অনেক সাধনার পরে পর্ব ৮

অনেক সাধনার পরে পর্ব ৮
অরনিশা সাথী

–“ঠিক আছে, কথা বলো ওর সাথে। ওকে জিজ্ঞেস করো তোমাকে নিয়ে ওর অনুভূতি কি? যদি ছেলেটার’ও তোমাকে পছন্দ হয় আমি সব দিক ভেবে চিন্তে দেখবো। আমি নিজে ওর পরিবারের সাথে কথা বলবো। ফোন করো এক্ষুনি।”
–“আ্ আব্বু আমি___”
রায়হান সাহেব রুজবাকে চোখ দিয়ে আস্বস্ত করে বললো,
–“ফোন করো।”
–“ফোন মায়ের কাছে।”

রায়হান সাহেব রুপশাকে ডেকে বললো ওর মায়ের ফোন দিয়ে যেতে। কিছুক্ষণ বাদে রুপশা ফোন দিয়ে গেলে রায়হান সাহেব ইশারায় ফোন করতে বললো। রুজবা কাঁপা কাঁপা হাতে মেসেঞ্জারে গিয়ে জারাফকে ফোন করলো। জারাফ অনলাইনেই ছিলো। তাই সাথে সাথেই ফোন রিসিভ করলো। প্রথমে টুকটাক জিজ্ঞেস করে বললো,
–“আ্ আব্বু কথা বলবে।”
জারাফ ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

–“আমার সাথে?”
–“হ্যাঁ।”
–“আচ্ছা।”
রুজবা ওর বাবার দিকে ফোন এগিয়ে দিলো। রায়হান সাহেব ফোন কানে নিতেই জারাফ সালাম দেয়। রায়হান সাহেব সালামের জবাব দিয়ে ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করলো। জারাফের পরিবার সম্বন্ধে জানলো। সব শুনে রায়হান সাহেব জিজ্ঞেস করলো,

–“রুজবাকে কি তোমার পছন্দ?”
জারাফ শান্ত কন্ঠে বললো,
–“হ্যাঁ।”
–“বিয়ে করার জন্য পছন্দ নাকি সময় কাটানোর জন্য?”
জারাফ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
–“বিয়ে করার জন্য।”
–“তার মানে বলছো, বিয়ে করতে চাও রুজবাকে?”
–“আ___”

হঠাৎ করেই রায়হান সাহেব ফোনের ওপাশে চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ পেলেন। জারাফের ওদিকে হয়তো কোনো শোরগোল বেঁধে গেছে। রায়হান সাহেব বেশ কয়েকবার হ্যালো হ্যালো করলেন। কিন্তু ওপাশ থেকে কোনো সাড়া শব্দ পেলেন না। ফোন কান থেকে নামিয়ে দেখলো কেটে গেছে। রায়হান সাহেব ফোনটা রুজবার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
–“বললো তোমাকে পছন্দ। বিয়ের কথা বলতেই লাইন কেটে গেলো। তোমাকে সামনের বৃহস্পতিবার বিকেল অব্দি সময় দিলাম। জারাফের সাথে কথা বলো। দেখো ওর কি জবাব আসে। ওর দিক থেকে কোনো জবাব না আসলে শুক্রবারে আমার পছন্দ করা ছেলের সাথেই তোমার কাবিন হবে। তোমার হাতে আর তিনদিন সময় আছে।”

কথাগুলো বলেই রায়হান সাহেব ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। রুজবা ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লো। হুট করে জীবনটা এলোমেলো হয়ে যাবে না তো? কান্না কান্না পাচ্ছে ভীষণ রুজবার। রুজবা জারাফকে আবারো ফোন করলো। কিন্তু জারাফ ফোন তুলছে না। বারবার কেটে দিচ্ছে। শেষ বার ফোন রিসিভ করে শুধু বললো,
–“আমি একটু ব্যস্ত আছি রুজ, পরে কথা বলবো তোমার সাথে।”

রুজবাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই জারাফ লাইন কেটে দেয়। ফোনটা ছুঁড়ে বিছানায় ফেললো রুজবা। টেবিলে দুহাত তুলে তাতে মুখ গুজে নিঃশব্দে কাঁদছে। এতদিন তো জারাফ এত ব্যস্ততা দেখায়নি, তাহলে আজ কেন দেখাচ্ছে? তা’ও রায়হান সাহেব কথা বলার মাঝেই খট করে লাইন কেটে দিলো ও। তাহলে কি রুজবা এতদিন ভুল ভেবে এসেছে? জারাফের কি কোনো ফিলিংস নেই রুজবার জন্য?

বিষন্ন মনে ছাদের উপর দাঁড়িয়ে রাতের আকাশ দেখছে নুহাশ। হাতে জলন্ত সিগারেট। যখন খুব বেশি মন খারাপ থাকে, কষ্ট অনুভব হয় মনে বা রেগে থাকে তখনই সিগারেট হাতে নেয় নুহাশ। নয়তো ছুঁয়ে’ও দেখে না। নুহাশের আজ ভিতরে ভিতরে সব যেন জ্বলে পুড়ে ছাঁই হয়ে যাচ্ছে। ভিতরটা ঝলসে যাচ্ছে। দগ্ধ ঘাঁ যেন বুকের ভিতরে জুড়ে। রুজবার নামের সাথে জারাফ নামটা সহ্য হয় না ওর। সেখানে রুজবার পাশে জারাফের উপস্থিতি কতটা ভয়ানক প্রভাব ফেলে নুহাশের মনে সেটা শুধুমাত্র নুহাশ’ই জানে। নুহাশ সিগারেটের ধোঁয়া আকাশে উড়িয়ে দিয়ে বললো,

–“তোমাকে আমি যতটা ভালোবাসি তার থেকেও অসম্ভব বেশি তুমি ভালোবাসবে আমায়। আমার থেকেও আমাকে বেশি বুঝবা। ভোর-সন্ধ্যায় পাগলের মতো খুঁজবা আমায়। এমন একটা সময় আসবে আমাকে ছাড়া কিচ্ছু বুঝবা না। সেই দিনটার অপেক্ষায় আছি আমি। চাওয়া সৎ/হালাল থাকলে আল্লাহ অবশ্যই পূর্ণ করবে।”
এইটুকু বলে আবারো সিগারেটে টান দিলো। সিগারেটের ধোঁয়া শূণ্যে উড়িয়ে দিয়ে চোখের কোনে জমা পানিটুকু মুছে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো,

–“চাইতেই থাকবো, প্রতিদিন চাইবো, লাগবে তো লাগবেই। কিভাবে দিবে, কখন দিবে তা আমি জানি না, তবে আমার চাই-ই চাই। দিতে হবে তো হবেই। উঠতে, বসতে, খেতে, শুতে, নামাযে, মোনাজাতে সবসময় চাইতেই থাকবো তুমি না দেওয়া পর্যন্ত। লাগুক সময়, একদিন, একসপ্তাহ, একমাস, একবছর বা তার চেয়েও বেশি কিন্তু তা আমার চাই-ই চাই। হতেই পারে সেটা আমার জন্য অকল্যাণ কিন্তু ইয়া রব, তুমি চাইলে তাতে’ও কল্যাণ ঢেলে দিতে সক্ষম। তুমি চাইলে সেই অকল্যাণ জিনিসটা’ও আমার জন্য কল্যাণের হবে। নিশ্চয়ই শুধু তুমিই তো দিতে পারো। সে আমার না হওয়া অব্দি আমি তাকে পাওয়ার চেষ্টা কিছুতেই ছাড়ছি না।”

