বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৫

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৫
জাওয়াদ জামী

কায়েস অঝোরে কাঁদছে। সে এত বছরেও বাড়ির কারও সাথে যোগাযোগ করেনি, বিধায় সে জানেনা, তার আব্বা-আম্মা কেউই বেঁচে নেই। বড় বোনের কাছে আব্বা-আম্মার কথা জিজ্ঞেস করতেই জানতে পারে তারা কয়েক বছর আগেই মা’রা গেছে। কথাটা শোনার পর থেকেই কায়েস কাঁদছে।

” আপা, এতবড় ভুল আমি কিভাবে করলাম! আইরিন কতবার বলেছে, বাড়িতে যেয়ে আব্বা-আম্মার কাছে ক্ষমা চাইতে। তাদের পায়ে ধরে মাফ চাইলে তারা আমাদের ক্ষমা করে দিবে। কিন্তু আমি একটাবারও আইরিনের কথা শুনিনি। সেদিন যদি ওর কথা শুনতাম, তবে আমি আব্বা-আম্মার শেষ সময়ে তাদের পাশে থাকতে পারতাম। ”
” আব্বা তোদের সেই কবেই ক্ষমা করে দিয়েছিল। তোদের বিয়ে মেনে নিয়েছিল। তোদের গ্রাম থেকে চলে আসার দুই বছর পর আব্বা আইরিনের বাবার বাড়িতে গিয়েছিল। তাদের কাছে ক্ষমা চাইতে। আব্বা ভেবেছিল, তারা বোধহয় তোদের খবর জানে। একসময় দুই পরিবারের সম্পর্ক জোড়া লেগেছিল। কিন্তু তারা তোদের কোন খোঁজ পায়নি। আব্বা সব কিছুর বিনিময়ে তোকে ফিরে পেতে চেয়েছিল। ”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

” আইরিন যখন গ্রামে যাওয়ার কথা বলত, তখন আমি ওর সাথে রা’গ করতাম। আমি ভাবতাম, বাড়িতে গেলে আব্বা আবার যদি অপমান করে তাড়িয়ে দেয়। এখানেই একটা কোম্পানিতে ভালো পদে জয়েন করেছিলাম। আইরিনকে নিয়ে সুখেই ছিলাম। তাই বাড়িতে যাওয়ার কথা ভাবিনি। কিন্তু সব সময়ই তোমাদের জন্য, আব্বা-আম্মার জন্য মন কেমন করত। তারপরও বুকে পাথর চেপে থেকেছি। পাষাণ সাজার চেষ্টা করতে গিয়ে আমি সত্যিই পাষাণ হয়ে গেছি, আপা। আব্বা-আম্মাকে শেষ চোখের দেখাটাও দেখতে পারলামনা। তাদের কবরে একমুঠো মাটি দিতে পারলামনা। এতটাই অযোগ্য সন্তান আমি। ”

আফরোজা নাজনীন ভাইয়ের চোখের পানি সহ্য করতে পারছেননা। এত বছর পর তিনি তার ভাইকে ফিরে পেয়েছেন, তিনি তার ভাইকে সুস্থ, সুখী দেখতে চান। তারা তিন বোন মিলে ভাইকে নানানভাবে শান্তনা দিতে থাকেন।
চার ভাইবোনের সুখ-দুঃখের গল্প করতে করতে দুপুর গড়িয়ে যায়। ততক্ষণে দৃষ্টি আর শিহাব বাড়িতে চলে এসেছে।

কায়েস ওদেরকে ফুপুদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। ওরা দুই ভাই-বোন এত বছর পর ফুপুদের পেয়ে ভিষণ খুশি হয়। শিহাব আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেছে। ওর নাজমা পারভিনকে ভিষণ পছন্দ হয়েছে। মেজ ফুপুর কোল থেকে ও নামছেইনা। নাজমা পারভিনও ভাতিজাকে পেয়ে ভিষণ খুশি। তিনি শিহাবকে বুকে শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছেন।
এরইমধ্যে শিউলি রুম থেকে বেরিয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পর সে ফিরে আসে।

