পূর্ণতা পর্ব ৬

পূর্ণতা পর্ব ৬
নন্দিনী নীলা

পূর্ণতাকে মিটিমিটি হাসতে দেখে পাশে বসা ছেলেটা কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা পাগল নাকি ভাবছে ছেলেটা! এই হাসছে এই কাঁদছে মেয়েটার হাবভাব ও কিছুই বুঝতে পারছে না। ছেলেটার ফোনের রিংটোন জোরে বাজতে পূর্ণতার ধ্যান চূর্ণ হয়। ও সোজা হয়ে এক পলক ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আবার জানালা দিয়ে বাইরে দৃষ্টি ফেলে।

ছেলেটি ওকে ডেকে উঠে,,” একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”
পূর্ণতা জানালা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ছেলেটির দিকে তাকাল। তারপর গম্ভীর মুখ করে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। ছেলেটি জবাব না পেয়ে বলল,,” আই এ্যাম তুষার। আপনি?”
পূর্ণতা কটমট করে চেয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,,” আমি কি আপনার নাম জানতে চেয়েছি?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তুষার থতমত খেয়ে বলল,,” জি না কিন্তু আমিই বললাম। পাঁচ ছয় ঘন্টা একসাথে জার্নি করব পাশাপাশি বসে থাকব কিন্তু পরিচিত হবো না ব্যাপারটা কেমন না? ধরেন হঠাৎ একদিন আমাদের দেখা হয়ে গেল। তখন কি বলে সম্বোধন করব?”

পূর্ণতা বিরক্তিকর কন্ঠে বলল,,” আমাদের কখনোই দেখা হবে না আর হলেও আমি আপনাকে চিনব না। আপনার আমাকে চেনার প্রয়োজন নেই।”
“আপনি মনে হয় অনেক বেশি ডিপ্রেশনে আছেন তাই না?”
পূর্ণতা আর কোন জবাব দিল না রাগী দৃষ্টিতে একবার তুষারের দিকে চেয়ে অন্য দিকে তাকালো। এমনটা বাচাল মানুষের সাথে ওকে বসতে হলো।
পূর্ণতা ফের অতীতে চলে গেল।

ভিজে ভিজে বাসায় যেতেই পূর্ণতা মায়ের কাছে এক গাদা বকুনি খেল। পূর্ণতার তখন মেজাজ গরম হয়ে আছে প্রভাতের সাথে ঝগড়া করে। আর ফুলগুলো সব নষ্ট হয়ে গেল। কে ওই লোকটা? তখন আর এটা মাথায় আসেনি। ছেলেটা ওদের বাসায় কি করছে! পূর্ণতা মায়ের বকা তোয়াক্কা না করে রুমে চলে গিয়েছে। বাইরে ভালোই বৃষ্টি হচ্ছে পরিবেশটা শীতল ও গোসল করে ড্রেস চেঞ্জ করে নেয়। এখন এক কাপ চা খাওয়া দরকার‌। এজন্য ও নিচে আসে এসে দেখে ভেজা পোশাকে প্রভাত সোফায় বসে আছে। ওর চোখ কপালে উঠে যায় প্রভাতকে নিজেদের ড্রয়িং রুমে বসে থাকতে দেখে। ও তেরে আসে প্রভাতের দিকে।

“আপনি আমার বাসায় কি করছেন? কোন সাহসে আমার বাসায় ঢুকেছেন আম্মু কোথায়?”
বলেই চিৎকার করে আম্মু বলে ডেকে উঠল।
এদিকে প্রভাত পূর্ণতার চিৎকার শুনে বসা থেকে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। প্রভাত পূর্ণতার চিৎকার শব্দে কানে হাত দিয়ে রেখেছে। পূর্ণতা চিৎকার করে একটানা আম্মু বলে ডাকছে। ভেতর থেকে ওর আম্মু ধমক দিল ওকে।
পূর্ণতা চিৎকার থামিয়ে অপমানিত বোধ করে তাকাল প্রভাতের দিকে। দেখল প্রভাত কানে হাত দিয়ে রেখেছে ও চোখ ছোটো ছোটো করে বলল,,,”আপনি কানে হাত দিয়েছেন কেন?”

