মধুমাস পর্ব ৩০

মধুমাস পর্ব ৩০
জাকিয়া সুলতানা ঝুমুর

সময় সময়ের গতীতে ছুটে চলে।সময়কে আটকানোর ক্ষমতা এই পৃথিবীতে কারো নেই তাইতো সবাইকে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হয়।
স্বপন ইসলাম মেয়ের জন্য অনেক পাত্রপক্ষ দেখে কিন্তু কেনো জানি কেউ’ই হ্যাঁ বলে না।এদিক দিয়ে শ্যামাকেও কিছু বলা যাচ্ছে না,পাত্র আসলে মেয়ে কোনো বাহানা ছাড়াই সুন্দর করে সেজে সামনে আসে তাছাড়া ফিরোজের সাথেও যোগাযোগ নেই তাহলে বিয়ে না হওয়ার কারণটা কি?উনি কোনো সমাধান খুঁজে পায় না।
রিপন চিন্তিত্ব হয়ে বললো,

“আব্বা,আমার মনে হয় কলকাঠি ফিরোইজ্জাই নাড়তেছে,একটা শিক্ষা দিয়ে দেই।”
স্বপন ইসলাম গম্ভীর গলায় বললো,
“এসব নেতা ফেতার সাথে লাগতে যেও না পরে দেখা যাবে মেয়ের চরিত্রে কলঙ্গ ছিটিয়ে দিয়েছে।”
“কিন্তু বিয়ে ভাঙ্গছে কেনো তাহলে?”
“কি জানি!যখন হওয়ার তখন হবে।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আজকে রাতে ফাতেমা বেগম শ্যামার রুমে আসে।সহয গলায় বললো,
“আমি আশা করি তুই আগের শ্যামা হয়ে গিয়েছিস।”
শ্যামা সুবোধ বালিকার মতো বললো,
“জ্বী আম্মা।”
“ফিরোজ যে তোর জন্য না এটা যে বুঝতে পেরেছিস তাই অনেক।”
শ্যামা মাথা নাড়ে।ফাতেমা বেগম বললো,

“আমি আর তোর সাথে থাকবো না,তোর আব্বার শরীর ইদানীং ভালো যাচ্ছে না, আশা করি উল্টাপাল্টা কিছু করবি না।”
শ্যামা কি বলবে বুঝতে পারে না।আস্তে করে মাথা দুলায়।ফাতেমা বেগম চলে যায়।শ্যামা সোজা হয়ে শুয়ে থাকে,তার আম্মা আর তার সাথে থাকবে না এটা ভাবতেই মনের দেয়ালে হুড়মুড় করে অসংখ্য প্রজাপতি ডানা ঝাপটে যায়।উঠে দরজা আটকে আসে।টেবিলের লুকানো স্থান থেকে মোবাইল বের করে সুইচ অন করে।

তার আর ফিরোজের বিয়ের দুই মাস পেরোলো।এই দুই মাসে দুজন দুজনার আরো আপন হয়েছে,কিভাবে এক হওয়া যায় সেই চিন্তায় মশগুল থেকেছে।লুকিয়ে চুড়িয়ে ফোনের মৃদু কথাবার্তা গভীর থেকে অতল জলে গিয়ে পৌছেছে, অবশ্য সব বেশামাল কথা ফিরোজের ডিকশনারী থেকেই আসে ;শ্যামা শুধু হু হ্যাঁ করেই শেষ।দুজনের খুচরো আদরের লেনাদেনা হয়,ফিরোজের আবদারে নিলজ্জ শ্যামাও নুয়ে পড়ে,মাথা নিচু করে লুকানোর জায়গা খুঁজে বেড়ায়।কিন্তু দুজনেই বুঝে তাদের চাওয়া পাওয়া,কাছে আসার তীব্র ইচ্ছা,একটু ছুঁয়ে দেয়ার আকাঙ্খা।এসব ভাবা ভুলের কিছু না ফিরোজ তার স্বামী।শ্যামা চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে।বুকটা ছটফট করছে।বারোটা বাজার সাথে সাথে ফিরোজ ফোন দেয়,শ্যামা আজকে আর হেডফোন গুঁজে না,ফিরোজ মিহি গলায় বললো,

“আমার সোনাবউ কি করে?”
শ্যামা সবসময় মেসেজ পাঠায় কিন্তু আজকে মেসেজ পাঠালো না,কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো,
“আপনার বউ আপনার কথা ভাবছে।”
শ্যামাকে কথা বলতে দেখে ফিরোজ লাফিয়ে উঠে বসে।উত্তেজিত গলায় বললো,
“আম্মা কাছে নেই?”
“না,আব্বা অসুস্থ তাই আম্মা আর আমার সাথে থাকবেনা।”
ফিরোজ উত্তেজিত হয়ে বললো,

