মেজর পর্ব ৯

মেজর পর্ব ৯
জাকিয়া সুলতানা ঝুমুর

বাসার সবাই বাস কাউন্টারে তাদেরকে বিদায় দিতে আসে।মিতুর কাপড়চোপড় একটা বড়ো লাগেজে,উপন্যাসের বই আর একাডেমিক বই মিলিয়ে দুইটা বস্তা হয়েছে।মিতু কাঁদছে,মিতুর কান্না দেখে মুশফিকের বলতে ইচ্ছে করছে, ভাই তুমি যেতে হবে না,তারপরও প্লিজ কেঁদো না।

কিন্তু মুখে কিছু বললো না।সে আগেই অনলাইনে টিকেট বুক করে রেখেছিলো।খাগড়াছড়ি যাওয়ার মানুষ অনেক,তা বাস কাউন্টারে না আসলে বুঝা যাবে না।পঁচানব্বই ভাগ মানুষ ঘুরতে যাচ্ছে আর কিছুস্থানীয় আর কিছু চাকরিসূত্রে বসবাস করে।মুশফিকও তাদের দলে,নির্জন পাহারী অঞ্চলে তার বসবাস।রাত দশটায় বাস আসে।মিতু জানালার পাশে বসে।সে ঢাকার মেয়ে হলেও বেশীক্ষণ বাস জার্নি করতে পারে না, কেমন গা ঘুলায়,বমি ভাব হয়।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

জানালার পাশে বসার কারন বাহিরের ঠান্ডা বাতাস গায়ে লাগলে বমি ভাব হবে না। বাসের কন্ডিশন খুব ভালো,সিটগুলো বেশ বড়,বাসটা মিতুর খুব পছন্দ হলো।বাস পূর্ণগতিতে সামনে এগিয়ে যায়।মুশফিক চুপচাপ বসে আছে,সারাদিন মিতু একটুও কথা বলেনি।তার মত মানুষকে কেউ এড়িয়ে যাবে ব্যাপারটা ভাবলেই কেমন লাগে।সবকিছুর উর্ধ্বে ভালো কথা হল মিতু তার সাথে যাচ্ছে। সে একটু পরে মিতুকে বললো,

“কোনো সমস্যা হলে আমাকে বলবে।অকে?”
মিতু মুশফিকের দিকে তাকায়।বাসের নিয়ন আলোয় সুচালো তীক্ষ্ণ চোখের দৃষ্টি মেলে মেজর তার দিকে তাকিয়ে আছে।সে মাথা নাড়ে,অর্থাৎ বলবে।মুশফিক কিছুটা হেলে চোখ বন্ধ করে বসে।মিতুর কেমন দম বন্ধ লাগে,হাফসাফ করে জানালা খুলতে চায়,কিছুক্ষণ টানাটানি করে কিন্তু খুলে না।মিতুর নড়াচড়ায় মুশফিক চোখ খুলে তাকায় ভ্রু কুঁচকে বলল,

“কি হয়েছে?”
মিতু বিবর্ন মুখে বললো,
“জানালা খুলতে চাচ্ছিলাম।কেমন গা ঘুলাচ্ছে।”
মুশফিক মনে মনে ভাবে, সর্বনাশ।এই মেয়ের কি জার্নি করে অভ্যাস নেই নাকি,অভ্যাস না থাকলে তাকে খাগড়াছড়ি জামাই দেখে বিয়ে দিলো কেনো?আশ্চর্য! মিতু ছটফট করে উঠে।মিতুর ছটফট দেখে মুশফিক ভাবে,মিতু বুঝি এখনি বমি করে দেবে।সে মুশফিকের দিকে তাকিয়ে করুণ গলায় বললো,

“বাতাস লাগলে ভালো লাগতো।”
মুশফিক শান্তস্বরে বললো,
“এটা এসি বাস মিতু।এসি বাসের জানালা খুলা যাবে না।”
এতোক্ষণে মিতু ভালো করে লক্ষ করে।জানালা না খুললে কিভাবে হবে?সে বিষন্ন মুখে বললো,
“নন এসি নিতেন।”
মুশফিক মিতুর বিষন্ন মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,

