প্রেয়সী পর্ব ৭১

প্রেয়সী পর্ব ৭১
নন্দিনী নীলা

এক সপ্তাহের মধ্যে জানাজানি হয়ে গেল ফুয়াদ সমুদ্রের নামে মামলা করেছে। এটা জানার পরে বাসার সবাই ফুয়াদের সাথে একপ্রকার কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। নিজের বড় ভাইয়ের নামে কেন মামলা করেছে এসব নিয়ে ওর সাথে সবাই রাগারাগী করতে শুরু করে। সমুদ্রের ব্যাপারে যখন সবকিছু জানালো তখন কেউই এসব বিশ্বাস করল না।

তাদের এক কথা তাদের ছেলেকে কেউ ফাঁসাচ্ছে। নাফিসা বেগম তো ফুয়াদের সাথে কথা বলায় বন্ধ করে দিল। এজন্যই তার ছেলে এমন পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। এক ছেলে তার আরেক ছেলের নামে মামলা করেছে। এমন দিনও তার দেখতে হলো। আর কত কিছু তার দেখার বাকি আছে সে জানে না। এখন সে দিনরাত চিৎকার করে কান্না করে আর বিলুপ করে।
‘ আমার ছেলেকে আমার কাছে এনে দাও।’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ফুয়াদ কে চোখের সামনে দেখলে আবার বাজে কথা বলতে শুরু করে। মধুর উপর যতটুকু ভালোবাসা তৈরি হয়েছিল সবটাই আবার পানি হয়ে গেছে এখন। বাসার কেউ ফুয়াদ মধু দুজনের একজন কেউ সহ্য করতে পারছে না। সবাই মনে করে মধু ফুয়াদের জীবন আসার পরেই দুই ভাইয়ের মধ্যে ঝামেলা হয়েছে। মধু একটা অলক্ষী। তার জন্য তার এক ছেলে আরেক ছেলের নামে মামলা করেছে।

ছেলে বাড়ি ছাড়া হয়েছে। সব করেছে মধু। সবকিছু মধুর উপর পড়লো। এতো ঝামেলার নিয়ে থাকার জন্য মধু কয়েকদিনে অসুস্থ হয়ে পড়ল। তাই ফুয়াদ বাধ্য হয়ে মধু কে নিয়ে মধুর বাবার বাসায় আসলো। এতে অবশ্য বাসার কেউই দ্বিমত পোষণ করলো না। মধু আর ফুয়াদ বাসা থেকে বেড়িয়ে আসাতে তারা সবাই খুশি হয়েছে। ফুয়াদ ভাবতে পারছে না। বাবা মা এমন করবে সে ভেবেছিল বাবা-মা তার ওপর রাগ করবে।

কিন্তু সব জানার পর যে ফুয়াদকে এতটাই অবিশ্বাস করবে জানা ছিল না। আর পুলিশের প্রমাণ সবকিছুই তারা দেখেও যেন দেখছে না। সবকিছুই তাদের কাছে ভুল মনে হচ্ছে। তাদের বাড়ির ছেলে এমন কোন খারাপ কাজ করতে পারে না। এটা তাদের অন্ধবিশ্বাস। মধু কে এমন পরিবেশে রাখা যাবেনা তাই ফুয়াদ ইচ্ছে করে মধুকে নিয়ে মানিকগঞ্জে আসলো।

ফুয়াদ কে সমুদ্র মারতে চেয়েছে এটা ফুয়াদ কাউকে জানায়নি। পরিবারের সবাইকে এত শক ও দিতে চায় নি। এখন ওর মনে হচ্ছে জানালেও হয়তো তারা বিশ্বাস করত না।
সমুদ্র কোথায় আছে ফুয়াদ জানেনা তার বিদেশে যাওয়ার কোন প্রমাণ পায়নি। তাই মধুকে ও একা রাখতে ও ভয় পায়। নিজের সন্তান ও মধুর কোনো ক্ষতিও হতে দেবে না। তাই নিজেও মানিকগঞ্জে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একটা পথ আল্লাহ বন্ধ করে দিলে আরেকটা পথ খুলে দেয়। সেটারই প্রমাণ মধুর বাবা মা। ফুয়াদ কখনো ভাবেনি মধুর বাবা ওকে মেনে নেবে। ওকে আদর যত্ন করবে। কিন্তু এবার যখন ওরা আসলো। আর বাসার পরিস্থিতি জানালো তখন দেখতে পেল মধুর বাবা কতটা চেঞ্জ হয়েছে। ওকে ছেলের মতো ট্রিট করছে।

