বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ৮

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ৮
সাদিয়া জাহান উম্মি

দমকা হাওয়া প্রবাহমান।এই বুঝি নামলো আবার বৃষ্টি।পুরো আকাশ জূড়ে কালো মেঘেদের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে।থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।বাতাসের সাথে কোথা থেকে যেন এমটা কাঠগোলাপফুল উড়ে এসে পরলো বারান্দায়।আরাবী ফুলটা হাতে তুলে নিলো।এতোক্ষন সে প্রকৃতিবিলাশে মগ্ন ছিলো।কিন্তু হঠাৎ এই কাঠগোলাপ ফুলটি তার ধ্যান ভঙ্গ করতে বাধ্য করেছে।ফুলটা কোথা থেকে আসলো বুঝলো বা আরাবী।

বাগানে যে কাঠগোলাপ গাছটা আছে সেখান থেকে এতো উপরে আসা সম্ভব না।তবে কি ছাদের থেকে এসেছে?হতেও পারে।আরাবী এখনো এই বাড়ির ছাদে যায়নি।তাই ছাদে কি আছে না আছে জানেনা আরাবী।অবশ্য এতোদিন কোন আগ্রহ ছিলো না ওর মাঝে ছাদ নিয়ে।তবে কাঠগোলাপ ফুলটি দেখে একবার ছাদে যাওয়ার অদম্য ইচ্ছা জাগ্রত হলো মনের মাঝে।আরাবীর গা কাঁপছে ঠান্ডায়।এতো জোড়ে হাওয়া বইছে।কেউ বলবে যে আজ কি তুখোড় গরমটাই না গিয়েছিলো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

অবশ্য বর্ষাকাল চলছে।কখন যে বৃষ্টি নামবে এর কোন সঠিক সময় নেই।মেঘেরা যখন মন চায় কালো মেঘে রূপান্তরিত হয় তারপর তাদের বুকচিরে বৃষ্টি নামক ভালোবাসা ঝরিয়ে দেয় ধমনী শীতল করতে। আর ঠিক তেমনভাবেই আরাবীও বারান্দায় এসেছিলো প্রকৃতির হাওয়ায় নিজেকে শীতল করতে।তবে এখন প্রচন্ড শীত করছে আরাবীর।দ্রুত পায়ে রুমে এসে বারান্দার দরজা লাগিয়ে দিলো।দরজা দিয়ে বাতাসের সাথে ধুলোবালি এসে ঘর ভরে যাচ্ছে।

আরাবী ভার্সিটি থেকে এসেই ফ্রেস হয়ে কোনরকমে খাওয়া দাওয়া করে এক লম্বা ঘুম দিয়েছে।মিলি অবশ্য ডাকতে এসেছিলো।আরাবী তখন মিলিকে জানায় ওর প্রচুর মাথা ব্যাথা।এটা শুনে মিলি তৎক্ষনাৎ বাম নিয়ে আরাবীর মাথায় মালিশ করে দিয়েছিলো।আর আরাবী মিলির কোলে মাথা দিয়েই সুয়ে পরেছিলো।বাড়িতে এসে মার সাথে কথা বলে মার কাছে যাওয়ার জন্যে মনটা বড্ড অস্থির ছিলো আরাবীর।কিন্তু যখন মিলির সান্নিধ্য পেলো মনে হলো যেন ওর মায়ের কোলেই ও মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে আছে।যখন ঘুম থেকে জাগলো তখন দেখে রুমে কেও নেই।আর ওর গায়ে কাথা জড়ানো।

মাথা ব্যাথাটাও নেই।আরাবী জানে সব মিলি করে করেছে। এই বাড়ির প্রতিটি ব্যাক্তির ব্যাবহারে আরাবী ক্ষনে ক্ষনে বড্ড অবাক হয়।এইভাবে অন্যের মেয়েকে কেইবা এতো আদর যত্ন দিয়ে রাখে এই জমানায়?প্রান থেকে শ্রদ্ধাবোধ করে আরাবী সবার।
হঠাৎ দরজায় ঠকঠক শব্দ শুনতে পেরে আরাবী চকিতে তাকায়।বাহির থেকে ইফতির গলার স্বর শোনা যাচ্ছে।আরাবী দ্রুত পায়ে গিয়ে দরজাটা খুলে দিলো।ইফতিকে দেখে বলে,

-‘ কখন আসলে ভাইয়া?’
-‘ এইতো মাত্রই আসলাম।’
বললো ইফতি।আরাবীর দিকে আবারও পূর্ন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,
-‘ তোর নাকি অনেক মাথা ব্যাথা? ‘
আরাবী অবাক হলো।বললো,
-‘ তোমায় কে বললো?’
ইফতি বিরক্তি নিয়ে বলে,

