্থা তোমার, মাইশারটা তো জানি।

রাদিফ তাকালো ছোঁয়ার দিকে অপেক্ষা করছে ওর উত্তরের।
যেদিন জে এস সি রেজাল্ট দিলো বেচারার কয়েকবারই মনে পড়েছে ছোঁয়ার কথা।
মনে মনে প্রেয়সীকে ধন্যবাদ দিচ্ছে এই সময় এই প্রশ্নটা করার জন্যে।
এক মিনিট এক মিনিট আমি কেনো এতো আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি ওর উত্তর শোনার জন্য। ও যা ইচ্ছে রেজাল্ট করুক তাতে আমার কি। কিন্তু তবুও শুনতে ইচ্ছে করছে কেনো?
আরেহ অল্পস্বল্প চিনি মেয়েটাকে আর এইসব রেজাল্টের বিষয় সবারই আগ্রহ থাকে বেশি সেজন্যে আমিও নাহ।

ছোঁয়া একবার চোখ তুলে রাদিফের দিকে তাকালো, দেখলো রাদিফ ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। বেচারি লজ্জায় মাথা আরো নিচু করে নিলো।
তারপর আস্তে করে বললো,
মাইশার মতোই সেম আপু।
রাদিফ বিরক্ত হলো ওর কথায়।
উফ মেয়েটা কি মুখে বলতে পারে নাহ।
প্রেয়সী আবারো বলে উঠলো,
ও আচ্ছা তা তোমার পয়েন্ট কত?

রাদিফের যেনো প্রেয়সীর প্রশ্নটা পছন্দ হয়েছে।
ছোঁয়া মাথা নিচু রেখে মিনমিন করে বললো,
4.82
বাহ ভালই তো করছো মোটামুটি।
সাব্বির বললো,
মোটামুটি কি মেয়েটা কতো ভালো করেছে আর তুই মোটামুটি বলছিস কেনো ছাগল।

রাদিফ ভ্রু কুচকে সাব্বিরকে দেখলো ওর এত আলগা পিরিত সহ্য হচ্ছে না রাদিফের।
প্রেয়সী সাব্বিরের কথায় ভেংচি কাটলো। এরপরে বললো,
তুই একটা গাঁধা সর সামনে থেকে।
সাব্বির কিছু বলবে তখন আবারো প্রেয়সী বললো,
তা তোমরা ভর্তি হতে এসছো নাকি?

ওর কথা সুনে সাব্বির আবারও বললো,
তুই আসলেই একটা ছাগল।
আজকে জানুয়ারির ১ তারিখ অবশ্যই ভর্তি হতেই আসবে বলদ মার্কা কথা বলতেছিস কেন। হুদাই মেয়েটা তোর আজাইরা প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে হয়রান হচ্ছে।

রাদিফ এবারে বলে উঠলো,
ও কি একবারো বলছে যে ও হয়রান হচ্ছে।
তোর সমস্যা কই?
সাব্বির রাদিফের কথায় একটা টেডি স্মাইল দিয়ে ওকে জালাতে বললো,
তুমি বুঝবা নাহ বন্ধু।

রাদিফ কিছু বলবে তখনই প্রেয়সী দুম করে সাব্বিরের পিঠে এক কিল বসিয়ে দিলো।
তুই আমার পুরা কথা না শুনেই এতো বকরবকর করস কেন?
আমি তো ওরে জিজ্ঞেস করতাম কোন গ্রুপে ভর্তি হবে।
সাব্বির কিছু বলবে তার আগেই মাইশা বললো,
আপু আমরা মানবিক শাখায় ভর্তি হবো।

কেন?
কমার্সে ভর্তি হয়েছে যা।
এতক্ষণ ছোঁয়া মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনতেছিলো।
এবার মাথাটা উঁচু করে প্রেয়সীর দিকে তাকিয়ে বললো,
আপু আমার ইতিহাস পড়তে ভালো লাগে। মনে রাখতে পারি।
আর আমার মনে হয় মানবিক শাখার সাবজেক্ট গুলো আমি ভালো পারবো তাই এই শাখায় ভর্তি হওয়া।

