মন পাথরে হঠাৎ ঝড় সিজন ২ পর্ব ১৩
Tahrim Muntahana
বিকেলের শেষ ভাগ। সূর্যের অন্তিম মুহূর্তটা উপভোগ করছিলো কয়েকজন কপোতকোপতি। তার মধ্যে মৃহান-সুবাহ, আতইয়াব-হৃদযা ও রয়েছে। বর্তমানে তারা রিসোর্টের ছাদে অবস্থান করছে। এখানে আসার একদিন হয়ে গেছে। এখনো কোনো কাজ এগোয়নি। যে যার মতো সময় কাটাচ্ছে।
কারণ আদর-হৃদান। আদর চেয়েছিলো সে নিজের ডিরেকশন মতে রিসোর্ট টা সাজাবে। প্রোগ্রামের সকল কিছু সে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে করবে। আতইয়াব সায় জানিয়েছে। তার কাছে বোনের আনন্দের কাছে কোনো কিছুই নেই। যদিও বড় রা চেয়েছিলো নিজেদের মতো সাজিয়ে রাখতে কিন্তু আতইয়াব সরাসরি নিজের মতামত প্রকাশ করেছে। অনেকেই বাঁকা দৃষ্টি দিলেও পাত্তা দেয় নি সে। কি দরকার!
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
মৃহান সুবাহ কে দেখছে আড়চোখে। সে এখনো সরাসরি ভালোবাসার কথা বলেনি যদিও আকার ইঙ্গিতে সুবাহ ঢের বুঝেছে। সব সময় কি মুখে বলতে হবে নাকি। মানুষটা বুঝে নিক না। হঠাৎ করেই মৃহানের মনে ভয় জেঁকে বসে। অতিত যে সে সম্পূর্ণ ভুলতে পারেনি। এক নারীর ছলনার স্বীকার হয়ে যে তাকে নানা কটু পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। সেই পরিস্থিতি যদি ভবিষ্যতে চাড়া দিয়ে উঠে। সে সইতে পারবে না। একদম নিঃশেষ হয়ে যাবে।
শক্ত করে আকড়ে ধরে সুবাহ হাত। চমকে উঠে সুবাহ। ঠিক ঠাহর করতে পারে না হঠাৎ কি হলো। তবে সে মৃহানের আরেকটু কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। মৃহান শান্ত চোখে তাকিয়ে থাকে। চোখের দৃষ্টিতে কি ছিলো সুবাহ বুঝতে পারে না তবে ঈষৎ কেঁপে উঠে। শিতল শিহরণ বয়ে যায় শরীর জুড়ে।
মানুষ টা কিছু নিয়ে আপসেট? কথাটা মনে হতেই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় সুবাহ। মৃহান হাসার চেষ্টা করে; যা সুবাহ’র একটুও ভালো লাগে না। সে কি মানুষটার আপন হয়ে উঠতে পারেনি? হাত ছেড়ে দিয়ে সিড়ির দিকে হাঁটা ধরে। কিছুই বলে না মৃহান। সে অভিনয় করতে পারে না; তাই মিছে মিছে প্রেয়সীর রাগ ও ভাঙাতে পারবে না। আগে নিজের ভেতর টা একটু ঠিক হোক তারপর না হয় যাবে। একটু কাঠখড় পোড়াতে হবে; ক্ষতি কি তাতে! মেয়েটি যে একান্তই তার!
