প্রেয়সী পর্ব ৫৩(১)

প্রেয়সী পর্ব ৫৩(১)
নন্দিনী নীলা

মধু তিন্নির রুমে এসে বসে নাম্বার টাতে কল দিচ্ছিল। রিং হবার আগেই পেছন থেকে তিন্নি ওর কাঁধে হাত রাখল। ও আচমকা কারো উপস্থিত পেয়ে ভয়ে ছিটকে বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল। তিন্নি মধুর কাঁধে হাত রাখায় মধু কে এমন ভয় পেতে দেখে নিজেও হতবুদ্ধি হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলল,,” কি হলো তুই আমাকে দেখে ওমন ভয় পেলি কেন?”
মধু বুকে ফুঁ দিয়ে বলল,,” তোকে দেখে ভয় পাব কেন? আমি তো হঠাৎ কে না কে আমার কাঁধে হাত রাখল তাই ভেবেই ভয় পেয়েছি।”

তিন্নি সন্দেহের দৃষ্টিতে মধুর দিকে চেয়ে থেকে বলল,,” মিথ্যা বলবি না মধু। সাতসকালে এমন ভয় কে পায়! এখন কি রাত বারোটা যে ভূত এসে তোর কাঁধে হাত রাখছে কিনা ভেবে তুই ছিটকে উঠলি?”
মধু অসহায় মুখ করে তাকিয়ে আছে তিন্নির দিকে। তিন্নি কড়া চোখের চাহনি মেলে ওর দিকে চেয়ে আছে। ও তা দেখে ঢোক গিলল। তিন্নি বলল,,” আমার থেকে কি লুকাচ্ছিস তুই মধু? বলবি না আমাকে?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মধু একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বিছানায় বসে বলল,,” আমি নিজে আগে শিউর হয়ে নেয় তারপর তোকেও বলব প্রমিজ। এখন কিছু জিজ্ঞেস করিস না আমি বলতে পারব না। তুই আমাকে বিলিভ করিস তো তিন্নি?”
তিন্নি ওকে পেছন থেকে জাপ্টে ধরে বলল,,” তোর উপর আমার বিশ্বাস আছে মধু। কিন্তু আমাকে জানালে তোর নিজের জন্যে হয়তো ভালো হতো আমি তোকে হয়তোবা সাহায্য করতে পারতাম।”
” যখন লাগবে ব‌লব‌ই তো। তুই ছাড়া আমার এই বাসায় আর কে আছে আপন বলতো।”

তিন্নি আর কিছু জিজ্ঞাসা করল না মধু ত্যারামি তে বুঝেছে ও কিছুই বলবে না। যখন ইচ্ছা হবে নিজ থেকেই বলবে তাই আর জোর করল না। কিন্তু নিশ্চিত মধুর মাথা কিছু তো একটা ঘুরছেই। তিন্নি বলল,,” আমার সাথে ওই বা’ন্দর দেখা করতে রাজি হয়েছে। চল একদিন ওই বা’ন্দরের সাথে দেখা করে আসি। আর রহস্য উদঘাটন করি।”
মধু কপাল কুঁচকে বলল,,” কোন বা’ন্দর আর বা’ন্দর কি?”

তিন্নি ওর মুখের এক্সপ্রেশন দেখে হেসে বলল,,” ওই যে রং নাম্বারে ফোন দিয়ে বিরক্ত করে বলছিলাম না ওই ছেলে।”
” তো বা’ন্দর বললি কেন? বানর ও তো বলতে পারতি।”
তিন্নি বলল,,” নাম বলে না তাই আমিই নাম দিছি বা’ন্দর। বানর তো এক প্রজাতির নাম আছে তাই এটা আমি বানাইছি। ইউনিক নাম।”

” তো যা আমি যাব কেন তোর বা’ন্দর তুই গিয়ে দেখা কর।”
” তোকে ও যেতে হবে। আমার একা ভয় করে!”
” ভীতু, আচ্ছা যাবো নি।” তিন্নি চলে গেল।

