সে আমার সুকেশিনী পর্ব ১৭

সে আমার সুকেশিনী পর্ব ১৭
রাউফুন

ভোর চারটের পর থেকেই ভীষণ জ্বরে কাহিল অবস্থা বিউটির। প্রচন্ড জ্বরের ধাক্কা কিছুদিন আগেই সামলে আবারও এরকম জ্বর বাড়ির সবাইকে চিন্তিত করে তুলেছে। তার উপর আজ তার বিয়ে।
তার এমন তুমুল জ্বরে কি তার বিয়ে হবে? সুপ্রিয় ভাই বর বেশে এসে যদি তাকে এমন কাত হয়ে বিছানায় পড়ে থাকতে দেখে তবে কি বলবে?

টিটকারি করে বড়ই রসিকতার সহিত বলবে, ‘কি রে বিয়ে করবি নাকি? নে এবারে কর বিয়ে। বিয়ের কথা শুনতেই এতো জ্বর বাঁধিয়ে ফেললি। এতো দূর্বল শরীরে বিয়ে করবি কিভাবে? আমার সঙ্গে বিয়ের সময় যদি প্রতিবার তুই জ্বরে কাহিল হয়ে যাস বিয়ে হবে কিভাবে? প্রতিবার এরকম অসুস্থ হলে বিয়ে টা আর করা হবে না বুঝলি? আঠারো বছরের অপেক্ষা হবে আজীবনের অপেক্ষা।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

চিরকালের চিরকুমার এর খাতায় নাম লেখালে কেমন হয়? নামটা লিখিয়েই ফেলি কি বলিস? না হলে তুই এক কাজ কর, ভালো ভালো খাবার খেয়ে শরীরে বল নিয়ে আয়। আমি এমন দূর্বল মেয়েকে বিয়ে করতে পারবো না।’

সুপ্রিয় ভাইয়ের এতো এতো জ্ঞানের কথার মাঝেও বিউটি মুগ্ধ হয়ে সুপ্রিয়কে দেখে যাবে। চমৎকার হেসে বলবে, ‘সুপ্রিয় ভাই আপনাকে বর বেশে দারুন লাগছে। মনে কি চাচ্ছে জানেন? টপাটপ দশ বারোটা চুমু দিয়ে দিই। বুড়ো বয়সে এতো সুন্দর হচ্ছেন কেন? বলেছি না সুন্দর হবেন না? আপনি সুন্দর হলে আপনাকে নিয়ে আমার মহা বিপত্তি বাঁধবে। পরনারীর কু দৃষ্টি পড়বে আপনার উপর৷ আমি আপনার অর্ধাঙ্গিনী হয়ে সহ্য করবো কি করে?’

‘এখন আমাকে সুন্দর দেখালে আমার কি দোষ? আমি কি নিজে নিজে সুন্দর হয়েছি?’
‘নিজে নিজে সুন্দর না হোন, অসুন্দর তো হতেই পারেন?’
‘কিভাবে?’
‘কেন মুখে কালি মেখে! যেখানে যাবে কালি মেখে বের হবেন।’
‘আমি সারাক্ষণ মুখে কালি নিয়ে ঘুরবো? এতো গোবরে ঠাসা কেন তোর মাথা? এই বুদ্ধির বহর তোর? তোর বরকেই তো মানুষ শেষে কালো বলবে! তখন কি বলবি?’

‘ওমা কালো সে তো মানুষ জানবে। আমি তো জানি আমার বর ফর্সা টকটকে,সুদর্শন। একদম খেয়ে ফেলা’র মতো সুন্দর!’
‘ছিঃ বিউটি। তোর মনে এসব চিন্তা আমাকে নিয়ে? এসব বিচ্ছিরি ভাবে আমাকে ভাবিস?’