ছাদের এক কোণায় বসে আছে আতইয়াব-হৃদযা। হৃদযার মুখ মলিন; হাসি টাও মলিন। আতইয়াব জানে তার কারণ। ঘাটাতে চাই না সে । সে যে নিশ্চিন্ত তা নয়! তার ও চিন্তা হচ্ছে, মনের মধ্যে নানা কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। আদর তাকে কিছুই বলেনি। বাহাদুর কে হুমকি-ধামকি দিয়েও খুব একটা লাভ সে করতে পারেনি। ব্যাটায় বস-মেম ছাড়া কিচ্ছু বুঝে না। সেই যে সেদিন কথা হয়েছে মধ্যে এক রাত চলে গিয়ে আবার রাত চলে এলো আদরের পাত্তায় নেই। ফোন ও ধরছে না।
আতইয়াব এত মানুষ রেখে যেতেও পারছে না। আদর নিজেও হুমকি দিয়েছে এমন কাজ যেন না করে। ছোট্ট দম নিয়ে আতইয়াব হৃদযাকে নিজের কোলে বসিয়ে দেয়। হুট করে এমন হওয়ায় হৃদযা তাল সামনে না পেরে আতইয়াবের কাঁধ খামচে ধরে। শান্ত চোখে তাকিয়ে থাকে। আর মাত্র ক’দিন তারপর এই মেয়েটা সম্পূর্ণ তার। যার মুখ দেখেই সে সকাল শুরু করবে। ভাবতেই মনটা পুলকিত হয়ে গেলো আতইয়াবের। সকল চিন্তা ভুলে প্রেয়সীর মন ভালো করতে লেগে গেল। আদরের উপর সে চোখ বন্ধ বিশ্বাস করতে পারে।
আচ্ছা হৃদু বিয়ের পর কোথায় ঘুরতে যাবে। দেশের কোথাও নাকি এব্রুড?
হৃদযা আতইয়াবের কথায় ভ্রু কুচকায়। বিয়ে হতে আরো কয়েকটা দিন বাকি এখনি ঘুরার চিন্তা। হৃদযা কিছু একটা ভেবে মুচকি হেসে বলে উঠে,
আপনার তো হার্ট কাটতেই সময় যায়; ঘুরতে যাওয়ার সময় আছে নাকি?
আতইয়াব বুঝতে পারলো হৃদযার মনের সুক্ষ্ম অভিমান টা। কত কত বার হৃদযার সাথে দেখা করবে বলে অপারেশন রুমে ঢুকতে হয়েছে হিসেব ছাড়া। কখনো জানিয়ে দিতে পারতো আবার কখনো সেই সুযোগ টাও মিলতো না। মেয়েটা অপেক্ষা করতে করতে মলিন মুখে চলে যেত। কখনো কখনো বুঝতে পেরেও অপেক্ষা করতো যদি হুট করে চলে আসে! তবুও কোনো অভিযোগ করেনি। সে নিজেও মুচকি হেসে বলল,
আমার একমাত্র অর্ধাঙ্গিনীর জন্য তো আমার জান হাজির! তবে অন্যজনের জান তো নয়। আর আমার পেশাটা অত্যন্ত সম্মানীয় পেশা হৃদু। কতটা পরিশ্রম করতে হয়েছে আজকের পজিশনে আসতে তোমাকে নিশ্চয়ই বলতে হবে না। এতটা পরিশ্রম শুধু মাত্র নিজের স্বপ্ন পূরণ আর মানুষকে সু চিকিৎসা দেওয়ার জন্য। এখন আমিই যদি নিজের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে এতদিন থাকি তবে লাভ টা কি বলো?
হৃদযা নিজেও বুঝে। ওইযে বলে না প্রেম মানুষকে আবেগী বানিয়ে দেয়। হৃদযাও অনেক সময় আবেগী হয়ে বলে উঠে। আর আতইয়াব সবটা সময় এভাবে বুঝায় কখনোই রেগে যায় না। হৃদযা শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আতইয়াবের গভীর চাহনীর দিকে। আতইয়াব পরিস্থিতিটা পাল্টাতে চাইলো। কতক্ষণ মনমরা হয়ে বসে থাকবে!
