প্রণয় বিরহ পর্ব ১৯

প্রণয় বিরহ পর্ব ১৯
অর্ষা আওরাত

পুরো বাড়ি জুরে এখন নিস্তব্ধতা! কিয়ৎক্ষন পূর্বে চারিদিকপূর্ন কোলাহল পরিবেশ এখন নিস্তব্ধতায় গ্রাস করেছে। সকাল গড়িয়ে দুপুরের রেশ পড়েছে বেশ অনেকক্ষণ যাবত। ঘন্টা তিনেক আগে মেহমান সব চলে গিয়েছে। ছেলে আসেনি ছেলের বাবা মৃত মা আর মামারা আর একজন খালা এসে দেখে গিয়েছে বৃষ্টি আপুকে তাদের পছন্দ ও হয়েছে নাকি বেশ। আর ছেলের নিজেরও নাকি বৃষ্টি আপুকে পছন্দ করে রেখেছিলো আগ থেকে!

এখন সবাই রাজি আছে দেখা যাচ্ছে ঝেঠু দু’দিনের সময় নিয়ে ছেলের খোঁজখবর নিতে চায়। তাই সবাই মিলে ঠিক করলো যেহেতু ছেলে আসতে পারেনি কাজের চাপে তাই আর ক’দিনের ভিতরেই বৃষ্টি আপুর বিয়ে হয়ে যাবে। মেহমান চলে যাওয়ার পর সকলে বিশ্রাম নিচ্ছে যে যার ঘরে। আমিও অনেকক্ষন যাবতই নিজের ঘরে আবদ্ধ রয়েছি।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

বৃষ্টি আপুকে ফ্রেশ হয়ে দরজা বন্ধ করে রেখেছে ঘরের। সবাই ভাবছে হয়তো বিয়ে হয়ে যাচ্ছে তাই দরজা বন্ধ করে রেখেছে। কিন্তু আমি জানি আপু তার ভালোবাসার জন্য জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে ভেতর থেকে! হউক না সেটা অপ্রকাশিতো তবুও তো ভালোবাসা। আর ভালোবাসা না পাবার কষ্ট কি তা আমি অনুভব করেছি তাই বৃষ্টি আপুর কষ্টটা এই মুহুর্তে আমার চেয়ে ভালো আর কেউ উপলব্ধি করতে পারবে না!

আমি নিরাশ হয়ে জানলার পাশ ঘেঁসে বসে আছি। জীবনটা এতো বিরহে পরিপূর্ণ কেনো সবার? কি এমন ক্ষতি হতো যদি পূর্নতা পেতো? বিরহে বিলীন হবার কষ্ট যে হৃদয়ে বড্ড পোড়ায় যা সহনীয় নয়! আমি যে কষ্টের মধ্যে দিয়ে গেছি এখন সেই একই কষ্ট যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে বৃষ্টি আপু যাবে ভাবতেই মনের গহীন কোন থেকে এক রাশ খারাপ লাগা এসে হৃদয় ছুঁয়ে যাচ্ছে!

হঠাৎই মস্তিষ্কে একটি কথার উদয় হলো আপুর রুমের ডুপ্লিকেট চাবি তো আছেই আমার কাছে তাহলে আমি সেটা কেনো করছি না? সময় নষ্ট না করে চলে গেলাম আপুর রুমে! আস্তে আস্তে দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করে অবলোকন করলাম খাটের এক পাশে ফ্লোরে ঘুমিয়ে আছে আপু! চোখজোড়ার নিচে কেমন কালি পড়ে গেছে হয়তো অনেক্ষন ধরে একনাগারে কেঁদে গেছে তাই।

পড়নের শাড়িও বদলায়নি এখনো সেই আগের লাল শাড়িই রয়েছে। মেহমান যাবার পর সেই যে দরজা খুলেছে এখনো অব্দি না কিছু খেয়েছে আর না এই শাড়ি খুলে ফ্রেশ হয়েছে! এসব খুললেও তো একটু হালকা লাগতো? কিন্তু বৃষ্টি আপু যে ভাবে ঘুমাচ্ছে তাতে আর আপুকে ডাকতে সাহস হলো না আমার! আগের ন্যায় দরজা টুকু ভিজিয়ে দিয়ে আমি আমার রুমে যাবার জন্য অগ্রসর হচ্ছিলাম ঠিক তখনি ইহাদ ভাইয়ার রুম থেকে প্রিমার কিছু কথা কানে এসে বাজলো,