রাদিফ বলে উঠলো,
যার যেই সাবজেক্টের প্রতি আকর্ষণ বেশি তার সেটা নিয়ে পড়া উচিত।
ছোঁয়া চমকে তাকালো রাদিফের দিকে। রাদিফ ওর দিকে তাকিয়েই কথাটা বলেছে। এখনো তাকিয়ে আছে তাই দুজনের চোখাচোখি হয়ে গেছে।
ছোঁয়া আবারও মাথা নিচু করে নিলো। ওর মন খুশিতে বাকবাকুম করছে রাদিফ কিনা তার বলা কথার উত্তর দিলো। এই প্রথম তাদের কথা হলো সরাসরি না হোক হয়েছে তো।

ছোঁয়া বেশ সহজ সরল মনের একটা মেয়ে। তার উপরে বয়সটাও কম পিচ্চি একটা মেয়ে। মাত্র কিশোরী বয়সে পদার্পণ করেছে। এই বয়সে ভালোলাগার ছোট ছোট জিনিস গুলো আকাশ ছুঁয়ি মনে হয়।
কেউ কিছু বলার আগেই সোহেল উপর থেকে নিচে উঁকি দিয়ে দেখলো স্যাররা আসছে।
তাদের অফিস কক্ষের রুমগুলো স্কুল বিল্ডিং এর ডান পাশে স্কুলের সাথে এডজাস্ট করা দুই তলা ভবনের নিচের তলার রুম গুলা। তাই স্কুল বিল্ডিং থেকে ভালোভাবেই দেখা যায় স্যারদের আসা যাওয়া।

সোহেল বললো,
এবার কথাবার্তা রাখ নিচে তাকিয়ে দেখ স্যাররা আসছে রুমে চল।
মাইশা আর ছোঁয়া ওদের বিদায় জানিয়ে নিজেদের রুমের উদ্দেশ্যে চলে আসলো।
রাদিফরাও নিজেদের ক্লাসরুমে চলে গেলো।
আনিতা বেগম সুফিকে ভর্তি করিয়ে মাত্র বাড়ি ফিরলেন।
সুফি শিশু শ্রেণী থেকে এ বছর ক্লাস ওয়ানে উঠলো। আজকে প্রথম দিন বলে ক্লাস হবে না তাই মেয়েকে নিয়েই বাড়ি ফিরলেন তিনি।
ছেলে মেয়ে দুটোকে একসাথে খেলতে বসিয়ে রান্না ঘরে চলে গেলেন। ছোঁয়ার পছন্দের খাবার বানাতে হবে। এসে তো গাল ফুলিয়ে বসে থাকবে ওর সাথে স্কুলে না যাওয়ার জন্যে।

ভর্তির ঝামেলা শেষ করে এখন বইয়ের জন্য দাঁড়িয়ে আছে মাইশা আর ছোঁয়া।
ছোঁয়া বিরক্ত হয়ে বললো,
কি একটা ঝামেলা বলতো সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি বই দেয়ার নাম নেই।
মাইশা বললো,
হুম,, আর দেখ প্রেয়সী আপুরা কি সুন্দর বসে বসে আড্ডা দিচ্ছে বইয়ের ঝামেলা নেই।
ছোঁয়া ঐ দিক তাকিয়ে বলল, ওনারা তো দশম শ্রেণীর স্টুডেন্ট বইয়ের ঝামেলা থাকবে কি করে।

এসব বলতে বলতেই ওদের সিরিয়াল চলে এসছে। দুইজনের পয়েন্ট কাছাকাছি হওয়াতে রোল নং এক সাথে হয়েছে সাথে তাই বইও এক সাথেই পেয়ে গেলো।
বই পেয়ে গিয়ে ওরা দুইজন আর দাঁড়ালো না। ঠিক করলো বাসায় চলে যাবে এখনই।
মাইশা বললো,
চল তাহলে এখন, অনেক ক্লান্ত লাগছে বইন।

পূর্ণতায় অপূর্ণতা পর্ব ১৪

হুম চল।
রাদিফ সোহেল সাব্বির শহীদ মিনারের কাছে বসে বসে আড্ডা দিচ্ছে। ছোঁয়া একবার সেদিকে তাকিয়ে মাইশার হাত ধরে স্কুল থেকে বেরিয়ে গেলো।
রাদিফ হঠাৎ গেইটের দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো ছোঁয়া আর মাইশা চলে যাচ্ছে।
সে একটা বড় নিঃশ্বাস নিয়ে সাব্বিরের সাথে কথা বলতে লাগলো।

পূর্ণতায় অপূর্ণতা পর্ব ১৬