ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ২৪
নীহারিকা নুর
আম্মু এই আম্মু কথা বলতেছো না কেন৷ চোখ খোলো আম্মু। আম্মু তুমি কি রাগ করে আছো আম্মু। এই আম্মু আমি আর কোন অন্যায় করব না আম্মু। তুমি যা বলবা সব শুনব। আর রাত করে বাসায় ফিরব না আম্মু। তোমারে ছাড়া আর এক বেলাও খাবার খাব না প্রমিজ আম্মু। একটা বার ফিরে এসো না আম্মু প্লিজ।
করুণ কন্ঠে আর্তনাদ করছিল হসপিটালের করিডোরে বসে। র’ক্তে মাখানো মায়ের মুখশ্রীতে হাত বেলাচ্ছে আর পা’গলের মতো চুমু খাচ্ছে। আশপাশে থাকা ড. নার্সরা দাড়িয়ে দাড়িয়ে আর্তনাদ দেখছে। একপাশে দেয়ালে হেলান দিয়ে নিশ্চুপ হয়ে বসে আছেন তায়েফ সাইয়িদ। আশপাশের মানুষ জন সান্ত্বনা না দিয়ে ভিডিও করছে। সিঙ্গার তুরাগ সাইয়্যিদ তার মায়ের মৃ’ত দেহের সামনে বসে আর্তনাদ করছে এরকম ভিডিও ব্লগ হিসেবে ছাড়বে না তা কি করে হয়। এখন মানুষ মানুষের বিপদে এগিয়ে আসার আগে ব্যাস্ত থাকে কখন ছবি তুলবে কখন ভিডিও করবে তা নিয়ে৷
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মাকে ছেড়ে উঠে দাড়ায় তুরাগ। পাশাপাশি তিনটা লা’শ শোয়ানো। দ্বিতীয় লা’শটার মুখের দিকে তাকায়। মোহনার থেতলানো মুখ দেখে আতকে ওঠে তুরাগ। আর দেখার সাহস হয় না। কাপড় টেনে ঢেকে দেয় মুখ। পরের জন ছিল ড্রাইভার। সবাইকে পাশ উঠে পা’গলের মতো দৌড়ে আবার অপারেশন থিয়েটার এর সামনে যায়। মাস্ক খুলতে খুলতে ড. বেরুচ্ছে সেখান থেকে। হামলে পড়ে তুরাগ ড. এর উপর।
– ড. পেসেন্ট এর কি অবস্থা। ও সুস্থ আছে তো ড.।
-……..
– কথা বলছেন না কেন ড.। কি হয়েছে বলুন না।
– আ’ম স্যরি মি. সাইয়্যিদ।
ড. এর মুখে স্যরি শব্দটা শুনে মাথা ফাকা হয়ে গেল তুরাগ এর। ওদিকে মায়ের লা’শ পড়ে আছে। এদিকে মিথিলার ক্ষীণ আশা জেগে ছিল। ড. এর মুখে স্যরি শব্দ শুনে সেই আশাটুকুও যেন নিভে গেল। হাটু৷ ভেঙে সেখানেই বসে পড়ল তুরাগ। তখন কাধে হাত রাখল ড.। আস্তে আস্তে মাথা তুলে তাকালো তুরাগ।
– সে মা’রা যায় নি। তবে-
বসা থেকে এক লাফে উঠে দাড়ায় তুরাগ৷ ব্যাস্ত কন্ঠে জানতে চায়
– কি বললেন ড.। তবে কি, কি হয়েছে বলুন না
– আসলে
– ড. প্লিজ।
– তিনি কোমায় চলে গেছেন। এটা থেকে তিনি কবে আবার সুস্থ লাইফে ফিরে আসতে পারবেন তার কোন নিশ্চয়তা নেই। আর বয়স্ক যেই নারী ছিল তিনিও গুরুতর আহত৷ তবে তিনি খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হবেন আশা করা যায়।
ড. চলে যায় সেখান থেকে। সেখানেই হাটুগেরে বসে পড়ে তুরাগ৷ চিতকার করে কাধতে থাকে। মানুষ বলে ছেলেদের নাকি কাদতে নেই। কে বলেছে। ছেলেদের ও মন বলে কিছু আছে। তাদের ও কষ্ট হয়।
এরকম একটা মুহুর্তে নিজেকে কি করে সামলাবে তুরাগ। গলা ফাটিয়ে চিতকার করে কাদছিল সেখানে বসেই। তুরাগ এর বাবাও বাকহারা হয়ে আছেন। তিনি কোন কথাই বলছেন না। তুরফাকে এখনো জানান নি। এরকম একটা কথা তো মেয়েটাকে বলার সাহস নেই তার। কয়দিন আগেই এসে গেল। এখন হুট করে বাসায় আসতে বললেই মেয়েটা বুঝে যাবে। এত দূরের পথ। কি করে আসবে মেয়েটা একা একা।