বাপির এই পরিবর্তন দেখে মধু নিজেও খুব খুশি।
ফুয়াদ মধু কে নিয়ে আশেপাশে ঘুরতে বের হবে। সমুদ্র ভাইয়ার খবরটা পরিবারের সবাই জানার পর থেকে ওদের দুজনের উপর দিয়ে মানুষিক চাপ গেছে। নিজেকে নিয়ে ফুয়াদ ভাবে না কিন্তু মধুকে ডক্টর এই সময় হাসিখুশি রাখতে বলেছিল। ওকে সব রকম দুশ্চিন্তা থেকে দূরে রাখতে বলেছে। কিন্তু আমাদের কপালে এতটাই খারাপ যে সমস্ত টেনশন দুশ্চিন্তা এই সময় এসেই মাথায় চেপে বসেছে। ফুয়াদ মধু কে বলল সেজেগুজে রেডি হতে। মধুর প্রেগনেন্সির তিন মাস চলছে।

মধু বলল,,” রেডি হয়ে কোথায় যাব আপনার বাসায় যাবেন?”
ফুয়াদ বলল,,”বাসা থেকে কেউ কল না করলে আমি আর ওখানে যাচ্ছি না। এখন ওখানে তোমাকে নিয়ে গেলে তুমি আরো মানুসিক চাপে থাকবে। ওখানে পরিবেশ ঠিক হবার নয়। সবাই আমাকে দোষী ভাবছে আর তোমাকে। আমি চাইনা তুমি এইসব দুশ্চিন্তা করে নিজের আর আমাদের বেবির কোন ক্ষতি করো।”
“শুধুমাত্র আমার জন্য আপনাদের দুই ভাইয়ের সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে। আমি আসলেই অলক্ষ্মী। এখন আপনার নিজের আপন জন ছেড়ে দূরে পড়ে থাকতে হচ্ছে।”বলতে বলতে মধুর চোখ ভিজে এলো।

মধুর কথা শুনে ফুয়াদ রাগী কণ্ঠে বলল,,”বাজে কথা বলতে মানা করেছি না? শুধু তোমার জন্য নয়। ভাইয়া আগে থেকেই আমাকে মারতে চায়। আমি আসলে তার পথের বাধা হয়ে যাচ্ছিলাম। আস্তে আস্তে তাকে ধরে ফেলছিলাম। যেটা ভাইয়া চায় নি। সে নিজেকে বাঁচাতে আমাকে মারতে চেয়েছে তুমি তো পরের ব্যাপার।”

মধু তবুও চোখে জল ফেলছে দেখে ফুয়াদ উঠে বলল,,”মধু তুমিও যদি কান্না করো আমাকে বোঝার চেষ্টা না করো। তাহলে আমি নিজেকে কিভাবে ঠিক রাখবো বলো তো? আমার উপর দিয়ে কি যাচ্ছে তুমি তো বুঝতে পারছো। শুধুমাত্র তোমার আর আমাদের সন্তানের জন্য আমি ঠিক আছি। সব ভুলে নিজেকে হ্যাপি রাখার চেষ্টা করছি। শুধুমাত্র তোমাদের জন্য।

তুমি যদি এসব দুশ্চিন্তা করে নিজের ও বেবির কোন ক্ষতি করে বসো তাহলে আমি কি নিজেকে ঠিক রাখতে পারব? ডক্টর কিন্তু বারবার করে বলেছে তোমাকে এই সময় সমস্ত দুশ্চিন্তা থেকে দূরে রাখতে। হ্যাপি রাখতে। তুমি প্লিজ এসব চিন্তা বাদ দিয়ে শুধু আমাদের কথা ভাবো। আমাদের একটা সুন্দর সংসারের কথা ভাবো‌।”
মধু ফুয়াদের হাত ধরে টেনে নিজের গালে স্পর্শ করে বলল,,” আমার চোখের পানি মুছে দিন।”
ফুয়াদ হেসে ওর চোখের অশ্রু মুছে দিল মধু বলল,,”শাড়ি পরি?”

” হোঁচট খাওয়া যাবে না কিন্তু!”
” থাক, শাড়ি পরে না হয় আমরা তিনজন ঘুরতে যাব এখন শাড়ি তোলা থাক।”
” হ্যাঁ জান আমাদের ছোট্ট একটা পরী আসবে। তারপর আমরা তিনজন ঘুরতে যাব। তুমি পড়বে শাড়ি আর আমি পড়বো পাঞ্জাবি। আমাদের রাজকন্যা কে পরীর মতো সাজিয়ে ঘুরতে যাব।”
মধু কল্পনায় চলে গেল যেন।

” ইশ মুহুর্তটা কত সুখের হবে।”
” এবার রেডি হ‌ও।”
মধু রেডি হয়ে আসলে দুজনেই বেরিয়ে গেল। মধুর সমবয়সী ছেলে-মেয়ে রা অনেকদিন পর মধু কে আর সাথে একটা অপরিচিত ছেলে দেখে এগিয়ে আসলো। ওদের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। একটা মেয়ে মধু কে বলল,,” আরে মধু কেমন আছিস? এটা তোর হাজব্যান্ড?”
মধু এখানে আসার পর বের‌‌ই হয় না।
মধু বলল,,” হ্যাঁ কেমন আছিস তোরা?”

