বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ২৯

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ২৯
জাওয়াদ জামী

প্রায় আধাঘন্টা নির্জন রাস্তায় দুজনে পাখির মত উড়ে বেড়ায়। তাহমিদের ইচ্ছে ছিল আরও কিছুক্ষণ থাকার। কিন্তু কুহুর জোড়াজুড়িতে সেটা আর হয়ে উঠেনা।
বাসায় এসে কুহু ফ্রেশ হয়ে বিছানায় যায়। ওর দু’চোখে ঘুম এসে হানা দিয়েছে।

” আমার রাতজাগা পাখিটার কি খুব বেশি ঘুম পেয়েছে? ”
” একটুতো পেয়েছেই। কিন্তু আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে ঘুম আপনার থেকে দুই মাইল দূরে অবস্থান করছে৷ কিভাবে পারেন এত রাত জাগতে! সারাদিনের পরিশ্রম শেষে একটুও ঘুমাতে ইচ্ছে করেনা! ”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

” সারাদিন আমার পাশে তুমি থাকনা। আমার বাহিরে থাকলেও মনটা তোমার কাছেই থাকে। বাসায় এসে তোমার মুখখানা দেখলে আমার সকল ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। রাতের এই সময়টুকু ছাড়া তোমাকে দেয়ার মত সময় আমার নেই। তাই বারংবার ঘুমকে ছুটি দিয়ে তোমাতে হারাই। ”

কুহুকে বুকে টেনে নিয়ে বলল তাহমিদ।
তাহমিদের কথা শুনে কুহুর বুকে শান্তির ঢেউ এসে দোলা দেয়। দুনিয়া উথাল-পাথাল করে স্নিগ্ধ মলয় এসে ওর সমস্ত সত্তায় আলোড়ন তোলে। ধূ ধূ মরুভূমির বুকে এক পশলা রিমঝিম বৃষ্টি ন্যায়, ভালোবাসার বৃষ্টি নামে কুহুর বক্ষপিঞ্জরিয়ায়। দুকূল ছাপিয়ে উছলে ওঠে প্রনয়ের ঢেউ। এই মানুষটা একান্তই ওর। কথাটা ভাবতেই আরেকবার ভালোলাগায় অসার হয়ে যায় ওর চিত্ত।

” একটা কথা বলব? মন দিয়ে শুনবেন তো? ”
” একটা নয়, এক হাজারটা কথা বল। এই বান্দা তোমার কথা শোনার জন্য সর্বদাই প্রস্তুত। আমার একটামাত্র বউ বলে কথা। তার কথা আমি শুনবনা এটা হতে পারে! ”
” নীরা ভাবি আর ভাইয়ার মধ্যে কিছু একটা ঠিক নেই। ভাবির কথাবার্তা শুনে আমার ভালো লাগেনা। বারবার মনে হয় ভাবি ভালো নেই। আজ আমি ভাবিকে জিজ্ঞেস করতেই, সে আমার কথা এড়িয়ে যায়। ”

কুহুর কথা শুনে তাহমিদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। সে নিজেও লক্ষ্য করেছে নীরার ব্যাপারে তাহমিদের উদাসীনতা।
” আমিও বিষয়টি লক্ষ্য করেছি। তুমি একটু ভাবির দিকে খেয়াল রেখ। আমি একটু ফ্রি হয়েই ভাবির সাথে কথা বলব। ততদিন ভাবির দ্বায়িত্ব তোমার। ” কুহুর নাকে চুমু দিয়ে বলল তাহমিদ।

” আমি বাসায় থাকলে ভাবির কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করি। কিন্তু আপনি ফ্রি হবেন কবে! এভাবে পরিশ্রম করলে শরীর টিকবে? ”
” আমার জীবনে একটা লক্ষ্য আছে, বউ। একটা হসপিটালের স্বপ্ন দেখতাম ছোটবেলা থেকেই। যেখানে অন্তত ১৫ টা রোগের চিকিৎসা করা হবে। থাকবে বিশেষজ্ঞ ডক্টর। যেখানে দেশের অভাবগ্রস্থ মানুষকে সম্পূর্ণ ফ্রি চিকিৎসা দেয়া হবে।

