রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৪

রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৪
সিমরান মিমি

পাখির কিচিরমিচির শব্দে মুখরিত ধরণী।রাতের নিকষ কালো অন্ধকার সময়ের সাথে সাথেই হারিয়ে গেছে শুভ্রতার আলোর বিপরীতে।ঘড়ির কাঁটা’য় তখন মাত্র সাড়ে ছয়’টা।দিনের আলো ফুটেছে অনেকক্ষণ।বেশ তোড়জোড় করে ব্যাগ গোছাচ্ছে স্পর্শী।পাশেই ভীতু বেশে একটা স্কুল ব্যাগ খামছে বসে আছে শ্রাবণী।অনন্দা দুরেই করুণ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে স্পর্শীর দিকে।বাকিরা সবাই গোজগাজ করে দিতে ব্যস্ত।

সকাল সাড়ে দশটায় পিরোজপুর থেকে ঢাকা যাওয়ার বাস আসবে।হিসেব মতে দশটা/সাড়ে দশটায় ঘর থেকে বেরোলেই পার্ফেক্ট হতো।কিন্তু এতোক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে সত্ত্বেও তারা বেরিয়ে পড়লো বাড়ি থেকে।কেননা,ঠাকুরমশাই তাদেরকে দ্বিতীয়বার দেখলেই রেগে যাবে।নিজের অপমান কে এতো তাড়াহুড়ো ভুলবে না কভুও।শেষে আবার ঝামেলা বাঁধবে।স্পর্শী চায় না আবারো কোনো ঝামেলা হোক।প্রথমত এর দায় সম্পুর্ণরুপে অনন্দার পরিবারের উপর পড়বে,২য়ত শ্রাবণীকে আর কোনো ঝামেলায় ফেলবে না সে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

দুহাতে দুটো ব্যাগ নিয়ে শ্রাবণীকে নিয়ে এগিয়ে এলো গেটের কাছে।নির্জন গ্রামের রাস্তা।কিছুক্ষণ পর পর দু একজন মানুষ হেঁটে যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে।প্রায় দশ মিনিট বটগাছের গোঁড়ায় বসার পর একটা অটো আসলো।হাতে হাতে ব্যাগ গুলো নিজে উঠে বসতেই থমকে গেল।পেছন থেকে অনুশোচনার স্বরে সব্যসাচী বললেন-
“ক্ষমা করো মা।ডেকে এনে তোমাকে অপমান করলাম।তোমার পক্ষ নিতে পারি নি।আসলে কি বলোতো,দিনশেষে সমাজ নিয়েই চলতে হয়।তাই সবসময় সেই সমাজের বিরুদ্ধে যেতে পারি না।”
হাসলো স্পর্শী।অনন্দার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে বললো-

“বিপক্ষেও তো যান নি?আপনার নিরবতাকেই সম্মতি মনে করে মনে আরো বেশি সাহস পেয়েছি। ”
আলতো হাসলো সব্যসাচী। স্পর্শী গাড়ি থেকে নেমে জড়িয়ে ধরা শ্রাবণীকে তার মায়ের থেকে আলাদা করলো। তাদের কে আশ্বাস দিয়ে চলে এলো অটোতে।গাড়ির চাকা ইতোমধ্যে ঘুরতে আরম্ভ করেছে।দ্বিতীয়বারের মতো স্পর্শী পিছু ঘুরে না দেখলেও শ্রাবণী সেই একধ্যানে নিজের পরিচিত বাড়ির গেটের দিকে তাকিয়ে রইলো।গাড়ির চাকার বেগের সাথে সাথে একসময় অদৃশ্য হয়ে গেল সেই বট গাছ।