“সত্যি?”
শ্যামা ফিরোজের কথার ধরন দেখে হেসে বললো,
“জ্বী।”
ফিরোজ দম আটকে বললো,
“তাহলে আমি আসি?”
“কোথায়?”
“তোমার কাছে। ”
শ্যামা ধমকে বললো,
“এই!একদম না, দুষ্টু পুরুষ।”

ফিরোজ আফসোস করে বললো,
“কিরে ভাই!কতোদিন হলো বিয়ে হয়েছে এখনো বউয়ের কাছেই যেতে পারলাম না,একটু এই সেই কতোরকম আদর আছে তা তো কিছুই করতে পারলাম না ,তুমি এতো নিষ্ঠুর;
পাষান মহিলা।দয়া মায়া নেই নাকি? ”
শ্যামা ফিরোজের বুকের উত্থান পাতান ঠিক টের পায়,কিন্তু সংকোচ, ভ,য়ও পায়।ফিরোজের কথা শুনে হেসে বললো,

“না।মায়া নেই।”
ফিরোজ কিঞ্চিৎ অভিমান করলো।
“এই কথা মনে থাকবে তো?থাকলেই হলো।”
“আচ্ছা।”
“তুমি জানোই না আমি কতো সুন্দর হয়ে গিয়েছি,আজকে আসলে দেখতে পারতে।”
“আমি দেখতে চাই না।”
ফিরোজ আফসোস করে বললো,

“আমার কপালে কি এমন কঠিন বউ ছিলো?হায় কপাল।”
শ্যামা আহ্লাদী গলায় বললো,
“ভালোবাসি গো মধুরাজা।”
ফিরোজ শান্তস্বরে বললো,
“মিঠা কথায় চিড়া ভিজবেনা।বুঝেছো সুন্দরী?”
“না এতোশত বুঝিনা।”

“তাহলে আমাকে বুঝানোর সুযোগ দেয়া হোক।আশা করি আমি ভালো বুঝাতে পারবো।”
“দরকার নেই।”
ফিরোজ হতাশ গলায় বললো,
“শোন মেয়ে ফ্রী ফ্রী উপদেশ দেই,স্বামীকে এতো কষ্ট দেয়া ভালোনা,গুনাহ হয় বুঝেছো?”
“বুঝেছি।”

“বুঝলে তো আমার আসার কথা।রাইট?”
“জ্বী না।আপনার এখন ঘুমানোর কথা।আমিও ঘুমাবো।”
ফিরোজ চুপ করে থাকে।অভিমানে তার বুকটা ভার লাগছে,মেয়টা কি কিছু বুঝে না?
শ্যামা স্বামীর মন খারাপের মৃদুমন্দ বাতাসের রেশ টের পায় কিন্তু সে নিরুপায়।বুঝানোর ভঙ্গিতে বললো,
“আজকে রাখি?হঠাৎ যদি আম্মা চলে আসে তো।”

ফিরোজ বললো,
“আচ্ছা।”
চারপাঁচ দিন পরেও যখন ফাতেমা বেগম আর শ্যামার সাথে ঘুমাতে আসে না তখন শ্যামা বুঝে আর আসবে না।এক রাতে শ্যামার ফিরোজকে বেশী মনে পড়ে কিন্তু ফিরোজকে বুঝতে দেয় না।কিছুক্ষণ পরে ফিরোজ ফোন দিয়ে বললো,
“ম্যাম আপনার দরজার সামনে পার্সেল রাখা দয়া করে কেউ দেখে নেয়ার আগেই মহারানীর দরজা খুলে পার্সেল ভেতরে নেন।”

শ্যামা ঝটপট দরজা খুলে একটা বড়োসড়ো প্যাকেট পায়।হাতে নিয়ে দ্রুত দরজা বন্ধ করে বললো,
“এটা কি?”
“শাড়ি।”
“আপনি এসছিলেন?”
“হ্যাঁ।”
“তাহলে দেখা করলেন না?”
“দেখা করলে বেশ খারাপ হয়ে যেতাম তাই। ”
“গুড বয়।”

শ্যামা লাউডস্পিকারে দিয়ে শাড়িটা বের করে।ফিরোজের থেকে দেয়া প্রথম উপহার।উপহার পেতে সবারই ভালো লাগে শ্যামাও খুশী হয়।লাল জামদানী শাড়ি,সাথে মিলিয়ে কানের দুল,গলার হার,রুপার নুপুর,আলতা রাখা।সে খুশীতে বাকবাকুম হয়ে বললো,
“খুব সুন্দর।”
“ধন্যবাদ ম্যাম।একটা চিরকুট আছে এটা পড়ুন আর… আর… থাক আর কিছু বলতে হবে না আমার বউ বুদ্ধিমতী।তাই না?”
শ্যামা ফোন কেটে দেয়।চিরকুট বের করে পড়ে,
মধুরানী,

