প্রেয়সী পর্ব ৫৮

প্রেয়সী পর্ব ৫৮
নন্দিনী নীলা

নাফিসা বেগম গাড়ি নিয়ে সোজা মিতুলের বাড়ি এসে হাজি হয়। দরজা খুলে নাফিসা বেগম কে গম্ভীর মুখে দাঁড়ানো দেখে মিতুলের মা ভয় পেয়ে যান। নিজের মেয়ের কীর্তি কাহিনী শোনার পর থেকে বান্ধবীর সাথে কথা বন্ধ করেছে ভয়ে। এখন সে বাসায় এসে হাজির। তাই দেখেই ভয় পেয়ে যায়। ঢোক গিলতে লাগে।
নাফিসা বেগম বললেন,,” কিরে ভেতরে আসতে দিবি না?”

মিতুলের মা সরে দাঁড়িয়ে ভেতরে যাবার রাস্তা করে দেয়। মিতুলের ছোটো বোন নিহা সোফায় বসে টিভি দেখতে ছিল। নাফিসা বেগম গিয়ে তার পাশে বসে বললেন,,” নিহা তোর আপুকে ডেকে আনতো।”
” ওয়াও আন্টি কেমন আছো?
” ভালো। মিতুল কে ডাকো।”
“আচ্ছা।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

নিহা দৌড়ে মিতুল কে ডাকতে চলে যায়। মিতুলের মা শুকনো মুখ করে দাঁড়ায় আছে।
মিনমিন স্বরে বলেন,,” হঠাৎ তুই কোন দরকার!”
নাফিসা বেগম আগুন গরম চোখে তাকাল শুধু মুখে কিছু বলল না তাতেই তিনি ভয় পেয়ে চুপসে গেলেন। মিতুল মিনিট পাঁচেক পরেই নিচে নামে। নিচে নেমে দেখে নাফিসা বেগম বসে আছে সোফায়। মিতুলের চোখের পাড়ে কালি জমে গেছে। চোখ মুখ শুকিয়ে একটু খানি হয়ে গেছে। নাফিসা বেগমের পাশে এসে বসল মিতুল।

” ভালো আন্টি কেমন আছো?”
নাফিসা বেগম ঠাস করে থাপ্পড় মারল মিতুলের গালে। মিতুল টু শব্দটি পর্যন্ত করল না। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
” তোর এতো বড় সাহস তুই আমার ছেলেকে কিডন্যাপ করিস শত্রুর সাথে হাত মিলিয়ে।”

টিভি তখনো অন ছিল একটা হিন্দি গান বাজছিল। নিহা মিতুল কে ডেকে এসে আবার আরেক সোফায় গিয়ে বসে টিভিতে মনোযোগ দিয়ে ছিল। বোনকে থাপ্পড় খেতে দেখে ভয়ে হাত থেকে রিমোট ফেলে দেয় নিহা। তারপর ফ্যালফ্যাল করে বোন আর নাফিসা বেগমের দিকে তাকিয়ে থাকে। নাফিসা বেগম রেগে তাকায় নিহার দিকে আর টিভি বন্ধ করতে বলেন।

নিহা সোফার নিচে থেকে রিমোট বের করে তাড়াতাড়ি টিভি অফ করে দাঁড়ায় যায়। বোনের কান্ড কারখানা কিছুই জানে না নিহা এখনো। এজন্য এসব কেন হচ্ছে। নাফিসা আন্টি ওদের খুব আদর করে আজ কেন হঠাৎ এমন রাগী লাগছে থাকে। মিতুল কে মারছে সব কিছু ওর কাছে অস্বাভাবিক লাগছে। নিহাকে ওর মা ধমক দিয়ে বললেন,,” হ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে কথা গিলছিস কেন? যা রুমে যা।”

নিহা ধমক খেয়ে নিজের রুমে চলে আসে। কিন্তু মনের খুঁতখুঁতুনি দূর হয় না। সবাই ওর থেকে কি লুকোচুরি করছে? ভালো আন্টি কেন হঠাৎ এতো রাগারাগী করছে!
নিহার মাথায় বুদ্ধি আসে ও বালিশের তলায় থেকে ফোন বের করে ফাহাদ কে কল লাগায়।
ফাহাদ ফোন রিসিভ করতে সময় লাগায় তিনবারের বেলায় কল রিসিভ করে।

