প্রেয়সী পর্ব ৫১

প্রেয়সী পর্ব ৫১
নন্দিনী নীলা

দশ মিনিট পর সমুদ্রের গাড়ি পাওয়া গেল। মধু ড্রাইভার কে সমুদ্রের গাড়ি দেখিয়ে বলল ফলো করতে। লোকটা ও তাই করতে লাগল। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এই গাড়ি যাচ্ছে কোথায়? এটা তো মানিকগঞ্জের রোড। মধু দ্বিধায় পরে গেল সমুদ্র আমাদের বাসায় যাচ্ছে কেন? আমাদের বাড়ি যাচ্ছে নাকি ওদিকেই ফুয়াদ কে রেখেছে।

এদিকে সি এনজি ওয়ালা গাড়ি থামিয়ে দিয়েছে সে আর যাবে না। হাই রোডে তিনি উঠবেন না। তাও আরেক জেলার দিকে। কি বিপদ? মধু এই মাঝ রাস্তায় নেমে গেলে ফলো করবে কি করে? এখনি একটা কার পেলে ভালো হতো। মধু সি এনজি থেকে নামছে না দেখে তিনি রাগারাগী করছে। মধু তাকে নিজের সমস্যার কথা খুলে বলতে তিনি বললেন তার পরিচিত একজন আছেন যিনি কার চালায়। মধুর চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। ও তাকে আসতে বলল। তিনি ফোন করে জানল তিনি কাছাকাছিই আছেন দশ মিনিট এর মধ্যে আসবেন। এদিকে সমুদ্রের গাড়ি আবার হাত ছাড়া হয়ে গেছে। ভাড়া মিটিয়ে মধু নতুন গাড়িতে উঠে বসল। পর্যাপ্ত পরিমাণ টাকা না আনলে এখন ঝামেলায় পড়তে হতো।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মধু সমুদ্র কে আরো অনেকটা সময় পর পেল। ওর গাড়ি পেতেই মধুর ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠল। ড্রাইভার কে গাড়িটা দেখিয়ে ফলো করতে বলল। সমুদ্র আরো আধা ঘন্টা পর গাড়ি থামাল। মধু রা গাড়ি থামাতে দেখেই দূরেই থেমে গেল। মধু
গাড়ি থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে দিল। ড্রাইভার বলল,,” আমি কি আপনার জন্য অপেক্ষা করব নাকি?”
মধু বলল,,” না না আপনি চলে যান আমার দেরি হবে।”

ড্রাইভার আচ্ছা বলে চলে গেল। মধু দূরে থেকে দেখল ওর ভাই আরেকটা গাড়ি করে এসে নেমে দু’জনে কিছু কথা বলছে। দূর বিধায় কোন কথাই মধু শুনতে পারছে না। কিন্তু এই কথা গুলো ওকে কোন আশার আলো হয়তো দেখাত কিন্তু ও কোন ভাবেই কথা বুঝতে পারছে না। মধু এগিয়ে ও যেতে পারছে না।

খোলা রাস্তায় ও গাছের আড়াল থেকে বের হলেই ধরা পরে যাবে। সামনে নিজেকে আড়াল করার জন্য এখন শুধু সমুদ্রের গাড়িটা আছে। কথাগুলো শোনার জন্য আর কৌতূহল দমিয়ে রাখতে পারল না মধু। গাড়ির পেছনেই নিজেকে নিয়ে দাঁড়াল। তখনি তাদের জরুরি সব কথা শেষ হয়ে গেল‌। দুজনে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে বসল। মধু কি করবে বুঝতে পারছে না ও গাড়ির পেছনে মালপত্রের জায়গায় উঠে বসার ছাড়া আর কোন দিশা খুঁজে পেল না। কারণ চলে গেলেই ও ভাইয়ের চোখে ধরা খাবে।

এখানে এসে কোন লাভ ই হলো না। ভাইয়ার সাথে গোপনে কি আলাপ করল সমুদ্র সেই চিন্তায় মধু অস্থির হয়ে উঠল। গরমে নিঃশ্বাস আটকে বসে আছে। সমুদ্র গাড়ি পার্কিং করে চলে গেল মধু আস্তে ধীরে নেমে দাঁড়াল। ঘেমে গোসল করে ফেলেছে যেন। মধু বাগানে গিয়ে দোলনায় বসে পা ঝুলিয়ে নিজের অস্থিরতা দূর করতে চাইছে। বাসায় ঢুকলে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে বলবে ও বাগানে ছিল। দারোয়ান চাচাকে তার আগে মানাতে হবে। মধু সেদিকে ছুটল এতোক্ষণে কিছু বলে দিলে তো সর্বনাশ হবে।

