প্রেয়সী পর্ব ৫৭

প্রেয়সী পর্ব ৫৭
নন্দিনী নীলা

মাহতিম হোসেন নিজের দলবল নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর নাফিসা বেগম মধুর উপর থাকা সব রাগ ঝারতে লাগে। এদিকে বাপির কথা শুনে মধুর ভেতরটা দুমরে মুচড়ে যায়। মাথা নিচু করে মধু চোখের জল ফেলতে লাগে। তার মধ্যে আবার নাফিসা বেগম এসে ধমকে বকতে লাগে। মধুর কানে তার কোন কথাই যায় না।
ফুয়াদ কথা বলে উঠে,,” আম্মু তুমিতো মধু কে অনেক পছন্দ করতে যখন ও প্রথম আসলো বাসায় তুমিই ওকে সবথেকে ভালোবাসতে।”

নাফিসা বেগম রাগে রাগান্বিত স্বরে বলতে লাগে,,”হ্যা ভালবাসতাম তখন তো জানতাম না আমার ছেলের গলায় ঝুলে পড়বে। জানলে কখনোই এই মেয়েকে আমি বাসায় জায়গা দিতাম না।”
” উফফ আমার কথা শোনো তো আগে। তুমি মধু কে পছন্দ করতে, ভালবাসতে। তাহলে বলা যায়, শুধু মাত্র ওকে আমি ভালবেসেছি,বিয়ে করছি এজন্য তুমি মধুকে এখন পছন্দ করো না। আমি যদি ওকে এসব না করতাম। তুমি কি মধু কে এখনো আগের মতোই ভালবাসতে?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

নাফিসা বেগম চিন্তায় পড়ে গেল। আসলেই মধু কে প্রথম থেকে নিজের মেয়ের মতোই ভালবেসেছে। চঞ্চল মেয়েটা কে পেয়ে নিজের মেয়ের জায়গা দিয়েছিল। শুধু মাত্র ফুয়াদের সাথে সম্পর্ক জানতেই তার মাথায় আগুন ধরে যায়। এটা সমুদ্রের সাথে শুনলেও হয়তো উনার রাগ হতো না।

কিন্তু ফুয়াদের সাথে হয়েছে বলেই উনি এতোটা ক্ষিপ্ত কারণ ফুয়াদের ব‌উ হিসেবে নিজের বান্ধবীর মেয়ে মিতুল কে চেয়েছিল। কিন্তু মধুর জন্য সব কিছু ভেস্তে গেছে। তার কথার দাম নাই হয়ে গেছে। তার ছেলে তার কথার বিরোধীতা করেছে শুধু মাত্র আরেকজনের জন্য। মধু কে তখন থেকেই সহ্য করতে পারে না। ফুয়াদের সাথে কোন সম্পর্ক না থাকলে এখনো আগের মতো ভালবাসতো। এটা সত্যি।

মায়ের নিরবতা দেখে ফুয়াদ নিজেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মধু কে ছেড়ে মাকে নিয়ে সোফায় বসল। তারপর খুব শান্ত ভাবেই বলল,,” তোমার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করিনি বলেই এতো রাগ আমার আর মধুর উপর তোমার তাই না?”

নাফিসা বেগম কিছু বলল না চোখ মুখ শক্ত করেই বসে আছে।
ফুয়াদ ফের বলল,,” কিন্তু তুমি কি জানো মধুর ভাইয়ের সাথে হাত মিলিয়ে তোমার প্রিয় বান্ধবীর মেয়ে আমাকে বন্দি করে রেখেছিল!”

নাফিসা বেগম চোখ বড়ো বড়ো করে তাকায় ফুয়াদের দিকে। তার চোখে মুখে চরম বিষ্ময়। বিষ্ময় এ কথা বলতে পারেন না‌। ফুয়াদ মায়ের একটা হাত নিজের দুই হাতের মুঠোয় নিয়ে চুমু খেয়ে বলে,,” মিতুল আমাকে কিডন্যাপ করতে হেল্প করেছিল মধুর ভাইকে। তাছাড়া মধু কেও কিডন্যাপ করেছিল মিতুল। মধু কে নজরে রাখার জন্য অনেক আগেই আমি গার্ড রেখেছিলাম। যার জন্য আমি ওদের বন্দি দশা থেকে বের হতেই খবর পায় আর মধু কে ছাড়িয়ে নেয়। এমন ডেঞ্জারাস টাইপের মেয়ে তোমার পুত্রবধূ হয় নাই শুকরিয়া আদায় করা হচ্ছে উচিত তোমার।”

