বুকে যে শ্রাবণ তার সিজন ২ পর্ব ৯

বুকে যে শ্রাবণ তার সিজন ২ পর্ব ৯
নিশাত জাহান নিশি

“ব্লা’ডি, স্টু’পিট, ন’নসে’ন্স মিশাল। শালা তোর রুহের হায়ের জন্য আজ আমার দুর্বল জায়গায় ফুলস্টপ পরে গেল!”
সেই রাতে তীব্র হায় হুতাশ নিয়ে সাহিল ঘুমিয়ে পরল। জেনিয়া তাকে একটিবারের জন্যেও ছুঁতে দিলোনা! মোদ্দা কথা, সাহিলকে তার গাঁয়ের সাথে একদম ঘেঁষতেই দিলোনা। যেন বড়ো রকমের পাপ লেগে যাবে তার গাঁয়ের সাথে ঘেঁষলে! সাহিল রীতিমতো বিরক্ত হয়ে ওঠছিল জেনিয়ার এহেন অস্বাভাবিক আচরণে। উল্টোদিকে জেনিয়া মিটিমিটি হেসে সাহিলের হতাশ মুখখানি দেখছিল! সাহিলের অসহায়ত্বে সে বেশ ভালোই মজা নিচ্ছিল।

অবশেষে মিশালের ইতালি যাওয়া কনফার্ম হয়ে গেল। ইতালির পাসপোর্ট ও ভিসা তৈরি করতে প্রায় দুইমাস লেগে গেল! মোট চৌদ্দো লক্ষ টাকা ইনভেস্ট করতে হয়েছে তার পাসপোর্ট ও ভিসার জন্যে। এরমধ্যে লাখ ছয়েক টাকা সাহিলের বাবা অর্থাৎ তরুন চৌধুরী এককালীন ধার হিসেবে দিয়েছেন। অবশিষ্ট টাকা বিভিন্ন ব্যাংক লোন এবং শাহনাজ বেগম ও রুমকির সমস্ত গহনাগাঁটি বিক্রি করে বন্দোবস্ত করা হয়েছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

বেশ হিমশিম খেতে হয়েছিল এই টাকা জোগাড় করতে। মিশাল যাওয়ার পর যে প্রথম মাসের সংসার খরচ চলবে তার জন্যেও কোনো অবশিষ্ট টাকা ছিলনা তাদের কাছে! কিস্তি হিসেবে লোনের টাকাও পরিশোধ করতে হবে। তাছাড়া ইতালি যাওয়ার পর যে সাথে সাথেই তার জব হয়ে যাবে এমনও তো কোনো গ্যারান্টি নেই! মাসে মাসে কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে না পারলে যে তার মা ও বোনকে বেশ ঝুঁকির মধ্যে পরতে হবে! এসব ভাবতে ভাবতেই হাত পরে গেল মিশালের মাথায়৷ মা ও বোনের দুঃশ্চিন্তায় তার আত্মবিশ্বাস ধীরে ধীরে কমতে লাগল!

সামান্তা ও সামান্তার পরিবার এক্ষেত্রে মিশালকে কোনোরূপ সাহায্য করেনি। মিশাল দায়িত্ব নিয়ে একা কতটুকু কি করতে পারে তা তারা দেখতে চেয়েছিল। মিশাল নিজেও তাদের কাছে কোনো রকম সাহায্য চায়নি। সামান্তার সাথে তো তার টানা দুইমাস ধরে কোনো কথাই নেই! সেখানে সাহায্য চাওয়া তো দূরের ব্যাপার। অভিমানে মিশাল সামান্তার থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিলেও সামান্তা প্রতি মুহূর্তে মুহূর্তে মিশালের খোঁজখবর নিয়েছে। মিশালও কম যায়না। সামান্তার মতো সেও আড়ালে থেকে সামান্তার প্রতিদিনকার খবরাখবর নিয়েছে। তবে কেউ কারো কাছে ধরা দিতে রাজি নয়।