-“তানভীর কথা সেটা না বোঝার চেষ্টা করো তুমি এই বাড়ি থেকে বের হওয়া দিনের পর দিন খুব অসুবিধা হয়ে যাচ্ছে! তাই তোমার সঙ্গে মিট করাও পসিবল না।”
অপর পাশে ফোনে থাকা ব্যক্তি কি বলতে পেলো তা তো শুনলাম না কিন্তু প্রিমা আপুর কথা শোননাম,
–“বেশ তুমি যখন এতোই জেদ ধরেছো তখন আজকে বিকেল বেলা মিট করবো? তখন না হয় ইহাদকে নিয়ে আর এই বাড়ি নিয়ে আমাদের বাকি প্ল্যান আলোচনা করা যাবে। এখন রাখছি কেউ চলে আসবে।”

আর কিছু শোনার জন্য অপেক্ষা না করে আমি দৌড়ে নিজের রুমে চলে আসলাম! তার মানে যা ভেবেছি তাইই ওই তানভীরের সাথে প্রিমা আপুর কোনো সম্পর্ক আছে আর ইহাদ ভাইয়াকে বিয়ে করবার পিছনেও নিশ্চয়ই কোনো উদ্দেশ্য আছে এখন তো প্রায় তিনটে বেজে গেছে বিকেল পাঁচটা বাজতে আর মাত্র দু’ঘন্টা বাকি আছে। আগের বার প্রমানের জন্য ইহাদ ভাইয়া আমাকে বিশ্বাস করেনি এবার এই ফোনটাকে ভালো মতন চার্জ করে তারপর প্রমান কালেক্ট করে ওই ইহাদ ভাইয়াকে বেশ ভালো করে বুঝিয়ে দিবো আমি ভুল ছিলাম নাকি সে ভুল ছিলো!

ঘড়ির কাঁটায় সাড়ে চারটা বাজতেই আমি বোরখা আর হিজাব পড়ে নিজেকে আবৃত করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলাম আধা ঘন্টা আগে যাতে প্রিমা বা কারোর সন্দেহ না হয়! বাড়ি থেকে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালাম প্রিমা আপুর আসার অপেক্ষায়। কিয়ৎক্ষন সময় অতিবাহিত হবার পর কাঙ্ক্ষিত মানুষটির দেখা মিললো। আমি আপুর পিছু পিছু অনুসরণ করছি। রাস্তা ঘাটে তেমন ভীড় নেই আমি ফলো করছি প্রিমা আপুকে।

হঠাৎই একটা গলির দিকে মোড় নিয়ে সরু গলিতে ঢুকে গেলো প্রিমা আপু! আমিও তার পিছু পিছু গেলাম কিছুক্ষণ পর হাঁটার পর একটা অন্ধকারে ঘেরা দোকানের ভিতর ঢুকে গেলো প্রিমা আপু! দরজাটি বাহির থেকে দুম করে বন্ধ করে দিলো আর আমি এক রাশ হতাশা নিয়ে বাহিরে দাঁড়িয়ে রইলাম নিরুপায় হয়ে। কিন্তু আমার হতাশায়ও এক চিলতে আশার আলো দেখা গেলো দোকানটির ভিতর একটি ছিদ্র দেখে! ছিদ্রটি অতি সুক্ষ্ম চোখে পড়ে না এরকম!

কিন্তু আমার চোখে পড়েছে যখন তখন আমি এক চোখ বন্ধ করে আর এক চোখ দিয়ে দেখতে লাগলাম। প্রিমা আপু কিছু একটা বলছে সেটা আমি শুনতে পাচ্ছি না কিন্তু দেখতে পাচ্ছি। হঠাৎই প্রিমা আপু ওই তানভীর নামক ছেলেটিকে জ*ড়ি*য়ে ধরে! শুধু তাই নই কি বিশ্রি ভাবে প্রিমা আপু তার হাতের আঙুল দ্বারা ওই ছেলের ঠোঁট স্লাইড করছে! এগুলো দেখে আমার মুখ অটোমেটিক হা গেছে! ভালোবেসে বিয়ে করে নিজের স্বামী থাকা অবস্থায় এসব করছে সে!

ভাবতেই মহিলার উপর এক রাশ ঘৃনা এসে ভর করলো! এবার পানির মতন সবটা পরিষ্কার এই তানভীর হচ্ছে প্রিমার বয়ফ্রেন্ড! বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এরকম হয় না। এখন যদি এগুলোর ছবি তুলতে পারতাম তাহলে এখনি এই ভদ্রমহিলার মুখোশ টেনে খুলে দিতে পারতাম! কিন্তু আফসোস তা পারছি না। প্রিমা আপুর সাথে সাথে ওই ছেলেটিও আপুর কো*ম*ড় জ*ড়ি*য়ে ঝা*পটে দাঁড়িয়ে থাকা থেকে একটি চৌকির মতন বিছানায় শুয়ে পড়লো! প্রিমা আপু কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু তানভীর তার মুখে হাত দিয়ে নিজের প্রিমা আপুর উপর অগ্রসর হয়ে ওঠছে!

