মেজর পর্ব ৫

মেজর পর্ব ৫
জাকিয়া সুলতানা ঝুমুর

“মেজর আপনি খুব পঁচা।আই হেট ইউ সো মাচ।”
মুশফিকের পুরু ঠোঁটের ভাজে মুচকি হাসির রেখা ফুটে উঠে।লাভ ইউ শোনার আগেই হেট ইউ শুনতে হলো!অথচ তার বউয়ের এখন লাভ ইউ সোনা,মনা বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলার কথা ছিলো কিন্তু সে কি শুনছে?ডিফেন্সে জব করলে কি এমনই হয়?

মিতু অভিমান করেছে যা খুবই স্পষ্ট কিন্তু তার কি করার ছিলো সে কাজে এতো পরিমান ব্যস্ত ছিলো যে ফোন দেয়ার ফুসরত মিলেনি।সারাদিন পরিশ্রম করার পরে রাতে কটেজে ফিরে শরীরটা ক্লান্ত ভঙ্গিমায় বিছানা খুঁজে তখন আর কিছু ভালো লাগে না তাছাড়া মিতু তার কল্পনায় ধোয়াশা,দুজনের কম সখ্যতা হওয়ার কারনেই বুঝি এমন হচ্ছে সেটা ভেবেই আর গভীর রাতে ফোন দেয়া হয়নি।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আজকে ল্যাপটপে অভিমানী চঞ্চল মেয়ের ফুলা মুখটা দেখে এতো মিষ্টি লেগেছে।অভিমান করলেও কাউকে দেখতে এতো ভালো লাগে!সে ভালো করে দেখার আগেই ফোন কেটে দিয়েছে।মুশফিক চোখ বন্ধ করে তার সাদা উজ্জ্বল বিছানায় মিতুকে ভাবে।ভাবতেই দেহ মন শিহরিত হয়,চোখের তারায় নেচে যায় মায়াবী একজোড়া চোখের চাহনী।

মিতুর মেসেজটা দেখে মুখে হাসি আসলেও মন তাকে তিরষ্কার করে উঠে।মুশফিকের অবচেতন মন বুঝি ভালোবাসার কথাই শুনতে চাচ্ছিলো তাইতো এই হাস্যকর তিরষ্কার।সে আসলেই এই কয়টা দিন খুব ব্যস্ত ছিলো।অথচ সদ্য বিবাহিত স্ত্রী কিনা রাগ করে ফেলেছে।সে তপ্ত শ্বাস ফেলে মিতুর নাম্বার ডায়াল করে।

বিছানায় রাখা মোবাইলটা কেঁপে কেঁপে উঠছে মিতু সেদিকে চুপচাপ তাকিয়ে থাকে।তিনবার ফোনকল আসে কিন্তু মিতু রিসিভ করে না অভিমানী ডাগর আঁখিতে ততক্ষণে জলে টইটুম্বুর হয়ে গেছে।চারবারের সময় যখন ফোন আসে তখন মিতু নড়েচড়ে বসে,সবার কাছে শুনেছে মুশফিক খুব রাগী।তাকে এতোবার ফোন দিচ্ছে সে যদি না ধরে তাহলে কি মেজর রেগে যাবে?

কাজটা কি বেয়াদবির সমতুল্য হচ্ছে?মিতু ধাতস্থ হয়ে ফোনটা রিসিভ করে কানে ঠেকায়।মেজরের গম্ভীর কন্ঠ কর্ণগোচর হয়,বুকের খাচার পাখি ভ,য়ে জমে যায়,সারাদিন পকপক করতে থাকা মিতু কথা বলতে পারেনা।মুশফিক কান থেকে মোবাইলটা নামিয়ে দেখে যে লাইনে আছে কিনা,লাইনে আছে অথচ কথা বলছেনা।হঠাৎ মুশফিকের ভিষণ রাগ হয়।মিতুর এমন নিশ্চুপতায় সারা অঙ্গে রাগ যেনো চিরবিরিয়ে উঠে।গম্ভীর গলার স্বর আরো গভীর শোনায়।