আদালত থেকে টুটুল চৌধুরীর সাজা ঘোষণা করা হয়েছিল আজ থেকে প্রায় দেড়মাস পূর্বে। যাবজ্জীবন জেল ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছিল তার বিরুদ্ধে। জরিমানার পুরো টাকা সামান্তার হাতে এসেছিল। সেই টাকা সামান্তা তার চিকিৎসার খরচে ব্যয় না করে বরং লাবিবের চিকিৎসার কাজে ব্যয় করেছিল। হাতের হাড্ডি ফেটে যাওয়ায় লাবিবের একটি ছোট্টো অপারেশন করানোর বাকি ছিল। সেই টাকায় লাবিবেরও অপারেশন হয়ে গেল। সাইফা ও লাবিবের এনগেজমেন্ট আজ থেকে প্রায় পাঁচমাস আগেই সম্পন্ন হয়েছিল। এবার শুধু ভালো দিনক্ষণ দেখে তাদের বিয়ে হওয়ার বাকি।

এইতো আর ঘণ্টা খানিক বাদে মিশালের ফ্লাইট৷ রাত এখন একটা প্রায়। এয়ারপোর্টের বাইরে দাঁড়িয়ে মিশাল ও সাহিল। সাহিলের গাড়ির ওপর ওঠে একের পর এক সিগারেট ফুঁকছে মিশাল। মনে শান্তি নেই তার ক্ষীণ বাতাসে চুল উড়ছে তার। কপালে প্রখর দুঃশ্চিন্তার ছাপ। গৌড় বর্ণের মুখখানি কালচে ও নেতিয়ে রয়েছে। বুকে শ্রাবণ বইছে। রাতকে রাত মনে হচ্ছেনা এখানে। চারিদিকে লাইটের আলো রোশনাইয়ে এখানটাকে দিন মনে হচ্ছে। এয়ারপোর্টের বাইরে ও ভিতরে বেশ ভীড় জমেছে। বিদেশ থেকে আসা যাওয়া যাত্রীদের আত্মীয়-স্বজনদের ঢল। কেউ দেশে ফেরার আনন্দে হাসছে তো কেউ দেশের বাহিরে চলে যাওয়ার দুঃখে কাঁদছে। নীরব ভঙিতে মিশাল তার আশেপাশে তাকিয়ে এসব অবলোকন করছে।

গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে সাহিল। বুকে দু’হাত গুজে। বিষণ্ন মিশালের দিকে ধীর দৃষ্টি তার। মৌণতা ভেঙে অবশেষে সে প্রশ্ন ছুড়ল,
“সামান্তার সাথে দেখা না করেই চলে এলি যে?”
“কেন? তার সাথে দেখা করার কথা ছিল নাকি?”
“যার সুখের জন্য দেশ ছাড়ছিস তার সাথে দেখা করার কথা ছিলনা?”

“আমার সুখের জন্য আমি দেশ ছাড়ছি ভাইয়া। তার সুখের জন্য নয়। উল্টো বলতে পারো যে, সে আমার সুখ। তাকে পেতে হলে আমাকে সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দিয়ে তো আসতে হবে। সেই অভিযানেই যাচ্ছি আমি।”
“ওকে বুঝলাম। বাড়ির আর কাউকে আসতে দিলিনা কেন?”
“তাদের যতো দেখব ততোই আমি দুর্বল হয়ে পরব। তাই সাথে কাউকে আনিনি।”

এই বলে লাফ দিয়ে মিশাল গাড়ি থেকে নামল। সিগারেটটিতে শেষবারের মতো ফুঁক দিয়ে তা মাটিতে ফেলে দিলো। পা দ্বারা পিষে দিলো সিগারেটটি। আচমকা বুকের বাঁ পাশটিতে আঙুল ঠেকালো সে। আঙুল ঘুরিয়ে নিথর দৃষ্টিতে সাহিলের পানে তাকালো। ভারী গলায় বলল,
“এখানটায় খুব ব্যথা হচ্ছে ভাইয়া। শরীরের ব্যথা আমি মানিয়ে নিতে পারি, কিন্তু এখানটার ব্যথা মানিয়ে নিতে পারিনা। বিধাতা আমার দুর্বল জায়গাতেই সবসময় আঘাত করে।”