” এতো সময় লাগল কেন রিসিভ করতে?”
” বাথরুমে ছিলাম। কলের শব্দ পেয়ে কাজ না সেরেই চলে আসলাম। এই সময়ে কল দিলে যে তুমি না রাত ছাড়া কথা বলতে পারো না? সূর্য আজ কোনদিকে উঠেছিল!”
” দরকারে ফোন দিছি তোমার মতো আজাইরা কাজে না।”
ফাহাদ বলল,,” আমি কি আজাইরা কাজে কল দেই আমিও তো দরকারেই কল‌ দেই।”

” ইশ কি দরকার শুনি তোমার?”
” প্রেম দরকার।”
” আইছে প্রেমিক পুরুষ। এদিকে আমি টেনশনে মরি।”
” আচ্ছা বলো কি হয়েছে। আমি থাকতে তোমার আবার কিসের টেনশন!”
” ভালো আন্টির কি হয়েছে?”
” কোন আন্টির?”

” আরে তোমার মায়ের কি হয়েছে? আন্টি রেগে আমাদের বাসায় আসছে একটু আগে। তারপর আপুর সাথে চিল্লাচিল্লি করছে। কি সব জানি বলতেছে। আপুকে থাপ্পড় ও দিয়েছে।”
” আমি তো বাড়ি নাই জানোই তুমি। শুক্রবার বাসায় যাব। এখন বাসায় কি হয়েছে তার খবর আমি কীভাবে জানব। আর তোমার যা বোন তার তো ভুলের শেষ নাই। কিছু অবশ্যই করেছে না হলে আমার আম্মু রাগারাগী করার মতো মানুষ না।”

” আমার আপু কে নিয়ে খারাপ কথা বলবে না। রাগটা একটু বেশী কিন্তু অনেক ভালো।”
” তোমার বোনের টপিকস নিয়ে কথা বলতে চাইছি না। ওসব নিয়ে কথা বললে ঝগড়া হবে আর আমি তোমার সাথে ঝগড়াই করতে চাইনা।”
” তোমার কোচিং কখন? খেয়েছ?” নিহা ও ঝগড়া করতে চায় না তাই কথা ঘুরিয়ে দিল।
” বের হবো রাখি রাতে কল করব।”

ফাহাদ ফোন কেটে কল লাগাল তিন্নি কে।
তিন্নি মায়ের বকা গিলছিল তখন কিচেন রুমে।
” তোকে বলছি না ওই মেয়ের আশেপাশে যাবি না। বজ্জাত মেয়ে একটা। তার সাথে মিশে তুই ও খারাপ হতে চাস তাই না?” রাগী গলায় ধমক স্বরে বললেন আনিতা বেগম।
তিন্নি বলল,,” আম্মু মধু কে তুমি বজ্জাত বললে কেন? ও আমার ফ্রেন্ড আর এখন ফুয়াদ ভাইয়ার ব‌উ‌। তুমি এভাবে ওকে বাজে কথা বলতে পারো না।”

” তোর জন্যেই তো এসব হচ্ছে। বান্ধবী এনে বাসায় তুলেছিল আমাদের সর্বনাশ করতে। দেখলি তো কীভাবে ঘাঁটি গেড়ে বসেছে এখন। ওই মেয়ের জন্য সবসময় বাসায় অশান্তি লেগে থাকে। তার থেকে দূরে থাকবি তোর বাবাও কিন্তু বলেছে। আমার একার কথা না।”
তিন্নি বলল,,” মা তুমি কিন্তু বেশি করছো।”

” হ করছি, বোনের বাসায় গিয়ে থাক এখানে থাকলে তোকে ওই মেয়ের থেকে সরানো যাবে না।আজকেই যাবি।”
তিন্নির ফোন বাজতেই কথা বন্ধ করে দেখল ফাহাদের কল। ও রিসিভ করল,,” হ্যা বল।”
” বাসায় কি হয়েছে?”
” দুইদিন বাসায় না থেকে অনেক কিছু মিস করে গেলি রে। বাসায় আয় সারপ্রাইজ আছে।”
” সিরিয়াস কিছু?”
” হুম কোচিং শেষ করে বাসায় আসিস। রাখছি।”