“আমি সবসময় এই বাসেই চলাচল করি।তাছাড়া ভাবলাম এতো দূরের জার্নি তোমারও সুবিধা হব, আরামে যেতে পারবে।”
“আমি এসি বাসে অভস্ত্য না।”
“জানতাম না।”
“আচ্ছা সমস্যা নেই।আই ওইল ম্যানেজ।”
মুশফিক মিতুর দিকে তাকিয়ে থাকে কিন্তু কিছু বলে না।মিতু চুপ করে বসে আছে।মুশফিক হেসে মিতুর দিকে ফিরে তাকায়।

“আমার সাথে কথা বলো মিতু,কথার মাঝে থাকলে দেখবে বমি আসবে না।”
“কে বলেছে?”
“তুমি কথা বলে দেখো।”
মিতু মুশফিকের গম্ভীর অথচ মায়াকাড়া চেহারাটার দিকে তাকিয়ে থাকে।কি কথা বলা যায়?
“এটা কি বাস?”
“হানিফ এন্টারপ্রাইজ।”
“এসি বাস?”
“হ্যাঁ।”
“ভাড়া কত?”

“আগে ১৪০০ ছিলো এখন ১৬০০ করা হয়েছে।”
মিতু আফসোস করে বললো,
“এত্তোগুলো টাকা দিয়ে না এসে ননএসি বাসেই আসা যেতো।”
মুশফিক ঠোঁট টিপে হাসে।
“বউকে আরামে রাখার জন্য এইটুকু টাকা তোমার বরের আছে।”
মিতু হাসোজ্জল মুখে তাকায়।

“আমরা কখনো পৌছাবো? ”
মুশফিক ঘড়িতে সময় দেখে বললো,
“সকাল হয়ে যাবে।”
“এতোক্ষণ? ”
“এতোক্ষন তো লাগবেই ২৭২.৬ কিলোমিটার রাস্তা কি আর এক ঘন্টার মধ্যে পাড়ি দেয়া যাবে?”
মিতু অবাক হয়,অবাকের রেশ তার মুখে লেপ্টে থাকে।

“খাগড়াছড়ি এতো দূরে?”
“হ্যাঁ।”
মুশফিক থামে মিতুর দিকে তাকিয়ে বললো,
“তুমি কোথাও ঘুরতে যাওনি মিতু?”
মিতু দুঃখ ভারাক্রান্ত চেহারায় বললো,

“না।আমি তো খুব দুষ্টু তাই আম্মু মনে করে আমাকে দূরে কোথাও একা পাঠানো যাবে না,কোনো না কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলবো।আম্মু এক কথা বিয়ের পরে বর নিয়ে ঘুরো। ”
মিতু তার সাথে আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হচ্ছে।এই যে বেশ স্বাভাবিক গলায় কথা বলছে।সে বললো,
“তুমি দুষ্টু নাকি?”
মিতু মিটিমিটি হেসে বললো,
“ভিষণ।”

“আমার তো মনে হয় তুমি শান্ত।”
“আপনার সাথে তো কোনো দুষ্টুমি করি না।”
“কেনো?”
মিতু জানালার দিকে তাকিয়ে বললো,
“ভ,য় লাগে।”
“কেনো?”
“জানিনা।আপনি কাছে থাকলে আমার খুব ভ,য় হয়।”
“এখন যে এতো কাছে বসে আছো ভ,য় লাগছে না?”