ঘড়ির কাঁটা গাড়ির চাকার সাথে প্রতিযোগিতা করছে। কিন্তু পারলো কই।নিজের সর্বোচ্চ টা দিয়েও গাড়ির আগে পৌছাতে পারলো না।পনেরো মিনিটের মধ্যেই দেড় কিলোমিটার পাড়ি দেওয়া শেষ চাকার।বাজারের মধ্যে আসতেই বন্ধ হয়ে গেলো সেই চাকা।ত্রস্ত পায়ে শ্রাবণীকে ধরে নামিয়ে একটা ব্যাগ হাতে নিলো।তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে গেল সামনের বাস কাউন্টারের দিকে।তাকে অনুসরণ করে অটোওয়ালা ও বাকি ব্যাগদুটো নিয়ে এলো।একটা বেঞ্চির পাশে রেখে পুনরায় গাড়ির কাছে চলে এলো।তারপর আবারো চাকা ঘুরতে লাগলো তার আপন ঠিকানায়।

অস্থির হয়ে পায়েচারি করছে স্পর্শী।কতক্ষণ পর পর হাত ঘড়িতে দেখে নিচ্ছে সময়।টানা দেড় ঘন্টা অপেক্ষা করতেই কেমন বিষিয়ে উঠেছে শরীর।দাঁতে দাঁত কড়মড় করতে করতে চোখ চলছে রাস্তার দু-প্রান্তে। কোন প্রান্ত থেকে না জানি বাস চলে আসে।উফফফ!ঘড়ির কাঁটায় মাত্র সাড়ে আট’টা।এখনো টানা দু ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে।ভেতরটা কেমন ছটফট ছটফট করছে।নিজের জেদ গিয়ে পোষালো কাউন্টারের টিকিট বিক্রিয়কারী’র উপর।খাঁমখেয়ালী করে বললো-

“আপনারা এতোটা আক্কেল-জ্ঞানহীন কি করে ভাই?সময়ের একটুও মূল্য নেই নাকি?একটু হলেও তো পানচুয়ালিটি মেইনটেইন করতে পারেন।এতো দেরি হচ্ছে কেন বাস আসতে?হ্যাঁ! ”
দু চোখের কোঁটর বেড়িয়ে আসার উপক্রম লোকটির।হাতের ফোন’টাতে আরেকবার শিউর হয়ে টাইম দেখে নিলো।তারপর অবাক হওয়ার ভান ধরে বললো-
“আপনি তো ঢাকা যাবেন।আর ঢাকার বাস তো আসতে আসতে সাড়ে দশটা বেঁজে যাবে।আপনার টিকিটেই তো লেখা আছে।এতো আগে আসছেন কেন?”
দাঁত কটমট করে স্পর্শী পুনরায় বললো-

“কেন?এই যে এত্তোগুলা বাস আসলো পর পর।এরাও তো ড্রাইভার নাকি?এরা যদি আগে আসতে পারে তাহলে আপনার ঢাকার বাস কেন আগে আসতে পারবে না?”
থত খেয়ে গেল লোকটি।পাশে কাউন্টারে দাঁড়িয়ে থাকা আরো কয়েকটা মহিলা অবাক হয়ে দেখছে স্পর্শীকে।বোঝানোর স্বরে লোকটি বললো-

“দেখেন আপা,ঢাকার বাস তো সেই মঠবাড়িয়া থেকে লোক নিয়ে আসে।এরপর সাফা গিয়ে আবার লোক উঠায়।এভাবে প্রায় পাঁচ/ছয় জায়গার কাউন্টার থেকে ঢাকার পেসেঞ্জার উঠাইয়া তারপর আমাগো রুপাতলির কাউন্টারে আসবে।তাই দেরী হয়।”
হা হয়ে গেলো স্পর্শী।বুঝতে পারলেও এই অপেক্ষা করতে গিয়ে মেজাজ তার তুঙ্গে।খামখেয়ালী করে পুনরায় বললো-