চোখে টইটম্বুর জল নিয়ে মিশাল অগত্যা সাহিলকে জড়িয়ে ধরল! আবেগমিশ্রিত গলায় বলল,
“তুমি আমার পরিবারকে দেখেশুনে রেখো ভাইয়া। তারা আমার সবচেয়ে দুর্বল জায়গা। তোমার কাছে আমি তাদের সঁপে গেলাম। আর সামান্তাকে বলে দিও আমি তার সুখের জন্য সব করতে পারি। একবছর পরে ফিরে এসে যেনো তাকে আমি সেই আগের মতো করেই পাই! আমার প্রতি ভালোবাসা যেনো তার বিন্দু পরিমাণ কম না হয়। আর যদি ফিরে না আসি কোনো কারণে যদি উপর ওয়ালার প্রিয় হয়ে যাই, তবে যেনো সে পারুর মতো আমাকে একটিবার ছোঁয়ার আশায় ঐভাবে পাগলের মতো ছুটে না আসে!”

সাহিলও কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল। মিশালকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরে বলল,
“ষ্যাহ্, এসব কথা বলেনা। কিছু হবেনা তোর। দেশের কাউকে নিয়ে কোনো চিন্তা করতে হবেনা তোর। তাদের সবাইকে দেখার জন্য আমি ও আমার পরিবার রয়েছি। তুই শুধু তোর লক্ষ্যে ফোকাস কর, বাকিটা আমি দেখে নিচ্ছি।”

ইতোমধ্যেই মিশালের ফ্লাইটের সময় হয়ে গেল। এনাউন্সমেন্ট শুরু হয়ে গেল। যাত্রীরা সব এক এক করে এয়ারপোর্টের ভেতরে প্রবেশ করতে লাগল। সাহিলের থেকে বিদায় নিয়ে মিশাল তার স্যুটকেস সহ দৌঁড়ে এয়ারপোর্টের ভেতর ঢুকে গেল।শেষ বারের মতো মিশাল পিছু ঘুরে তাকাতেই সে থমকে দাঁড়ালো! ক্লান্ত চোখ দুটো তার শান্ত হয়ে এলো।

বুকের ব্যথা ক্রমশ হ্রাস পেতে লাগল। তুমুল গতিতে তার হার্ট বিট করতে লাগল। চঞ্চল ও অবাধ্য হয়ে ওঠল সে। তার থেকে প্রায় কয়েক ফুট দূরত্বে দাঁড়িয়ে তার বুকের হৃৎস্পন্দন, তার সামান্তা! মুখে ওড়না পেঁচিয়ে সামান্তা চক্ষুভরা তৃষ্ণা ও জল নিয়ে দাঁড়িয়ে। রীতিমতো হাঁপাচ্ছে সে। বুঝাই যাচ্ছে গাড়ি থেকে নেমে সে একপ্রকার দৌঁড়ে এসেছে এয়ারপোর্টে। মিশাল ছুটে আসতে চেয়েও পারলনা! এয়ারপোর্টের গার্ডসরা তাকে আটকে দিলো। ভেতর থেকে দরোজা লাগিয়ে দিলো। মাথা নুইয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে দিলো সামান্তা। বিমূঢ় গলায় বিড়বিড় করে বলল,

“আই মিস ইউ সো মাচ মিশাল।”
সামান্তার পাশে এসে দাঁড়ালো সাহিল। সামান্তাকে শান্তনা দিলো। শক্ত গলায় বুঝিয়ে বলল,
“এভাবে ভেঙে পরিসনা সামান্তা। তুই মিশালকে যতো দুর্বলতা দেখাবি, মিশাল ততো বেশি তোর প্রতি দুর্বল হয়ে পরবে। তার লক্ষ্য থেকে সরে যাবে। এক বছরেরই তো ব্যাপার, চোখের পলকেই কেটে যাবে।”