মধু সেই নাম্বারে কয়েকবার কল দিল নাম্বার সুইচ অফ বলছে। বিরক্ত হয়ে মধু ফোনটা বিছানায় ছুড়ে মারল।
মধু সকাল থেকে মিতুল আর সমুদ্রের পিছনে পরে আছে। ওরা কোথায় যাচ্ছে কি করছে খেয়াল করছে। কিন্তু একটা বিষয় মধু কে বারবার অবাক করছে তা হলো সমুদ্র মধু কে রাতে বাসায় আনার পর আর একবার ও ওর কাছে আসে নি আর না এই নিয়ে কিছু ওকে জিজ্ঞাসা করেছে।

একেবারে ছেড়ে দিয়েছে ওকে ওর মতো মধু ক্ষণে ক্ষণে থমকাচ্ছে। সমুদ্রের হাতে ধরা খেয়ে মধু ভেবেছিল ওর সামনের দিন গুলো খুব কষ্টদায়ক হবে। ও সব জেনে গেছে তার পর আর সমুদ্র কে শান্তিতে থাকতে দেবে না হয়তো। পর পর তিন দিন চলে গেল সমুদ্র স্বাভাবিকভাবেই থাকছে চলছে ওর খোঁজখবর নিচ্ছে। ওই দিন রাতের বিষয় নিয়ে ওকে কোন প্রশ্ন জেরা কিছুই করে নি। মধু তিনদিনের দিন সমুদ্রের রুমে গেল। সমুদ্র শুয়ে ছিল‌ ওকে দেখে লাফ দিয়ে বিছানা থেকে উঠে বসল।

” আরে মধু তুমি আসো আসো বসো। কি সৌভাগ্য আমার তুমি আমার রুমে এসেছ।”
মধু খাটে বসল। সমুদ্র দাঁড়িয়ে আছে দেখে ও বলল,” আপনিও বসুন না। দাঁড়িয়ে আছেন কেন?”
” আরে না তুমিই বসো। আমি দাড়িয়েই ঠিক আছি।”

মধু খেয়াল করল সমুদ্র ওর থেকে যথেষ্ট দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়েছে। ও সেসব পাত্তা না দিয়ে বলল,,” আপনার মাথায় কি ঘুরছে বলেন তো?”
সমুদ্র চোখ ছোটো ছোটো করে বলল,,” মানে কি ঘুরবে?”
” ফুয়াদ কে কোথায় রেখেছেন?”

সমুদ্র কপালে আঙুল চালিয়ে পায়চারী করতে লাগল। মধু বলল,,” কি হলো উত্তর দিন।”
সমুদ্র রাগী স্বরে বলল,,” আমি যদি অপরাধী হ‌ই আমি কি যেচে তোমাকে বলতে যাব সব? এতোটাই মাথা মোটা তুমি? নিজে খোঁজে বের করো।”

মধু বসা থেকে দাঁড়িয়ে বলল,” তারমানে স্বীকার করলেন আপনিই এমন জঘন্য কাজ করছেন ছিহ।”
ঘৃণা ভরা দৃষ্টিতে নিক্ষেপ করল মধু সমুদ্রের দিকে। তারপর রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
মধু কাঁদতে কাঁদতে সমুদ্রের রুম থেকে বেরিয়ে তিন্নির রুমের দিকে যাচ্ছিল তখনি দেখল মিতুল কারো সাথে সিরিয়াস ভাবে কথা বলতে বলতে তাড়াহুড়ো করে নিচের দিকে যাচ্ছে। মধু চোখ মুছে ওর পিছু নেয়। মিতুল ফোনে কাউকে বলছে,,” দাঁড়াও আমি আসছি আমার দশ মিনিট লাগবে।”

মিতুল বেরিয়ে গেল মধু কে টেনে ধরল তিন্নি,,” কোথায় যাচ্ছিস?”
মধু দরজার দিকে চেয়ে থেকেই বলল,,” আমি মিতুল আপুর পিছু যাচ্ছি। তুই বাসার দিকটা সামলে নিস। আমার আসতে হয়ত সন্ধ্যা হবে।”