“কেন?এটা কি লোকাল বাস নাকি?এত্তো জায়গায় থামতে হবে কেন?আজব সব লোকজন।”
ব্যাগের পাশের বেঞ্চে শ্রাবণীকে বসিয়ে সামনের রাস্তায় হাঁটছে স্পর্শী।মন কিছুতেই মেজাজ’কে হারাতে পারছে না।হুট করে দূরের এক দোকানে তাকাতেই অবাক হয়ে গেল।চোখে মুখে উপচে পড়ছে তার উত্তেজনা।ওখানে যাবে কি যাবে না ভাবতেই প্রথমে সময় দেখে নিলো।সাড়ে নয়টা বাজে।এখনো এক ঘন্টা বাকি বাস আসতে।শুধু শুধু দাঁড়িয়ে থেকে অপেক্ষা করার থেকে অন্যকে জ্বালানো অধিক শ্রেয়।এতে মন -মেজাজ তো শান্ত হবেই,সাথে সময় ও কেঁটে যাবে।যেমনি ভাবনা ওমনি কাজ।দ্রুতপায়ে হেঁটে গেলো রাস্তার ওপাশে।এইতো পাশের এক দোকান থেকে বেরোচ্ছে পরশ শিকদার সহ দলের বাকিরা।হয়তো আজকে এদিক’টাতে ঘুরে দেখবে।

“আরেহ,বাহ!এখন দেখতে দারূণ লাগছে।একদম পার্ফেক্ট।”
পেছন থেকে মেয়েলি কন্ঠস্বর শুনতেই পেছনে তাকালো পরশ।স্পর্শীকে দেখতেই ভ্রুঁ কুঁচকে চাইলো।পরক্ষণেই পাভেলের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে নিলো।পাভেল এগিয়ে গেল স্পর্শীর দিকে।মুখভঙ্গি সিরিয়াস করে প্রশ্নবিদ্ধ করলো।বললো-

“কাকে দারূণ লাগছে?”
মুহুর্তে’ই জিভ কাটলো স্পর্শী।দ্রুত বললো-
“আই মিন আজকে দাঁড়িটা ছোট করেছে তো, তাই ভালো লাগছে।আমি বলতে চাইছি।এখন নেতা নেতা লাগছে।”
থেমে দেবে যাওয়া কন্ঠে আস্তে বললো-
“এতোদিন তো গুন্ডা গুন্ডা লাগতো।”

তড়িৎ বেগে আবারো স্পর্শীর দিকে চাইলো পরশ।এই মেয়ে সীমার বাইরে কথা বলছে।আশেপাশে তাকাতেই দেখলো উৎসুক জনতা তাদের দিকে তাকিয়ে আছে।দ্রুতপায়ে সেখান থেকে গাড়ির দিকে এগিয়ে এলো।পাভেল ও আর টু শব্দ করলো না।চুপচাপ অন্যদের সাথে ভাইয়ের পিছু নিলো।এলাকার লোকজনের দৃষ্টি মোটেও সুবিধার লাগছে না তাদের কাছে।

স্পর্শী অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।তাকে একপ্রকার ইগনোর করে সবাই চলে গেছে।দ্রুতপায়ে পাভেলদের পেছনে যেতে যেতে চেঁচিয়ে বললো-
এইযে শুনুন, এমপিমশাই।আপনিতো এখানকার নেতা।বিচার করে যান।আমাকে এই এলাকার একটা মন্দিরের ঠাকুরমশাই গ্রামছাড়া করেছে।সে আমাকে ঘুরতে দেয় নি।তিন দিন ও শান্তিতে থাকতে পারি নি আমি।বিচার করে যান।

থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো পরশ।কিন্তু পিছু ফিরলো না।সামনে যেতে যেতে আওড়ালো-
“প্রশংসা জনক কাজ করেছে ঠাকুরমশাই।”
স্পর্শী ছুটে পরশের সামনে দাঁড়ালো।মুখভঙ্গি সিরিয়াস করে বললো-
“আপনি আমার কথার উত্তর দিচ্ছেন না কেন?দেখুন, কথা না বললে আমি ভাববো আপনি আমাকে অপমান করছেন।”