ফাহাদ টেনশনে পড়ে গেল। এখন আর কোচিং এ ও যেতে ইচ্ছে করছেনা।
মধু আর ফুয়াদ খাওয়া দাওয়া শেষ করে সোফায় ই বসে আছে। দুজনেই বসে আছে নাফিসা বেগম এর অপেক্ষায়। কোথায় গেল হন্তদন্ত হয়ে জানতে। ড্রাইভার কে কল করেছিল ফুয়াদ কিন্তু তার নাম্বার বন্ধ। দুই ঘন্টা পর আগুন হয়ে বাসায় ফিরলেন তিনি। যাওয়ার সময় ও যেভাবে দুজনে বসে ছিল এখনো তাই শুধু খাবারের প্লেট নাই। নাফিসা বেগম আড়চোখে চেয়ে রুমে দিকে যাচ্ছিল।

ফুয়াদ দৌড়ে মায়ের কাছে গিয়ে বলল,,’ আম্মু কোথায় গিয়েছিলে?”
” কেন এখন তোকে আমি কোথায় যাব না যাব তার কৈ‌ইফত দিতে হবে?” চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন।
ফুয়াদ মায়ের রাগী কথা শুনে বলল,,” আমার উপর এতো রেগে আছো কেন?”
নাফিসা বেগম কিছু বললেন না ছেলেকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন। ফুয়াদ অসহায় মুখে মায়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে র‌ইল।

তিন্নি কে জোর করিয়েই আনিতা বেগম বিকেলে রাহীর বাসায় পাঠিয়ে দিল। তিন্নি যাবে না তাও শুনল না। ফাহাদ সন্ধ্যার পর বাসায় এসে দেখল তিন্নি বাসায় নাই। কল করে শুনল রাহীর বাসায় গেছে। ফুয়াদ কে দেখে এক চিৎকার দিয়ে দৌড়ে আসে ভাইয়া বলে আর ফুয়াদকে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে।
অনেকক্ষণ ভাইকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকে। ভাইয়ের মরার খবর শোনার পর একবারে ভেঙে পড়েছিল ও। তারপর যখন জানল ভাই বেঁচে আছে অনেক খুশি হয়েছিল কবে আবার ভাইকে জড়িয়ে ধরবে সেই আসায় পথ চেয়েছিল। ভাইকে আবার ছুঁতে পেরে মনটা শান্তি পেয়েছে।

ভাইকে ছেড়ে মধুর কাছে চলে যায়। ডিনারের আগের সময়টা মধুর সাথেই গল্প করে কাটায়। তিন্নি চলে যাওয়ায় মধুর মুড অফ হয়ে গিয়েছিল ফাহাদ কে পেয়ে মুড ঠিক হয়েছে। ওর সাথে গল্প করে কাটিয়ে সময়টা ভালো গিয়েছে। ফুয়াদ ও এই সুযোগ এ বাসার বাইরে চলে‌ যায়। কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে। ডিনারের আগেই বাসায় ফিরে আসে। ফাহাদ এই সময়টা মধু কে সঙ্গ দেয়।

খাবার টেবিলে ফুয়াদ আর মধুর জন্য একটা সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছিল। যেটা ওরা দু’জনের কেউ ই আশা করেনি। কল্পনার ও বাইরে ছিল। নাফিসা বেগম মধুর উপর যে পরিমাণ রাগ। বিয়েটাই কীভাবে বানাবে সেই চিন্তায় অস্থির ছিল ফুয়াদ। মধু তো কিছু ভাবতেই পারছিল না। কিন্তু এমন সারপ্রাইজ পেয়ে দুজনেই হতভম্ব। নাফিসা বেগম জানিয়েছে মধু আর ফুয়াদের বিয়ে নিয়ে একটা পার্টির আয়োজন করতে চান। আত্নীয় স্বজন সবার সামনে মধু কে পুত্রবধূ বলে পরিচয় করিয়ে দিতে। মধু তো বিষ্ময় এ গলায় খাবার আটকে ফেলল।