“হ্যালো!মিতু শুনতে পাচ্ছো?কথা বলো।”
মুশফিকের এমন কণ্ঠে মিতু জলদি বলে,
“জ্বি।”
মুশফিকের কাছে নিজের কণ্ঠই কর্কশ শোনালো,সে নিঃশব্দে শ্বাস ফেলে শান্ত হলো,রাগ লুকানোর এক অদম্য ক্ষমতা আছে তার,চেহারা দেখে কিংবা কন্ঠ শুনে কেউ তার মনের ভাব বুঝতে পারবেনা।মিতুর ভয়মাখা কন্ঠ শুনে ঝট করে নিজেকে শান্ত করে নিলো।

“এতোক্ষণ ধরে ফোন দিচ্ছি,কোথায় ছিলে তুমি?”
মিতু নিশ্চিত যে মুশফিক জানে যে সে কাছেই ছিলো তাও জিজ্ঞেস করছে কোথায় ছিলো।তার কন্ঠে আবার অভিমান ভীর করে।সে বলে,
“কাছেই ছিলাম।”
“তাহলে ফোনটা ধরোনি কেনো মিতু?”

“আপনাকে অপেক্ষা করালাম,অপেক্ষা করতে কতো কষ্ট সেটা একটু হলেও নিশ্চয়ই বুঝেছেন।”
মুশফিক বালিশে মাথা রাখে,পাখির মুখে বুলি ফুটছে,কন্ঠে অভিমানের সাগর।তার মুখে হাসি ফুটে উঠে।
“আমার ফোনের জন্য অপেক্ষা করেছো?”
মিতু চুপ করে থাকে।মিতুকে চুপ করে থাকতে দেখে মুশফিক বললো,
“একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিলো,যদিও তোমাকে বলতে পারছিনা কাজটা কি।”

মিতু মুখ গম্ভীর করে।আর্মিদের আবার কাজ কিসের?আর্মিরা তো খালি খালি মাটি কে,টে গর্ত করে তারপর ওই গর্তে ঘুমায়।আজাইরা কাজকর্ম সব।
মিতুকে এমন নিশ্চুপ হয়ে থাকতে দেখে মুশফিকের গলার স্বর মিহি হয়,আস্তে করে বললো,
“সরি।আমার উচিত ছিলো একটু হলেও ফোন দেয়া। কথা বলো না মিতুল। ”
মুশফিকের এমন নরম কন্ঠ শুনে মিতুর টলমল চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পরে,অভিমান রূপ নেয় কান্নায়।সে ফুপিয়ে উঠে।

মিতুর কান্নার শব্দ শুনে মুশফিক হতভম্ব।চঞ্চল মেয়ের মন যে এতো নরম তা কে জানতো?সে ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললো,
“রাত হয়ে গিয়েছিলো, ভেবেছিলাম এতো রাতে ফোন দিলে যদি ডিস্ট্রাব হও।”
“আমি অপেক্ষায় ছিলাম।”
“আচ্ছা আচ্ছা,এখন থেকে গভীর রাত হলেও ফোন দেবো।কেঁদো না।”
মিতু হঠাৎ ঝাঝ মাখানো কন্ঠে বললো,
“আমি কাঁদছি না,কাঁদবো কেনো?”

মুশফিক মুচকি হাসে।মিতু যদি তার এই হাসিটা দেখতো তাহলে নির্ঘাত মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতো।সে হাসছে মিতুর কথা শুনে।সে স্পষ্ট কান্নার মৃদু শব্দ শুনেছে অথচ এখন উলটো কথা।সে বললো,
“আসলেই তো কাঁদবে কেনো?”
মিতু অভিমানে ভাসে,অভিমানের স্রোতে ধাক্কা দিয়ে মুশফিক বললো,
“মেসেজে যা বলেছো তা কি ঠিক? ”
“হুহ।”
“শিউর?”
“হুহ।”

“একমাত্র বউয়ের কাছে এসব শোনা লাগবে আগে জানলে বিয়ে করতাম না।”
“একমাত্র বউ মানে!মানুষের বউ কয়টা থাকে?”
“চারটা থাকাই তো জায়েজ।একবউ হেট ইউ বললে আরেক বউ লাভইউ বলবে,সুযোগ আছে।”
মিতু আবার কেঁদে দিলো।তারপর রাগ করে ফোনটাই কেঁটে দিলো।সাথে সাথে একটা মেসেজ আসে।
❝লাভ ইউ বলার জন্য আরেকটা বউ লাগবে দেখা যাচ্ছে।❞
মিতুর মুখে হাসি ফুটে উঠে।সে যতো চঞ্চল আর দুষ্টু মুশফিক তার থেকেও বেশী দুষ্টু।
আরেকটা মেসেজ আসে।