প্রভাত কান থেকে আঙ্গুল সরিয়ে বলল,,”যে ভাবে চিৎকার করছিলে। কানে তালা ফেটে বয়রা হয়ে যেতাম। সেই ভয়ে এই পন্থা অবলম্বন করতে হলো।”
“আপনার এতো বড় সাহস আপনি আমাকে আমার বাসায় দাঁড়িয়ে অপমান করছেন!”
পূর্ণতার মা রোজিনা বেগম এগিয়ে এসে বললেন প্রভাতকে,,”হ্যাঁ ভাইয়ের সাথে কথা বললাম। তুমি তাহলে ভাড়া থাকবে।”

প্রভাত বলল,,” জি আন্টি।”
“পূর্ণ যা তো প্রভাত কে ওর রুম টা দেখিয়ে দিয়ে আয়। গতকাল যে রুমটা পরিষ্কার করালাম ওই রুমে থাকবে। চাবিটা নিয়ে যা আমার ড্রেসিং টেবিলের সামনেই রাখা আছে।”

পূর্ণতা আকাশ থেকে পরে বলল,,”হোয়াট? উনি আমাদের বাসায় থাকবে কেন আম্মু? জানো উনি কত বেয়াদব? আমি কত কষ্ট করে গাছে ওঠে এতগুলো ফুল পারলাম। আর ওনার জন্য সবগুলো ফুল নষ্ট হয়ে গেছে। আমাদের বাসায় এসে আমাকে অপমান করছে। তুমি উনাকে আমাদের বাসায় থাকতে দিচ্ছ! অসম্ভব আমি উনাকে কিছুতেই আমাদের বাসায় থাকতে দেবো না। এই যে বের হোন আমাদের বাসা থেকে এক্ষুনি বের হোন বলছি।”

উত্তেজনায় পূর্ণতা গাছে ওঠার কথাটা বলে দিয়েছে। রোজিনা বেগম মেয়ের দিকে কটমট চোখে তাকিয়ে বললেন,,”তুই আবার গাছে উঠেছিলি?”
পূর্ণতা নিজের কথায় নিজেই ফেঁসে গেছে বুঝতে পেরে আমতা আমতা করতে লাগল।
রোজিনা বেগম গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,,”বড়দের সাথে কেউ এভাবে কথা বলে? তাড়াতাড়ি সরি বল আর আমি যা বলছি তাই কর বেয়াদব মেয়ে।”

মা রেগে আছে বুঝতে পেরে পূর্ণতা আর মায়ের ধমকের উপরে কথা বলল না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে রাগে ফেটে যাচ্ছে। পূর্ণতা ওর মায়ের দিকে থেকে চোখ সরিয়ে আগুন দৃষ্টিতে তাকালো প্রভাতে দিকে তারপর গজ গজ করে চলে যাওয়া ধরল।

রোজিনা বেগম প্রভাতের দিকে তাকিয়ে লাজুক কণ্ঠে বললেন,,”ওর কথায় কিছু মনে করো না প্রভাত। ছোট তো বোঝে না কোথায় কি বলতে হয়। এক বাপের এক মেয়ে তো এজন্য মাথায় ১০০ ডিগ্রী রাগ। দেখো না কেমন চাটাং চাটাং করে কথা বলল। বাবাকে দেখে একটু ভয় পায় কিন্তু তাকে তো কাছেই পায় না। সে তো তার কাজ নিয়েই ব্যস্ত।আমি যতই রাগ ধমক দেই না কেন এই মেয়েকে শোধরাতে পারি না। চল আমি তোমাকে এরকম দেখিয়ে দিচ্ছি।”

“প্রবলেম নেই আন্টি।” রোজিনা বেগম রুমে চলে গেল চাবি আনতে।
“অল্প বয়সী মেয়েদের রাগটা একটু বেশিই থাকে। এরা বুঝে কম চিল্লায় বেশি।” প্রভাত সিঁড়ির কাছে পূর্ণতা কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল।
সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে পূর্ণতা প্রভাতের কথা শুনে রাগে অগ্নিমূর্তি ধারণ করল। পূর্ণতা রুমে এসে ঠাস করে দরজা আটকে দিল।

রুমে এসে রাগে চিৎকার করে উঠল। আম্মু কীভাবে ওর নামে বদনাম করল‌ একটা বাইরের বেয়াদব ছেলের কাছে। নিজের মেয়ের প্রতি কোন ভালোবাসা নেই কীভাবে ওকে অপমান করল ছেলেটা। ওদের বাসায় এসেছে আর ওকেই সমানে অপমান অপদস্থ করে যাচ্ছে আর ও কিচ্ছুটি করতে পারছে না।