মধু কে দেখে দারোয়ান চাচা চমকে উঠল।
” তুমি ভেতরে আসলে কেমনে?”
মধু নিজেও থতমত খেয়ে গেল। তাকে তো আর বলা যায় না ভেতরে কীভাবে এল। তার সন্দেহ ভরা চাহনি দেখে অস্বস্তিতে পড়ল মধু।

” আমি আপনার সামনে দিয়েই তো ভেতরে গেলাম। দেখেন নাই?”
” ক‌ই আমি তো যেতে দেখলাম না।” চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন তিনি।
মধু বলল,,” আপনি অন্য ধ্যানে ছিলেন তাই আমাকে খেয়াল করেন নি।”

তিনিও বোকা চোখে তাকিয়ে আছে মধুর দিকে। মধুর কথাটা তার কাছে বিশ্বাসযোগ্য লাগছে না। কিন্তু এছাড়া উপায় ও তিনি পাচ্ছেন না। কারণ ভেতরে তো আর উড়ে আসে নাই। যেভাবেই হোক এসেছে তার হয়ত ভুল হয়েছে।
মধু তাকে বলল কাউকে যেন না বলে ও বাইরে গিয়েছিল। তিনি কারণ জিজ্ঞাসা করলে মধু বলল সবাই চিন্তা করবে। ও কারো চিন্তার কারণ হতে চায় না।

অনেক বলে কয়ে মধু ভেতরে আসলো। ওকে দেখেই তিন্নি চিৎকার করে বলল,,” এই তুই কোথায় ছিলি আমি সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে তোরে খুঁজলাম।”
মধু ওর পাশে এসে সোফায় বসে বলল,” এইতো বাগানে ছিলাম। বাগানে নিশ্চয়ই খুঁজিস নাই।”
” বাগানে খোঁজার কথা মনেই ছিল না। ছাদে খুঁজেছি।”
” তাহলে আমাকে পাবি কিভাবে। আমি ছিলাম বাগানে তুই বাগান বাদে সবখানে খুঁজেছিস।”
“হুম।” মন খারাপ করে বলল তিন্নি।

সমুদ্র উপরে থেকে নেমে এসব শুনে জিজ্ঞেস করে,,” মধু কোথায় ছিল?”
মধু ছিটকে উঠলে। ভয়ে ওর গলা শুকিয়ে এল। সমুদ্র তিন্নি কেই প্রশ্ন করেছে সমুদ্র কিছু সন্দেহ করে যদি। মধু ভয়ে ঘাট হয়ে বসে আছে তিন্নি বলল,” আর বলো না ভাইয়া মধু বাগানে বসে ছিল আমি ওকে সারা বাসায় খুঁজেছি পায় নি। তাই বলছিলাম।”
” ওহ ।”

বিকেলে তিন্নি ওর এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে যাবে। মধু কেও জোর করেই নিজের সাথে নিয়ে গেল। মধু বোরিং মন নিয়ে বসে আছে। ওরা ঘুরা ঘুরি করে একটা রেস্টুরেন্টে এসে বসেছে। মধুর‌ খেতে মন চাচ্ছে না। তিন্নি তার সাথে গল্প করছে মধু চুপচাপ বসে আছে। বসে বাইরে তাকিয়ে আছে। রেস্টুরেন্ট টা দুতলায়। ও দুতলা থেকে নিচে তাকিয়ে আছে হঠাৎ সমুদ্র কে দেখল ফোন কানে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মধু চমকে উঠল। সমুদ্র এখানে কি করছে?

তিন্নি ওর মতো আছে মধু উঠে বেরিয়ে এল। তিন্নি ওকে খেয়াল করল না। মধু লিফটে করে তাড়াতাড়ি নিচে নেমে দেখল। সমুদ্র কিছু খাবারের প্যাকেট হাতে দাঁড়িয়ে আছে। ফোনে কাউকে বলছে,,” আমি খাবার নিয়ে আসছি তুই বাইরে দাঁড়া।”
মধু শঙ্কিত মনে ভাবছে,,” সমুদ্র কার জন্য খাবার নিয়েছে। কাকে দাঁড়াতে বলল। এটা ফুয়াদের জন্য নয়তো?”

মধুর বুক কেঁপে উঠল‌। সমুদ্র নিজের গাড়িতে উঠে বসেছে। মধু তাড়াতাড়ি গাড়ির পেছনে মালপত্রের জায়গায় উঠে বসল। আশেপাশে বেশি মানুষ ছিল না বলেই কেউ ওকে দেখল না। ভেতরে মার্কেট এজন্য সবাই ভেতরেই আছে বাইরে মানুষের আনাগোনা কম। মধুর বুকের ভেতর ধুকপুক করছে। মধু ফোন সাইলেন্ট করতে গিয়ে দেখল ছয়টা বাজে। তিন্নি ওকে খোঁজে তো হয়রান হবে। ওকে মেসেজ করে দিল। ওকে না খুঁজে যেন বাসায় চলে যায়। তারপর ফোন অফ করে বসে র‌ইল। গাড়ি শব্দ করে থামতেই মধু শিড় দাড়া সোজা করে ফেলল। একটু উঁচু করে‌ আশেপাশে কেউ আছে নাকি খেয়াল করে তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল। ভয়ে ওর হৃদপিন্ড লাফাচ্ছে। হাত পা অনবরত কাঁপছে।