” ওই মেয়ের পিছে ক‌ই যাচ্ছিস? কেন যাচ্ছিস?”
” তোকে এখনি সব বলব নাকি আগে ওকে ফলো করে এসে বলব?”
তিন্নি ওকে ছেড়ে দিয়ে বলল,” সাবধানে যাস। কোন দরকার হলে কল দিবি।”
” ওকে।”

মিতুল একটা অটো করে চলে গেল। মধুও আরেকটা অটো করে ওর পিছু গেল। মধু বিশ মিনিট ওর পিছু যেতে যেতে অবশেষে দেখল মিতুল অটো থেকে নেমেছে মধু ও হাফ ছেড়ে বাঁচল আর অটো থামিয়ে নিজেও নেমে গেল। দেখল মিতুল ফাঁকা গলি দিয়ে ঢুকছে মধুও দূরত্ব রেখে ওর পিছু নিল। ওর মন বলছে আজকে ও ফুয়াদ কে পেয়ে যাবে। সমুদ্র আর মিতুল মিলেই হয়তো কিছু করেছে।

ওর হাত পা কাঁপছে উত্তেজনায়। ভয় ও লাগছে জায়গা টা বেশিই নিস্তব্ধ। এতোটা নীরবতা ওর গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। কোন মানুষ নেই ওরা দুজনেই যাচ্ছে। তার মধ্যে ও তো পা টিপে টিপে হাঁটছে ওর আওয়াজ পাওয়া না গেলেও মিতুল গটগট শব্দ তুলে যাচ্ছে। যার জন্য ওর পায়ের হিলের শব্দ জোরে লাগছে এই নিস্তব্ধ জায়গাতে। মধু হঠাৎ কিছুতে হোঁচট খেয়ে ঠাস করে নিচে পড়ে গেল।

সাথে সাথে মিতুল পিছু ঘুরে তাকাল। মধুর আত্মা কেঁপে উঠল। সমুদ্রের পিছু নিয়েও ধরা খেয়েছিল এবার মিতুলের চোখেও ধরা খাবে ওকে দিয়ে কি কিছুই হবে না?
ও উঠে দাঁড়িয়েছে। মিতুল অবাক বিষ্ময় নিয়ে এগিয়ে এলেও সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,,” আরে মধু যে। গোয়েন্দাগিরি ও তুমি ভালোই পারো দেখছি।

ভেরি গুড।” দাঁত কেলিয়ে বলল মিতুল।ভয়ে মধুর মুখ সাদা হয়ে উঠেছে। মিতুল বলল,,” আমি জানতাম তুমি আমায় ফলো করবে। রাতেও যে তুমিই আমার ঘরে উঁকি দিয়েছিলে সেটাও আমি জানি। আবার সকালে আমার রুম থেকে নাম্বার নিয়েছ সেটাও আমি জানি। তুমি হয়ত ভেবেছ তুমি আমার চোখে আড়ালে সব করেছ। না গো মধু। আমি চেয়েছি বলেই তুমি আমার পিছু করে এতো দূরে এসেছ। আসলে আমি নিজেই তোকে এখানে টেনে এনেছি।”
মধু কাঁপা কাঁপা ঠোঁট নাড়িয়ে বলল,,” মানে?”

” মানে পরে বুঝো। এখন আমার সাথে চলো।”
” কোথায় যাব?”
মধু নিজের মাথায় আঘাত পেল‌ আচমকাই পেছনে থেকে। ও ব্যথায় কুঁকড়ে উঠল। আর্তনাদ করে রাস্তায় পরে গেল। পেছনে থেকে মিতুলের একজন লোক মধু কে আঘাত করেছে। মধু আঘাতের জন্য জ্ঞান হারিয়েছে। মিতুল মধুর দিকে তাকিয়ে শয়তানি হাসি দিয়ে বলল,,” এবার তোকে কে বাঁচাবে মধু। তোমাকে বাঁচানোর জন্য তো তোমার ফুয়াদ ও নাই।”

