শেষ বিকেলে তুমি আমি সিজন ২ পর্ব ১০

শেষ বিকেলে তুমি আমি সিজন ২ পর্ব ১০
আলিশা

আজ নয় মাস হবে আমি এবাড়িতে এসেছি। দিনগুলো চলে গেলো চোখের পলকে। জয়নব খালার সাথে সংসারের সব কাজ সামলে রাতে হাসিঠাট্টার মধ্য দিয়ে তিনজনে ঘুমের দেশে চলে যাওয়ার ব্যাপারটা প্রশান্তির। দুদিন আগেও আমি নিজেকে সুখী দাবি করতাম।

তবে গত আটচল্লিশ ঘন্টা হলো আমি নিজেকে সুখী দাবি করতে দ্বিধায় জড়িয়ে যাচ্ছি। ভাবতে হয় আমাকে আকাশ পাতাল। স্মরণের আচরণ উদ্ভট হয়েছে। তার হাসিমুখ হয়ে গেছে বিষন্ন। গত রাতে সে বাসায় ফেরেনি। আজ সকাল পেরিয়ে সন্ধ্যা নামছে সে একপ্রকার নিখোঁজ। মনটা বড়ই ছটফট করছে আমার। ছোঁয়া এসবের কিছু বোঝে না। সে তোো আমায় নিয়ে ব্যস্ত। ছাদ আর ঘর, ঘর আর বেলকনিতে তার ছোটাছুটি।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সদর দরজায় দাড়িয়ে ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে অণুধ্যানে মগ্ন হলাম। একবার কি ফোন করবো? সে আবার অফিশিয়াল কাজে অনবসর নয়তো? মনের প্রশ্ন প্রাধান্য দেবো কি দেবো না এ নিয়ে আরো খানিকটা সময় কাটিয়ে দিলাম। অবশেষে সব ভাবনা ছুড়ে ফেলে ফোন করে বসলাম তাকে। ফোন করার দু সেকেন্ডের মাথায় নজরে এলো গেইট দিয়ে প্রবেশ করা কালো রঙের প্রাইভেট কার। বুঝতে বাকি রইলো না গাড়িটা স্মরণের। ফোন কাটলাম। ঠাঁই দাড়িয়ে রইলাম সদর দরজায়। গাঢ় অভিমানে আমার জেদ চাপলো। সে দরজা অব্দি এলে আমি কি করবো তা নিজেও মনশ্চক্ষুতে দেখতে পেলাম না।

স্মরণ গাড়ি পার্ক করে গটগট করে এগিয়ে এলো। হাতের ঘড়ি চলতি পথেই খুলতে ব্যাস্ত হলো। তার এমন ব্যস্ততার মাঝে আমি যেন অদৃশ্য বস্তু। তার নজরে পরলাম না। সে নিষ্ঠুরতম ভাব নিয়ে আমাকে এড়িয়ে প্রবেশ করলো ঘরে। আমি তাজ্জব হলাম। হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইলাম তার যাওয়ার পানে। আমার অভিমান শূন্যে ভেসে হারিয়ে গেলো অজানায়।

ঘরে ফিরেই গোসল করে সে কারো সাথে কোনো প্রকার বাক্য বিনিময় না করে রিডিং রুমে প্রবেশ করলো। অতঃপর বন্ধ দরজার ওপাশে যেন সে ধ্যানে বসে পরলো। এপর্যায়ে আমার ভাবনা গাঢ় হলো। রাগ হলো আমার এক পৃথিবী। কেন এতো ব্যস্ততা? কিসের এতো ব্যস্ততা? পুরো দেশ জুড়ে কি সে একাই ইনভেস্টিগেশন অফিসার? ভাব যেন কয়েকশো ভোল্ট। কাছে গেলেই শক।

রাতে ঘুম হলো না আমার। মনে বিক্ষোভ। কেন এমন ভাব তার? ছটফট করে রাতের অর্ধেক প্রহর কাটিয়ে এগিয়ে গেলাম স্মরণের নিকট। রিডিং রুমের দরজা তখন হালকা খোলা। এপাশ হতে বললাম
— ডিনার করবেন না?
তার জবাব
— নাহ।
— আমি ডিনার করিনি।

— প্লিজ খেয়া। ইম্পর্টেন্ট কাজ করছি। ইচ্ছে হলে খাও। না হলে ঘুমিয়ে পরো। ডিসটার্ব কোরো না।
বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠলো তার উচ্চবাক্য শুনে। আর একটা কথাও ব্যয় না করে চলে এলাম ঘরে। বাকি রাত পার করলাম তার প্রতি ক্ষোভ নিয়ে।