হঠাৎ পেছন থেকে কাধে কেউ হাত রাখায় গোটানো হাতের শার্টে নিজের চোখ মুছে পেছনে মুখ ঘুরায় তুরাগ। পেছনে কালাম মেল্লা, প্রান্তসহ আর বাকি সবাইকে দেখে উঠে দাড়ায় তুরাগ। কালাম মোল্লা বুকে টেনে নেয় তুরাগকে। সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করে।
– ভাই আপনার মাথার ব্যাথা
– আমি ঠিক আছি। একটা খবর দেয়ার ছিল। যদিও এই মুহুর্তটায় কি বলব তোমাকে।
– আমরা হেরে গেছি ভাই।
কালাম মোল্লা মাথা নেড়ে না বোঝায়। কান্না থামে তুরাগ এর। জড়িয়ে ধরে আবারও কালাম মেল্লাকে। এরকম একটা পরিস্থিতি না হলে আজকের দিনটা হতে পারত অন্যরকম একটা খুশির দিন। এই নির্বাচন এর জন্য কত কষ্ট করেছে। আজ দেখো দলের সবাই উদযাপন বাদ দিয়ে তুরাগকে সান্ত্বনা দিতে হসপিটালে ছুটে এসেছে। প্রান্ত এগিয়ে আসে সামনে। বুকে জড়িয়ে ধরে তুরাগকে।
– প্রান্ত এরকমটা কেন হলো আমার সাথে। আমি মনে হয় বড় কোন পাপ করেছি। যার কারণে আমাকে এত বড় শাস্তি পেতে হচ্ছে। আমি তো মাকেও কষ্ট দিয়েছি। মা কি আমাকে ক্ষমা করবে প্রান্ত। কি করব এখন আমি।
– শান্ত হ ভাই। আন্টি তোকে অনেক আগেই ক্ষমা করে দিয়েছে। সন্তানরা কতো ভুল করে। কিন্তু মা বাবারা কি সেই ভুল ধরে বসে থাকে বল। মা বাবারা কখনো সন্তান এর উপর রাগ করে থাকতে পারে না। তুই এখন আন্টির জন্য দোয়া কর। উপরওয়ালা যেন তাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করেন।
– —-
– দেখ ভাই ভোটের ফলাফল শোনার পরেই এখানে চলে এসেছে। কথা বলবি না তার সাথে।
– আহা প্রান্ত কি করছো। ওর সিচুয়েশনটা বোঝো। কাদুক। কাধতে দাও। কান্না করলে মন হালকা হয়৷
– তুরাগ তুরফাকে বলবি না।
– আমি বলতে পারব না। তুই একটু ওরে আনার ব্যাবস্থা কর না।
– হুম।
কালাম মোল্লা জিগেস করেন
– আচ্ছা তখন হসপিটাল থেকে বের হওয়ার পর কি হয়েছিল বলোতো। ফোন দিয়ে পেলাম না যে।
ফ্লাসব্যাক –
দুপুরে হসপিটাল থেকে রে’গে বেরিয়ে গেলেও বাহিরে এসে মাথায় কাজ করল যে না এই মুহুর্তে নিজেকে শান্ত করা জরুরি। নিজেকে শান্ত করার প্রচেষ্টা চালালেন। ভাই অসুস্থ এখন যদি সেও ঝামেলা করে তাহলে এদিক দেখবে কে। তাই চলে এলো কেন্দ্রে। সারাদিন এ কেন্দ্র থেকে ও কেন্দ্রসা দৌড়াদৌড়ি করে পাচটার দিকে ফ্রি হলো। এরপর ভোট গননার পালা।
তুরাগ ভেবেছিল এখন একটু বসে নিবে। সেই মুহুর্তেই পকেটে থাকা ফোনটা বাজখাই শব্দে বে’ঝে ওঠে। এই মুহুর্তে ফোন আসায় বিরক্ত হলেও ফোন বের করে ফোন রিসিভ করলো। ওপর পাশ থেকে জানালো যে হসপিটাল থেকে ফোন করেছে। হসপিটাল থেকে ফোন শুনেই বসা থেকে উঠে দাড়ায় তুরাগ৷ মিথিলা হসপিটালে তাই মনে করেছিল মিথিলার কিছু হয়েছে। কিন্তু হসপিটাল থেকে জানালো তাদের গাড়ি এক্সিডেন্ট করেছে।
সবার অবস্থা গুরুতর৷ সেই মুহুর্তে সেই অবস্থায় ছুটে বেরিয়ে আসে তুরাগ। প্রান্ত সাথে আসতে চাচ্ছিল। কিন্তু তুরাগ না করে দেয়। এখানে থাকতে বলে। দিগ বিদিক শুন্য হয়ে ছুটে এসেছিল হসপিটালে। এখানে আসতে আসতে হসপিটাল এর সামনে বসেই শুনতে পায় একটা গাড়ি এক্সিডেন্ট এ নাকি তিনজনই স্পট ডে’ড। দুজন এখনো আছে তবে গুরুতর আহত। সব মানুষজন ঠেলেঠুলে দৌড়ে হসপিটাল এর ভেতরে আাসে তুরাগ।