কিন্তু হলফ করে বলতে পারি আমার বউয়ের সাথে রোমান্সের সময়ে স্বয়ং নরেন্দ্র মোদী এসে ডাকলেও যাবো না। রসহীন জীবনে রসের বড্ড অভাব। একদম আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখবো।
আতইয়াবের কথায় হৃদযা লজ্জায় মাথা নিচু করে নিলো। আতইয়াব নিজেও ঘোরের মধ্যে চলে গেছে। ঠিক তখনই ঠুসসস করে একটা শব্দ হয়। চমকে যায় দুজনে। পাশে চোখ যেতেই দুজনের চোখ বড় বড় হয়ে যায়। কান্চু পেছন ঘুরে হালকা বাঁকা হয়ে বায়ু নির্গত করে দিয়েছে।
তার ই শব্দে ধ্যান ভাঙলো দুজনের। দুজনই একে অপরের দিক তাকিয়ে নাক চেপে ধরে উঠে দাঁড়ায়। ছিহ গন্ধ! কান্চু দাঁত কেলিয়ে হেসে যেই না কথা বলবে আতইয়াবের রাগান্বিত মুখশ্রী দেখে উল্টো ঘুরে এক দৌড়। আতইয়াব ধরতে যেয়েও পারে না। হৃদযা কিছুক্ষণ চুপ থেকে হো হো করে হেসে দেয়। আতইয়াবের মুখশ্রীও নরম হয়ে আসে। প্রেয়সী কে হাসানোর জন্য হলেও কান্চুর ধন্যবাদ প্রাপ্য।
চারদিক এত এত ভালোবাসার জুটি দেখে রামিয়ার মনে ধাক্কা খেল ভিষণ ভাবে। আজ রাফিন থাকলে তারাও বুঝি এভাবে সূর্যাস্ত দেখতো! হাতে হাত রেখে কতশত প্রেমময় বাণী আওড়াতো! দুজন দুজনার চোখে হারিয়ে যেত কিছু সময়ের জন্য। দুজনের ঠোঁটের কোণেই মুচকি হাসি বিরাজ করতো। ভবিষ্যতের এক প্রেমময় বন্ধনের কল্পনায় বিভোর থাকতো!
তাচ্ছিল্য হাসে রামিয়া। তার ভাবনার সত্য রূপ কখনোই সম্ভব না। সে তো একপাক্ষিক কল্পনা সাজাচ্ছে। যা রাফিনের কাছে হাস্যকর ব্যাপার। সে একাই ভালোবেসে গেল; একাই বিরহে দগ্ধ হলো অথচ চাইলেই আজকের মুহূর্ত টা সুন্দর হতে পারতো। ছোট্ট শ্বাস ফেলে আকাশের দিকে তাকায় সে। সূর্যের রক্তিম আভায় সে রাফিন কে দেখতে পায়। জ্বলজ্বল করছে মুখখানা। দৃষ্টি নামিয়ে নিয়ে হাঁটা ধরে। একপাক্ষিক ভালোবাসা বড্ড পোড়ায়!
সিড়ির ঠিক সামনে এসেই পিয়ানির সাথে দেখা হয়। পিয়ানি মুখ বেঁকালেও রামিয়া মুচকি হাসে। মেয়েটা অযহত পেইন নিচ্ছে। মেয়েটার এমন ব্যবহারে তার উপর এখন কোনো প্রভাব পড়ে না। সে নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত। কে তাকে পছন্দ করলো কে করলো না কিচ্ছু যায় আসে না। পিয়ানি রামিয়ার হাসি দেখে অবাক হয়। এরা দুই বোন কি পাগল? একেক সময় একেক রকমের রিয়েকশন দেয়।
অপমান করলেও হাসে! কেমনে পারে এসব ভাবতে ভাবতেই আস্তে আস্তে পা ফেলে আতইয়াবের কাছে যাচ্ছিলো পিয়ানি। ঠিক তখনি কারোর সাথে ধাক্কা খেয়ে ঠাসস করে পড়ে যায় সে। একটু জোরে শব্দ করতেই এগিয়ে আসে আতইয়াব। পিয়ানি কান্চুকে দেখেই রক্তচক্ষু নিয়ে তাকায়। রাগে তার শরীর রি রি করছে। কান্চু দাঁত কেলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কিছু বলে না। হঠাৎ ঠাসস করে পাদ মেরে বলে উঠে,
এটার ই অপেক্ষা করছিলাম। যাই হোক মুখ বেঁকানোর শাস্তি এটা। মিস ক্রাশুর বোনের সাথে রাগ দেখালে তোকে পাদ মেরে উড়িয়ে দিবো ডাকপিয়ন।
পিয়ানির মুখ রাগে থম থম করছে। বেশী ব্যাথা না পেলেও কিছুটা ব্যাথা সে পেয়েছে। তার উপর তাকে পিয়ন ডাকছে। গর্জে উঠে পিয়ানি,
হোয়াটটট! পিয়ন কে? তোকে আমি মেরেই ফেলবো!
