সায়েবা আসক্তি পর্ব ১১

সায়েবা আসক্তি পর্ব ১১
লেখিকা সানজিদা বিনতে সফি

কয়েক মুহূর্তের মধ্যে এতগুলো ঘটনা সবাই কে স্তব্ধ করে দিয়েছে। ড্রয়িং রুমে এখন পিনপতন নীরবতা। সায়েবা এখনো স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। ফারহানা বেগম সায়েবার গালে মলম লাগিয়ে দিচ্ছে। ফরহাদ বিপরীত পাশের সোফায় মাথা চেপে ধরে বসে আছে।
সানোয়ার সাহেব চুপচাপ বসে আছে। তার আদরের ভাগনি ফারহানের শক্ত হতের থাপ্পড় খেয়ে এখন কি অবস্থায় আছে তাতে তার কোন মাথা ব্যাথা নেই। সত্যি বলতে সে লিজা কে খুব একটা পছন্দ করে না।নেয়াৎ ই বোনকে কথা দিয়ে ফেলেছেন তাই কিছু বলতে পারছেন না। তার হয়েছে দু দিক থেকেই বিপদ। এই যে তার বউ তার দিকে একটু পর পর আগুন চোখে তাকাচ্ছে তাতে কি তার ভয় হচ্ছে না? ভিতরে ভিতরে সে ভয়ে সিটিয়ে আছে। বোন ভাগনির পাল্লায় পরে এই বুড়ো বয়সে কতদিন যে বউ ছাড়া থাকতে হবে কে যানে!মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলো সে।

— তোর আন্টি কে খবর দিয়েছিস?
মায়ের কথায় মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো ফরহাদ। সায়েবার দিকে তাকিয়ে তপ্ত শ্বাস ফেলে বললো,
— এটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না আম্মু?না মানে এভাবে বললেই কি বিয়ে হয়ে যায়? ফারহান এখনো পড়াশোনা করছে।ও আগে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে তুলুক।তত দিনে সায়েবার পড়াশোনা ও কমপ্লিট হয়ে যাবে।আর এখানে যা ঘটে গেলো তাতে তোমার মনে হয় আন্টি রাজি হবে এই বিয়েতে?
ফরহাদের কথায় যুক্তি আছে। ফারহানা অবেগম ভাবনায় পড়ে গেলেন। সায়েবার ভিতু চেহারার দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় শান্ত হতে বললেন।ফারহানের কথা চিন্তা করে তার নিজের ও ভয় হচ্ছে। ছেলেটা অতিরিক্ত রাগী। রাগ উঠলে মাথা ঠিক থাকে না।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

এদিকে সায়েবার অবস্থা নাজেহাল।মায়ের কথা চিন্তা করে গলা শুকিয়ে সাহারা মরুভূমি হয়ে যাচ্ছে। কোন পাগল কুকুরের কামড় খেয়ে যে এখন এখানে এসেছিলো সেটা ভেবে নিজেকে কয়েক শ গালি দিয়ে ফেলেছে মনে মনে। মা যদি এসে শুনে এখানে এসব কান্ড ঘটে গেছে তাহলে একটা জুতোর বারিও মাটিতে পরবে না। এমনিতেই ওই রাক্ষুসির থাপ্পড় খেয়ে চেহারার মানচিত্র বদলে গেছে।আজকের দিনটাই খারাপ। ওদিকে অই ফালতু লোকটা ওকে ফাসিয়ে দিয়ে চলে গেছে।বিয়ে মানে!এখন কিসের বিয়ে? আজব!এখনো কি বিয়ের বয়স হয়েছে নাকি তার!প্রেম ভালোবাসা পর্যন্ত ঠিক আছে। তাই বলে এখুনি বিয়ে! এই জীবনে প্রেম করার সাধ মিটে গেছে সায়েবার।ও শুধু মনে মনে আল্লাহ কে ডাকছে।হে রব্বুল আলামীন, একবার এই বিপদ থেকে রক্ষা করো। আর জীবনে এই ছাতার মাথা প্রেম করার নাম মুখে নিবো না। সত্যি!