-‘ উফ! কে বলবে আবার?আম্মু বলেছে।তা এখন কি মাথা ব্যাথা আছে?’
আরাবী মাথা নাড়িয়ে না বুঝালো।ইফতি সস্থির নিশ্বাস ফেলে বললো,
-‘ আমি ফ্রেস হয়ে আসছি।তুইও নিচে আয় একসাথে খাবার খেয়ে নিবো।সন্ধ্যায় নাস্তাও নাকি করিসনি।’
-‘ আচ্ছা তুমি যাও ফ্রেস হয়ে আসো।আমিও আসছি।’
ইফতি চলে গেলো।আরাবীও হালকা চোখে মুখে পানির ছিটা দিয়ে নিচে নেমে আসলো।তারপর হাতে হাতে মিলির সাথে কাজে সাহায্য করলো।ততোক্ষনে ইফতি ফ্রেস হয়ে নিচে এসেছে।ইফতি আসতেই সকলে মিলে ডিনার করতে বসলো।খেতে খেতে মিহান বলেন,

-‘ ক্লাস কেমন যাচ্ছে আরাবী?’
আরাবী পানি খাচ্ছিলো।খাওয়া শেষে মিনমিনে গলায় বলে,
-‘ এইতো ভালো আংকেল।বেশ ভালো ভার্সিটিটা।লেকচারারগুলোও অনেক ভালোভাবে পড়া বুঝায়।’
আরাবীর কথা শুনে ইফতি এক নজর তাকালো আরাবীর দিকে তারপর আপন মনে কিছু একটা বিরবির করলো।এরপর আরাবীর উদ্দেশ্যে বলে,
-‘ তোকে কেউ ডিস্টার্ব করে আরাবী?’
আরাবী ঠাওর করতে পারলো না ইফতির কথা তাই বলে,
-‘ মানে বুঝলাম নাহ ভাইয়া।’
ইফতি বিরক্ত হয়ে বললো,

-‘ মানে তোকে কোন ছেলে কি ভার্সিটিতে ডিস্টার্ব করে?’
আরাবী তাচ্ছিল্য হাসলো।বললো,
-‘ ভার্সিটিতে এতো স্মার্ট সুন্দর সুন্দর মেয়ে থাকতে কোন পাগলে আমার মতো আনস্মার্ট, গাইয়া মেয়ের পিছনে তাদের সময় নষ্ট করবে ভাইয়া বলো তো?’
ইফতি রেগে গেলো আরাবীর কথায়।ধমকে বলে,
-‘ নিজেকে কেন এতো ছোট করিস নিজের কাছে?তুই নিজেই যদি নিজেকে নিয়ে এতো খামখেয়ালিপনা করিস তাহলে অন্য কেউ বা আর কি করবে?কিছু বলবো না শুধু বলবো আয়নার সামনে একবার দাঁড়িয়ে নিজেকে একটু ভালোভাবে পরখ করে নিস!’

আরাবী কিছু বললো না আর।চুপচাপ নত মস্তকে খাবারটুক খেয়ে উপরে চলে গেলো।মিহান এইবার ইফতিকে বলে,
-‘ এইভাবে না বললেও পারতি ইফতি।মেয়েটা কষ্ট পেয়েছে।’
ইফতি বলে,
-‘ যা বলেছি ঠিকই বলেছি।ও এইভাবে নিজেকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য কেন করে বাবা?’
ছেলের কথা শুনে মিলি করুন কন্ঠে বলে,
-‘ তুই তো জানিস ও কতোটা কষ্টের মাঝে বড় হয়েছে বাবা।এইজন্যে মেয়েটা নিজের জীবন নিয়ে এমন উদাসিন।ওর দিকটাও তো আমাদের বুঝতে হবে তাই নাহ?’
ইফতি মায়ের মথার পরিপ্রেক্ষিতে আর কিছু বললো না।চুপচাপ উঠে চলে গেলো নিজের রুমে।

বারান্দায় চেয়ারে বসে আছে আরাবী।বিকালে অনেকক্ষন ঘুমানোর কারনে এখন ঘুম আসছে না আরাবীর। তাই বারান্দায় এসেই বসে রইলো। বারান্দাটা খুব পছন্দ আরাবীর।আরাবীর একলা সময়টা এখানেই কাটে বেশিরভাগ।হঠাৎ নাকে তীব্র সিগারেটের গন্ধ এসে লাগলো।এমন সময় সিগারেট কে খাচ্ছে বুঝতে পারলো না আরাবী।আশেপাশে তাকিয়ে খোঁজার চেষ্টা করতে নিতেই হঠাৎ জোড়ালো শব্দে ওর ডানপাশে যে বারান্দাটা আছে সেখানকার গ্লাসগুলো খোলার আওয়াজ পাওয়া গেলো।চকিতো সেদিকে তাকায় আরাবী।সাথে সাথে চোখগুলো বড়বড় হয়ে গেলো।