অর্থের অভাবে দেশের ছিন্নমূল মানুষেরা বিনা চিকিৎসায় অকালে প্রান হারায়। আমি সেইসব মানুষদের একটু সাহায্য করতে চাই। আমার সেই স্বপ্ন পূরণ করতে গেলে অনেক টাকার প্রয়োজন পরবে। তাই আমি দিনরাত পরিশ্রম করে আমার স্বপ্নকে ছোঁয়ার চেষ্টায় আছি। ”

” আমি শুনেছি আপনি এখনও অনেককেই বিনা পয়সায় চিকিৎসা দেন। ফ্রি চিকিৎসা ক্যাম্পিং শুরু করেছেন। এভাবেই চলুকনা। ”

” আমার স্বপ্নযে আরও বড়। ছোটবেলা থেকে একটা স্বপ্ন দেখেই আমি বড় হয়েছি। যখন অলমোস্ট স্বপ্ন পূরণের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছি, তখন কিভাবে পিছিয়ে আসি বল? একটা বড় হসপিটাল, অনেকগুলো ডক্টর, সিস্টার রোগীদের নিয়ে ব্যস্ত সময় পাড় করছে। রোগীদের চোখমুখে তৃপ্তির হাসি। এটা আমার আজীবনের স্বপ্ন, বউ। ”

কুহু অবাক হয়ে ওকে জড়িয়ে রাখা মানুষটার দিকে তাকিয়ে আছে। মানুষটার চোখ জ্বলজ্বল করছে। তার চোখে স্বপ্ন পূরণের হাতছানি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে কুহু।
” আপনার স্বপ্নের চিলেকোঠায় আমাকে একটু ঠাঁই দিবেন? আমিও আপনার স্বপ্ন পূরণের সারথি হতে চাই। আপনার হাতে হাত রেখে, আপনার লক্ষ্য পূরণে সহযোগী হতে চাই। ”
” তুমি ছাড়া আমি শূন্য। আমার স্বপ্ন পূরণের পথে তোমাকে সহযোগী কিংবা সারথি নয়। আমি তোমাকে নিজের ছায়া রূপে আমার পাশে চাই। ”

” আমি আপনার ছায়া হয়ে জন্ম-জন্মান্তর কাটিয়ে দিতে চাই। আপনার আশেপাশে থেকে আমি প্রতিনিয়ত নিজেকে নতুনভাবে চিনছি। তাই আরেকবার নিজেকে আবিস্কারের সুযোগ আমি ছাড়তে চাইনা। ” তাহমিদের বুকে মাথা রেখে বলল কুহু।

” তোমার সকল অবস্থায়ই আমাকে তোমার পাশে পাবে। আমি স্বামী রূপে নয়, বন্ধু রূপে তোমার পাশে থাকব। ” কুহুর ললাটে অধর ছোঁয়ায় তাহমিদ। এরপর দুষ্টুমি করে বলল,
” বউ অলরেডি রাত তিনটা বেজে গেছে। আর কতক্ষণ এভাবে আমাকে ঝুলিয়ে রাখবে! এবার তো একটু ভালোবাসা দাও। আমিও তোমাকে ভালোবেসে নিজের তৃষ্ণা মেটাই। ”
তাহমিদের এমন লাগামহীন কথা শুনে কুহু লজ্জায় তাহমিদের বুকেই মুখ লুকায়। তাহমিদও উত্তর পেয়ে গেছে।

” সিক্তা, ঘুমিয়েছিস? তোর চোখে এত ঘুম কোথা থেকে আসে! ” ভিডিও কলে সিক্তাকে দেখছে আনান।
এদিকে সিক্তার ঘুম পেয়েছে। ও কিছুতেই চোখ খুলে রাখতে পারছেনা। আনানের সাথে কথা বলার এক পর্যায়ে ও ঘুমিয়ে পরে।
আনানের ডাক শুনে সিক্তা অনেক কষ্টে চোখ খোলে।

” এখন একটু ঘুমাই, প্লিজ। তুমিও ঘুমাওনা। কাল ভার্সিটিতে দেখা হবে। তখন যত খুশি গল্প কর। ” সিক্তা কথা বলছে আর বারবার হামু দিচ্ছে।
” ঘুমের রানি, তুই ঘুমা। আমার চোখের ঘুম কেড়ে নিয়ে শান্তিতে ঘুমা। কাল সময়মত ভার্সিটিতে চলে আসিস। এখন রাখছি। ”