লোকটাকে বলল মধু কে নিয়ে তার সাথে যেতে। লোকটা মধু কে নিয়ে মিতুলের সাথে যেতে লাগল।মিতুল মধু কে ইচ্ছে করেই এমন নির্জন জায়গা নিয়ে এসেছে। আর মধু নিজেকে চালাক ও সাহসী ভেবে এসেছিল‌‌। কিন্তু মিতুল এমন সন্দেহ জনক কাজ ইচ্ছে কৃত ভাবে করেছে মধুর মনে প্রশ্ন তৈরি করতে।
মধু ওর ফাঁদে পা দিয়ে বড় ই ভুল করেছে।

মধু যখন চোখ মেলল ‌ওর চোখের সামনে একটা অপরিচিত রুম ভেসে উঠল। ওর মাথা এখনো চিনচিন ব্যথা করছে। ও ঘাড়ের পেছনে হাত দিয়ে উঠে বসল। তখনি বাথরুমের দরজা খুলে কেউ রুমে প্রবেশ করল মধু আঁতকে উঠে সেদিকে তাকাতেই থমকে গেল। বরফের মতো ও জমে গেল। মাথায় আঘাত পাওয়াতে কি ওর মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি। ও বিস্মিত চোখ দুটো অবাক বিস্ময়ে বন্ধ করে মুখ ঢেকে ফেলল।

ওর চোখ ফেটে জল গড়িয়ে পড়ছে। মিতুল ওকে এটা কোথায় নিয়ে আসছে। আর এখানে ফুয়াদ কীভাবে আসলো? এটা কি ওর কল্পনা নাকি স্বপ্ন।
সামনের মানুষ টা মধুর মুখ ঢেকে রাখা হাত দুটো টেনে চোখে সামনে থেকে সরিয়ে নিল। মধু চোখ পিটপিট করে তাকাতেই আবার সেই প্রিয় মুখটা ওর সামনে ভেসে উঠল। ফুয়াদ ওর হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে অপলক দৃষ্টিতে। মধু ঢোক গিলতে ব্যস্ত তখন। নিজের চোখকে ও বিশ্বাস করতে পারছে না। মিতুল ওকে ধরেছিল মাথায় আঘাত করল। ও মিতুলের বন্দি না হয়ে ফুয়াদের কাছে কীভাবে এল?

এতো মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। ও ফুয়াদ কে খুঁজে পেতে কত কিছু করেছে নিজে সফল হতে না পারলেও ফুয়াদ নিজেই ওর কাছে এসেছে। ওর সারা শরীর উত্তেজনায় কাঁপছে। তাও মনে হচ্ছে এটা স্বপ্ন নয়তো? ও ফুয়াদের হাতের মুঠোয় থেকে নিজের বাম হাত ছাড়িয়ে নিল। ওর হাত কাঁপছে ও কাঁপা হাত টা তুলে ফুয়াদের গাল স্পর্শ করল। ফুয়াদ নিষ্পলক চোখে তখন ওর দিকেই চেয়ে আছে।

মধু গাল থেকে হাত নামিয়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,,” আমি কি স্বপ্ন দেখছি?”
ফুয়াদ চিরচেনা সেই হাসি দিয়ে বলল,,” কি মনে হচ্ছে?”
” মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছি। এটা সত্যি হতেই পারে না। আপনাকে ফিরে পেতে আমার আরো অনেক কষ্ট করতে হবে। কারণ আমি আপনাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি আপনার ভালোবাসা অবজ্ঞা করেছি। তার শাস্তিই পাচ্ছি। এখন আমি হারে হারে টের পাচ্ছি। আমি আপনাকে কত ভালোবাসি।”

প্রেয়সী পর্ব ৫২(২)

বলতে বলতে মধুর চোখ বেয়ে গলগলিয়ে অশ্রু ঝরতে লাগল।
ফুয়াদ ওর চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলল,,” তোমার মতো ভীতুর ডিম ও যে এতো সাহসিকতা দেখাতে পারে আমার জানা ছিল না‌। আমাকে তো তুমি বড়‌ই চমক দিয়েছ সুইটহার্ট।”
মধু আর নিজেকে সামলাতে পারল না ঝাঁপিয়ে পরল ফুয়াদের বুকে।

প্রেয়সী পর্ব ৫৩(২)