“যাকে ছাড়া আমার এক মুহূর্ত থাকতে হাঁসফাঁস লাগে তুমি বলছ তাকে ছাড়া চোখের পলকেই বছর কেটে যাবে? আমি ভাবছি সে ওখানে গিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় একমুহূর্তও কাটাতে পারবে তো? এইযে কারণ ছাড়াই হুটহাট করে তার মাথা গরম হয়ে যায় ওখানে গিয়ে তার স্বভাব পাল্টাতে পারবে তো? কর্মস্থলে টিকে থাকতে পারবে তো?”
এই কঠিন প্রশ্ন সাহিলের মাথায়ও ঘুরপাক খেতে লাগল! এতো গভীরে তো সে কখনও ভেবে দেখেনি। এতোগুলো টাকা ধারদেনা করে মিশাল তো বিদেশে গেল ঠিকই কিন্তু সেই টাকার সঠিক উসুল করতে পারবে তো সে?

ভিডিও কল অন করে টেবিলে মাথা নুইয়ে বসে রয়েছে মিশাল। ওয়েটারের সাদা পোশাক তার গাঁয়ে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সামান্তা যেনো মিশালকে গিলে খাচ্ছে। সম্ভব হলে ফোন ভেঙে চলে যেত মিশালকে মারধর করতে। মাথা চুলকে মিশাল আড়চোখে সামান্তার দিকে একবার তাকাচ্ছে তো অন্যদিকে নখ কামড়ে খাচ্ছে! তার থেকে কয়েক ফুট দূরত্বে টেবিলে পা ঝুলিয়ে বসে হানিয়া হি হি করে হেসে যাচ্ছে! দাঁতে দাঁত চেপে মিশাল তার ওপর রাগ ঝারছে। হানিয়া তা দেখে দেখে মিশালকে ব্যঙ্গ করছে। বেশ মজা নিচ্ছে সে। ভিডিও কলের ঐ প্রান্ত থেকে সামান্তা এবার নীরবতা ভাঙল। রূঢ় গলায় বলল,

“এই তুমি চোরের মতো মাথা নুইয়ে রেখেছ কেন? তাকাও আমার দিকে। হেই লুক এট মি। আমি তোমার সাথে কথা বলছি শুনতে পারছনা তুমি?”
বেশ আলাভোলা ভাব নিয়ে মিশাল ফিরে তাকালো সামান্তার দিকে। ছোটো বাচ্চাদের ন্যায় অসহায়ত্বে ভরা তার চোখমুখ। হুট করে কানে ধরে হাঁটু মুড়ে বসে গেল সে ভিডিও কলের সামনে। মিনমিনে গলায় বলল,

“আ’ম সো সরি সামু। আমি আমার ভুলের জন্য ক্ষমা চাচ্ছি। বিশ্বাস কর আমি তার গাঁয়ে হাত তুলতে চাইনি। পাঁচ মিনিটই তো লেইট হয়েছিল কাজে আসতে, তাই বলে বসের কাছে নালিশ করতে হবে? চোখ রাঙিয়ে আমার সাথে কথা বলতে হবে? তুইতো জানিসই সামু আমার মাথা গরম। তাই ওভার রিয়েক্ট করে ফেলেছি।”

“হ্যাঁ তো? তোমার মাথা গরম তো তোমার জন্য অন্যরা কেন সাফার করবে? যার মধ্যে পাংচুয়েলিটির পি ও নেই তার নামে স্টাফরা বসের কাছে নালিশ করবেনা তো কি করবে? এই নিয়ে কয়টা রেস্টুরেন্ট চেঞ্জ করেছ তুমি? ইতালি গেলে আজ দশমাস হতে চলল। এই দশমাসে তুমি পাঁচটা রেস্টুরেন্ট পাল্টেছ। প্রতিবারই বাহানা দিয়েছ যে তোমার মাথা গরম, স্টাফদের গাঁয়ে হাত তুলে ফেলো, কারণ তারা তোমার বিরুদ্ধে সত্য কথা বলে!