” তুমিও ঘুমাও। এভাবে রাত জাগলে তোমার চোখের নিচে কালি পরবে, গাল ভেঙে যাবে। তখন তোমাকে দেখতে ভূতের মত লাগবে। আর আমি ভূতে ভয় পাই। ”
” আচ্ছা ঘুমাব। ” আনান হেসে বলল।
আনান ফোন কাটতেই সিক্তা আবার ঘুমিয়ে যায়।

পরের সাতদিন যে যার মত জীবন কাটায়। তাহমিদ ক্যাম্পিংয়ের জন্য দুইদিন বাসায় ছিলনা। কুহু, নীরা, সিক্তা মিলে হৈ-হুল্লোড় করে দিন কাটায়। যদিও তাহমিদের জন্য কুহুর মনে সর্বদাই চিন্তা বিরাজ করেছে। এই কয়দিন নীরা আর কুহু মিলে রান্নাঘর সামলেছে। তাহমিনা আক্তার অনেক বারন করলেও ওরা শোনেনি।

আজ শফিউল রাশেদিন বাসায় আসবেন। তিনি নরসিংদীর একটা সরকারি কলেজের অধ্যাপক। প্রতিমাসেই একবার তিনি বাসায় আসেন।
আজ তার আসার কথা শুনে নীরা আর কুহু মিলে রান্নার জোগাড় করেছে।
তাহমিদ মেডিকেলে গেছে। কুহু ওকে ফোন দিয়ে একটু তারাতারি বাসায় আসতে বলেছে।

” বউমা, তোমার ছেলের বউরা সংসার সামলানো শিখে গেছে। এখন তোমাদের বিশ্রাম নেয়ার পালা। ওদের দুজনকে দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। দুইটা হীরের টুকরা এসেছে আমার বাসায়। ” আয়েশা সালেহা আনন্দে চোখ মুছলেন।
” আপনার মত মা যেই সংসারে আছে। সেই সংসারে শুধু হীরাই ঠাঁই পাবে। ” তাহমিনা আক্তার হাসছেন।

” আম্মা, আপনাকে খেতে দিই? দুপুরে তো ভালো করে খেতে পারলেননা। ” আফরোজা নাজনীন তার শ্বাশুড়িকে জিজ্ঞেস করলেন।
” না বউমা, এখন কিছুই খাবনা। আমার ছেলেটা আসুক। একসাথে দুই ছেলেকে নিয়ে খাব। ”
” দিদুন, আমাদেরকে বুঝি সাথে নিবেনা? আমরা বুঝি পর হয়ে গেলাম! ” কুহু কৃত্রিম রা’গে মুখ ফোলায়।

” না কুহু সোনা। তুমি কি কখনো পর হতে পার! তুমি আমার নাতির কলিজা। আর নাতির কলিজা মানেই, আমাদেরও কলিজা। কলিজা ছাড়া কেউ বুঝি চলতে পারে? ” বৃদ্ধার কথা শুনে কুহু ঠোঁট টিপে হাসল।
” সবই বুঝি দিদুন, তোমার নাতির কলিজা মানেই তোমাদের কলিজা। তাহলে আমি কে? ” নীরা হাসিমুখে জানতে চায়।

” তুমি আমাদের হৃদপিণ্ড। হৃদপিণ্ড ছাড়াও কিন্তু মানুষ বিকল। ” নীরা দিদুনের কথা শুনে তাকে সানন্দে জড়িয়ে ধরল।
শফিউল রাশেদিন সন্ধ্যায় বাসায় এসেছেন। তিনি দুই পুত্রবধূর জন্য শাড়ি, নাতনীর জন্য জামা আর সিক্তার জন্য ওর পছন্দের পোশাক এনেছেন।