” আমরা তো ভালোই আছি। তুই তো এখন বাসা থেকেই বের হোস না। জামাই পেয়ে খালি তার সাথে থাকিস আমাদের সাথেও তো একটু দেখা সাক্ষাৎ করতে পারিস।”
মধু ফুয়াদের দিকে চেয়ে হেসে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। সবাই লম্বা করে ফুয়াদ কে সালাম দিল। ফুয়াদ হেসে তাদের সাথে কথা বলল। ওদের থেকে একটু দূরে দুটো মেয়ে দাড়িয়ে ছিল তারা কাছে আসে নাই ফিসফিস করে কি জানি বলছে আর ফুয়াদ আর মধুর দিকে কেমন করে জানি তাকাচ্ছে।

ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে বের হতেই ওরা গাড়িতে উঠে বসল। ওরা পার্কে আসলো। মধু এখানে ওখানে দাঁড়িয়ে সিঙ্গেল পিক তুলছে আবার দু’জনে সেলফি তুলছে একসাথে। ওরা পার্কের রেস্টুরেন্টে গিয়ে দ‌ই ফুচকা খেল। মধুর নাকি এটা অনেক পছন্দের তাই ফুয়াদ ও টেস্ট করল। ওদের বিকেলটা খুব রোমান্টিক কাটল। ওরা পার্কে সুন্দর একটা মুহুর্ত পার করল। সব টেনশন ভয় কাটিয়ে সময়টা ভালোই উপভোগ করল।

বাসায় ফিরে আসলো সন্ধ্যার আগে। মধুর মা বারবার করে বলে দিয়েছে আজানের আগে যেন বাসায় ফিরে। তার মতে সন্ধ্যার পরে নাকি প্রেগন্যান্ট মহিলাদের বাইরে থাকতে হয় না। এতে নাকি ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এসব কুসংস্কার অবশ্য মধু মানে না। আগেকার মানুষ এমন অনেক জিনিসই মেনে চলতো এইসব মায়ের কানে ওর নানু ঢুকিয়েছে। নানু মারা গেছে তাও অনেক বছর হলো। এসব না মানলেও মায়ের কথা মধু বা ফুয়াদ কেউই ফেলল না। ওরা সন্ধ্যার আগেই বাসায় ফিরে আসলাম।

ফুয়াদ সারাদিন মধুর পিছনেই থাকে নিজের বউয়ের কেয়ার নিজেই নেই। কাউকে ওর দরকার পড়ে না। ফুয়াদ মানিকগঞ্জে যাওয়ার পর নিজের কাজে থেকে দূরেই আছে। ওদের বস তিনি ওকে অনেকবার কল করে জরুরী মিশনেও পাঠাতে চেয়েছে কিন্তু ও রাজি হয়নি। ওর মন এখন সবসময় ভয়ে থাকে ও মধুর থেকে দূরে গেলে না জানি মধুর কোন বিপদ হয়ে যায়।

মানিকগঞ্জে থাকার দুই মাস পর নাফিসা বেগমের নাম্বার থেকে কল আসলো ফুয়াদের নাম্বারে। মধুর এখন পাঁচ মাস চলছে ওর পেট আগের থেকে এখন অনেকটা বড় বড় লাগে। হাঁটাচলা অনেকটা সাবধান এসেছে। মধু প্রেগন্যান্ট জানার পর থেকে অবশ্য হাঁটাচলাতে অনেক সাবধানী হয়ে গেছিল। এখন তো আরো। প্রতিমাসেই ওকে ডক্টরের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। দুই মাস পরিবারের সবার থেকে কোন রেসপন্স না পেরে মধু আর ফুয়াদ দুজনেই অনেক আঘাত পেয়েছে মনে। কিন্তু তবুও ফুয়াদ মধুকে হ্যাপি রাখার সবোর্চ্চ চেষ্টা করে গেছে।

ঠিক দুই মাস পর যখন ওদের আবার বাসায় ডাকলো তখন ওরা সমস্ত অভিমান ব্যথা ভুলে ছুটে গেল।
এই দুই মাসে ফাহাদ আর তিন্নির সাথে মাঝে মাঝেই কথা হয়েছে‌। রাহীও মাঝে মাঝে কল করে মধুর খোঁজ খবর নিয়েছে। কিন্তু যত বার ওরা কল করেছে ওদের মুখে একটা কথাই ছিল সেটা সমুদ্র ভাইয়ার নামে কেন ফুয়াদ এমন মামলা দিল।

প্রেয়সী পর্ব ৭০

একদিন ফুয়াদ তাই বলেছে,,,” তোরা যদি আমাদের এসব জিজ্ঞেস করিস ‌ তাহলে দয়া করে আর কোন যোগাযোগ করিস না।”

প্রেয়সী পর্ব ৭২