কান্চু হো হো করে হেসে দেয়। যেন জোকস শুনছে।
পিয়ানি থেকে পিয়ন তোর সাথে এটাই যায় বেঁকা মেয়ে।
কান্চু দৌঁড়ে চলে যায়। এতক্ষণ আতইয়াব মুখ টিপে হাসছিলো। পিয়ানি তাকাতেই অন্যদিক তাকিয়ে রইলো। পিয়ানির রাগ গিয়ে সম্পূর্ণ পড়লো রামিয়ার উপর। আতইয়াব তাকে আগের মতো ভালোবাসে না! ভেবেই নিলো সব দোষ আদর-রামিয়ার! ওই দুটোকে তো সে দেখে নিবে।
গাড়িতে পাশাপাশি বসে আছে আদর-হৃদান। হৃদানের জেদের কারণেই হসপিটাল থেকে চলে আসতে হলো। তাকে সবাই ভুল কথা বলেছিলো। এক্সিডেন্টে হৃদানের পা ভেঙে গেছে। পুরো এক মাসের মতো সময় লাগবে ভালো হতে। মাথাতেও লেগেছে। আদরের সে কি কান্না। দিন-দুনিয়া ভুলে হৃদানকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে। হৃদান থামায় নি। সে বুঝতে পেরেছিলো মেয়েটি ভেঙে পড়েছে। নিজের প্রতি ভালোবাসার মানুষটার আকুলতা কে না দেখতে চায়! হৃদান ও ব্যতিক্রম নয়; সে তো কোনো মহাপুরুষ নয়।
ড্রাইভিং করছে আদর। পাশেই হৃদান অপলক দেখছে তাকে। আদর কিছুক্ষণ পরপর কটমট চোখে তাকালেও খুব একটা লাভ হয় না; বিনিময়ে হৃদান গা জ্বালানো হাসি উপহার দেয়। এতে আদর আরো রেগে যায়। হৃদান চেয়েছিলো ড্রাইভিং করতে; হাতের তো কিছু হয়নি। আদর দেয় নি তাইতো সে এভাবে জ্বালাচ্ছে। আদর দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠে,
সময় আমারো আসবে তখন আপনাকে দেখাবো মজা। আগে রিসোর্টে যেতে দিন।
হৃদান হো হো করে হেসে দেয়। হৃদানের কাছে দুজনকে বাচ্চা লাগছে। এই একদিন দুজনের ঝগড়া লেগেই ছিলো। এ বলে এটা করতে তো ও বলে এটা না করতে। একদম টম জেরীর মতো সম্পর্ক হয়ে গেছে। কথাগুলো ভাবনার মাঝেই গাড়ি থামায় আদর। এখনো আঁধার নামেনি। সবকিছু ভালো ভাবেই দেখা যাচ্ছে। আদর সেই কখন নেমে হুইল চেয়ার রেখে দাঁড়িয়ে আছে হৃদানের কোনো খেয়াল ই নেই।
আদর কিছু একটা ভেবে দরজা খুলে জোরে এক চিৎকার দিতেই ধড়ফড়িয়ে উঠে হৃদান। আদর হো হো করে হাসছে; হৃদান চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে আদরের সাহায্যে হুইল চেয়ারে বসে পড়ে। বাহাদুর কে ইশারা করে আদর এগিয়ে যায় ভেতরের দিক। দুজনের বুকের ভেতরই টিপটিপ করছে। কে জানে সবার রিয়েকশন কেমন হয়। ভালো হবে না ঢের বুঝতে পারছে। আদর এসব ভাবতে চায় না বলে হৃদান কে ঠেস দিয়ে বলে উঠে,
উপর ওয়ালাই জানে এই ৮০ মণ বস্তা কে কতদিন টানতে হয়।
হৃদান ভ্রু কুঁচকে তাকায় যখন বুঝতে পারে আদর তাকেই ৮০ মণ বলেছে তখন দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠে,
যতদিন পৃথিবীতে আছেন ততদিন। আমার ভার আপনাকে সারাজীবন বহন করতে হবে। বিয়ের আগে অন্যভাবে আবার বিয়ের পর অন্যরকম ভাবে!