পরশ টানটান হয়ে স্পর্শীর সামনে দাঁড়ালো। গম্ভীর মুখশ্রী নিয়ে বললো-
“অপমান করতে’ই তো চাইছি।”
স্তব্ধ হয়ে গেল স্পর্শী।অপমানে মুখ থমথমে হয়ে গেলো।পরশ আর পিছু তাকালো না।ত্রস্ত পায়ে গাড়ির ভেতরে ঢুকলো।এতক্ষণে যেন ভ্রম দূর হলো তার।পরশকে পুনরায় দলের লোকের সামনে অপমান করতে বললো-

গতদিন আপনাকে আমি দুইশো টাকা দিয়েছিলাম চুল আর দাঁড়ি কাঁটার জন্য।কিন্তু আপনি শুধু দাঁড়ি ছোট করেছেন।বাকি একশ টাকা এক্ষুনি দিন।আমি ভাবতে পারছি না।সামান্য এই দুইশো টাকা থেকে একশো টাকা সরালেন।না জানি সরকারের দেওয়া জনগণের ত্রানের কোটি কোটি টাকার কত কোটি টাকা বাজেয়াপ্ত করেছে।
বলেই পেছন ঘুরে দিলো ভোঁ দৌড়। এতোক্ষণে লক করা গাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে সবাই।পাভেল নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছে না।এত্তো অপমানের মধ্যেও তার পেট ফেটে হাসি আসছে।

দাঁতে দাঁত চেপে ছুটে যাওয়া স্পর্শীকে পুনরায় দেখে নিলো পরশ।এখন এই পাজি,বেয়াদপ,ছুটন্ত মেয়েকে ধরতে গেলে তাদের ও ছুটতে হবে।শেষে গ্রামের লোকজন উলটো ভেবে কেলেংকারী ঘটিয়ে ফেলবে।এই মেয়েও কম নয়।ভীষণ রকমের অসভ্য।এর থেকে মিথ্যে শোনাটা মোটেও অসম্ভবের কিছু না।যদি গ্রামের লোকজন দের বলে দেয় তাকে ইভটিজিং করছিলো এমপির লোকেরা।

উফফ!সারা শরীর রাগে বিষিয়ে উঠেছে।এই মেয়ের সাথে তৃতীয়বার দেখা হোক সেটা পরশ খুব করে চায়।সেদিন বুঝিয়ে এবং ঠিকঠাক ভাবে চিনিয়ে দিবে পরশ শিকদার আসলে কি?

ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে স্পর্শী। প্রায় পাঁচ মিনিট ছুটে এসেছে সে।এইতো খানিক’টা পরেই কাউন্টার।এখান থেকেই শ্রাবণী’কে দেখা যাচ্ছে।পায়ের ধীর গতিতে জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে দাঁড়িয়ে পড়লো সেখানেই।মাথা’টা ঘুরে উঠলো যেন।চোখের সামনে কেমন অন্ধকার।কষ্ট করেও কেন জানি চোখ খুলতে পারছে না স্পর্শী।হঠাৎ ‘ই শরীরের পুরোপুরি ভর হারিয়ে লুটিয়ে পড়লো রাস্তার মাঝখানে।এর’ই মধ্যে পেছন থেকে দ্রুত গতিতে ধেয়ে আসলো এক বাস।

রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৩

মুহুর্তেই চারদিকে হইচই পড়ে গেল।শেষ মুহুর্তে ভীষণ কষ্টের মধ্যে আবছা চোখ মেললো স্পর্শী।দূর থেকে লোকজন এগিয়ে আসছে চিৎকার করে।এরইমাঝে পরিচিত মেয়ে শ্রাবণীর ছুটে আসার অবয়ব ভেসে উঠলো চোখের সামনে।আর পারলো না মেলে রাখতে।আচমকাই বন্ধ হয়ে গেল সেই কোমল,অশ্রুসিক্ত চোখ দুটির পাতা।

রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৫