মধুর এক পাশে ফুয়াদ ও আরেকপাশে চিত্রা ছিল। চিত্রা পানির গ্লাস এগিয়ে দিল মধুকে। ফুয়াদ নিজেও মায়ের সিদ্ধান্ত শুনে স্তব্ধ। মধু কে পানি দেওয়ার কথাই ভুলে গিয়েছিল। নিজেকে স্বাভাবিক করে ফুয়াদ মধুকে বলে,,” সাবধানে।”

মধু মাথা নাড়িয়ে বলল,,” আমি ঠিক আছি। আন্টির কথা শুনে খাবার গিলতে ভুলে গিয়েছিলাম।”
একটু জুড়েই বলল মধু। সবাই মধুর কথা শুনে তাকাল ওর দিকে। মধু ঢোক গিলে আমতা আমতা করতে লাগল।
নাফিসা বেগম বললেন,,” আগামী কাল শপিং এ গিয়ে যা যা লাগে কেনাকাটা করে ফেলো সবাই। দুই দিন পর‌ই অনুষ্ঠান আমি জায়গা ঠিক করে ফেলেছি।”

মধু একের পর এক শক নিতে পারছে না। ও খাওয়া থামিয়ে কথা গিলছে। সবাই অবাক হয়ে নাফিসা বেগমের দিকে তাকিয়ে আছে শুধু শান্ত আছে রাজিব খান। কারণ এসব করার আগেই তাকে সব জানিয়ে অনুমতি নিয়েছে। ফুয়াদ মায়ের মতিগতি কিছু বুঝতে পারছে না। মা তখন মিতুল দের বাসায় গিয়েছিল ড্রাইভার এর কাছে থেকে জানতে পেরেছে। সেখানে থেকে আসার পর থেকে মায়ের মুড চেঞ্জ‌।

বাহ ভালো তো। আমি আরো টেনশনে ছিলাম মা আর মধুর মিল করাবো কি করে তা যদি আমার কষ্ট ছাড়াই হয় ভালোই তো। ফুয়াদ নিজের মনের কথা ভেবে নিজেই প্রশান্তি অনুভব করল। খাবার টেবিলে থেকে সবার আগে নাফিসা বেগম উঠলেন। চেয়ার ছেড়ে উঠে মধু কে উদ্দেশ্য করে বললেন,,” খাওয়া শেষ করে আমার রুমে এসো একবার।”

মধু ভয়ে ভয়ে মাথা নাড়িয়ে আচ্ছা বলল। কিন্তু ভয় পাচ্ছে অনেক দিন হলো নাফিসা বেগমের সাথে ওর কথা হয়না স্বাভাবিক ভাবে। যেদিন থেকে ফুয়াদ আর ওর সম্পর্কের কথা জানতে পেরেছে তার পর থেকে কখনোই ভালো আচরণ করেনি আর না নরম স্বরে কথা বলেছে। তাই এখন তার সাথে কথা বলতেও মধু ভয় পায়।
খাওয়া শেষ করে মধু দাঁড়িয়ে নখ কাটছে। ফুয়াদ এসে ওর পাশে দাঁড়িয়ে বলল,,” আম্মু ডেকে গেল যাচ্ছ না কেন?”
” আন্টি আমাকে বকবে না তো? আমার ভয় করছে খুব। আপনিও চলেন না আমরা সাথে। প্লিজ।” মধু ফুয়াদের বাহু ধরে ঝাঁকিয়ে বলল।

” না না আমি গেলে আম্মু রাগ করবে। তোমাকে একা যেতে বলেছে একাই যাও। সব সময় নেগেটিভ না ভেবে পজিটিভ ভাবো‌। আমি রুমের কাছাকাছিই থাকব।”
ফুয়াদের কথা শুনে মধু মুখ গোমড়া করে ফেলল।

প্রেয়সী পর্ব ৫৭

(আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন সবাই?
মধু আর ফুয়াদের বিয়ে যারা খেতে চাইছিলেন তাদের জন্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। সবাই গিফট নিয়ে চলে আসবেন কেমন?)

প্রেয়সী পর্ব ৫৯