” আপা, দুপুর গড়াইছে সেই কখন। আপ্নেরা আসার পর থাইকা খাবার দিই নাই। এখন উঠেন হাত-মুখ ধুইয়া চারডা ভাত মুখে দেন। ” শিউলির কথা শুনে তারা সবাই পেটে ক্ষুধার অস্তিত্ব অনুভব করছেন।
নাজমা পারভিনের কেন যেন শিউলিকে পছন্দ হয়না। শিউলির কথার ধরন ভালো লাগেনি তার। এছাড়াও শিউলির হাঁটাচলা, মুখভঙ্গি সব কিছুই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ্য করেছেন তিনি। শিউলির কোন কিছুই তার পছন্দ হয়নি।
আফরোজা নাজনীনের কথায় তারা দুই বোন উঠে কলপাড়ে যায়।

রান্নাঘরের একপাশে মাদুর বিছিয়েছে শিউলি। সবাই হাত-মুখ ধুয়ে সেখানেই এসেছে।
আফরোজা নাজনীন কায়েসকে নিজের কাছে বসিয়েছেন। কায়েসও বাধ্য ছেলের মত বড় বোনের পাশে বসে।
শিউলি সবার প্লেটে একে একে ভাত, তরকারি তুলে দেয়। তরকারি বলতে শুধু ডাঁটা দিয়ে তেলাপিয়া মাছের ঝোল। শিউলি একটাবারও ভাবেনা, এই প্রথম সে ননদদের দেখছে। তারা আজই প্রথম ভাইয়ের কাছে এসেছে। শুধু এক তরকারি দিয়ে খেতে দিবে কেমন করে। সে কোন কিছু না ভেবেই মাছের ঝোল দিয়ে ননদদের খেতে দেয়। অথচ ঘরে ডিম আছে। সে ইচ্ছে করলেই দুইটা ডিম ভাজতে পারত।

” বড় আপা, তরকারিটা খুব মজার হয়েছে, তাইনা? অনেকদিন পর এত স্বাদের রান্না খাচ্ছি। ” শাহনাজ সুলতানা মজা করে খাচ্ছেন।
” হুম, খুব ভালো লাগছে খেতে। তুমি রান্না করেছ, শিউলি? ” আফরোজা নাজনীন বললেন।
শিউলি একটু আমতাআমতা করছে বড় ননদের প্রশ্নের উত্তর দিতে। কিন্তু ও কিছু বলার আগেই শিহাব কথা বলে।
” ফুপু, আমাদের বাড়ির সব রান্নাই কুহুপু করে। আজকেও আপুই রান্না করেছে। আপু সেই ভোরে উঠে রান্না করে। আবার বিকেলে এসে রাতের জন্য রান্না করবে। আম্মুকে কিছুই করতে হয়না। বাসনপত্রও আপু এসে পরিষ্কার করে। ”
শিহাবের কথা শুনে তারা তিন বোন অবাক হয়ে শিউলির দিকে তাকান। একটা মেয়ে পরিবার চালাচ্ছে চাকরি করে। সে আবারও সংসারের সব কাজও করে!

” তুমি সত্যি বলছ, আব্বা? ” নাজমা পারভিন উদগ্রীব হয়ে জানতে চান।
এদিকে শিহাব ছোট মানুষ। তার একটা কথায় যে এই পরিবারের সবকিছু ফাঁস হয়ে যাবে সে সম্পর্কে ওর কোন ধারনাই নেই। সে খেতে খেতে যা জানে সব গড়গড়িয়ে বলে দেয়।

” হুম ফুপু। আম্মু আপু যাওয়ার পর ঘুম থেকে উঠে। আপু রান্না করে, খাবার এখানে সাজিয়ে রেখে যায়। আম্মু ঘুম থেকে উঠে আমাদের খেতে দেয়। খাওয়ার পর আম্মু প্লেটগুলো কলপাড়ে রেখে দেয়। আপু এসে সেগুলো পরিষ্কার করে। সন্ধ্যার পর তিনজনকে প্রাইভেট পড়িয়ে আবার রান্না করতে বসে। এছাড়া বাড়ির সবার কাপড়চোপড় আপুই ধোয়। ”
শিহাবের কথা শুনে আফরোজা নাজনীনসহ তার দুই বোন স্তব্ধ হয়ে গেছে।

