মেজর পর্ব ৪

মেজর পর্ব ৪
জাকিয়া সুলতানা ঝুমুর

সাপ্তাহ পেরিয়ে গিয়েছে কিন্তু পা,ষাণ মানুষ ভুল করেও মিতুকে ফোন দিচ্ছে না।সেই যে যাওয়ার দিন রাতে উনপঞ্চাশ সেকেন্ড কথা হয়েছিলো আর একবারও মুশফিক ফোন দেয়নি।মিতুর মোবাইলে মুশফিকের ফোন নাম্বারটা আছে কিন্তু সে ফোন দেয়নি,সাধারণত স্বামীই স্ত্রীকে ফোন দিয়ে খোঁজখবর নেয়,তাছাড়া সে নতুন বউ তাকে তো আরো বেশী ফোন দেয়ার কথা তাহলে সে কেনো ফোন দেবে?ফোন দেয়ার দায়িত্ব তো মুশফিকের।

অথচ উনি লাপাত্তা।যদিও মিতুর মন আকুলিবিকুলি করে; গম্ভীর কন্ঠ শুনতে ইচ্ছে হয় তারপরও সে ঝিম মে,রে চুপচাপ থাকে,মনকে বোঝায় ওই বদ লোক তোর প্রেমিকা না মিতু এতো ছটপফটের কিছু নেই।’ উপরে এতো পকপক করলেও মিতু খুব করে চাইছিলো মুশফিক ফোন দিক,অশান্ত মন শান্ত হোক কিন্তু এই সাতদিন মুশফিক ফোন দেয়নি,মিতুর অপেক্ষা দীর্ঘ হয়।বারবার মুশফিকের নাম্বারটা দেখে।সারাদিন কানে বাজে উনপঞ্চাশ সেকেন্ড ফোনকলের কথাবার্তা।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সেদিন মুশফিক চলে যাওয়াতে মিতুর মন ছিলো বিষন্ন।রাত তখন এগারোটা ছুইছুই।খোলা আকাশের নিচে যেতে মনটা খুব চাইছিলো, ইচ্ছে করছিলো খোলা ছাদে চাঁদের আলো গায়ে মাখতে তাতে যদি মন খারাপের মাত্রা কমে কিন্তু মিতুর দাদী নিলু বেগমের কড়া নির্দেশ বিয়ের বছর বাহিরে উড়নচণ্ডী হয়ে ঘুরাঘুরি করা যাবে না,বিয়ের বছর খারাপ জিনিসের নজর লাগলে নাকি সারাজীবন এর দোষ কাটানো যায় না।

মিতু যদিও এসব কুসংস্কার মানে না কিন্তু তার দাদীকে খুব মানে,সেই মানা থেকেই ছাদে গেলো না,উনি দেখলে খুব বকা দেবে,এমনিতেই তার মন খারাপ এখন যদি আবার বকা শুনে তাহলে ব্যাপারটা খুবই বি,শ্রী হয়ে যাবে।মিতু ভাবে কোনো একদিন বোকা, আনরোমান্টিক মেজরের সাথেই রাতের নির্জন পথে হাটবে,কনিষ্ঠ আঙ্গুলের সাথে আঙ্গুল চেপে গুনগুনিয়ে গান গাইবে,রাতের পাখির উড়ার দেয়ার শব্দে গা ছমছমানো পরিবেশে মেজরকে জড়িয়ে ধরবে।মেজর চলে গিয়েছে প্রায় একদিন হয়ে যাচ্ছে কিন্তু একটাও ফোন করেনি উনার কি একবারও তার কথা মনে হয়নি?

তখনি হাতের পাশের মোবাইল মৃদু কেঁপে ওঠে।মিতুর অবচেতন মন যেনো এই একটামাত্র ফোনকলের অপেকক্ষাই ছিলো,সে ফোনটা কানে ঠেকায়,নাকমুখ দিয়ে নিঃশব্দে চেপে ধরে রাখা নিঃশ্বাস বের করে চুপ করে থাকে।
মুশফিক মাত্রই বাসায় ফিরেছে,আজকে সারাদিন খুব ব্যস্ত ছিলো,কোনোদিকে তাকানোর ফুসরত মিলেনি।গোসল করে কড়া লিকারে এক কাপ চা বানায়,চা হাতে লম্বা লাগোয়া বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়।রাতের পাহাড়ি ঠান্ডা বাতাস হু হু করে গা ছুঁয়ে যায়।