কুহুর অনুরোধে তাহমিদ আজ তারাতারি বাসায় এসেছে। ও দশটার আগেই ‘ কুঞ্জছায়া ‘ য় ফিরেছে। আজ অনেকদিন পর সবাই একসাথে খাবে। আয়েশা সালেহা নাতির অপেক্ষায়ই ছিলেন। তাহমিদ বাসায় আসতেই, তিনি ওকে ফ্রেশ হয়ে আসতে বললেন।
তাহমিদ গোসল সেড়ে এসে দেখল টেবিল খাবার দিয়ে কানায় কানায় পূর্ণ।
সবাইকে নিয়ে খেতে বসেছেন আয়েশা সালেহা। আজ মনি খাবার পরিবেশন করছে।
সবাই খেতে খেতে টুকটাক কথাবার্তা বলছে।

বৃদ্ধা বারবার আফসোস করছেন আজ তার ছোট ছেলে পাশে নেই বলে। তাহমিনা আক্তার বড় ছেলের কথা চিন্তা করছেন। বাসায় কত আয়োজন করা হয়েছে অথচ তার ছেলেটা কাছে নেই। ছেলের চিন্তায় তার গলা দিয়ে খাবার নামছেনা।

” ভাবি, ভাইয়া কবে আসবে? সেতো অমাবস্যার চাঁদ হয়েছে। সবার কাছ থেকে দূরে থাকতেই বোধহয় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। ” তাহমিদ কথার ফাঁকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে নীরার দিকে।

তাহমিদের কথা শুনে নীরার খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। হঠাৎই ওর চোখে টলটলে অশ্রু জমা হয়, যা তাহমিদের চোখ এড়ায়নি। দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কা’ম’ড়ে ধরেছে নীরা। ওর মুখাবয়বে কালো মেঘ জমা হয়। তাহমিদ বুঝতে পারল, ঘটনা সাধারন কিছু নয়, বরং গুরুতর।

” তাহমিদ, তোর কি মনে হয় আমার ছেলেটা পরিবার থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করে! নেহাৎই ওর ঢাকার বাহিরে পোস্টিং, তাই সবাইকে ছেড়ে থাকতে হয়। তুই এভাবে বলিসনা বাবা। ” তাহমিনা আক্তারের গলা ভিজে আসে।

” তোমার ছেলেটা আর মানুষ হলোনা শফিউল। এই ছেলেকে দিয়ে ভালো কিছু আশা করা বোকামি। তোমার ভবিষ্যৎ অন্ধকার বুঝলে? ছেলেদের জন্য এত কষ্ট করছ কিন্তু ফল চোখে দেখলেনা। তোমার বড় যা-ও একটু আছে, কিন্তু এটা সেই উজবুকই থেকে গেল। বড্ড আফসোস হয়। ” সানাউল রাশেদিনের কথা শুনে তাহমিদ কুটিল চোখে চায়।

” মাই গড! আমার ফুপাশ্বশুড় দেখছি মুখ খুলেছে! সে মুখ খোলা মানেই দুমমমমমমম। ঠিক যেন এ্যটম বো’ম। তা ফুপা শ্বশুর এখন পর্যন্ত কিন্তু আপনি আপনার একমাত্র শ্যালকের বড় মেয়ের জামাইকে মুখ দেখে কোন গিফ্ট দেননি। এটা কি আপনার জন্য সম্মানজনক!

ডক্টর জামাইকে এখনও যথার্থ সম্মান করতে না পারায় আপনার কি আফসোস হয়না? আমি তো দেখছি আপনার ভবিষ্যৎ অন্ধকার। জামাইকে সম্মান করেননা, কেমন শ্বশুর আপনি? বড়মা, আমার ফুপা শ্বশুরকে আরও কয়েক টুকরা মাংস দাও। সে আমাকে সম্মান করতে না পারুক, জামাই হিসেবে তাকে সম্মান করা আমার কর্তব্য। ”

সানাউল রাশেদিনের মুখ নিমেষেই চুপসে যায়।
তিনি বুঝলেন, এখন কোন কথা বলা মানেই তাহমিদের খোঁ’চা হজম করতে হবে। তাই তিনি চুপ থাকার সিদ্ধান্ত নেন।

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ২৮

” ভাবি, আজ একটু দেরি করে ঘুমিও। অনেকদিন তোমার সাথে আড্ডা দেয়া হয়নি। আজ আড্ডা দিব। ”
” ঠিক আছে। আমি সবকিছু গুছিয়ে রেখে তোমাকে ডাকব। ”
এভাবেই খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে কথা চলতে থাকে।

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৩০