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙলে ছোঁয়ার ওপাশে তাকিয়ে দেখি স্মরণের জায়গাটুকু শূন্য পরে আছে। বিছানা ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে মনের টানে একবার স্মরণের নিকট গেলাম। সে টেবিলে মাথা রেখে বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। কপালে ভাজ। হাতে কলম। কানের পিঠে পেন্সিল রাখা। না চাইতেও তার রূপ দেখে হেঁসে উঠলাম আমি। আমার হাসির শব্দে তার ঘুম ছুটে গেলো। চোখ মেলতেই আমি এক ছুটে চলে এলাম রান্নাঘরে। জয়নব খালা এক চুলোয় চায়ের পানি বসিয়েছেন। আমি চাল ধুয়ে অন্য চুলোয় বসিয়ে দিলাম ভাতের জন্য। ফ্রিজ হতে একটা ডিম নিয়ে যেই না বাটিতে ভাঙতে যাবো ঠিক তখনই ছোঁয়ার ভয়ার্ত কন্ঠ

। কেঁপে উঠলাম আমি। হাতের ডিম মেঝেতে পরলো। পা ছুটলো আমার ঘরের পানে। ছোঁয়া তখন ‘বাবা, বাবা’ বলে চিৎকার করছে। আমি রুমে ঢুকে দেখলাম স্মরণ ছোঁয়াকে ইতিমধ্যে কোলে তুলে একাধারে জিজ্ঞেস করে যাচ্ছে কি হয়েছে তার। ছোঁয়া কান্নার দমকায় কথা বলতে অপারক। আমি পানির গ্লাস এগিয়ে দিলাম স্মরণের কাছে। সে ছোঁয়াকে পানি পান করিয়ে ধাতস্থ করলো। তারপর ছোঁয়াকে চিৎকার করার কারণ জিজ্ঞেস করতেই সে বলল

— মা ফোন করেছিল। আমি মায়ের কাছে যাবো। আমি অথৈ মার কাছে যাবো।
ছোঁয়ার কথা শুনে আমার পায়ের তলার মাটি সরে গেলো যেন। শঙ্কিত চোখে স্মরণের পানে চাইতেই তার অবাক মুখ আমাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিলো নিমিষেই। সত্যি কি অথৈ ফোন করেছিল? অথৈ বেঁচে আছে কিভাবে? অথৈ বেঁচে গেলে মাটির বুকে কে শুয়ে আছে? ছোঁয়া ভুল করছে না তো? অথৈয়ের কন্ঠ ওর মনে আছে?

— সত্যিই তোমার মা ফোন করেছিল ছোঁয়া?
আমার শুষ্ক কন্ঠের প্রশ্নের প্রত্যুত্তরে ছোঁয়া বলল
— হুম…. মা আমাকে ছোঁয়া বলে ডেকেছে। মা বলেছে মা আছে। মাকে আটকে রেখেছে।

শেষোক্ত কথায় যেন অলৌকিক কিছু ছিলো। স্মরণ ছটফট করে উঠলো। ছোঁয়াকে হাজার প্রশ্নের সম্মুখীন করলো। তার চোখে যেন ভেসে উঠলো এক সমুদ্র আশা, ভালোবাসা। তার সেই ভালোবাসা আমার নয়ন ধারণ করে হৃদয়ে আগুন হয়ে জ্বলে উঠলো। আমি যেমন বাক শক্তি হারালাম তেমন হারালাম শ্রবণশক্তি। কাল পরিস্থিতি আমার অনুভব শক্তির বাইরে গিয়ে কেবল মনে প্রশ্ন উঠলো, আমার তবে কি হবে?

শেষ বিকেলে তুমি আমি সিজন ২ পর্ব ৯

যদি ছোঁয়া সত্যি বলে, স্মরণ কি আমাকে পর করে দেবে? ভাবনার মাঝে ঘর থেকে ধীর পায়ে প্রস্থান করলাম। আমার চারপাশের সব যেন ঘুরতে লাগলো, গা গুলিয়ে এলো। হঠাৎ আমার ছুটতে হলো ওয়াশরুমের দিকে। কোনোভাবে দরজা খুলে পৌঁছেই গরগর করে পেটের সব খাদ্য উগড়ে দিতে বাধ্য হলাম। চোখে মুখে পানির ছেটা দিয়ে ঘুরে দাঁড়াতেই আবারও বমিবমি ভাবে চোখ মুখ কুঁচকে এলো। ঠিক তখনই বুক কেঁপে উঠলো আমার। আমার জন্য নতুন কোনো বিপদ নয় তো?

শেষ বিকেলে তুমি আমি সিজন ২ পর্ব ১১