সামনেই বাবাকে বসে থাাকতে দেখে। গিয়ে জানতে চায় কি হয়েছে। জবাব দেয় না তিনি। এক ধ্যানে স্ট্রেচারে সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা লা’শের দিকে তাকিয়ে আছে তিনি। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে সেদিকে তুরাগ। ধীর গতিতে পা ফেলে সেখানে যায় তুরাগ। কাপা কাপা হাতে মুখের উপর থেকে কাপড় সরিয়ে যখন মায়ের মুখখানা দেখে তখনি মা বলে জোরে এক চিতকার দেয়। এরকম একটা সিচুয়েশনে পা’গলপ্রায় অবস্থা তুরাগ এর।
ফ্লাসব্যাক শেষ
তুরাগ এই মুহুর্তে একদম দুর্বল হয়ে গেছে। একদিকে মায়ের চলে যাওয়া। ভালোবাসার মানুষটা কোমায়। মোহনা মেয়েটাকেও ছোট বোনের মতো ভালোবাসত৷ তার নিথর দেহটাও হসপিটালের করিডোরে পড়ে আছে। কি করবে না করবে কিছুই বুজতে পারতেছে না। প্রান্তরা সহ বাকি সবাই মিলে হসপিটালের ফরমালিটিজ গুলো সম্পন্ন করে নিয়ে আসে তাদের। মিথিলা আর মিথিলার মা হসপিটালেই রইল।
মোহনার ভাগ্যটা কত অদ্ভুত তাই না। এতদিন যাবত নিজের বড় বোনের সেবা করে গেল। কোথায় বড় বোনকে নিয়ে সব সময় চিন্তা করত কি হবে না হবে তা নিয়ে। আজ সব চিন্তাকে অবসর দিয়ে নিজেই চিরবিদায় নিল। শেষ সময়টাতে তার কোন আপনজন তাকে একনজর দেখার সুযোগ পেল না। এরকম ভয়’ঙ্ক’র ভাগ্য কারো না হোক৷
নুরনাহার চলে যাওয়ার আজ পাঁচ দিন গত হয়েছে। তুরাগদের সমস্ত পরিবার যেন এখনো নিশ্চুপ হয়ে আছে। তুরফা এসেছিল পরদিন সকালে। কিন্তু মেয়েটা ইন্ট্রেভার্ট স্বভাবের। নিজের অনুভুতি গুলো যে কারো সামনে প্রকাশ করবে তাও পারে না। সেও তার বাবার মতো বাকহারা হয়ে চুপচাপ হয়ে আছে। ভেতরে ভেতরে ঘুমড়ে ম’রছে কিন্তু বাহিরে প্রকাশ করছে না। তহমিনাকে জড়িয়ে ধরে বলে আমার মা তো আমাকে একবারও বলল না মামিমা। তাহলে তো জীবনেও মাকে ছেড়ে যেতাম না। আমাকে না বলে গেল কেন মা। আমি কাকে মা বলে ডাকব মামিমা।
মায়ের দাফন শেষ হওয়ার পর আবার হসপিটাল এসেছিল তুরাগ। পা’গল পা’গল অবস্থা হয়ে গেছে। এখন আর বাসায় ফেরেনা। খাওয়া দাওয়াও ঠিকঠাক করে না। কেউ বাসায় নিতে চাইলেও বলে
– আমি বাসায় কার কাছে যাবো। কি করব গিয়ে। আমি মা বলে কাকে ডাকব। যাবো না আমি ও বাসায়। কোনদিন যাবো না। কেউ জোড় করেও নিতে পারে না। সবাই এসে দেখে যায়। তহমিনা এসে খাবার খাওয়াইয়া যায়।
তরুর দাদি থেমে থেমে মেয়ের জন্য কান্না করেই যাচ্ছেন। একজন মায়ের সামনে তার সন্তান এর চলে যাওয়া দেখাটা কতটা কষ্টের তা কেবল একজন মা ই জানে যে তার সন্তান হারিয়েছে।
ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ২৩
যেই সংসার নুরনাহার সামলাতো আজ তা তহমিনা দেখতেছে। কিন্তু কতদিন। তাকেও তো ফিরে যেতে হবে। এসব ফেলে কীভাবে যাবে সে।
মিথিলার মা এখনো হসপিটালে ভর্তি। তাকে এখনো মোহনার কথা বলা হয় নি। তিনি নিজেই তো অসুস্থ। তারউপর তার দুই মেয়ের আজ এমন দশা। এত শক তিনি নিতে পারবেন না। তাকে কীভাবে বলবে এটাই ভেবে পাচ্ছে না কেউ।