প্রেয়সী পর্ব ৪৯ (২)

প্রেয়সী পর্ব ৪৯ (২)
নন্দিনী নীলা

মধু মায়ের কেবিনে অনেক সময় বসে ছিল। আসার পর থেকে মায়ের কাছের বসে ছিল। সানজিদাহ বেগম এর হাতে স্যালাইন লাগানো। কয়েকদিন‌ ধরে একেবারে খাওয়া-দাওয়া না করার জন্য দূর্বলতায় অজ্ঞান হয়ে গেছিল তারপর তাকে হসপিটালে এডমিট করা হয়েছে। জ্ঞান ফিরে শুধু মধুর নাম বলতে লাগে।

মাহতিম হোসেন এজন্য সমুদ্রের মাধ্যমে মধু এখানে এনেছে। মধু ভোরের দিকে মায়ের কেবিনে থেকে বেরিয়ে আসে। মাথা ভার হয়ে আছে না ঘুমানোর জন্য। দরজা খুলে বেরিয়ে সামনে হাঁটতে লাগে। ভোর বিধায় হসপিটাল একদম নিরব। দুই একটা রুম থেকে রোগীর আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। লিফটের কাছে আসতেই দেখল সমুদ্র দাঁড়িয়ে আছে ফোন কানে ধরে। কারো সাথে খুব রাগান্বিত হয়ে কথা বলছে। ও বুঝতে পারছে না কার সাথে কথা বলছে। মধু সমুদ্রের থেকে একটু পিছনেই দাঁড়িয়ে কথা শেষ হবার অপেক্ষা করতে লাগল।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

হঠাৎ সমুদ্রের একটা কথা শুনে মধুর পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল। ওর বুকের ভেতরটা অস্বাভাবিক মাত্রায় কেঁপে উঠল।
ও মুখ সেপে ধরে নিজেকে লুকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। সমুদ্রের কথা শোনার জন্য। ওকে দেখলেই সমুদ্র কথা থামিয়ে দেবে কিন্তু মধু তা চায় না। ও অবিশ্বাস্য চোখে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে। সমুদ্র কথা বলছে খুব রাগ দেখিয়ে। শান্ত নরম সমুদ্রের সাথে এই সমুদ্রের কোন মিল নেই। খুব অপরিচিত লাগছে সমুদ্র কে এই মুহূর্তে।

সমুদ্র বলছে,,” ফুয়াদ কে কোন ভাবেই সজ্ঞানে আনবি না। আমার ভাই ও আমি ওকে চিনি। একবার জ্ঞান ফিরলেই ও ওখানে থেকে পালিয়ে আসবে যেভাবেই হোক।”
ওপাশ থেকে কি বলল মধু শুনল না। সমুদ্র আবার বলল,,” বেশি ঘুমের ইনজেকশন দিলে ওর ক্ষতি হলে অন্য কিছু কর। কিন্তু ওকে সজ্ঞানে আনা যাবে না।

আর আমি আমার ভাই কে কষ্ট ও দিতে চাই না। একবার মধু আমাকে স্বামী হিসেবে মেনে নিক তারপর ওকে ছেড়ে দিব। ভাইয়ের ব‌উ কে আমার ভাই কেড়ে নিবে না আমি জানি। কিন্তু মধু চলে গেলে আমি তো আটকাতে পারব না। আর এই মুহূর্তে ফুয়াদ চলে আসলে মধু ওর কাছে চলে যাবে। আমার দিকে ফিরেও দেখবে না। ফুয়াদ কে আড়ালে রেখে আমার ই ওর কাছে থাকতে হবে।”

মধু দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না ওর শরীর মাত্রাতিরিক্ত কাঁপছে। সমুদ্রের কথা শুনে ও পাথর হয়ে গেছে যেন। সমুদ্র এতটা নিচ ও ভাবতেও পারছে না। ছিহ নিজের ভাইকে শেষে নিজেই কিডন্যাপ করে আধমরা করে রেখেছে। এতো দিন এই মানুষটি কে ও কত‌ই না ভালো ভেবে এসেছে।আজ তার স্বরুপ সামনে না আসলে আজীবন তাকে ভালোই জেনে আসতো আর তলে তলে উনি কত কিছুই না করত।

নিজের ভাইয়ের সাথে এইভাবে প্রতারণা করছেন উনি। চোখ এলিয়ে জল গড়িয়ে পরতে লাগল মধু। সমুদ্র কথা বলছে মধু আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। লুকিয়ে আড়াল থেকেই আবার মায়ের কেবিনে এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগল। সমুদ্রের প্রতারণা ও মানতেই পারছে না। ওর নিজের ই এতো কষ্ট হচ্ছে ফুয়াদ জানলে ওর কি অবস্থা হবে? ফুয়াদ ভাই অন্ত প্রাণ। সেই ভাই ওর সাথে এসব করছে জানলে কি হবে? মানতে পারবে তো?