নাফিসা বেগম বিষ্ময় এ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে ফুয়াদের দিকে।
থমকানো কন্ঠে বলল,,”এসব সত্যি?”
” হ্যা সমুদ্র ভাইয়া ও সব জানে জিজ্ঞেস করে দেখো তাকে আর এখন মিতুলের বাবা মা ও এসব বিষয়ে অবগত।”
নাফিসা বেগম উঠে রুমে চলে গেলেন। বান্ধবীর কাছে এখনি ফোন করবেন। এসব সত্যি হলে উনার মুখ লুকানোর জায়গা থাকবে না।

যার উপর এতো বিশ্বাস রেখে নিজের ছেলের সাথে খারাপ আচরণ করেছে। সেই যদি এসব করে থাকে তাহলে..! উনি আর ভাবতে পারছেন না। সমুদ্র মাহতিম হোসেন চলে যেতেই বাইরে চলে গেছে।
মধু এখনো আগের মতোই দাঁড়িয়ে কাঁদছে। ওর পাশে দাঁড়িয়ে আছে তিন্নি। আনিতা বেগম ট্রে করে আনা খাবার তুলে আবার রান্নাঘরের দিকে হাঁটা ধরে। আর তিন্নি কে উদ্দেশ্য করে বলেন,,”আমার সাথে আয় ওখানে দাঁড়িয়ে না থেকে।”

তিন্নি মায়ের ধমক খেয়ে মায়ের পিছু যেতে লাগে। সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে ছিল চিত্রা সেখানে থেকেই বিড়বিড় করতে লাগে,,” এই বাসায় প্রতিদিন ই এখন সার্কাস চলে। এটা বাড়ি থেকে নাটকের মঞ্চ হয়ে উঠেছে।”
নিচে আর না গিয়ে তিনি আবার উপরে উঠতে লাগে। ফুয়াদ পায়ের উপর পা তুলে মধুর দিকে তাকিয়ে আছে। মধু এখনো সেই এক‌ই স্থানে দাঁড়িয়ে আছে শক্ত হয়ে। ফুয়াদ মধুর নিচু করে রাখা নাকের দিকে তাকিয়ে আছে। নাক লাল হয়ে উঠেছে।

” মধু এদিকে আসো।” একটু জোরেই ধমক দিয়ে ডাকল।
মধু অশ্রু সিক্ত নয়নে চোখ টেরা করে তাকাল ফুয়াদের দিকে। ফুয়াদ আঙ্গুল তুলে ওকে কাছে ডাকছে। মধু মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। ও দুঃখে কেঁদে কেটে সাগর করে ফেলছে আর উনি ওকে না থামিয়ে সাহেবের মতো পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে। আবার এখন কেমন‌ ধমক দিয়ে কাছে ডাকছে। কোথায় নরম স্বরে আদুরে গলায় এখন কথা বলবে, ওকে কান্না করতে মানা করবে তা না। কষ্টের মাঝেও রাগের মেজাজ গরম হয়ে উঠল। মধু দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত চাহনি মেলে ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে আছে।

ফুয়াদ আবার ডেকে উঠল,,” কি হলো ডাকছি তো। না এসে চোখ রাঙানি দিচ্ছ কেন? কাছে আসো।”
মধু তেজি গলায় বলে উঠল,,”আমি কাঁদছি দেখতে পাচ্ছেন না? ধমক দিচ্ছেন কেন?”
” কাঁদছো বলেই তো ধমক দিচ্ছি।”
” কাঁদলে কেউ ধমক দেয়?”
” তাহলে কি দেয় কিস?”

মধু রাগী চোখে ফুয়াদের দিকে দৃষ্টিপাত করে উল্টো ঘুরে উপরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে লাগে।
” আরে যাচ্ছ কোথায়?”
ফুয়াদ দ্রুত উঠে ওর হাত চেপে ধরে আটকায়।
” যাব না তো কি এখানে দাঁড়িয়ে আপনার ধমক শুনব?” রাগী কন্ঠে বলল মধু।
” আচ্ছা সরি। খালি রাগ করো।”

” সমস্যা কি আপনার? কষ্ট পাচ্ছি আমি, বাপি কত কি বলে গেল! আর আপনি আমার কষ্ট টা একটু বুঝার‌ চেষ্টা করছেন না। আমাকে রাগিয়ে যাচ্ছেন শুধু। এই আপনার ভালোবাসা তাই না?” অভিমানে মধুর চোখে আবার জল চলে আসে।
“সকাল থেকে না খেয়ে আছো চলো খাবে।”

” খাবার আমার গলা দিয়ে নামবে আপনার মনে হয়?”
” কেন কি এমন হয়েছে যে খাবার গলা দিয়ে না নেমে আটকে থাকবে। আর এতো কান্নাকাটির ই বা কি হয়েছে।”
” কাঁদার মতো কিছু হয় নাই?” অবাক স্বরে বলল মধু।

