অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ২৮

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ২৮
Mousumi Akter

ফায়েকের কঙ্কাল শরীর, জীর্ণদশা অবস্থা।ওয়াসেল আঘাত কারাতেই শরীরের দূর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে।সে কাঁপছে।চোখ দিয়ে পানি নির্গত হচ্ছে। দেখতেই অসহায় লাগছে।দারিদ্রতার সাথে সংগ্রাম করে বেঁচে আছে তা শরীরের দিকে তাকালেই বোঝা যায়।

শীত নেই, গরম নেই, মেঘ নেই, তুফান নেই তার মাঝে পানিতে ভিজে জীবন কাটিয়ে দিলো শুধু মাছ ধরে ধরে।জীবনে ভোগ বলে কিছুই করতে পারেনি। চৌধুরীদের সব কথা মাথা পেতে মেনে নিচ্ছে বছরের পর বছর।শুদু মাত্র মাছের বিনিময়ে পাওনা টাকার চেয়ে একটু বেশী টাকা পাবে তাই।ওয়াসেল এর আগেও অনেকবার খারাপ ব্যবহার করেছে তবে গায়ে হাত তোলেনি।আজ তুলেছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

শুধু মাত্র দরিদ্র মানুষ বলেই চুপচাপ সহ্য করল এমন অত্যাচার।গাল কে’ টে র*ক্ত গড়িয়ে পড়ছে ফায়েকের।যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে।শরীরের ব্যাথার চেয়ে অপমানের ব্যাথায় তার চোখ দিয়ে পানি নির্গত হচ্ছে। প্রভাত নিচু হয়ে বসল ফায়েকের সামনে।ফায়েকের দুই বাহু ধরে দাঁড় করিয়ে পকেট থেকে রোমাল বের করে র* ক্ত মুছে দিল।পরম ভালবাসা আর সম্মানের সাথে যন্ত্রণায় কাতর কন্ঠে ফায়েকের দুই গালে হাত রেখে বলল,

“ফায়েক চাচা এ বাড়িতে আপনি আর কোনদিন আসবেন না।আপনার জীর্ণ শরীরটা খেয়াল করছি আমার জন্মের পর থেকে।আপনাকে দেখে আমি অবাক হই।একটা মানুষ এতটা নিঃস্বার্থবান সরল মনের অধিকারী কীভাবে হতে পারে।রোজ সকালে আপনার সহজ সরল মুখটা দেখে দেখে আমি বড় হয়েছি।আমি জানি আপনার অভাবের সংসার, তবুও মুখের হাসি যেতে দেখেনি।দশ কিঃমি রাস্তা রোজ সকালে হেঁটে আপনি মাছ নিয়ে আসেন।ভাড়ার টাকা বাঁচাতে কোনদিন ভ্যান গাড়িতে চড়েন নি।আমি চিংড়ি পছন্দ করি বলে কোনদিন নদীর ভাল চিংড়ি টা নিজের ছেলেকে খাওয়ান নি।এত কষ্ট করে হেঁটে কেন আপনি মাছ নিয়ে আসেন? আজ থেকে অন্য জায়গা বিক্রি করবেন।আপনার বাড়ির আশে -পাশের বাজারে বিক্রি করবেন।”

ফায়েক প্রভাতের কথা শুনে চোখের পানি ছেড়ে দিল।তার মত সামান্য মানুষকে চৌধুরী বাড়ির কেউ কোনদিন এত গুরুত্ব দিবে সে ভাবতে পারেনি।ফায়েকের চোখের পানি দেখে প্রভাত বলল,
“প্লিজ কাঁদবেন না চাচা।আপনার না একটা ছেলে আছে।যদিও আমি তাকে চিনিনা।সে কেমন তা জানিনা।আপনার এত কষ্টের মূল্য সে কোনদিন দিতে পারবে কীনা জানিনা।সে যদি নাও দেয় আমি আপনার ছেলে হয়ে আপনাকে দেখব সারাজীবন। ”

ফায়েক নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছে না।প্রভাত ভাল সে জানে।এতটা ভাল সে জানত না।ফায়েক অশ্রুমিশ্রিত চোখে তাকিয়ে আছে প্রভাতের দিকে।প্রভাত আবার ও বলল,
“কাজের যে মেয়েটিকে আপনি নিয়ে এসেছেন নিয়ে যান।ওরা অমানুষ।ওদের জন্য যত যা করেন না কেন ওরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে না। আপনাকে আর কোনদিন মাছ নিয়ে আসতে হবেনা চাচা।আমি মাস শেষে আপনাকে টাকা পাঠাব সেই টাকায় আপনি চলবেন।খুব অফসোস হয় যে আমি ওয়াসেল চৌধুরীর ছেলে।বাবা হয় আমার।গায়ে তো হাত তুলতে পারিনা।