সমুদ্রের পায়ের আওয়াজে মধু নিজেকে স্বাভাবিক করে তুলে। সমুদ্র ওকে বাইরে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে,,” বাইরে একা দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
মধু ঝট করে তাকাল ওর দিকে। তাকাতেও ঘৃণা লাগছে ওর। কিন্তু সমুদ্র কে কোন ভাবেই বুঝতে দেওয়া যাবেনা ও সব জেনে গেছে? এতো ভালো আচরণের পেছনে যে কারো এতো কুৎসিত রুপ থাকে তা সমুদ্র কে না দেখলে মধু কল্পনায় ও আনতে পারত না।

মধু দাঁতে দাঁত চেপেই বলল,,” আম্মু ঘুমাচ্ছে আর বসে থেকে আমার ই ভালো লাগছিল না। তাই ভাবলাম বাইরে যাই।”
” চলো নিচে যাই। তোমার নিশ্চয়ই ঘুম পাচ্ছে?”
মধু আবার দরজা খুলে বলল,,” না আম্মুর কাছেই বসি কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না।”
সমুদ্র বলল,,” তোমার ফোন?”
” বাসায় রয়ে গেছে।”

সমুদ্র কি যেন ভেবে আচ্ছা বলে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর খাবার নিয়ে হাজির হলো সাথে মাহতিম হোসেন ও এসেছে। মধু আজকে বাবা আর সমুদ্রের গলাগলি ভাব দেখে মোটেও বিচলিত হলো না। খুব ভালো ভাবেই এখন বুঝতে পারছে দুজনের এতো ভাব হ‌ওয়ার কারণ। কিন্তু মধুর মাথা একটা কথাই ঢুকছে না। সমুদ্র আর ফুয়াদ দুজনেই তো ভাই। বাবা ফুয়াদকে এতো অপছন্দ করে আর সমুদ্র কে এতো পছন্দ ই বা কীভাবে করে?

এই একটা ব্যাপার ওর মাথায় কোনভাবেই আসছে না। সমুদ্রের চেয়ে ফুয়াদ অনেক বেশিই পারফেক্ট। দায়িত্ব শীল একজন মানুষ। সেদিকে সমুদ্র বখাটে টাইপের। নেশা করে পার্টি করে। কিন্তু ফুয়াদের কোন বাজে নেশা নাই। বাবা ফুয়াদকে পছন্দ করছে না কিন্তু সমুদ্রের মতো ছেলেকে কি দেখে এতো পছন্দ করল। সাফিন এরসাথে বাবা টাকার জন্য ওকে বিয়ে দিতে চেয়েছিল। বাবার কম টাকা পয়সা নাই। অসৎ উপায়ে অনেক টাকার মালিক হয়েছেন। কিন্তু সমুদ্র নিজেই পরিবারের উপর নির্ভর শীল। তাকে কি দেখে বাবা পছন্দ করল?

মধুর মাথা ধরে যাচ্ছে যত‌ই চিন্তা ভাবনা করছে কোন কিনারা করতে পারছে না।
দুপুরের পর নার্স সহ সানজিদাহ বেগম কে বাসায় নিয়ে যাওয়া হলো। মধু আর সমুদ্র ও গেল সাথে। সমুদ্রের ফোন বন্ধ হয়ে গেছিল মধু দের বাসায় গিয়ে চার্জে বসিয়ে কোথায় যেন চলে যায়। বাসায় এসে মধু এসব নিয়েই চিন্তা ভাবনা করে কাটালো এই কথা ও কার সাথে শেয়ার করবে? তিন্নি কে বললে কোনদিন ও বিলিভ করবে না। ভাইদের প্রতি যে অনেক ভালোবাসা ওদের সবার। ফুয়াদ সমুদ্র দুজনেই ওদের কলিজার ভাই।

মধু সারাদিন মন মরা হয়ে কাটাল। কীভাবে ফুয়াদ কে খোঁজে পাবে? সমুদ্রের কাছে থেকে কীভাবে জানবে ফুয়াদ কে কোথায় আটকে রেখেছে। একটা মেয়ের জন্য নিজের ভাইকে বন্দি করে রাখছে এমন ভাই কারো না হোক।
সমুদ্র কে দেখলেই মধুর এখন শুধু রাগ উঠে। নিজেকে কন্ট্রোল করছে খুব কষ্টে। সন্ধ্যার পর সমুদ্রের সাথে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হয়।

সমুদ্র ফোন অপেন করতেই বাসা থেকে অজস্র কল আসতে শুরু করে। মধু গাড়িতে বসে খেয়াল করে সমুদ্রের হাতে হসপিটালে ফুয়াদ কে নিয়ে কথা বলার সময় অন্য একটা ফোন দেখেছিল। ওই ফোনটা আগে কখনো সমুদ্রের কাছে দেখেনি। আজকেই ফাস্ট। ওই ফোনটা কোন ভাবে হাতে নিতে পারলে অনেক কিছু বের করতে পারবে মধু। এখন ওর একটাই উদ্দেশ্য ওই ফোনটা খোঁজ করা।