খিলখিল করে হেসে উঠলো বিউটি। হাসির দাপটে সারা শরীর দুলে উঠলো। কিন্তু মাথা যন্ত্রণায় আর হাসা সম্ভব হলো না। প্রচন্ড জ্বরে জীর্ণশীর্ণ হয়ে বিছানায় চিৎপটাং শুয়ে থাকা বিউটির চোখ বন্ধ হয়ে আসছে বার বার। সে আধো আধো চোখে দেখলো তার মা তার মাথায় পানি দিয়ে দিচ্ছে। চোখ বন্ধ এই অবস্থায় সে সবাইকে দেখছে। এটা ভীষণ বিস্ময়কর ব্যাপার তাই না? মাথায় পানি ঢালছেন মা, তার মানে তিঁনি মাথার পেছনে।

চোখ খোলা অবস্থাতেও তাঁকে দেখতে পাওয়ার কথা না। মাছি হলে দেখতে পেতো। মাছিদের মাথার পেছনেও চোখ থাকে। কিন্তু সে মাছি না হয়েও সবাইকে দেখতে পাচ্ছে। এটা কি বিস্ময়কর ব্যাপার না? বিস্ময়কর নাকি অদ্ভুত ঘটনা? এই ঘটনাকে কি বিস্ময়কর নাকি অদ্ভুত ঘটনা বলে? কি বলে আখ্যায়িত করা যায়? অদ্ভুত না বিস্ময়কর? তাঁর মা কি রঙের শাড়ী পরেছেন তাও সে দেখতে পাচ্ছে। ব্লক প্রিন্ট করা শাড়ী। ডিজাইন আর কড়া গোলাপি রঙটা চোখে বিঁধছে। আজ তাঁর মেয়ের বিয়ে আর তিনি কি না এরকম একটা বিশ্রি শাড়ী পরেছেন? মেয়ের বিয়েতে সবচেয়ে সুন্দর করে সাজুগুজু করা উচিত মেয়ের মায়ের। আশ্চর্য!

ঠান্ডার পানির স্রোতে ভীষণ আরাম লাগছে বিউটির। ঘুমানো উচিত তার। জ্বরের ঘুমও কষ্টের! ঘুমের মধ্যে জ্বরাক্রান্ত ব্যাক্তি মাথায় দপদপ, যন্ত্রণা অনুভব করতে পারে। তাছাড়া এভাবে ঘুমালে হবে না। আজ তার বিয়ে। অনেক কাজ পরে আছে। আজকে সুপ্রিয় ভাই বর বেশে আসবে। সে আজকে সুন্দর একটা শাড়ি পরবে। আর যায় হোক বউ সাজলে লাল টুকটুকে একটা শাড়ী না পরলে হয়?

শেষে দেখা গেলো যার বিয়ে তাকে কেউ-ই চিনলোই না। জীবনে প্রথম বার তার মনে হচ্ছে তার এই সাদা হলুদ রঙের ড্রেস ছেড়ে বিয়েতে সুন্দর করে শাড়ী পড়তে হবে। বিয়েতে কি আর হলুদ সাদা রঙের ড্রেস পরা যায়? উঁহু! এখন তো তার সুপ্রিয় ভাই এসে গেছে। কিসের চিন্তা আর? সুপ্রিয় ভাইকে দেখতে দেখতে তার চোখ পুরোপুরি বন্ধ হলো। হঠাৎই তার মনে হচ্ছে সুপ্রিয় ভাই দৌঁড়ে তার কাছে আসছে। কিন্তু তাকে কেউ আসতে দিচ্ছে না। জোর করে বেঁধে রেখেছে! সুপ্রিয় ভাই চিৎকার করছে।

বিউটির ঘুম ভাঙলে সে দেখলো মারিয়াম তার পাশেই বসে বসে ঝিমাচ্ছে। অন্য পাশে লিমন আর তার বাবা। তার মা, ভাবি হইতো বাইরে কাজ করছে। মাকে বলতে হবে সুন্দর একটা শাড়ি পরার কথা৷ আর ভাবিকেও সুন্দর একটা বেনারসি পড়তে বলতে হবে। বিয়ে বাড়িটাকে এতো নির্জীব লাগছে কেন? সবাই হৈচৈ করবে। মজা করবে তা না। অন্তত পক্ষে অনেক জন মানুষের গমগম আওয়াজ তো শোনা যাবে? তাও শোনা যাচ্ছে না। আশ্চর্য!