শেষের কথাটা হৃদান দুষ্টু হেসেই বলে। আদর লজ্জায় মাথা নিচু করে নেয়। এই লোকটা ঠোঁট কাটা স্বভাবের সে ভুলেই গিয়েছিলো। আদরের লজ্জা পাওয়া দেখে হৃদান মুচকি হাসে। তাদের সম্পর্ক টার কি নাম দেওয়া যায়। কোনটা দিলে বেশী সুট করবে! ভাবতে ভাবতেই মাথায় আসে ঝড়! হ্যাঁ আদর নামক ঝড় টা এসেই তাকে অনন্য এক সুখের রাজ্যে ভাসিয়ে নিচ্ছে। এক অপার্থিব আনন্দ বয়ে এনেছে এই ঝড়!
কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই বড় গেইট পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো দুজন। পেছন পেছন আসছে বাহাদুর টিমস। পুরো রিসোর্ট ই হৃদানের গার্ড দিয়ে ঘেরাও করা। কোনো প্রকার সে রিস্ক সে নিতে চায় না। আদর দের আসতে দেখেই আতইয়াব ওরা দৌড়ে নিচে নেমে এলো। ততক্ষণে আদর বিল্ডিং এ ঢুকে পড়েছে। ভাইয়ের এরকম অবস্থা দেখে হৃদযা মৃহান একেরপর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। আদর নিপুণ ভাবে সবাইকে সামলে হৃদান কে রুমে রেখে আসে। অনেকটা জার্নি করেছে এবার একটু রেস্ট নিক।
আদর নিজের জন্য পছন্দ সই একটি রুম নিয়ে নিজের মতো গুছিয়ে নেয় সবকিছু। পাশের রুমেই হৃদানের রুম সিলেক্ট করেছে সে। আজ কিছু করবে না; কাল সকাল থেকে সব কাজ শুরু করবে। কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে। গোসল করা হয়নি; ফ্রেশনেস দরকার। অন্যদিকে হৃদানের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে আছে হৃদযা। এইতো কিছুক্ষণ আগে এসেছে। সবার সামনে না কাঁদলেও একা একা কাঁদছে সে। তার বিয়ে নিয়ে হৃদানের যে বড্ড আশা ছিলো।
এটা করবে, ওটা করবে অথচ বিয়ের দু’দিন আগে এক্সিডেন্ট করে বসলো। ফ্যাচফ্যাচ শব্দে নড়ে উঠে হৃদান। কেবলই হালকা চোখ লেগে এসেছিলো। পিটপিট করে চোখ খুলে হৃদযা কে পাশে বসে কাঁদতে দেখে মুচকি হাসে। তার বোন কেমন সে জানে তো। হৃদান কে উঠতে দেখেই হৃদযা তড়িঘড়ি করে চোখের পানি মুছে নেয়। ধরে আধশোয়া করে বসিয়ে দেয়। হৃদান হৃদযাকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠে,
আমার কিচ্ছু হয়নি পাখি। সামান্য একটু লেগেছে। কিছুদিন পরেই ঠিক হয়ে যাবো। তুমি কান্না করলে আমার ভালো লাগে?
ভাইয়ের আদুরে কথায় হৃদযা শব্দ করে কান্না করে দেয়। ঠিক তখনি আতইয়াব একপ্রকার হামলে পড়ে ঘরে। বিরক্তি সুরে বলে উঠে,
দিলেন তো আমার বউ টাকে কাঁদিয়ে। আপনার কান্ডজ্ঞান বলতে কিছুই নাই। আরে ব্যাটা তোর বউ কি পালিয়ে যাবে যে যখন তখন ভাবতে হবে। ওরে প্রেম; ঠিকমতো গাড়িও চালাতে পারে না প্রেমিকার ভাবনায় মশগুল থাকে। আর কষ্ট করতে হয় আমাকে!