মধু দেখল সমুদ্র খাবারের প্যাকেট নিয়ে দুতলা বাসার দিকে যাচ্ছে। বাসার সামনেই একটা কালো করে লোক দাঁড়িয়ে আছে। সমুদ্র এগিয়ে যেতেই দাঁত কেলিয়ে হাসল। সমুদ্র তার হাতে খাবারের প্যাকেট দিয়ে তাড়াতাড়ি গাড়ির দিকে এগিয়ে এল। মধু গাড়ি ছেড়ে সরে দাঁড়িয়েছে। ওর সামনেই সমুদ্র গাড়িটা নিয়ে চলে গেল। মধু এই অচেনা অজানা জায়গায় একাই রয়ে গেল। নিজের সাহসে নিজেই হতবাক হচ্ছে।

ওর মতো ভীতু মেয়ে এমন নির্জন জায়গায় একা রয়ে গেল। এতো সাহস সবটাই ফুয়াদ কে পাওয়ার জন্য হয়েছে। আচ্ছা এখানে ফুয়াদ না থাকে তাহলে ওর কি হবে? ওই লোকটাকে দেখে তো গুন্ডা লাগছে। এমন বিপজ্জনক জায়গায় ও থেকে গেল ও নিজে ধরা পরলে ওর কি হবে? ভয়ে মধুর মুখের রক্ত সরে যাচ্ছে। ভুল পথে হাঁটছে নাকি সঠিক পথ? ফুয়াদ এখানে থাকে যেন আল্লাহ আমার সহায় হোন আল্লাহ। আল্লাহ কে ডাকতে ডাকতে মধু খুব সাবধানে সিঁড়ির দিকে এগুতে লাগল।

ও খাবারের প্যাকেট হাতে লোকটাকে উপরে যেতে দেখেছে। মধু ও তাই উপরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। জায়গাটা এতোটাই নিস্তব্ধ যে ওর মনে হচ্ছে ও যে নিঃশ্বাস নিচ্ছে সেটাও বোধহয় জোরে শোনা যাচ্ছে। খুব আসতে করে পা টিপে টিপে সিঁড়ির ধাপ অতিক্রম করছে। যাতে কারো কাছে ওর উপস্থিতি না যায়। অতি সাবধানের গলায় দড়ি বলে একটা প্রবাদ বাক্য আছে। মধুর সাথেও তাই ঘটল ও প্রথম লাইনের সিঁড়ি খুব সুন্দর ভাবেই উঠেছিল মাথায় গিয়েই মধু পা পিছলে গড়িয়ে পড়ল সিঁড়ির মাথা থেকে।

একদম গড়াগড়ি খেয়ে নিচে এসে পড়ল। ব্যথায় মধুর মন চাইল গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে। কিন্তু ওর গলা দিয়ে স্বর বের হলো না। ভয়ে আতঙ্কে মধুর গলা শুকিয়ে এল। গড়াগড়ি খেয়ে মধুর সারা শরীরের হাড্ডি মনে হয় ভেঙে গেছে ও নড়তে পারছে না ব্যথায় কপাল কুঁচকে আসছে ওর। গলা দিয়ে শব্দ আসবে তাই ঠোঁট কামড়ে নিজের ব্যথা নিবারণ করার চেষ্টা করছে মধু।

উপরে থেকে কয়েকটা পা ধপাধপ শব্দ করে নিচে আসছে। পায়ের আওয়াজ পেতেই মধুর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এল। ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে মধু। ও যে দৌড়ে পালাবে তার ও উপায় নাই। হাঁটু আর কোমরে এতোটাই ব্যথা পেয়েছে যে ও উঠে দৌড় ও দিতে পারবে না। ভয়ে মধুর কান্না পেয়ে গেল। বাঁচাতে এসে নিজেই বিপদে পড়ে যাবে। এখন নিজেকে রক্ষা করবে কীভাবে আর ফুয়াদ কেই পাবে কীভাবে?

প্রেয়সী পর্ব ৫০

ব্যথা নিয়েই দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না আরো পরে যাচ্ছে এতে আরো ঝামেলা হলো ও না চাইতেও মুখ দিয়ে আর্তনাদ বেরিয়ে এল। দুহাতে মুখ চেপে ধরে বসে র‌‌ইল শক্ত হয়ে। খুব কাছাকাছি চলে‌ এসেছে পায়ের শব্দটা। ও মুখ ঠেকে বসে চোখের জল ফেলছে।

প্রেয়সী পর্ব ৫২