মিতু মুশফিকের দিকে তাকায়।বুকের ভেতরের টিপটিপ ছন্দের মাত্রা বাড়ে।মুশফিক তার খুব কাছে।এই যে হাতের বাহু তার গা স্পর্শ করে আছে, কি যে ভ,য়ংকর অনুভূতির আলোড়ন হচ্ছে তা বুঝানো যাবে না।নাম না জানা বডি স্প্রের মৃদু সুভাস ছড়াচ্ছে,নিজস্ব পুরুষালী ঘ্রাণ কেমন গা ঝিমঝিম করিয়ে দিচ্ছে।মিতু চুপচাপ বসে আছে।এর আগে মুশফিক তার এতো কাছে আসেনি,আজকে প্রথম দুজনে এই সামান্য দূরত্ব ঘুচিয়ে একসাথে বসেছে অথচ অন্যদের বেলায় দেখা যেতো যে এতোদিনে বেশ কাছাকাছি চলে গিয়েছে।মিতুর অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে।সে ঝিম ধরে,চোখ বন্ধ করে বসে থাকে।মুশফিক শক্ত হয়ে বসে থাকা মেয়েটার চেহারার দিকে তাকায়।

“ঘুমোবে মিতু?”
মিতু মুশফিকের দিকে তাকায় না।লোকটা যেনো কেমন।হঠাৎ বুকে আগুন জ্বালিয়ে দেয়।এই যে একটু আগেও তো দিব্যি মুশফিকের সাথে কথা বলছিলো হঠাৎ যেনো গায়ে কেমনতর অনুভূতির ফোয়ারা ধিকধিক করে ছুটে যাচ্ছে,পুরুষালি ঘ্রাণ,গম্ভীর হৃদয়ছোঁয়া হাস্কি স্বর যেনো তাকে লজ্জায় ডুবিয়ে দিচ্ছে।মিতু কথা বলতে পারলো না। গলার স্বর যেনো আটকে গেলো।মুশফিকের বলিষ্ট হাত পায়ের সাথে তার হাত পাঁয়ের মৃদু ছোঁয়া যেনো গা কাঁপিয়ে দিচ্ছে।সে চুপ করে বসে থাকে।মুশফিক মাথাটা হেলিয়ে মিতুর দিকে তাকায়।

“কি ব্যাপার ম্যাডাম? ফুলস্টপ কেনো?”
মিতু আস্তে করে বললো,
“এমনি।”
মুশফিক মিতুর চেহারাটার দিকে তাকিয়ে বললো,
“হঠাৎ চুপ করে গেলে কেনো?”
মিতু চুপ থেকে কিছুক্ষণ পরে বিবস কন্ঠে বললো,
“চুপ থাকতেই ভালো লাগছে?”
মুশফিক মিতুর লাজুকরাঙ্গা মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
“এখন,এই মূহুর্তে কি পাচ্ছো ভ,য় না লজ্জা?”

মিতু অবাক চোখে মুশফিকের দিকে তাকালো।উনি কিভাবে বুঝে গেলো?সে মাথা নিচু করে নেয়।মুশফিক বললো,
“এতোক্ষণ তো সব স্বাভাবিকই ছিলো।হঠাৎ…. ”
মুশফিক আবার বললো,
“এই লজ্জা আর ভ,য় যে কিভাবে দূর করবো তা আল্লাহই জানে।”
মিতু অস্পষ্ট গলায় বললো,

“দূর।”
অস্পষ্ট করে বলা কথাটাও মিতুর কানে আসে।
“এখন দূর বললে তো দূরে যাবো না মিতু।”
মুশফিকের কথাগুলো দুষ্টরূপ নিচ্ছে সে প্রসঙ্গ পাল্টাতে চাইল।ফোস করে শ্বাস ফেলে বললো,
“আমি ঘুমাবো।”
মুশফিক মুচকি হাসে।
“আচ্ছা।”

মিতু চুপ করে থাকে।চুপ করেই বুঝতে পারে পাশের মানুষটা ছটফট করছে।সে ঘুমানোর চেষ্টা করে।
মুশফিক নিজের মাঝে আগে কখনো এমন পরিবর্তন লক্ষ করেনি,আজকে এমন হচ্ছে কেনো?বউ পাশে আছে বলেই হয়তো।এই যে এখন ইচ্ছে করছে অনেক কথা বলতে কিন্তু চঞ্চল হরিণের কি হলো কে জানে হঠাৎই লজ্জার অদৃশ্য চাদরে নিজেকে মুড়ে নিলো।মুশফিক আস্তে করে বললো,