মুশফিক চোখ বন্ধ করে জোড়ে জোড়ে কয়েকবার শ্বাস নেয়।ঠান্ডা বাতাসে গা ছুঁয়ে গেলেও মন ছুঁতে পারেনি,মনের হয়েছে ভিন্ন অসুখ,মুশফিক হলফ করে বলতে পারে অসুখটা আজকেই হয়েছে।অসুখটার নাম হলো মন ছটফটে অসুখ।মুশফিক দূর পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে ভাবে সারাদিনে একবার হলেও মিতুকে ফোন দেয়া দরকার ছিলো কিন্তু জরুরী মিটিংয়ে ফোনকল নো এলাউড।তাছাড়া সে মেজর হয়ে যদি নিয়ম ভঙ্গ করে তাহলে বাকি সেনারাও তা শুরু করবে,কাজের ব্যাপারে মুশফিক খুব সতর্ক।অনেক ভেবে সে মিতুকে ফোন দেয় আর সাথে সাথেই রিসিভ হয়ে যায় যেনো মেয়েটা এই ফোন কলের অপেক্ষায়ই ছিলো।মুশফিক হাসে,চঞ্চল মেয়ে কি তার অপেক্ষায় ছিলো?দুজনেই নিরব।মুশফিক নিরবতা ভেঙ্গে গমগমে কন্ঠে মিতুর অন্তর কাঁপিয়ে বললো,

“হ্যালো!আসসালামু আলাইকুম।”
মিতু নিজের বর্বরতায় নিজেই খিচে চোখ বন্ধ করে নেয়,সালাম দেয়া দরকার ছিলো।মুশফিক ফোনের মাঝেই মিতুর চুপসানো চেহারা দেখতে পেলো কিন্তু মিতুকে কোনো প্রকার লজ্জা না দিয়ে স্বাভাবিকভাবে বললো,
“ভালো আছো?”
“ভালো।”

আপনি কেমন আছেন?এই কথাটা বলার সাহস মিতুর নেই,মেজরের গলার স্বর শুনেই যেনো গলা শুকিয়ে গিয়েছে।অথচ মেজর কেমন আছে তা জানার জন্য মন ব্যাকুল হয়ে আছে।
মুশফিক বললো,
“আমি ভালো আছি।সারাদিন ব্যস্ত ছিলাম বলে ফোন দিতে পারিনি।ডিনার করেছো মিতু?”
উনি কিভাবে বুঝলো মিতু কি জানতে চায়!মন পড়তে পারে নাকি বোকা পুরুষ!মেজরের কৈফিয়ত দেয়ার ব্যাপারটা মিতুর ভালো লেগেছে।সে বললো,

“খেয়েছি।আপনি খেয়েছেন?”
“না।মাত্র গোসল করলাম।এখন চা খাচ্ছি।”
“এতো রাতে চা খেলে ঘুমাবেন কখন?”
“আজ রাতে তো ঘুমাতে পারবো না।হাতে অনেক কাজ,রাত জেগে কাজ করতে হবে।”
মিতু চুপ করে থাকে।মুশফিক নিজেও আর কোনো কথা খুঁজে পায় না,মুখ ফুঁটে বলতে পারে না সারাদিন খুব মনে করেছে।মিতুর নিশ্চুপতা দেখে সে বললো,

“ঠিকঠাক নামায পড়বে,ঠিকঠাক খাবার খাবে।”
“আচ্ছা।”
গম্ভীর মানুষ তার স্বভাব অনুযায়ী গমগমে কন্ঠে বললো,
“নিজের খেয়াল রেখো।ভালো থেকো।রাখছি মিতুল।”
কট করে ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়।ফোনের ডিউরেশন দেখে মিতু অবাক হয়,এতো সংক্ষিপ্তও কথোপকথন হয়?তার ইচ্ছে করছিলো আরো কথা বলতে কিন্তু মেজর যে কথা বলতে ইচ্ছুক না।মিতু ভাবে উনি মেজর হলো কি করে?মাথায় একটুও ঘিলু নেই উনি আবার মেজর!