একচুয়েলি তোমার সমস্যা কি জানো? তুমি কোনোকিছুই সিরিয়াসলি নিতে পারোনা! না আমাকে কখনও সিরিয়াসলি নিতে পেরেছ, না নিজের কাজকে। দেশে ফেরার তো কোনো তাড়াই নেই তোমার! হয়তো নতুন প্রেমিকা খুঁজে পেয়েছ, ওখানে সেটেল্ড হওয়ার চিন্তাভাবনায় আছো। যদি এমন কিছুই হয়ে থাকে তবে তুমি আমাকে ডিরেক্টলি বলছনা কেন? কেন আমাকে এভাবে ঝুলিয়ে রেখেছ? কি সমস্যা তোমার?”

সামান্তা তার রাগ সংযত করতে পারছিলনা। রীতিমতো চিৎকার চ্যাচাম্যাচি শুরু করে দিলো। মিশালের মেজাজও চটকে গেল। রাগে রি রি করে সেও পাল্টা বলল,
“ওহ্ আই সি। তোর নতুন প্রেমিক লাগবে তাইনা? তাই তুই এখন তোর ব্যাপারগুলো আমার ওপর চাপিয়ে দিচ্ছিস? কি ভেবেছিস আমি কিছু বুঝিনা? বোকা আমি।”

“জাস্ট শাট আপ। একদম মুখ সামলে কথা বলবে তুমি। ইচ্ছে করে আমায় আঘাত করো তাইনা? তুমি কিন্তু ভালো করেই জানো, আমার কুৎসিত চেহারার দিকে কেউ ফিরেও তাকায়না। সেই জায়গায় আমার নতুন প্রেমিক হওয়া তো দূরের ব্যাপার।”

“যা যা যা দেখা হয়ে গেছে আমার। ফেসবুকে আমিও মাঝেমধ্যে ঢু মারি। অফিসের বস তোর ছবির কমেন্টে যে রঙ বেরঙের কমেন্ট করে সব আমার চোখে পরে। টাকা থাকলে চেহারা একমাসেই পাল্টে ফেলা যায় ওকে? বস মানেই তো ধনী। ইভেন তোর সাথে যেকোনো ছেলে দুইমিনিট থাকলেই সে তোর প্রেমে পরতে বাধ্য! সো আমাকে এসব বুঝাতে আসিসনা।

আর হ্যাঁ, আগামী তিন মাসের মধ্যেই আমি দেশে ফিরছি! জারা বাঁচকে রেহেনা মুঝছে!”
ইতোমধ্যেই মিশালের ডাক এলো অর্ডার করা খাবার সার্ভ করার জন্য। ভিডিও কল অন রেখেই মিশাল স্থান পরিত্যাগ করল। চোখ জোড়া রক্তশূল করে হানিয়াকে বলে গেল সামান্তাকে উস্কে না দিয়ে বরং তাকে একটু বুঝাতে। হানিয়া ফিক করে হেসে ছুটে এলো ভিডিও কলের সামনে। হানিয়াকে দেখামাত্রই সামান্তা তার মুখভঙ্গি বদলে নিলো। ক্ষীণ হেসে হানিয়ার দিকে তাকালো। মৃদু হেসে হানিয়া বলল,

“হেই সামান্তা। হোয়াটস আপ?”
“আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো। তোমার কি অবস্থা?”
“ভালো। তোমাদের ফাইটিং দেখছিলাম এতক্ষণ। মাঝেমাঝেই দেখি, মজা লাগে!”
“মজা লাগেনা ছাঁই! এই লোকটা আমাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খেলো। মজার ব্যাপার হলো, যতোবারই আমি তাকে কল দিই ততোবারই আমাকে বেড নিউজ শুনতে হয়!”
আলতো হাসল হানিয়া। কেমন যেনো নিরাগ গলায় বলল,