রোজিনা বেগম প্রভাত কে দুপুরের খাবার ওদের সাথেই খেতে বললেন। কারণ যে বৃষ্টি এই অবস্থা বাইরে যাওয়া সম্ভব নয় আর প্রভাত সাথে করে একটা ব্যাগ এনেছে যাতে শুধু নিজের প্রয়োজনীয় জামাকাপড় ও ব‌ইখাতা নিয়ে এসেছে। প্রভাত রুমে এসেই ফোনটা অন করে চার্জে বসালো। আর নিজের ভেজা পোশাক পরিবর্তন করে নিল। শীতে চামড়া সাদা হয়ে গেছে অনেক সময় ধরে ভিজে ছিল। দুইটা হাঁচি ও দিল। প্রভাত ল্যাপটপ বের করে ভালো করে মুছে নিল‌। যদি পানি যায় সর্বনাশ হবে। ব্যাগে কয়েকটা বিস্কুট ছিল একটা ছিঁড়ে কামড় দিতে লাগল কারণ সকাল থেকে না খাওয়া। এক কাপ চা‌ ব্যতিত কর কিছুই খাওয়া হয়নি।

প্রভাত পড়ালেখার জন্য ঢাকায় এসেছে। স্টুডেন্ট ভালো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চান্স পেয়েছে‌। কিন্তু লোক না থাকায় হোস্টেলে সিট পায়নি। এজন্য এই বিলম্ব পদ্ধতি। ভাড়া ছাড়া প্রভাত থাকবে না। ঢাকা শহরে নিজের আপন কেউ না থাকলেও নিজেদের এলাকার মোটামুটি ভালো পরিবারের ছেলে ও। প্রভাত ল্যাপটপ এ কিছু করছে আর বিস্কুট খাচ্ছে। তখন দরজায় নক না করেই রুমে প্রবেশ করল পূর্ণতা।

পূর্ণতা কে জোর করেই ধমক দিয়ে পাঠিয়েছে এখানে। প্রভাত কে খেতে ডাকতে পাঠিয়েছে রোজিনা পূর্ণতা কে। পূর্ণতা সোজা রুমের ভেতরে গিয়ে কোমরে হাত গিয়ে বলল,,” আপনি তখন কি বলছিলেন যেন?”
প্রভাত ল্যাপটপ অফ করে সোজা হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলল,,” কি‌ বলছিলাম?”

” সাধু সাজবেন না। আমি কিন্তু সব শুনেছি।”
” শুনলে আবার আমাকে জিজ্ঞেস করছ কেন?”
নাকের পাটা ফুলিয়ে পূর্ণতা বলল,,” আমার বাসায় এসে আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করছেন? দয়া করে থাকতে দিয়েছি তাই মাথায় উঠে বসবেন তাই না?”

” আমি তো তোমার কাছে দয়া চাই নি। আমি ভাড়া দিয়েই থাকব।”
” আমাকে টাকার গরম দেখাচ্ছেন?”
” ক‌ই না তো!”
” এতোই যেহেতু টাকা তাহলে এখানে থাকছেন কেন? চলে যান আমাদের বাসায় আপনার মতো বেয়াদব ছেলের কোন জায়গা না।”

রাগে পূর্ণতার ফর্সা মুখটা লাল হয়ে উঠেছে। রীতিমতো এই ছেলেটা ওকে অপমান করছে। মা এই বেয়াদব ছেলেকে খেতেও অফার করেছে আবার ওকে ডাকতে পাঠিয়েছে। ও তাকে খেতে নয় আজ বাসা থেকে তাড়িয়ে ছাড়বে।
প্রভাত বিস্কুটের প্যাকেট থেকে আরেকটা বিস্কুট বের করে কামড় দিয়ে বলল,,” বিস্কুট খাবে?”
পূর্ণতা মুখটা হা করে বলল,,” এতো অপমান করছি তাও আপনার লজ্জা লাগছে না এখানে থাকতে? আমাকে আবার বিস্কুট সাধছেন?”

” অল্পবয়সী মেয়েরা দেখতেও যেমন সুন্দরী হয় তেমনি রাগটাও মাথায় উঠে থাকে। এরা বুঝে কম লাফায় বেশি। তুমি এখনো বাচ্চা। তোমার কথা ধরে বাসা থেকে চলে যাওয়ার মতো বোকা আমি নয়। বাচ্চাদের সব শুনতে হয় না।”

পূর্ণতা পর্ব ৫

বলেই প্রভাত ওকে রেখেই নিচে নেমে এলো। পূর্ণতা কাঁদবে না হাসবে বুঝতে পারছে না। এই ছেলেকে বাসা থেকে এতো সহজে তাড়ানো যাবে না। ভারি নির্লজ্জ ছেলে এতো অপমান করছে তাও যাচ্ছে না।
পূর্ণতা বিছানা থেকে অর্ধেক বিস্কুটের প্যাকেট নিয়ে সেটা দুহাতে মুচড়ে গুঁড়ি গুঁড়ি করে বিছানায় ফেলে চলে আসলো।

পূর্ণতা পর্ব ৭