আর দেখার সহ্য শক্তি নেই আমার! যা দেখেছি চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম! বুঝতে বাকি নেই এখন কি ঘটবে দু’জনের মধ্যিখানে এই বদ্ধ দোকানের ভিতর! সেখান থেকে বেরিয়ে আসলাম বাড়ির উদ্দেশ্য এখাসে এসব নোং*রা কর্মকান্ড দেখার চেয়ে বাড়ি চলে যাওয়াই ভালো। কেউ বিশ্বাস না করলেই বৃষ্টি আপু ঠিক বিশ্বাস করবে আমার কথা। কিন্তু আপুর নিজেরই এখন মনের অবস্থা ঠিক নেই সে কি করে আমার এই সমস্যার সম্মুখীন হবে?

মাথা ঘুরছে আমার কিছুক্ষণ আগের ঘটা ঘটনা দেখে! হঠাৎ করেই দেখতে পেলাম সামনে একটি বড়ো গাড়ি আমার দিকে ধেয়ে আসছে ঠিক তখনি কোনো পুরুষের হাত আমাকে ছুঁয়ে দিয়ে সাইডে নিয়ে আসলো! গায়ের মিষ্টি সুবাস থেকে বুঝে গেলাম পুরুষ মানুষটি আর কেউ নয় সেহেরিশ ভাইয়া! আমি কিছু বলবো তার আগেই তিনি বলে ওঠলেন,

–“এই মনোযোগ নিয়ে তুমি মেইন রোড পার হতে যাচ্ছিলে! কোনো জ্ঞান নেই তোমার? কি এমন ভাবছো তুমি? তোমার এই বেখেয়ালি ভাবনার জন্য কতো বড়ো ক্ষতি হতো ভাবতে পারছো তো তুমি?”
আমি সেসব প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তাকে জিগেস করে উঠলাম,

-“আপনি আমাকে চিনলেন কি করে? এই বোরখা তো আমি কালকে কিনেছি মাত্র বাড়ির কেউই দেখেনি আর আপনি না দেখেই চিনে ফেললেন এই বোরখা পরিহিতা মেয়েটি আমি?”
–“তুমি যেই কাপড়েই আবৃত হও না কেনো আমার এই চোখ জোড়া ঠিক তোমার ওই মায়াবি নয়নযুগল’কে খুঁজে নিবে জুঁইফুল!”

উনার কথা যেনো মাথায় ঢুকেও বেরিয়ে যাচ্ছে বারংবার! চোখের সামনে এখনো প্রিমার নোং*রা কাজগুলো ভেসে ওঠছে। সেহেরিশ বলে ওঠলো আমাকে,
–“প্রশ্নের জবাব দিবে না জুঁইফুল?”
ওনার কথা শুনে আমি ভাবলেশহীন ভাবে উত্তর দিলাম,

-“কিছু প্রশ্ন ছিলো যার উত্তর পাইনি। কিন্তু আজ উত্তর পেতই মনে হচ্ছে প্রশ্নগুলোর উত্তর আড়ালে থাকাই তো ভালো ছিলো বোধহয়।”
আমার এই কথার মানে যে উনি বুঝতে পারলেন না তা ওনার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে! ওনাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আমি হাঁটা লাগলাম। কিন্তু উনি আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলে ওঠলো,

-“তোমার মানসিক অবস্থা ভালো নেই হয়তো কোনো চরম সত্যির মুখোমুখি হয়েছো তুমি যা তোমার কথার ধরন দেখে বোঝা যাচ্ছে! এই অবস্থায় তোমাকে একা ছেড়ে দিতে পারি না আমি। সে তুমি না চাইলেও আমি তোমার সঙ্গে তোমার বাড়ি যাবো।”

প্রণয় বিরহ পর্ব ১৮

ওনার কথা পৃষ্ঠে কথা না বাড়িয়ে হেঁটে চললাম। সত্যিই তো যেই সত্যি দেখলাম নিজ চোখে তাতে আমারই অবস্থা খারাপ আর ইহাদ ভাইয়ার জানি কি হয়!

প্রণয় বিরহ পর্ব ২০