দুই জনই আতইয়াবের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। আতইয়াবের কেন কষ্ট হবে। ওদের চাহনী দেখেই আতইয়াব ভাবালেশ বলে উঠে,
আমার বোন, আমার বউ আপনার জন্য চোখের জল ফেলবে আমার বুঝি কষ্ট হয় না?
হৃদান হেসে দেয়। তার জন্য আতইয়াবের চোখে সে দুশ্চিন্তা দেখছে। আতইয়াব বিরক্তি ভাব নিয়ে হৃদান কে একবার চেকাপ করে। নাহ; ঠিকই আছে। শুধুমাত্র কিছুদিন হাঁটতে পারবে না এই যা! ডক্টরি সরঞ্জাম রেখে বলে উঠে,
আসুন আপনাকে গোসল করিয়ে দিই; বাবু হয়েছেন তো। বুড়ো বাবুকে গোসল করিয়ে দিতে হবে।
চল ভাই তোকে ছোটবেলার মতো গোসল করাবো ন্যাংটো করে!
আতইয়াবের কথা শেষ হতেই মৃহার ঘরে ঢুকতে ঢুকতে কথাটা বলে উঠে। পেছনেই আদর আর সুবাহ দাঁড়িয়ে ছিলো। আদর কে দেখেই হৃদানের কাশি উঠে যায়। খুকখুক করে কেশে উঠে। হৃদযা-সুবাহ সহ আতইয়াব-মৃহান ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠে। দারুণ মজা পেয়েছে। হৃদান ভাইয়ের দিকে কটমট চোখে তাকিয়ে বলে উঠে,
তোমাকেও মা ঠিক আমার মতোই গোসল করাতো তাই ভাব নিও না।
মৃহান এবার চুপসে যায়। কথাগুলো নিজের দিকে আসতে পারে ভেবেই হৃদান তাড়া দিয়ে ওয়াশরুমে নিয়ে যায়। হৃদানের লজ্জা পাওয়া দেখে আদর কিছুক্ষণ পরেই লজ্জামাখা হাসি দিয়ে চলে যায়। দিনগুলো এত ভালো যাচ্ছে কেন? মনে হচ্ছে পৃথিবীর মাঝেই সে কোনো স্বপ্নের রাজ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে! এ সুখ সইবে তো?
অন্ধকার ঘর । জুতোর ঠকঠক শব্দ। হাঁটার গতির সাথে শব্দ গুলোও বিকট হচ্ছে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে অতিরিক্ত টেনশনে পাইচারি করছে। কিছুক্ষণ পর আরেকজনের হাঁটার শব্দ আসতেই সে পাইচারি থামিয়ে দেয়। ভয়ে সিটিয়ে যায় সে। কি জবাব দিবে? শব্দ টা যত কাছাকাছি হচ্ছে ভয়টা ততই বেড়ে যাচ্ছে। একসময় শব্দ থেমে যায়। মাথা তুলে তাকাতেই রক্তচক্ষু দেখে আবার মাথা নামিয়ে নেয়। কাঁপা কন্ঠে বলে উঠে,
বিশ্বাস করো আমি সব ব্যবস্থা করেছিলাম। কিন্তু ওই হৃদান সুযোগ বুঝে গাড়িটা ঘুরিয়ে দেয়। চিন্তা করো না বিয়েতেই কিছু একটা করবো আমরা!
খবরদার বিয়েতে কিছু করবি না। ওই আদর-হৃদান উঁত পেতে আছে। বিয়েতে কিছু করলেই ধরা পড়ে যাবো। বিয়ের পর করবো যা করার। কাউকে বিশ্বাস হয় না আমার; এখন থেকে যা করার আমিই করবো।
চিৎকার করেই কথাগুলো বলে চলে যায় বস নামক লোকটি। সে চলে যেতেই অপর লোকটি বিড়ডিড় করে কিছু বলে নিজেও চলে যায়। আস্তে আস্তে পা ফেলে এগিয়ে যায় তবে হুট করে তার সামনে কয়েক জোড়া পা দেখে থমকে যায় সে। মস্তিষ্ক বলছে পালাতে হবে। উল্টো ঘুরে দৌড় দিতে যাবে তখনি সামনে দাঁড়ায় বাহাদুর। বিশাল শরীরটার সাথে ধাক্কা খেয়ে লোকটা মাটিতে পড়ে যায়। বাহাদুর শরীর দুলিয়ে হেসে উঠে। তার এই শরীর টা নিয়ে তার যে কি পরিমাণ গর্ব হয় বলার বাহিরে। সামনে দাঁড়ানো পান্চুর দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,
বস দেখছিস বস! শরীর দেখেই অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার উপক্রম। আর তোর মতো টাকলা কে দেখে একটু শুধু ভয় পায়। সম্মান দিয়া কথা বলবি!