তাই আপনাকে বলেছিলাম আপনি গায়ে হাত তুলুন।আপনাকে কিছু বললে আমি দেখে নিতাম।ওয়াসেল আর ওয়াজেদ চৌধুরী যে অন্যায়গুলা করে সারাদিন জনসম্মুখে নিয়ে কু* ত* ত্তা পে’ টা’নো’র মত পে’ টা’ লে’ ও শোধ হবেনা।ওয়াসেল চৌধুরীর মত ধনী কেউ নয়, আপনার মত একজন দরিদ্র জেলে যদি আমার বাবা হত আমি গর্বের সাথে বলতাম আপনি আমার বাবা।বিশ্বাস করুন চাচা আমি ওয়াসেল চৌধুরীর পরিচয় কোথাও গিয়ে দিইনা।ওদের ব্যবসা,বাণিজ্য কিছুর সাথে আমি জড়িত নই।

ওরা আমাকে ওদের ব্যবসায়ের হাল ধরতে বলে কিন্তু আমি ধরিনা।আমি ওদের সম্পত্তি নিয়ে গর্ব করতে চাইনা। চেষ্টা করেছি নিজের যোগ্যতায় পরিচিতি লাভ করতে।কিন্তু ভাগ্য খারাপ আমি না চাইতেও মানুষ আমাকে চৌধুরী বাড়ির ছেলে বলে অন্য রকম চোখে দেখে। বাইরের মানুষ যখন বলে তুমি ওয়াসেল চৌধুরীর ছেলেনা? এত ভাল একজন মানুষ তোমার বাবা তুমি নিজেও জানোনা।তোমার বাবা সাক্ষাৎ একজন দেবদূত।তখন আমি মানুষের মুখের দিকে আশ্চর্যজনক চাহনিতে তাকিয়ে থাকি।কিছুই বলতে পারিনা।মৃদু হেসে জায়গা ত্যাগ করি।চাইলেও তো চিৎকার দিয়ে বলতে পারিনা আপনারা যা ভাবেন তা সত্য নয়।চাইলেই অনেক কিছু বলা যায়না চাচা।আমিও বলতে পারিনা।তবে আর নয়।আমি কোনো অন্যায় আর হতে দিবনা।”

ফায়েক বোকা মানুষ। সে কিছুই বুঝল না।সে বোকা হেসে বলল,
“ওয়াসেল স্যার তো সত্যি তো ভালা মানুষ। রাগের জন্য আমার গায়ে হাত তুলছে।অনেক সময় এসব হয়ে যায়।কিন্তু এইডা তো সত্যই স্যার মানুষের সাহায্য করে।”
প্রভাত ফায়েকের সরলতা দেখে মলিন হেসে বলল,
“যান চাচা আপনি চলে যান।”

ফায়েক বাইরে গেল।মিনিট দু’য়েকের মাঝে একটা মেয়ের হাত ধরে চৌধুরীতে পদার্পন করল।দূর থেকে পূর্ণতা দেখল তার চেয়ে কম বয়সী একটা মেয়ে। কেউ কিছু বলার আগে ফায়েক বলল,
“প্রভাত বাবা ওর নাম হইলো পূজা।আমাগো জেলে পাড়ার গনেশ দাদার মেয়ে।স্যার আমাকে কইছিলো একটা কামের বেডি খুঁজতে।গনেশ দাদারে কয়ে বলে রাজি করিয়ে এনেছি।আপনারা ওরে মাস শেষে যা দিবেন ও তাতেই খুশি।”

ওয়াসেল প্রভাতের কাছে আজ চরম অপমানিত হয়ে চুপ আছে।প্রভাতের উদ্দেশ্য বলল,
“আমি গেস্ট হাউজে যাচ্ছি।মেয়েটির সাথে কথাবার্তা বলে ঠিক করো সব।আমি আর এসব বিষয়ে থাকছি না।”
ওয়াসেল এর সাথে ওয়াজেদ ও চলে গেল।পূর্ণতা প্রভাতের কাছাকাছি এসে দাঁড়াল।প্রভাত মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল,