জায়ান দাঁড়ানো সেখানে।আর জায়ানের হাতে সিগারেট দেখে বুঝতে পারলো আরাবী সিগারেটের গন্ধটা ওখান থেকেই আসছিলো।আরাবী চোখ বড় করে তাকিয়ে জায়ানের দিক।লোকটা একটা ট্রাউজার পরে উদোম শরীরে এসে দাড়িয়েছে এখানে। পেটানো সুঠাম দেহি শরীরটা দেখলেই বুঝা যায় লোকটা জিম করে।বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে সিল্কি চুলগুলো এলোমেলো হচ্ছে খুবভাবে।আর জায়ান হাত দিয়ে ব্রাশের মতো করে ঠিক করছে বারবার।মুখের অঙ্গভঙ্গি শক্ত করে রেখেছে।উদাম ফর্সা শরীরটা দেখে ঢোক গিললো আরাবী।লজ্জায় গাল দুটোতে লালাভ আভা দেখা দিলো।

মৃদ্যু শব্দ করে চোখ ঢেকে নিয়ে দ্রুত ঘরের ভীতর ঢুকে গেলো।রুমে গিয়ে বড়বড় নিশ্বাস নিচ্ছে আরাবী।এমন আশ্চর্য চরিত্রের লোক আরাবী কাশ্মিনকালেও দেখেনি।নির্লজ্জ,বেহায়া লোক।কিভাবে উদোম শরীরে এসে দাঁড়িয়ে ছিলো।আর বাহিরে এমন বাতাসে তো আরাবীর দাঁত লেগে আসছিলো ঠান্ডায়।তাই আরাবী চাঁদর জড়িয়ে নিয়েছিলো গায়ে।আর এই লোক কিনা এমন ঠান্ডায় উদোম শরীরে দাঁড়িয়ে ছিলো।উফফ, আর ভাবলো না আরাবী চুপচাপ বেডে বসে রইলো।খানিকক্ষন এদিক সেদিক হাটাহাটি করলো।ঘুমও আসছে না যে ঘুমিয়ে যাবে।আরাবী বিরবির করে বললো,

-‘ অনেকক্ষন তো হলো লোকটা এতোক্ষনে চলে গিয়েছে বোধহয়।আমি একটা গল্পের বই নিয়ে যাই বারান্দায়।এতো সুন্দর আবহাওয়ায় বই পড়লে মন্দ হবে না।’
যেইভাবে সেই কাজ।আরাবী একটা বই নিয়ে আবারও বারান্দার কাছে গেলো।উঁকি ঝুকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করলো কেউ আছে কিনা।কিন্তু বারান্দার বাতিটা নিভিয়ে দিয়েছে লোকটা।তাই বেশি ভালোভাবে কিছু দেখা যাচ্ছে না।আরাবী চোখমুখ কুচকে আবারও দেখার জন্যে মাথাটা উঁকি দিয়েই। গম্ভীর কন্ঠ শুনতে পেলো,

-‘ এইভাবে অন্যের বারান্দায় চোরের মতো উঁকিঝুকি দেওয়াকে কি বলে জানো তো?’
আরাবী থতমত খেয়ে গেলো। দ্রুত সেখান থেকে সরে যেতে নিতেই আবারও সেই কন্ঠস্বরের ঝাঝালো কথা,
-‘ আবারও যদি দেখি এরকমভাবে আমার ব্যালকনিতে উঁকি দিতে। তাহলে সেদিন আমি তোমার বারান্দায় এসে তোমাকে বারান্দা থেকে নিচে ফেলে দিবো বলে দিলাম।’

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ৭

আরাবীর ভয়ে হৃৎস্পন্দন বেরে গেলো।বই রেখে দিলো টেবিলে।তারপর এসে বারান্দার দরজা আটকে দিয়ে রুমের লাইট নিভিয়ে দিয়ে বিছানায় এসে কাথামুরি দিয়ে সুয়ে পরলো।বই পরার কল্পনা বাদ।সে এখন চোখ বুজে মরার মতে পরে থাকবে সিদ্ধান্ত নিলো।ঘুম একসময় আসবেই।

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ৯