বস! দাঁড়া তোর বসগিরি ছুটাচ্ছি। বসকে ফোন দিবো?
বাহাদুর ঢোক গিলে নড়েচড়ে দাঁড়ায়। বসকে সে জমের মতো ভয় পায়। বাহাদুরের এক্সপ্রেশন দেখে পান্চু কিটকিটিয়ে হেসে ফোন দেখাতেই বাহাদুর বলে উঠে,
ওমন করস কেন। তুই না আমার বন্ধু। আমি তোকে কত ভালোবাসি জানস? যা তোকে আমার এক্স আছিরন আছু আক্তার আশা ফুলবানু মধু কে দিয়ে দিলাম!
আছিরনের কথা বলতেই পান্চু রেগে বাহাদুরের মাথায় দিলো এক বারি। বাহাদুর কিছু বলার আগেই নিজের টাক মাথাতেও দিলো এক বারি। এ যেন আছিরনের প্রতি ঘৃণার নিরব প্রকাশ। আর সবাই এদের দুইজনের কান্ড দেখে মাথা চাপড়াচ্ছে। এরা দুজন এক হলেই এমন করে আবার আলাদা মিশন দিলেও বসের হাতে পায়ে ধরে একসাথে যায়।
ব্যাপারটা এমন যে একসাথে ও থাকতে পারে না আবার দূরেও থাকতে পারে না। ওদের দুইজন কে ওদের মতো ছেড়ে দিয়ে লোকটাকে নিয়ে ওরা চলে যায়। গাড়ির শব্দ হতেই ওরা দৌড়ে আসে কিন্তু লাভ হয় না বরাবরের মতোই ওদের রেখে চলে গেছে। দুইজন আবার এক হয়ে সবার গোষ্ঠী উদ্ধার করতে লেগে পড়ে!
সকাল ছয়টা বাজতে কিছুটা সময় বাকি। এলার্মের শব্দে লাফ দিয়ে উঠে আদর। দশ মিনিট লেট হয়ে গেছে। ঝটপট রেডি হয়ে নিলো সে। হৃদানকে একবার দেখতে যাবে ভাবলো। আবার কখন না কখন দেখতে পারবে কে জানে। যেই ভাবা সেই কাজ; পা চালিয়ে পাশের রুমটাই চলে আসলো আদর। দরজা ভিড়ানো। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই হৃদানের ঘুমন্ত মুখশ্রী নজরে পড়ে। বুকে দুই হাত গুজে ঘুমাচ্ছে। আদর এগিয়ে গেলো।
কড়া ডোজের ঔষধ খাওয়ায় গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে হৃদান। মুখটা হালকা খসখসে হয়ে গেছে। কয়েকদিন যে যত্ন নিতে পারেনি সে বুঝলো। তবুও তার কাছে সামনের পুরুষ টাকে অতি সুদর্শন লাগছে। হঠাৎ এক নিষিদ্ধ ইচ্ছা জাগলো তার মনে। একটু ছুয়ে দেখার প্রবল ইচ্ছাটাকে দমাতে না পেরে হৃদানের কপালে ডিপলি ঠোঁট ছোঁয়ালো। আদরের ভিষণ ভালো লাগছে। আদর দ্বিতীয় বার হৃদানের গালে শব্দ করে চুমু খেয়ে হেসে উঠলো।
নিজেকে চোর মনে হচ্ছে তার। প্রেম চোর! আবার হেসে উঠলো সে। এই মানুষটার সাথে থাকলে সে নিজেকেই হারিয়ে ফেলে। নানা রকম অদ্ভূত ইচ্ছা মনের সাথে সাথে মস্তিষ্কে বিচরণ করে। পাগল পাগল লাগে নিজেকে। আজ যেন ঘুমন্ত পেয়ে ইচ্ছাটাকে পূরণ করেই নিলো। একপলক দরজার দিকে তাকিয়ে হৃদানের বুকের উপর মাথা রেখে শুয়ে পড়লো আদর। বুকটার ভেতর এত জোরে ঢোল বাজছে যে শুয়ে থাকা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে।