সায়েবার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে ওর মা আর ফারহান। ফারহান পারলে এখুনি কাচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলে ওকে।কিছুক্ষণ আগে বিয়ে করবে না বলে সাফ সাফ মানা করে দিয়েছে সায়েবা।যদিও শুধু ফারহান কে বলেছে।ফারহান ওর কথা ফু দিয়ে উড়িয়ে দিলেও দৃষ্টি দিয়ে ঝলসে দিচ্ছে। বাকি সবাই বিয়ে নিয়ে কথা বলছে সায়েবার মায়ের সাথে। সায়েবার দৃষ্টি এখন ওর মায়ের পায়ের দিকে।আজকে ভাতের বদলে মার খেয়ে পেট ভরাতে হবে এটা কনফার্ম।
— আমার মেয়েকে এখন বিয়ে দিবো না আপা।মেয়ে আমার এখনো ছোট। এত তারাতাড়ি মেয়েকে শশুর বাড়ি পাঠাব না।আর আজকের ঘটনার পরে এখন বিয়ের তো প্রশ্নই আসে না।
ফারহান হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে মাথা নিচু করে বসে আছে। সায়েবার মায়ের কথা শুনে ফারহানা বেগম অসহায় চোখে স্বামীর দিকে তাকালো। সানোয়ার সাহেব এখনো নিশ্চুপ হয়ে বসে আছেন।ফারহানা বেগম বোঝানোর ভঙ্গিতে বললো,

— আমি আপনার অবস্থা টা বুঝতে পারছি আপা।
সায়েবার কোন অমর্যাদা আমরা কখনো হতে দিবো না। এখন শুধু বিয়েটা পড়িয়ে রাখি।পরে সময় বুঝে বড় অনুষ্ঠান করে আমাদের বাড়ির বউ আমরা নিয়ে আসবো। এখন সায়েবা আপনাদের বাড়িতেই থাকবে।এখন শুধু রেজিস্ট্রার টা করে রাখবো।
— না আপা। তা হয় না। আমার একটা মাত্র মেয়ে।তাকে আমি এভাবে বিয়ে দিতে চাইনা।আর ভাইজানের এই বিয়েতে মত নেই।সেখানে আমি কিভাবে নিজের মেয়ে দিতে পারি। আজ আপনার ননদের মেয়ে আমার মেয়ের গায়ে হাত তুলেছে।কাল আরো বেশি কিছু করতে পারে।জেনে শুনে আমি আমার মেয়েকে এমন জীবন দিতে পারি না। ওর বাবা বেচে নেই। ওদের ভালো থাকাটাই আমার কাছে মোক্ষ। আমি আর কোন অপ্রিতিকর পরিস্থিতিতে ফেলতে চাইনা আমার মেয়ে কে।মাফ করবেন।
সায়েবার মায়ের কথা শেষ হতে না হতেই ড্রয়িং রুমে হাযির হলো লিজা।সায়েবার মায়ের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,

— ভালো মানুষির মুখোশ পরে বড়লোক ছেলে দেখে নিজের মেয়েকে লেলিয়ে দিয়েছেন।এতোই যখন লোভ তাহলে মেয়েকে রাস্তায় কেন নামিয়ে দিচ্ছেন না।আরেক জনের হবু বরের দিকে নজর দেয়া মেয়ে মানুষের চরিত্র আর কতটা ভালো হবে। আপনার মেয়ে আমার বিয়ে ভাঙতে চাইছে।আর আপনি এখনো এখানে বসে তামাশা দেখছেন?এমন মেয়েকে তো বিষ খাইয়ে মেরে ফেলা উচিত। এসব মেয়েদ,,,
লিজা কথা শেষ করার আগেই আরেকটা চড় পরলো তার গালে।চড়ের দমক সামলে উঠতেই দেখলো ফারহানা বেগম রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। চড় টা সেই দিয়েছে। সানোয়ার সাহেব হতভম্ব হয়ে গেছে ভাগনীর ব্যবহারে।লিজা প্রথম থেকেই উশৃংখল মেয়ে। বড়দের সম্মান করা
তার ধাতে নেই।তাই বলে এতটা উদ্ধত্য!
সায়েবার মা শক্ত হয়ে বসে আছে। তার চোখের কোনায় পানি চিকচিক করছে।এবার আর সায়েবা চুপ করে থাকতে পারলো না।চোখের পানি মুছে মায়ের কাছে গিয়ে বললো,

— এখান থেকে চলো মা।আমার জন্য যতটা অপমানিত হওয়ার হয়েছো।আর না।আমি নিজেও জানতাম না আমার জন্য এখানে এতো কিছু অপেক্ষা করছে।আমাকে ক্ষমা করে দিও মা।(কান্না করে)আমি তোমার ভালো মেয়ে হয়ে থাকতে পারলাম না। ভালোবাসার মতো বড় পাপা আমার দ্বারা হয়ে গেলো। (ফারহানের দিকে তাকিয়ে) ।কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি এসবের কিছুই জানতাম না। যদি জানতাম তাহলে কখনো এখানে আসতাম না।
সায়েবার কন্নার শব্দ ফারহানের বুকে ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে।চোখ দিয়ে যেন এখুনি রক্ত বেরিয়ে আসবে।ফারহান অশ্রুসিক্ত চোখে একবার মায়ের দিকে তাকালো।ফারহানা বেগমের চোখ টলমল করছে। ফারহান নিজের জায়গা থেকে উঠে সায়েবার মায়ের সামনে গিয়ে হাটু গেরে বসে তার হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে অনুনয়ের সুরে বললো,