‘আব্বু, ভাইয়া তোমরা আমার রুমে কি করছো?’
‘কি করছি মানে? চারপাশে তাকিয়ে দেখো কোথায় তুমি!’
বিউটি ভালো ভাবে তাকিয়ে দেখলো এটা তার বেডরুম না। সারা রুম আর জানালার পর্দা সহ সাদা আর নীল। পাশের টেবিলে অনেক গুলো ডাক্তারি অস্র। তার মানে এটা হসপিটাল। সে হসপিটালে? তবে তার বিয়ের কি হলো?

কড়া ফিনাইলের গন্ধ তার পেটে ভুড়ভুড় করে শব্দ হলো। সে তার বাবা ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে বললো,
‘এই সামান্য জ্বরে আবার তোমরা আমাকে হসপিটালে এনেছো? আশ্চর্য। আগেও বলেছি না আমাকে এই সামান্য কারণে হসপিটাল নিয়ে আসবে না। কথা শুনো না কেন তোমরা?’

‘তুমি পুরো ছত্রিশ ঘন্টা থেকে অজ্ঞান, আর তুমি বলছো তোমাকে হসপিটাল আনবো না? একবার ভাবো কতটা খারাপ অবস্থা হওয়ার পর হসপিটাল নিতে হয়েছে তোমাকে?’ বলতে বলতে হাশেম আলীর গলা কেঁপে উঠলো। বিউটি অবাক হয়ে গেলো সে পুরো একদিনের উপরে অজ্ঞান ছিলো? তার মানে বিয়ে ক্যান্সেল! তার বিয়েটা ভেঙে গেছে? সুপ্রিয় ভাই আদোতে আসলো না বর বেশে? কিন্তু সে যে স্পষ্ট দেখলো সুপ্রিয় ভাই এসেছে সুন্দর একটা শেরওয়ানী পড়ে।
‘ভাইয়া, আমার গতকাল বিয়ে ছিলো। বিয়েটা ভেঙে গেলো তবে?’

‘ভেঙে যায়নি তো। সায়রের বাবা, তিনি অনেক দিন শয্যাশায়ী ছিলেন। তোদের বিয়ের দিন তিনি ইন্তেকাল করেছেন। বিয়েটা হবে তবে আরও দুই মাস পর। ম’রা আর বিয়ে তো একই বাড়িতে হতে পারে না? ম’রা ম’রা গন্ধ আছে না?’
বিউটির এই সংবাদ টা শুনে ভীষণ খারাপ লাগছে। মারিয়াম ঘুম ঘুম চোখে তাকালো। তড়িঘড়ি করে জিজ্ঞেস করলো,

‘বিউটি তুই ঠিক আছিস? জ্বর কমেছে? সায়রের বাবার মৃ’ত্যুর কথা শোনার পর সেই যে অজ্ঞান হলি এখন জ্ঞান ফিরলো!’
‘আমাকে বলেছিলি?’
‘হ্যাঁ কেন তোর মনে নেই?’
‘নাহ!’