এদিকে শিউলি মনে মনে ছেলেকে হাজারটা গালি দিচ্ছে।
দৃষ্টি ও কায়েস চুপচাপ খাচ্ছে। কারন তারা জানে, তারা যদি এখন কোনও কিছু বলে, পরে শিউলি ওদেরকে মুখ দিয়ে ধুয়ে দিবে। পারতপক্ষে কায়েস কিংবা দৃষ্টি কেউই শিউলিকে সুকৌশলে এড়িয়ে চলে।
আফরোজা নাজনীন ভাতিজার কথা শুনে চুপচাপ খেতে থাকেন। তবে তিনি বুঝতে পেরেছেন তার বড় ভাতিজীটি সৎমায়ের সংসারে সুখে নেই।

আসরের নামাজের পর বাসায় ফিরে কুহু অবাক হয়ে যায়। তিনজন নতুন মুখ সে দেখল। দৃষ্টি আর শিহাবের মুখে হাসি ধরছেনা। তারা দুইজন সেই তিনজন মহিলার গা ঘেঁষে বসে আছে। তারাও যেন আগলে রেখেছে দৃষ্টি আর শিহাবকে। ছোটমা মুখ কাঁচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
কিন্তু বাবার মুখের তাকিয়ে, তার চোখেমুখে খুশির ঝলক ঠিকই লক্ষ্য করল।
” এই যে আমার মা এসে গেছে। “আয় মা, এদিকে আয়। ”
বাবার ডাক শুনে তার কাছে এগিয়ে যায় কুহু।

কিন্তু ও বাবার কাছে পৌঁছাতে পারেনা। তার আগেই আফরোজা নাজনীন ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। কুহুর সরু ডানহাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়েছেন।
” নাজমারে, এ কি দেখছি আমি! কতদিন পর মায়ের মুখ দেখছি বলে মনে হচ্ছে! মায়ের মুখ কতদিন দেখিনা বলতো! আজ যেন মায়ের মুখখানি দেখার সাধ মিটল! ” আফরোজা নাজনীন দু’হাতের আঁজলায় কুুহুর মুখটা তুলে ধরেছেন।
নাজমা পারভিন এবং শাহনাজ সুলতানাও উঠে দাঁড়িয়েছেন। তারাও আগলে নেন কুহুকে।
” তুমি ঠিক বলেছ, বড় আপা। এ যেন অবিকল আমার মায়েরই মুখখানি! কে বলেছে আমাদের মা নেই! এ যে আমাদেরই মা হয়ে আবার ফিরে এসেছে। ” নাজমা পারভিনের কন্ঠে বিস্ময়।

কুহু বুঝতে পারছেনা ইনারা কারা। আর কার কথাই বা বলছেন। সে শুধু চুপচাপ থেকে সবার কথা শুনছে।
” বুঝলে শিউলি, আমার আব্বা ছিলেন ফর্সা আর আম্মা শ্যামলা। আমার সব ভাই-বোনই আব্বার মত গায়ের রং পেয়েছে। শুধু আমি ছাড়া। আমি আম্মার গায়ের রং পেয়েছি। আবার আমার আম্মার চেহারার সাথে কায়েসের চেহারার খুব মিল। আর কায়েসের সাথে কুহুর চেহারার কত মিল। তাই কুহুকে প্রথম দেখেই আমরা চমকে গেছি। ” আফরোজা নাজনীন সহাস্যে বললেন।

এবার কুহুর বুঝতে বাকি থাকেনা ইনারা কারা। আনন্দে ওর চোখে পানি এসে গেছে। সে এবার আবেগে আপ্লুত হয়ে ফুপুদের জড়িয়ে ধরে। বাবা প্রায় দিনই নিজের গ্রাম, দাদা-দাদি আর ফুপুদের নিয়ে কত গল্প করে। কুহু মুখ তুলে তাকায় ফুপুদের দিকে। চিনতে চেষ্টা করে কে, কোন ফুপু।
খানিক পরেই হাসিমুখে কথা বলে সে,