❝আমি সময় পেলেই ফোন দেবো,এই কারণে রাগ করতে হয় না।❞
মিতুর মন ভালো হয়ে গেলো।সে সব বুঝে কিন্তু কেনো জানি স্বল্প পরিচিত মুশফিকের গলার স্বর শুনে এতো আপন লাগলো যে খুব ছেলেমানুষী করে ফেলেছে।

ভোর সাড়ে চারটা।মুশফিকের মোবাইলে ইমারজেন্সি কল আসে।সে সটান দাঁড়িয়ে কাপড়চোপড় পরে নেয়।উপরমহল থেকে ফোন এসেছে এখনি একটা অপারেশনে যেতে হবে।সে নামায পড়ে বেরিয়ে যায়।আজকে কেনো জানি বেরিয়ে যাওয়ার আগে মিতুকে খুব মনে পড়ছে কিন্তু মুশফিক জানে তাদের কোনো পিছুটান থাকতে নেই,তাদের জীবন দেশের জন্য উৎসর্গঃ।সে শূন্য কটেজের দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে পরে। সামান্য দূরের কোয়ার্টার থেকে নয়না বেরিয়ে আসে।মুশফিক সেদিকে তাকায় না।নয়না এগিয়ে আসে।

“আসসালামু আলাইকুম স্যার।”
মুশফিক নয়নার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,
“তুমি!অপারেশনে যাচ্ছো?”
“জ্বি।বাবাকে বলেছিলাম অপারেশনে যেতে চাই।”
“এটা কোনো ছেলেখেলা না যে বাবার কাছে চকলেটের আবদার করলে আর তোমার বাবা তা এনে দিলো।ইটস এ অপারেশন। ”

পিছন থেকে কর্ণেল ফারুক আহমেদের কন্ঠ ভেসে আসে।
“ও যাক মুশফিক।আমি জানি তুমি নয়নার খেয়াল রাখবে।”
মুশফিকের শরীর রাগে জ্বলে গেলো,সে অপারেশনে যাচ্ছে কারো খেয়াল রাখতে নয়।মুখে বললো,
“ইয়েস স্যার।”

নয়নার ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠে মুশফিক সেই হাসি দেখে ইচ্ছে করলো থাপ্পড় দিয়ে গাল লাল করে দিতে,বেয়াদব মেয়ে।
প্রথমবার সাতদিন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিলো এবার নয়দিন।এবার মিতু মুশফিকের কলের আশায় বসে থাকেনি সে অনেকবার ফোন দিয়েছে কিন্তু প্রতিবারই শোনাচ্ছে নেটওয়ার্কের বাহিরে।মিতুর মনে হলো সে সেদিন হেট ইউ বলাতেই কিনা মোবাইল বন্ধ করে রেখেছে,অনেক ভেবে সে মেসেজ লিখলো,

❝আর কখনো হেট ইউ বলবো না,যা শুনতে চান তাই বলবো।❞
সারারাত মিতু কাঁদলো।তার এতো কান্না পাচ্ছে।কাউকে নিজের কষ্টের কথাও বলতেও পারছে না।ভোর রাতের দিকে চোখে ঘুম আসলো।

তখন সকাল কয়টা বাজে তা মিতুর জানা নেই।চোখ না খুলেই মনে হলো তার মনটা পরে আছে
খাগড়াছড়িতে,সেখানে এক পাষান পুরুষের বাস,যে কিনা তাকে কষ্ট দিচ্ছে।সে মন খারাপ করেই চোখ খুলে তাকায় আর সাথে সাথে লাফিয়ে উঠে।মুশফিক তার দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে আছে।মিতু জোড়ে জোড়ে শ্বাস ফেলছে।তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে মুশফিক তার সামনে।বারবার মনে হচ্ছে এটা স্বপ্ন।
তার ভাবনা চিন্তার অবসান ঘটিয়ে গমগমে কন্ঠে মুশফিক বললো,

মেজর পর্ব ৪

“আমার বউ আর হেট ইউ বলবে না,আমি যা শুনতে চাই তাই বলবে,ভাবলাম মোবাইলে শুনলে তো আমার হবে না আফটারঅল মেজর বলে কথা,আমার সবকিছুই স্পেশাল হওয়া চাই।তাই ফেস টু ফেস শোনার জন্যই ছুটে এলাম।”

মেজর পর্ব ৬