— আমি সায়েবাকে খুব ভালোবাসি আন্টি।এখানে সায়েবার কোন দোষ নেই। আমিই ওকে এখানে আসতে বলেছিলাম।আমার জন্য আজ আপনাকে এতটা অপমানিত হতে হলো। তার জন্য আই এম সরি।কিন্তু আমার ভালোবাসা টা একবিন্দু ও মিথ্যে নয়।আমি যতটা ভালো আমার মাকে বাসি ঠিক ততটাই সায়েবা কে ভালোবাসি। প্লিজ সায়েবা কে আমার থেকে আলাদা করবেন না। আমি মরে যাবো।এটা ভাববেন না কয়েকদিন পরে সব ঠিক হয়ে যাবে। সায়েবা কে ছাড়া আমার জীবনে কোন কিছু ঠিক হবে না। বেচে থাকার জন্য আমার সায়েবা কে দরকার। ও আমার আসক্তি। আপনি না চাইলে আজকে বিয়ে হবে না। কিন্তু সময় হলে সায়েবা কে আমাকে দিয়ে দিতে হবে। আপনি আমাকে পরিশ্রুতি দিন সায়েবা আমার,আমি আপনার সব কথা মেনে নিবো।
ফারহানের চোখের পানিতে সায়েবার মায়ের হাত ভিজে যাচ্ছে।

— ঠিক আছে। সায়েবাকে আমি তোমার হাতে তুলে দিবো।তবে তার আগে তোমাকে প্রতিষ্ঠিত হয়ে দেখাতে হবে। নিজের বাবার টাকার জোরে নয়।নিজে কিছু করে দেখাতে হবে। ততদিন তুমি সায়েবার সাথে কোন যোগাযোগ করতে পারবে না। সায়েবার পড়াশোনা শেষ হওয়ার আগে যদি তুমি নিজেকে সায়েবার যোগ্য করে তুলতে পারো তাহলে আমি দাঁড়িয়ে থেকে সায়েবাকে তোমার হাতে তুলে দিবো। তবে মনে রেখো,তোমার বাবার টাকায় তুমি কিছু করতে পারবে না।
এক নিশ্বাসে কথা গুলো বলে সায়েবা কে নিয়ে চলে গেলেন সাহেরা বেগম (সায়েবার মা)ফারহান এখনো মাথা নিচু করে ফ্লোরে বসে আছে। সানোয়ার সাহেব স্তব্ধ চোখে ছেলে আর ফারহানা বেগমের দিকে তাকিয়ে আছে।
ফারহানা বেগম সানোয়ার সাহেবের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললো,

— আজকে পরিবার আর তোমার জেদের মধ্যে একটা বেছে নিতে হবে তোমাকে সানোয়ার। এই মেয়ে যদি এই বাড়িতে আর এক মুহুর্ত থাকে তাহলে আমি আমার ছেলেদের নিয়ে এ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবো।
সানোয়ার সাহেব লিজার দিকে তাকিয়ে বললো,
— তুমি বাসায় চলে যাও লিজা।আমার যা বলার আমি তোমার মায়ের সাথে বলবো।
— আমি কোথাও যাবো না মামু।ফারহান কে চাই আমার।আর আমি ফারহান কে ই বিয়ে করবো।
লিজার ব্যবহারে বাসার সবাই বিরক্ত।ফারহান ফরহাদের দিকে তাকিয়ে দাত কিড়মিড় করে বললো,

সায়েবা আসক্তি পর্ব ১০

— এটাকে যাষ্ট বাইরে ফেলে দিয়ে আয় ভাই।আমার ওকে একদম সহ্য হচ্ছে না।
— আরে শান্ত হ ভাই আমার।এতো চিন্তা করছিস কেন?ওর ব্যবস্থা হয়ে যাবে।আর টাকার চিন্তা করছিস কেন? বাবার টাকা নাহয় না ই নিলি।আমাদের মায়ের ও কিন্তু অনেক টাকা।কি বলো আম্মু?(বাকা হেসে)

সায়েবা আসক্তি পর্ব ১২