কাঁধে কারো স্পর্শ পেয়ে পাশ ফিরে তাকালো নুহাশ। নিবির দাঁড়িয়ে আছে। নুহাশ সিগারেট ফেলতে চেয়ে’ও ফেলল না। নিবির আর নুহাশ ছোট থেকেই বেশ ক্লোজ। নুহাশ সিগারেটে একটান দিয়ে নিবিরের দিকে এগিয়ে দিলো। নিবির সিগারেট নিয়ে বললো,
–“তুই তো সচারাচর সিগারেট খাস না। আজ হঠাৎ তোর হাতে সিগারেট যে?”
নুহাশ শূণ্যে ধোঁয়া উড়িয়ে বললো,

–“এমনি।”
নিবির সিগারেটে শেষ টান দিয়ে সিগারেট ফেলে দিলো। তারপর বললো,
–“কাহিনী কি বল তো?”
–“কিসের কাহিনী?”
–“রুজবাকে হঠাৎ করে বিয়ে করতে চাইছিস, কোনো ঝামেলা বা কিছু হয়েছে?”
–“তেমন কিছু না। রুজবার বাবা কিছু জানিয়েছে?”
–“বাবা তো বললো এখনো কিছু জানায়নি। উনারা তেমন একটা রাজি না এখন রুজবাকে বিয়ে দিতে। তার উপর তুই এখনো স্টুডেন্ট।”

–“সো হোয়াট? এখন স্টুডেন্ট আছি, সবসময় তো আর থাকবো না। আমার বাবার কি টাকা পয়সা কম আছে? এগুলো কাদের জন্য করেছে? অবশ্যই আমাদের দুই ভাইয়ের জন্য। আমার বাবার যে টাকা আছে তাতে আমি বসে খেলেও সমস্যা নেই। আর মেয়েকে তো একদিন আগে পরে বিয়ে দিবেই। তাহলে এখন বিয়ে দিতে সমস্যা কি?”
নিবির নুহাশের কাঁধ চাপড়ে বললো,

–“কুল, এত রিয়্যাক্ট করছিস কেন?”
–“আমার ওকে চাই।”
–“আমরা তো অমত করিনি। বাবা তো চেষ্টা করছে রুজবার বাবা’কে মানাতে। এখন উনি রাজি না হলে___”
–“এতকিছু জেনে লাভ নেই। আমার ওকে চাই মানে চাই। এখন সেটা কিভাবে এনে দিবে সেটা তোমাদের ব্যাপার। বড় ভাই হিসেবে এইটুকু দায়িত্ববোধ তোমার অবশ্যই আছে আমার প্রতি? রুজবা’র বাবা রাজি না হওয়া অব্দি লেগে থাকো বাবা আর তুমি। কত দিন আর অমত করবে? একদিন না একদিন ঠিক রাজি হবে।”
কথাগুলো বলেই নুহাশ ছাদ থেকে নেমে গেলো। নিবির নুহাশের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আপন মনেই বললো,

–“তোকে এখন কি করে বোঝাই ভাই? আমরা তো চাই তুই যাতে তোর ভালোবাসার মানুষটাকে নিজের করে পাস। কিন্তু এখানে রুজবা’র বাবা রাজি না হলে আমরা কতদূর কি করতে পারবো বল? এত্ত জেদী আমার ভাইটা৷ নাহ দেখি আমি একবার আংকেলের সাথে কথা বলবো।”
বিড়বিড় করে কথাগুলো বলে নিবির’ও ছাদ থেকে নেমে যায়।

বৃহস্পতিবার সকাল আজ। আজকের দিনটুকুই আছে রুজবার কাছে। কাল শুক্রবার। এখনো জারাফের ফোন বন্ধ। গতকাল থেকেই ওর ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে। রুজবা একের পর এক ফোন দিচ্ছে। কিন্তু ফলাফল শূণ্য। কলেজ যায়নি ও আজ। ভালো লাগছে না কিছু। হঠাৎ করে জারাফের এমন নিরবতা ওকে ভালো থাকতে দিচ্ছে না। এতদিন তো বেশ ছিলো। তাহলে বিয়ের কথা উঠতেই এত নিরব কেন জারাফ? ভেবে পাচ্ছে না রুজবা। ফারিন এসে বসলো রুজবার পাশে। রুজবাকে মনমরা দেখে ফারিন জিজ্ঞেস করলো,