প্রিয়তমা,আমাকে খুব বেশী ভালোবাসতে ইচ্ছে হয়না?তোমার না হলে না হতে পারে কিন্তু এই পুরুষের খুব ইচ্ছে হয়।তুমি আমার বউ না!এতো কিসের ভ,য়?বিশ্বাস করোনা আমাকে? আমার বউকে লাল শাড়ীতে দেখার তৃষ্ণায় বুক ছটফট করে।তাইতো এই শাড়ী পাঠালাম,পছন্দ হয়েছে?রানীকে খুব মানাবে আমি জানি।এটা পড়লে তোমার রাজা রাজ্য জয়ের মতো খুশী হবে, কিন্তু একটা শর্ত আছে।

শর্ত হচ্ছে আমি আসার পরে শাড়ি পড়বে,আমি একটুও জ্বালাবো না প্রমিস,একদম ভালো ছেলে হয়ে চোখ বন্ধ করে রাখবো।শুধু নিজের হাতে তোমার কোমল পায়ে আলতা পড়াবো।সবশেষে একটা কথাই বলতে চাই কালকে তোমার রাজা কোনো প্রহরীবিহীন তার রানীর কাছে আসবে।বুঝা গেলো তো?
ভালোবাসা পাঠালাম এক আকাশ; মুঠো পুড়ে বুকে মিশিয়ে নিও সোনা।”

শ্যামা লজ্জায় রাঙ্গা হয়।শাড়ীটা বুকে চেপে বসে থাকে।পরের সারাটাদিন ছটফট করে কাটায়।রাতের পরে কেমন উশখুশ করে।বারোটায় ফোন আসে।শ্যামা একটা হলুদ থ্রীপিস পড়ে আছে।সে দরজা খুলে দেখে অন্ধকার গায়ে মেখে তার বিবাহিত বর দাঁড়িয়ে আছে।শ্যামাকে দেখে ফিরোজ মিষ্টি হেসে বললো,
“আসসালামু আলাইকুম হলুদপরী।”

ফিরোজ বিসমিল্লাহ বলে ভেতরে ঢুকে।শ্যামা দুরুদুরু বুকে আশেপাশে তাকিয়ে দরজা আটকে দেয়।
“আপনার একটুও ভ,য় লাগলো না?যদি আব্বা বা ভাইয়া দেখতো।”
ফিরোজ আয়েশ করে খাটে বসে গায়ের শার্ট পেছনে ঠেলে দেয়।
“শশুড়ের ভ,য়ে বউয়ের কাছে আসবো না?তা কি করে হয়।”

শ্যামার লজ্জা লাগছে,লজ্জায় লুকাতে ইচ্ছে করছে কিন্তু যার জন্য এই লজ্জার সমাহার সে’ই ভাবলেশহীন হয়ে আছে।ইতোমধ্যে সে খাটে হেলান দিয়ে শুয়ে পড়েছে।তার ব্যবহার দেখে মনে হচ্ছে যেনো অনেকবার এসেছে এই ঘরে।শ্যামা উশখুশ করে বললো,

“হুহ।”
ফিরোজ হেসে বললো,
“আরে!তুমি কি আমাকে লজ্জা পাচ্ছো মধুরানী?”
“আপনাকে লজ্জা পাবো কেনো?লজ্জা পাচ্ছি না।”
ফিরোজ গালে হাত দিয়ে বসে বললো,
“আচ্ছা,সাহসী রমনী।এবার শুরু করেন তো।”

“কি?”
“শাড়ী পড়া।”
“অসম্ভব।”
ফিরোজ উঠে দাঁড়ায়।
“অসম্ভব!তাহলে আমিই পড়াই কি বলো সুন্দরী! ”
শ্যামা পিছিয়ে যায়।ফিরোজ এগুনোর আগেই দরজায় শব্দ হয়।ফাতেমা বেগম শব্দ করে ডাকলেন,
“শ্যামা দরজা খুল।”

মধুমাস পর্ব ২৯

শ্যামা আর ফিরোজ স্তব্ধ হয়ে যায়। শ্যামা ফিরোজের হাত ধরে টানতে টানতে ঘরের এইপাশ ওইপাশ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
“আল্লাহ!এত্তোবড়ো জামাই কই লুকাবো?”

মধুমাস পর্ব ৩১