হৃদান হালকা নড়তেই আদর চমকে উঠে দাড়ালো। একপলক হৃদান কে দেখেই ছুটে বেরিয়ে গেলো। ইশশশ কি লজ্জা! দেখে ফেললে লোকটা তাকে লজ্জা দিয়েই যেত। আদর কে বের হয়ে যেতে দেখেই আড়াল থেকে বের হয়ে আসলো হৃদযা। সে সবটাই দেখছিলো। ফোনে ভিডিও করেও নিয়েছে। ভাই কে পরে দেখাবে সে। কাজ টা করতে পেরে যেন সে গর্বিত ফিল করছে। বাঁকা হেসে প্রস্থান করে হৃদযা।
সময় গড়িয়ে চলছে খুব তাড়াতাড়ি। সকাল দশ টা বেজে গেছে। সবাই ঘুম থেকে উঠে নিজেদের মতো সময় কাটাচ্ছে। কারোরই কাজের ঝামেলা নেই কারণ সব দায়িত্ব একা আদর নিয়েছে। এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছে আদর। ঘেমে একাকার অবস্থা। একটু পর পর ফোনে ডিরেকশন দিচ্ছে আর একটু পর পর নিজে হাতে করে দিয়ে কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছে। বাহাদুর আর পান্চুকে হুমকির উপর রেখে কাজ করাতে হচ্ছে।
এরা একটু পর পরই ঝগড়া লাগিয়ে ফেলে। আর কান্চু তো কিছুক্ষণ পর পর দূরে গিয়ে বায়ু নির্গত করে আবার আদরের পিছু পিছু ঘুরছে। আদর বলে দিয়েছে আরেকটা শব্দ যদি সে করে একদম তুলে আছাড় দিবে। আদর রামিয়াকেও কাজে লাগিয়ে দিয়েছে। বসে থাকার কোনো কারণ দেখছে না । তার বোন সবার সাথে আড্ডাও দিবে না তাই কাজ করুক মন ভালো থাকবে। উপর থেকে নাবিল চৌধুরী আদর কেই দেখছিলো। কিছুদিন আগেও মেয়েটিকে সে দেখতে পারতো না অথচ এখন চোখে হারায়।
অনেকক্ষণ হলো হৃদান ঘুম থেকে উঠেছে। মৃহান এসে ফ্রেশ করিয়ে দিয়েছে। আদর ই তাকে বলেছে যদিও। ঘরের মধ্যেও বসে থাকতে ইচ্ছে করছে না তার। আশে পাশে কাউকে দেখতে না পেয়ে হৃদান ফোন লাগায় পান্চুর কাছে। পান্চু আর দেরী করে না দৌড়ে বসের কাছে চলে আসে। কে জানে কোনো সমস্যা হলো না তো!
মন পাথরে হঠাৎ ঝড় সিজন ২ পর্ব ১২
এত তাড়াতাড়ি পান্চু কে দেখে হৃদান হাসে। হুইল চেয়ারের দিকে ইশারা করতেই পান্চু ধরে বসিয়ে দেয়। ঢোক গিলে বেরিয়ে যায়। একজন বলে খবরদার হৃদ যেন এখানে না আসতে পারে। আবার আরেকজন বলে খবরদার আমার কথা অমান্য করলে তোর জীবনের শখ মিটিয়ে দিবো। কোন দিকে যাবে সে নিজেই বুঝতে পারে না। দেখা যাক নিচে গিয়ে কি হয়…!