‘আচ্ছা দেখি তোর জ্বর কমেছে কি না!’ মারিয়াম বিউটির কপালে হাত দিয়ে দেখলো এখনো প্রচন্ডরকম জ্বর রয়েছে বিউটির।
‘লিমন ভাই, যান ডক্টরকে ডাকুন। ওর যে জ্বর কমেনি এখনো।’

লিমন বেজার মুখে চলে গেলো। একটা মাত্র বোন আর তার শরীরে বাসা বেঁধে রয়েছে বিশাল ভয়ংকর রোগ! তার চোখ ভিজে যাচ্ছে বার বার। কিন্তু পুরুষ মানুষের তো কাঁদতে নেই। হাশেম আলী অনেক্ষন যাবৎ চুপ করে রইলেন। এরপর তিনিও চলে গেলেন বাইরে। মেয়ের সামনে বসে থাকা দায় হয়ে যাচ্ছে। বিউটি তাকে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করছিলো কিন্তু তার কানে কোনো কথায় যায় নি।

সন্দিপ্তা আর শাহানা বেগমকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেহেতু সায়রের বাবা মা’রা গেছে আর একই সঙ্গে রাহেলার স্বামীও হয় নওশের হোশেইন, তাই মৃত্যু শোক দুই বাড়িতেই লেগেছে! হাশেম আলী বুকে ব্যথা অনুভব করলেন। তিনি বুকে হাত দিয়ে বসে পরলেন একটা ব্রেঞ্চে। কিছুক্ষন বসে থাকার পর তিনি উঠে আস্তে আস্তে হেঁটে বাড়ি চলে গেলেন।
বিউটি শুয়ে পরলো। মারিয়াম তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।

বিউটি বললো, ‘আমার জন্মদিনের দিন রাত এগারোটা পঞ্চান্ন মিনিটে সুপ্রিয় ভাই এসেছিলো জানিস? কেক এনেছিলো, এই দেখ আমার গলায় লকেট দেখছিস, এটা সুপ্রিয় ভাই দিয়েছে। আরও সুন্দর একটা চিঠি দিয়েছে। আমার সঙ্গে দেখা করেনি। আমার কি ইচ্ছে করছিলো জানিস? পুরো একটা বাথটবে পানি ভরিয়ে, সেটাতে সুপ্রিয় ভাইকে চুবিয়ে চুবিয়ে দম বন্ধ করা কষ্ট দিতে। এই যে আমাকে দেখা না দিয়ে চলে গেছে এর একটা বিহিত হওয়া দরকার তাই না?’

মারিয়াম তাকিয়ে দেখলো সত্যিই বিউটির গলায় সুন্দর একটা প্লাটিনামের চেইন। অন্য সময় হলে মারিয়াম ভাবতো, এসব বিউটির কল্পনা। কিন্তু না, সত্যিই বিউটির রুমের টেবিলে একটা বড়সড় কেক ছিলো। চিঠিও সে দেখেছে। বিউটি চোখ বন্ধ অবস্থাতেই বললো, ‘কি হলো কথা বলছিস না কেন? আচ্ছা বাথটবের বাংলা কি রে?’

‘বাথটবের বাংলা মানে? তুই বাথটবের বাংলা জেনে কি করবি?’
‘কিছু করবোনা। তবে জানতে মন চাচ্ছে!’
‘আমি জানি না। এতো জিনিস থাকতে তোর বাথটবের বাংলা জানতে মন চাইলো?’
‘আশ্চর্য, জানিস না বলবি না। এতো কথা শুনাচ্ছিস কেন?’
‘কথা শুনালাম? কখন?’

সে আমার সুকেশিনী পর্ব ১৬

‘এই যে প্যাঁচাচ্ছিস কথা। আশ্চর্য তোদের সঙ্গে কথাও বলা যাবে না।’
‘জ্বরে তোর মাথা ঠিক নেই।এতো কথা বলিস না।লিমন ভাই আসছে না কেন এটাই বুঝতে পারছি না। তুই শুয়ে থাক আমি আসছি!জ্বর যখন মাথায় উঠে যায় তখন মানুষ আবোলতাবোল প্যাঁচাল পারে। আমি যায়,লিমন ভাই কি করছে দেখি!’
মারিয়াম চলে গেলো। বিউটির দুই চোখ বেয়ে পানি পরলো। অজান্তেই তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে।

সে আমার সুকেশিনী পর্ব ১৮