” তুমি আমার বড় ফুপু। আমার দাদীর কৃষ্ণ কলি। তুমি আমার মেজ ফুপু। আমার দাদার ফুলকুমারি। আর তুমি আমার ছোট ফুপু। আমার বাবার মায়া রানী। ” একে একে তিন ফুপুর দিকে নির্দেশ করে বলে কুহু।
কুহুর কথা শুনে ওর তিন ফুপু চোখ বড় বড় করে তাকায়। এই মেয়েটি তাদের সম্পর্কে আগে থেকেই জানে! আবার সেই অনুযায়ী চিনেও ফেলেছে!
” হ্যাঁ সোনা মা, আমিই তোর দাদির কৃষ্ণকলি। কতদিন পর তুই আবার নামটা মনে করিয়ে দিলি। আম্মা মা’রা যাবার পর এই নামে আর কেউ ডাকেনা। ”

” তুই আমাদের এসব নাম জানিস! বাবার কাছে শুনেছিস নিশ্চয়ই? ” শাহনাজ সুলতানা চোখ মুছে বললেন।
” তুই সত্যিই আমাদের মা হয়ে এসেছিস। আমাদের মা, যে অনেক বছর আগে হারিয়ে গেছে। সেই থেকে আমরা কাঁদছি। আজ আরেকবার তুই কাঁদালি। ” নাজমা পারভিনও কাঁদছেন। সেই সাথে চুমু দিচ্ছেন কুহুর চোখেমুখে।
” বড় ফুপু, তোমার তো বিয়ে হয়েছে, তাইনা? ” শিহাব হঠাৎই বলে উঠে।
শিহাবের কথা শুনে সবাই কান্নার মাঝেও হেসে ফেলে।

” হুম আব্বা, আমার অনেক আগেই বিয়ে হয়েছে। কিন্তু তুমি এটা জিজ্ঞেস করছ কেন? ”
” আপু যে বলল, দাদি তোমাকে কৃষ্ণকলি ডাকত। কৃষ্ণকলি তো কালো মেয়েদের ডাকে! আপুকে এই পাড়ার একটা ভাইয়াও কৃষ্ণকলি ডাকে। তার কাছ থেকেই জেনেছি, কৃষ্ণকলি মানে কালো মেয়ে। কিন্তু আম্মু যে আপুকে বলে, তুই কালী, তোর বিয়ে হবেনা। কোন রিক্সওয়ালা কিংবা টোকাইয়ের কাছে তোকে বিয়ে না দিলে ভালো কেউ তোকে বিয়ে করবেনা! তোমার যদি ভালো জায়গায় বিয়ে হয়, তবে আপুর কেন হবেনা? ” ছোট্ট শিহাব ফুপুদের পেয়ে একে একে মনে সব কথা উগরে দিচ্ছে।

এদিকে শিহাবের কথা শুনে আফরোজা নাজনীন চরম মাত্রায় বিস্মিত। কবে তিনি এটা বেশ বুঝতে পারছেন, সৎমায়ের সংসারে কুহু ভালো নেই। তবে আজ প্রথম দিন জন্য তারা তিনজনই চুপ থাকেন।
আর দৃষ্টি আছে অন্য চিন্তায়। আজ ফুপুরা চলে গেলে, শিহাব আর কুহুকে রিমান্ডে নিবে তার মা। এটা ভেবেই ওর হাত-পা ঘামছে। আজ শিহাবের ভুলে আপুর কপালে দুর্ভোগ আছে।

কুহু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আজ ছোটমা নির্ঘাত ওকে দু-চার কথা শুনিয়ে দিবে। কুহুও মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় ও ছোটমার কথার কঠিনভাবে প্রতিবাদ করবে। যদিওবা ও সব সময়ই প্রতিবাদ করার চেষ্টা করে। কিন্তু এখন থেকে আর তাকে কোনরকম ছাড় দিবেনা।
কুহু বাড়িতে এসেছে অনেকক্ষণ। কিন্তু এখন পর্যন্ত ওর খাওয়া হয়নি। নাজমা পারভিন লক্ষ্য করলেন শিউলি একটাবারও মেয়েটাকে খাওয়ার কথা বললনা।