–“কি হয়েছে?”
–“জারাফের ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে এখনো।”
–“এইজন্য মন খারাপ করে বসে আছিস? হয়তো কোনো সমস্যায় পড়েছে তাই।”
–“কিন্তু এই অব্দি ওর ফোন কখনো বন্ধ পাইনি আমি। পরশু আব্বু বিয়ের কথা বলতেই___”
–“তুই কি তোর প্রতি জারাফের ফিলিংস সম্পর্কে সিয়র ছিলি?”
–“আমার মনে হতো ও আমাকে ভালোবাসে।”
–“ও তোকে ভালোবাসার কথা বলেনি রুজবা। হাবভাবে তো কত কিছুই বোঝা যায়। তুই না জেনে বুঝেই কাকা’কে জারাফের কথা বললি কেন?”
রুজবা অসহায় চোখে তাকালো। বিষন্ন গলায় বললো,

–“গত কয়েকদিন ধরে কেউ আব্বুকে আমার জন্য বিয়ের কথা বলছে। আব্বু রাজি ছিলো না। কিন্তু সেদিন কে যেন জারাফের সাথে আমাকে দেখে আব্বুকে জানিয়েছে। তাই আব্বু এই সম্বন্ধের ব্যাপারে ভাবছে ফারু। আমাকে দুটো অপশন দিয়েছে। আজ বিকেলের মধ্যে জারাফের জবাব চাই নয়তো কাল আব্বুর পছন্দ করা ছেলের সাথে কাবিন করতে রাজি হতে হবে আমার। জানিস’ই তো। এখন কি করবো আমি? জারাফের ফোন বন্ধ পাচ্ছি। ভালো লাগছে না আমার।”

–“তোদের তো রিলেশন নেই রুজবা, তাহলে এতটা কষ্ট কেন হচ্ছে তোর?”
–“আমি জারাফকে ফিল করি, ওর জন্য আমার ফিলিংস কাজ করে ফারু।”
কথাটা বলেই ডুঁকরে কেঁদে উঠলো রুজবা। ফারিন রুজবার মাথা নিজের কাঁধে এনে ওর গালে হাত বুলিয়ে বললো,
–“কাঁদিস না। যা হবে ভালোই হবে।”
রুজবা কিছু না বলে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ফারিন ভাবছে,

–“তুই জারাফের জন্য কাঁদছিস, জারাফ যদি আজকের মধ্যে জানায় তোকে ভালোবাসে তাহলে কাকা জারাফের সাথে তোর বিয়ের কথা বলবে। আর যদি জারাফের দিক থেকে কোনো রেসপন্স না পাওয়া যায় তাহলে কাল অন্য একজনের সাথে তোর কাবিন হওয়ার সম্ভাবনা। অচেনা অজানা একটা মানুষের সাথে কাটাতে হবে সারাজীবন তোকে। এটা যদি নুহাশ ভাই জানে তাহলে উনার কি হবে?

অনেক সাধনার পরে পর্ব ৭

নুহাশ ভাইয়ের পুরো দুনিয়া তো উলটে যাবে। জারাফের সাথে তুই রিলেশনে নেই। শুধুমাত্র জারাফের জন্য তোর মনে ফিলিংস আছে। তাই তুই কেঁদে কেটে বুক ভাসাচ্ছিস। আর ওদিকে নুহাশ ভাই তোকে তিন বছর ধরে পাগলের মতো ভালোবাসে। তার মনে কি বয়ে যাবে সেটাই ভাবছি। নিশ্চয়ই পাগল পাগল হয়ে যাবে? উনার অবস্থার কথাটা আমি ভাবতে পারছি না।”

অনেক সাধনার পরে পর্ব ৯