“কি নাম তোমার?”
“পূজা স্যার।”
প্রভাত একটু শক্তপোক্ত কন্ঠে বলল,
“আমাকে ভাইয়া বা দাদা ডাকতে পারো কিন্তু স্যার ডাকবে না।”
পূজা লাজুক হেসে বলল, “আচ্ছা দাদা।”

পূজার চোখে মুখে কেমন লাজুকপানা হাসি।দুই হাতের মধ্য ওড়নার মুড়ো নিয়ে কচলাচ্ছে আর হালকা দুলছে।পূজার মনের মধ্য ভাল লাগছে।মনের আনন্দ চেপে রাখতে পারছে না।জেলে পাড়ার দরিদ্র পরিবারের একটা মেয়ে।এত বড় রাজ প্রসাদে ঢুকেই আনন্দে আত্মহারা হয়েছে।বাড়ির চারদিক দেখছে আর মুগ্ধ হচ্ছে।প্রভাত আর পূর্ণতা টের পাচ্ছেনা পূজার চোখে মুখের এই আনন্দের কারণ।

প্রভাত আবার ও বলল, ” তুমি তো দেখতে ছোট।কি কাজ করবে তুমি।”
পূজা মুখের ভঙ্গী আগের ন্যায় রেখে বলল, ” আমি সব কাজ ই পারি দাদা।খালি ভারী জিনিস বইতে পারিনা।আমার নিজের ওজন কমতো এইজন্য।না হলে ওসব ও পারতাম।”
পূর্ণতা ফিক করে হেসে ফেলল পূজার কথা শুণে।প্রভাত পূর্ণতার এই হাসি টুকু দেখে যেন রাজ্যর আনন্দ পেল।এই হাসি দেখলেই প্রভাত পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রশান্তি পায়।সে আবার পূজাকে প্রশ্ন করল,

“কোন ক্লাসে পড়ো?”
“এইতো এইবার ইন্টার ফার্স্ট ইয়ার পড়ি।”
” লেখাপড়া করবে না।”
” হ্যাঁ করব তো।”
” কাজ করলে লেখাপড়া কীভাবে করবে।”
” রাতে পড়ব।”

” এখান থেকে রেগুলার যাতায়াত করতে পারবে। জেলেপাড়া তো বেশ দূরে। দশ কিঃ মি।”
” মাঝে মাঝে যাব, মাঝে মাঝে থেকে যাব।”
” বই খাতা নিয়ে আসবা। এখানে এসে বই পড়বা।পড়ার সব সুযোগ পাবে তুমি।”
“বই এখনো কিনিনি।কেউ পূরাতন বই বিক্রি করবে কীনা খোজ করছি।”
পূর্ণতা বলল,

” তুমি বই এর লিস্ট দিও।তোমার দাদা কিনে দিবে।”
পূজা গোল গোল চোখে তাকাল।এই বাড়িতে এত সুযোগ সুবিধা কাজের।এরা এত ভাল মনের।সারাজীবন ফায়েক চাচার পায়ের ধুলো নিতে হবে।এ বাড়িতে এনে কপাল খুলে দেওয়ার জন্য।পূজা খুশি মনে বলল,
” দিবো।”
প্রভাত বলল,

” এক মাসে কাজের বিনিময়ে কত টাকা দিতে হবে?”
পূজা ফট করেই বলে উঠল,
” একটা ভিডিও মোবাইল দাদা।”
প্রভাত-পূর্ণতা দু’জনেই অবাক হয়ে দু’জনের দিকে তাকাল।প্রভাত অভাক চোখে প্রশ্ন করল,
” মোবাইল?”

পূজা লাজুক হেসে জবাব দিল, ” জি দাদা।”
” দুনিয়ায় এত কিছু থাকতে মোবাইল চাইছো?”
“হ্যাঁ দাদা, ভিডিও ফোন লাগবে।”
” তার মানে প্রতি মাসে তোমাকে মোবাইল দিতে হবে।”
” না একটা মোবাইল দেওয়ার পর,তার পরের মাস থেকে এমবি কেনা টাকা দিলেই হবে আর কিছু লাগবে না।”
প্রভাত ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ২৭

” মোবাইলের প্রতি এর আগ্রহ কেন?”
পূজা আবার ও লাজুক হেসে জবাব দিল,
” দিদিকে বলবানি।আপনাকে বলতে পারব না।”
প্রভাত অবাক হয়ে পূর্ণতার দিকে তাকাল।কি এমন কথা যা পূর্ণতাকে ছাড়া বলা যাবে না।”
পূর্ণতা হালকা হেসে বলল, ” তাহলে তুমি থাকো, ফিরে এসে শুনব কেমন।”

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ২৯

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here