বউয়ের সাথে কিভাবে মিষ্টি আলাপ করতে হয় সেটাও বুঝেন না নাকি?উনাকে কি শিখাতে হবে কিভাবে আলাপ করতে হয়?মিতুর ইচ্ছা করলো নিজের কপাল নিজে চাপড়াতে,তার মতো কথা পাগল মানুষের সাথে কিনা এমন মানুষ জুটলো যাকে আলাপের ট্রেনিং দিতে হবে!মিতু মনে মনে কল্পনা করলো মেজরকে সে মিষ্টি আলাপের ট্রেনিং দিচ্ছে।ভাবতেই মিতু হেসে উঠলো।উনপঞ্চাশ সেকেন্ডের কথোপকথনে তার মন ভালো হয়ে গেছে।সে শান্ত মনে ঘুমাতে যায়,কানে বাজে মুশফিকের বলা কথাটা,” ভালো থেকো মিতুল”

কিন্তু এর পর থেকে প্রতিনিয়ত অপেক্ষায় থেকেছে কিন্তু কোনো ফোন আসেনি।মনে মনে খুব চেয়েছে উনপঞ্চাশ সেকেন্ডএর ফোনই আসুক কিন্তু আসেনি।আর এই না আসার আজ এক সাপ্তাহ।
আজ সাহেরা খাতুন পুত্রবধূকে বাসায় নিয়ে গিয়েছে।ছেলে নেই তাতে কি মেয়েটা উনার কাছেও থাকবে এটাই উনার ইচ্ছা।ছেলে কাছে নেই বলে যেনো মিতুর মনে একাকীত্ব ভর না করে সে কারনেই মূলত মিতুকে সঙ্গ দেয়া।মেয়েটা এতো চঞ্চল আর মিষ্টি কিন্তু উনি একটা ব্যাপার খেয়াল করলেন যে মিতু যেনো কেমন বিষন্ন হয়ে আছে।উনি বললেন,

“মুশফিকের সাথে তোমার কথা হয় মিতু?”
মিতু মাথা নেড়ে না জানায়।মুখে বললো,
“না।আম্মু।”
“কতোদিন ধরে?”
মিতু মিনমিন করে বললো,
“এক সাপ্তাহ।”
সাহেরা খাতুন মিতুর মাথায় হাত ভুলিয়ে বললো,

“কাজের এতো চাপ।এই কাজটা শেষ হলে দেখবে প্রতিদিন ফোন দেবে।”
মিতু হাসে।সাহেরা খাতুন কি কাজে যেনো তার রুমে যায়।মিতু তার রুমের দিকে যায়,রুমটা তার নাকি মুশফিকের? এক দিনের বিবাহিত জীবনে কি রুমের দখলদার নিতে পারবে? কি জানি!
মিতু রুমে প্রবেশ করে।মুশফিকের রুমে গিয়ে মন খারাপ হয়।চুপচাপ বিছানায় বসে মনে হয় সে মুশফিককে অনুভব করছে।তখন সাহেরা খাতুন মিতুর কাছে আসে।
হাতের ফোনটা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,

“নাও।মুশফিক লাইনে আছে। ”
মিতু আইপ্যাডের দিকে তাকায়।শক্ত গম্ভীর চেহারার মুশফিক তার দিকে তাকিয়ে আছে।সাহেরা খাতুন চলে যায়।মিতুর হঠাৎ রাগ হয়,অভিমানে অন্তর ছেয়ে যায়।সে ফোন ডিসকানেকটেড করে দেয়।মা ফোন দিয়েছে বলেই কথা বলতে চাচ্ছে,অথচ এতোদিন কোনো খবর নেই,খারাপ মানুষ।
মুশফিক চঞ্চল হরিণের অভিমান বুঝে।তারপর মিতুর মোবাইলে একটা ম্যাসেজ পাঠায়।
মিতু হাতের ফোনের দিকে তাকায় সেখানে লেখা,

মেজর পর্ব ৩

❝আমিহীন আমার বিছানায় বসার অপরাধে আপনাকে যে গুরুতর শা,স্তি দেয়া হবে তা কি আপনি জানেন? ❞
মিতু কোনো উত্তর দেয় না। মুশফিক আবার লেখে,
❝রাগ করলে শা,স্তির পরিমান কিন্তু বাড়বে। ❞
মিতু লেখলো,
❝মেজর! আপনি খুব পঁচা।আই হেট ইউ সো মাচ।❞

মেজর পর্ব ৫