” না তো। তোমার বাবা সামান্য একটা কথায় এতো কাঁদার কি আছে। উল্টো উনি তোমাকে একেবারে আমার হাতে তুলে দায়দায়িত্ব ছেড়ে দিছে এটা ভেবে তো খুশি হ‌ওয়া উচিত। মেয়ের বিয়ে হলে সব বাবারাই মেয়ের দায়িত্ব ছেড়ে দেয়। তারা না ছাড়লে আমরা হাজব্যান্ড রা দায়িত্ব নেব কি করে? এখন তোমার ভালোমন্দের দায়িত্ব তো আমার।”
” বাপি আমাকে মৃত প্রমাণ করে দিয়ে গেল।”

ফুয়াদ মধু মুখে আঙ্গুল দিয়ে বলল,,” এই বাজে কথাটা আর কখনো মুখে আনবে না। তিনি বাবা রাগের মাথায় এসব বলেছে। যখন রাগ চলে যাবে তখন…..।”
মধু ফুয়াদের মুখের কথা টেনে নিয়ে বলল,,”বাপি আমাকে এমনিতেই বেশি ভালোবাসে না। সব সময় তার অবহেলা পেয়ে এসেছি আর আজ এতো কিছুর পর আমাকে মৃত করে সম্পর্ক ছিন্ন করে গেল। তার এই রাগ কখনোই যাবে না আমি জানি।”

ফুয়াদ মধুর কষ্টটা অনুভব করতে পারছে তাই আর এই নিয়ে কথা বাড়ালো না‌। খাবার দিতে বললে কাজে মেয়ে এনে খাবার দিল। আনিতা বেগম রান্না ঘরে থেকে খাবার সাজিয়ে দিয়েছে প্লেটে। ফুয়াদ হাত ধুয়ে এসে নিজের হাতে খাইয়ে দিতে মধুর পাশে বসে। মধু মুখ গোমড়া করে বসে আছে। মধুর এখন নিজের মায়ের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে খুব। কিন্তু বাপি কি আর কখনো ওকে মায়ের সাথে কথা বলতে দিবে?

” হা করো।” ফুয়াদ ভাতে লোকমা মধুর মুখের সামনে ধরে বলল।
” আমি খাব না।‌”
” মধু জেদ করো না। হা করো। আমার হাতে খাওয়ার সুযোগ সবসময় পাবে না।”
মধু চোখ ছোটো ছোটো করে বলল,,” ঢং। আপনার হাতে খাওয়ার জন্য আমি যেন মরে যাচ্ছি।”
” আমি তো খেতে মরে যাচ্ছি।”

” তো নিজে খান। আমাকে জোর না করে।” বলে মধু মুখ ঘুরিয়ে নিল।
” তোমার হাতে খেতে মরে যাচ্ছি। তাও তো আমার উপর একটু মায়া করছো না।”
” শখ কতো।”
“জান প্লিজ খেয়ে নাও‌। তোমার জন্য আমিও খেতে পারছি না। আমার পেটে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে।”
” কেন আমি কি আপনাকে না খেয়ে থাকতে বলেছি? আমার জন্য খেতে পারছেন না কেন?”

ফুয়াদ মধু কে খাবার মুখে নিতে এটা সেটা বলে মানাতে চাইছে আর মধু শুধু জেদ দেখিয়ে যাচ্ছে। এদিকে গটগট করে নিজের রুমে থেকে বেরিয়ে আসে নাফিসা বেগম। তিনি বাইরে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে এসেছেন। তিনি বাইরে এসেই ফুয়াদ আর মধুর দিকে তাকায়। ফুয়াদ খাবারের প্লেট নিয়ে মধু কে খাইয়ে দিতে তোষামোদ করছে আর মধু গাল ফুলিয়ে এটা সেটা বলছে, তা দেখে তিনি মুখ ফিরিয়ে চোখ মুখ গম্ভীর করে সদর দরজার দিকে হাঁটা ধরেন। তার পায়ের শব্দে ফুয়াদ আর মধু তার দিকে তাকায়।

ফুয়াদ জিজ্ঞেস করে উঠে,,” আম্মু কোথায় যাচ্ছ?”
নাফিসা বেগম ছেলের কথাটা কানেই নেন না। গটগট শব্দ করে বাইরে চলে গেল।
ফুয়াদ অস্ফুট স্বরে বলল,,” আম্মু হন্তদন্ত হয়ে কোথায় গেল?”

প্রেয়সী পর্ব ৫৬

মধুও বোকা চোখে তাকিয়ে আছে। ও নিজেও বুঝতে পারছে না বাইরে কোথায় গেল?
ফুয়াদ আর মধু দুজনেই নাফিসা বেগম কোথায় গেল সেই চিন্তায় একে অপরের দিকে তাকাল।

প্রেয়সী পর্ব ৫৮