” কুহুতান, সেই কখন এসেছিস, এবার একটু খেয়ে নে মা। যা তারাতারি খেয়ে আয়। ”
নাজমা পারভিন ভাইয়ের মেয়েকে তাড়া লাগালেন।
” যাচ্ছি ফুপু। ” কুহুও আর দাঁড়ালোনা। ওর ভিষণ ক্ষুধা পেয়েছে। সেই সকালে দুইটা রুটি খেয়ে বেরিয়েছিল।
কুহু ঘরে যেয়ে পোশাক পাল্টে কলপাড়ে যায়। মুখহাত ধুয়ে রান্নাঘরে আসে খেতে। সারা রান্নাঘর খুঁজেও কোন খাবার পায়না। ও বুঝতে পারে ছোটমা ফুপুদের খেতে দিয়েছিল, তাই খাবার নেই। ও হাসিমুখে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসে। কেউ লক্ষ্য না করলেও নাজমা পারভিন লক্ষ্য করলেন কুহু না খেয়েই রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। তবুও মেয়েটার মুখে হাসি। এক তীব্র ব্যথায় নাজমা পারভিনের বুক চিনচিন করে ওঠে। মেয়েটা কতইনা কষ্টে দিনাতিপাত করছে!

” কুহু, দৃষ্টি, শিহাব তোমরা সবাই তৈরি হও। আমরা সন্ধ্যার আগেই এখান থেকে বেরিয়ে যাব। শিউলি তুমিও তারাতারি কর। কাপড়চোপড় গোছগাছ করতে আমরা সাহায্য করছি। কায়েস আর দেরি করিসনা। ”
আফরোজা নাজনীনের কথা শুনে কায়েসসহ সবাই প্রশ্নবোধক চাহনিতে চায় আফরোজা নাজনীনের দিকে।
” আপা, আমরা কই যামু? ” শিউলি প্রশ্ন করেই বসে।

” তোমরা আমার বাবার বাড়িতে যাবে। যেটা কায়েসের নিজের বাড়ি। আমার আব্বার বিষয়আশয়, সম্পত্তি থাকতে তোমরা এখানে কেন কষ্ট করবে? কুহু যা সোনা মা কাপড় গুছিয়ে নে। শুধু কাপড়চোপড় নাও, অন্য কিছু নিতে হবেনা। দৃষ্টি, শিহাব তোমরাও যাও। তোমাদেরকে ছোট ফুপু সাহায্য করবে। ”

” আপা, আমি এভাবে যেতে পারবনা। এত বছর আব্বা-আম্মার খোঁজ নিইনি। তাদের মৃ’ত্যু’র সময়ও পাশে ছিলামনা। তাদের ক’ব’রে একমুঠ মাটি দিতে পারিনি। আমি সেই অকৃতজ্ঞ ছেলে হয়ে আব্বার বাড়িতে কিভাবে ফিরে যাব। ”
” আব্বা মৃ’ত্যু’র আগে আমাদের সবার সম্পত্তি ভাগ করে দিয়ে গেছে। তোর যা যা প্রাপ্য তার সবই তোর নামে করে দিয়েছে। আব্বার কাছে তোর কোন দোষ ছিলনা শেষ পর্যন্ত। সে তোকে প্রানভরে দোয়া করে গেছে। তুই তোর অধিকার বলে তোর বাড়িতে যাবি। আমি আর কতদিন এসব সামলাব? আর কোন কথা বলবিনা। যা তৈরি হয়ে নে। এখন দেরি করলে গ্রামে পৌঁছাতে মাঝরাত হয়ে যাবে। ” আফরোজা নাজনীন নরম গলায় ভাইকে বোঝান৷

” কিন্তু আপা, আমি এই বাড়িঘর এম্নে ফালায় যামু কেম্নে? সব চুরি হইয়া যাইব। ”
” কি আছে তোমার এই বাড়িতে? আমার আব্বার বাড়িতে যেয়ে দেখবে কি কি আছে সেখানে। এই বাড়ির মায়া করলে সারাজীবন তোমার এইভাবেই দিন যাবে। দুই দিনের ভেতর এই বাড়ি বিক্রির ব্যবস্থা করব। এখন এই বাড়ির মায়া না দেখিয়ে তৈরি হয়ে নাও। বড় আপার কথা আমরা কেউ কখনো অমান্য করিনা। এখন থেকে তোমাকেও সেটাই করতে হবে। ” নাজমা পারভিন এবার মুখ খুললেন। তিনি আসার পর থেকেই শিউলি আক্তারের ভাবভঙ্গি দেখে তাকে পছন্দ হয়নি তার।
এরপর আর কোনও কথা থাকেনা।