“ঘুমিয়ে গিয়েছো?”
মিতু চোখ খুলে তাকায়।মুশফিক বললো,
“তুমি বোধহয় ভ,য় পাচ্ছো।তুমি চাইলে আমি তোমার হাত ধরে বসতে পারি,এতে ভ,য় কম লাগবে।”
মুশফিকের কথা শুনে মিতু চুপ করে।লোকটা যে কড়া চালাক তা এইমাত্র বলা কথাটা বুঝা যাচ্ছে।হাত ধরতে ইচ্ছে করছে অথচ বলবেনা হাত ধরবে, বললো কি হাত ধরলে ভ,য় কম লাগবে।মিতু আস্তে করে বললো,

“আমার হাত ধরতে ইচ্ছে করছে?”
মুশফিক বিস্তর হাসে।হাত দিয়ে চুল টেনে বললো,
“বউ কাছে থাকলে হুটহাট এমন অনেক ইচ্ছাই জাগে।”
মিতু চুপ করে মুশফিকের দিকে তাকিয়ে আছে।মুশফিক আস্তে করে মিতুর হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নেয়।চিকন সরু আঙ্গুলের ভাজে বলিষ্ট,শক্ত,কড়াপড়া হাতের আঙ্গুল গুজে দিয়ে চুপচাপ সিটে হেলান দেয়।

মিতু কিছুক্ষণ পরে ঘুমিয়ে যায়।একটু হেলে পরে মুশফিকের দিকে।মুশফিক ঘুমায়নি,বাসে সে ঘুমাতে পারে না,মিতুর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসে।মিতু তার কাধে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে।গালের পাশের চুল সরিয়ে দেয়।খুব নিচু গলায় ফিসফিস করে বললো,
“শোন আমার হৃদয়হরণী,তোমাকে কাছে আনতে পেরে যেনো যুদ্ধ জয় করার সুখ পাচ্ছি,তুমি কি কখনো তা উপলব্ধি করতে পারবে।”

মিতু হাত দিয়ে মুশফিকের শার্ট আঁকড়ে ধরে মুখ গুজে দেয় তার কাধে।মুশফিকের দেহ অসাড় হয়ে আসে,সে নিঃশব্দে গভীর নিঃশ্বাস ফেলে মিতুর দিকে আদরমাখা চোখে তাকিয়ে থাকে।আচ্ছা মিতু জেগে থাকলে কি এভাবে কাছে আসতো?মোটেও না এই মেয়ে তো লজ্জায় কথাই বলে না।মুশফিক আস্তে করে পরম আদরে মিতুর কপালে একটা চুমু দেয়,মিতু নড়েচড়ে বসে।মুশফিক চুপচাপ মিতুর হাতটা আঁকড়ে ধরে বসে আছে।

মিতু চুপ করে আছে,লজ্জায়, শিহরণে তার দম বন্ধ হয়ে আসছে কিন্তু সে সরে আসতে পারছে না,অজানা আকর্ষণে আরও লেপ্টে থাকতে ইচ্ছে করছে।মুশফিকের বলা কথাগুলো হৃদয়ে লেগেছে।সে কপালে মুশফিকের ঠোঁটের ভেজা চুম্বন এখনো অনুভব করতে পারছে।হঠাৎ মনে হলো,

মেজর পর্ব ৮

মেজর এতো খারাপ! গাড়িতেই চুম্মাচাটি শুরু করেছে বাসায় নিতে পারলে কি করবে?ভাবতেই মিতুর গলা শুকিয়ে গেলো।সে আস্তে করে মুশফিকের দিকে তাকালো।মুশফিক তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো,সে মিতুকে তাকাতে দেখে বুক মুচড়ে উঠলো,গোপন কথা, গোপন স্পর্শ কি মেয়েটা জেগেই অনুভব করেছে। আস্তে করে বললো,
” এই তুমি ঘুমোওনি?আশ্চর্য!”

মেজর পর্ব ১০