মধু সমুদ্রের কথা বলা দেখছে। বাসার সবাই যে রেগে বোম হয়ে আছে সমুদ্রের কথা বলার ধরন ই বলে দিচ্ছে। মধু সমুদ্রের ভালোমানুষি দেখতে পারছে না। কটমট করে চেয়ে কথা গিলছে‌। বাসায় পৌঁছাতেই নানান ঝড়ের মুখোমুখি হতে হলো দুজনকেই। নাফিসা বেগম সমুদ্র কে ঠাস করেই থাপ্পড় মারলেন প্রথমে তারপর কড়া কথা বলতে লাগলেন। মধু থাপ্পড় দিতে দেখে মনে মনে বেজায় খুশি হলো।এতো কিছু জানার পর ও কিছুই করতে পারছে না। আর ও বললে ও ওর কথা কেউ ই বিলিভ করবে না। নাফিসা আন্টি যখন জানবেন উনার এক ছেলে নিরুদ্দেশ হ‌ওয়ার পেছনে আরেক ছেলে আছে তখন উনার কি অবস্থা হবে?

রুমে আসতেই তিন্নি বলল,,” কোথায় ছিলি তোরা? সত্যি আন্টি অসুস্থ হয়েছিল নাকি দুজনে ঘুরতে গিয়েছিলি?”
মধু অবাক স্বরে বলল,,” কার সাথে ঘুরতে যাব। আম্মু খুব অসুস্থ হয়ে পরেছিল তাই গিয়েছিলাম।”
” জানিয়ে যাবি তো।”
” খেয়াল ছিল না। মায়ের খবর টা শোনার পর আর কোন দিকে খেয়াল ছিল না।”
” আচ্ছা আন্টি এখন কেমন আছে।”

” মোটামুটি। স্যালাইন চলছে। কথাও বলতে পারেনি। এতোটা দূর্বল হয়ে গেছে।”
” চিন্তা করিস না। আন্টি দ্রুত সুস্থ হয়ে যাবে।”
মধু মাথা নাড়িয়ে চুপ করে বসে আছে। তিন্নি ফোন টিপছিল‌। ভাবছিল মধু কিছু বলবে। কিন্তু মধু কোন ধ্যানে যেন মগ্ন হয়ে আছে‌। তিন্নি ফোন থেকে চোখ সরিয়ে ওর দিকে র‌ইল।
মধুর কাঁধ ধরে ধাক্কা দিয়ে বলল,,” কি রে কি হয়েছে তোর?”
মধু ছিটকে উঠে বলল,,” ক‌ই কিছু না তো।”

” মিথ্যা বলবি না।”
” ফুয়াদের কথা মনে পড়ছে।”
” তোর চোখে মুখে আমি রাগ দেখতে পাচ্ছি। এতো রেগে আছিস কার উপর।”
” ধুর আমি চিন্তায় আছি ফুয়াদ কে নিয়ে।”
” এতোদিন ও তো ছিলি। কিন্তু আজকের রিয়েকশন পুরোই আলাদা। কিছু হলে জানা আমাকে।”
মধু মনে মনে বলল,,” বলতে পারলে আমার নিজের ই যে খুব শান্তি লাগত রে। কিন্তু এই কথা বললে তুই যে বিশ্বাস করবি না আমাকে।”

” কি করে কি হলো কথা না বলে হা করে তাকিয়ে আছিস কেন?”
” একটু ঘুমাতে দে।”
বলেই মধু শুয়ে পড়ল।
মধু শুয়েও একটা কথাই ভাবছে সমুদ্র কে নজরে রাখতে হবে‌। যেভাবেই হোক উনার দ্বিতীয় ফোনটা আমাকে একবার নিতেই হবে।

তার জন্য তার রুমে যেতে হবে। ঘুমের ভান করে পরে র‌ইল মধু। কিন্তু ঘুম আসছে না। তিন্নি ওকে টেনে ডিনার করতে নিয়ে আসলো‌। খাবার টেবিলে সমুদ্র কে পাওয়া গেল না। তিনি তো ক্লাবে থাকে আজ কেও কি গিয়েছে? তিন্নি কে রুমে এসে জিজ্ঞেস করল মধু।

প্রেয়সী পর্ব ৪৯ (১)

তিন্নি বলল,,” না ভাইয়া তো ঘুমে। আজকে বাইরে যায়নি। তোকে বাসায় নিয়ে আসায় পর থেকে যাচ্ছে না। বাসায় ই আছে।”
মধু ওহ বলে চুপ করে র‌ইল। না গেলে ও রুম সার্চ করবে কীভাবে?

প্রেয়সী পর্ব ৫০