শিউলি ইতিউতি করতে করতে তৈরি হয়ে নেয়। ছেলেমেয়েরাও তৈরি হয়ে বড় ফুপুর কাছে আসে।
বাড়ির জিনিসপত্র সব ঘরে তুলে রেখে বাড়িটা তালাবন্ধ করে ওরা গাড়িতে উঠে বসে। ওদের কাছে শুধু তিনটা ব্যাগ যেখানে সবার কাপড়চোপড় আছে।
প্রায় আধাঘন্টা পর নাজমা পারভিন ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলে, ছেলেমেয়েদের নিয়ে নেমে পরেন। সামনে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে খাবার অর্ডার করেন। ছেলেমেয়েদের খাইয়ে তিনি সবার জন্য খাবারের প্যাকেট নিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে আসেন।

গ্রামে পৌঁছাতে ওদের রাত বারোটা পেরিয়ে যায়। রাস্তায় প্রচুর জ্যাম থাকায় তাদের পৌঁছাতে দেরি হয়।
আফরোজা নাজনীন আগেই ওদের বাগান, বাড়ি দেখাশোনা যে করে তাকে ফোন করে বলে রেখেছিলেন।
গাড়ি বাড়ির সীমানায় ঢুকতেই বেরিয়ে আসে শফিকুল ইসলাম। যার কাছে কায়েসের বাবার বিষয়সম্পত্তির দ্বায়িত্ব দেয়া আছে।

রাতের ঘন কালো আঁধারে শিউলি প্রথমে কিছুই বুঝতে পারেনা। বাইরের উঠানের আলো জ্বলতেই ও চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে থাকে। ও ভাবতেই পারেনি কায়েস এতবড় বাড়ির ছেলে।
শিহাব, দৃষ্টি ওরা ঘুমিয়ে গেছিল। আফরোজা নাজনীন ওদের মৃদুস্বরে ডাক দিলে, ওরা চোখ কচলে ঠিক হয়ে বসে। এরপর একে একে বেরিয়ে আসে গাড়ি থেকে।

কায়েস বিশ বছর পর নিজ বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে অতীতের স্মৃতিচারন করতে ব্যস্ত। এই বাড়ির প্রতিটি কোনায় কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে। এতবছরেও সেসব একটুও মলিন হয়নি। আজ সেই বাড়ি, সেই বাগান সবই আছে, কিন্তু তার বাবা-মা নেই।
ছেলেমেয়েরা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ওদের দাদাবাড়ীর দিকে। কতবড় বাড়ি ওদের!
” সোনা মা, এই যে তোদের বাড়ি। তোদের দাদার বাড়ি। ”

কুহু অন্ধকারেই আনাচেকানাচে তাকাচ্ছে। বাবার কাছ থেকে এই বাড়ির অনেক গল্প শুনেছে ও৷ তাই পুরো বাড়িটার নকশা ওর মুখস্থ হয়ে গেছে। ও দেখতে চেষ্টা করছে বাবা যেভাবে বলেছিল, সেগুলো সব ঠিক ঠিক জায়গায় আছে কি-না। রাতের ঘন আঁধারে সেগুলো নিরীক্ষা করতে ব্যর্থ হয় সে।
হতভম্ব ছেলে-মেয়ের হাত ধরে কায়েস বিশ বছর পর প্রবেশ করে তার নিজ বাড়িতে। যেখানে তার নাড়ি পোঁতা রয়েছে। জড়িয়ে রয়েছে একরাশ মায়া।

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৪

কুহু ওর বড় ফুপুর হাত ধরে কম্পমান পায়ে প্রবেশ করছে তার দাদার বাড়িতে। না দেখেও যে মানুষটাকে ও অসম্ভব ভালোবাসে। যার জন্য মনের কোনে জমা রেখেছে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার সাগর।

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৬