“মিশাল তোমাকে যতোটা না জ্বালায় তার চেয়েও বেশি নিজে পুঁড়ে! তুমি হয়তো জানোনা মিশাল কি পরিমাণ হার্ড ওয়ার্ক করে। তার সাথে তো বিগত সাতমাস ধরে আমি আছি। এই সাতমাসে আমি একদিনও তাকে একটা রাত নিশ্চিন্তে ঘুমাতে দেখিনি। রেস্টুরেন্টের কাজ শেষ হলে সে পার্ট টাইম জব হিসেবে হসপিটালে নাইট গার্ডের কাজ করে! ঘুম-নিদ্রা বলতে তার জীবনে কিছু আছে কিনা আমার জানা নেই। যার কারণে সে সবসময় এগ্রেসিভ হয়ে থাকে। প্রতিমাসে সে স্যালারির বেশিরভাগ টাকাই দেশে পাঠিয়ে দেয়, বিদেশে থেকে আমি মেয়ে হয়ে যতো টাকা খরচ করি এর টেন পার্সেন্টও মিশাল খরচ করেনা! খুবই সাদামাটা চলাচল তার। আরেকটি টপ সিক্রেট হচ্ছে সে আলাদাভাবে তোমার সার্জারির জন্য টাকা জমায়!”

বাকরুদ্ধ সামান্তা। ঝট করে ল্যাপটপটি বন্ধ করে দিলো। মুখ চেপে ধরে সে ফুঁপিয়ে কেঁদে দিলো। বিড়বিড় করে বলল,
“আ’ম সো সরি মিশাল। তোমার ওপর খুব চাপ দিয়ে ফেলছি। বাট আমার কিছু করার নেই। আমি চাই তুমি নিজেকে প্রমাণ করো। সবাইকে দেখিয়ে দাও, তুমি চাইলে সব পারো!”

সেদিন রাতে সামান্তা না খেয়েই ঘুমিয়ে পরল। প্রতিদিনকার ন্যায় সকালে ওঠে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল। বাড়িতে একা থাকতে থাকতে সামান্তা অসুস্থ হয়ে যাচ্ছিল। দুঃশ্চিন্তা তাকে গ্রাস করছিল। তাই মাস খানিক হলো সে ছোটোখাটো একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে জব নিয়েছে। কাজে কাজে থাকার ফলে তার মিশালকে নিয়ে অতিরিক্ত ভাবনা কম হয়।

অফিসে যাওয়ার উদ্দেশ্যে সাহিল রেডি হচ্ছিল। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে বেশ বদরাগী ভাব নিয়ে সে গলায় টাই বাঁধছিল। ইতোমধ্যেই জেনিয়া ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে এলো। মৃদু হেসে সে সাহিলের দিকে এগিয়ে এলো। জেনিয়ার হাসিমুখ কেন যেনো হজম হলোনা সাহিলের। ভ্রু কুঁচকে সে প্রখর গলায় বলল,
“সকাল সকাল তোমার মুখ দেখে গেলেই কি আমার পেট ভরে যাবে? চা-নাশতা কোথায়? তোমার মধ্যে দায়িত্ব জ্ঞান বলতে কিছু আছে কি?”

ধীরে ধীরে জেনিয়ার মুখভঙ্গি পাল্টাতে লাগল। ঠোঁট থেকে হাসি মুছে গিয়ে তা কঠিন রূপ ধারণ করল! ডাইনিদের ন্যায় তার চোখ বের হয়ে আসার উপক্রম হলো। কোমড়ে হাত গুজে সে দাঁত কিড়মিড়িয়ে সাহিলের দিকে তাকাতেই সাহিল ভয়ে শুকনো ঢোঁক গিলল। ভেতরে ভেতরে আল্লাহ্’র নাম যপ করতে লাগল।

কপাল বেয়ে তার ঘাম গড়াতে লাগল। পরিস্থিতি সামলানোর জন্য সে আপত্তি থাকা সত্ত্বেও হু হা করে হেসে দিলো। হরদমে বলতে আরম্ভ করল,
“আরে আমিতো জাস্ট আজ স্বপ্নে যা দেখলাম তার ডেমো দেখাচ্ছিলাম! তুমি কেন আমার আমার জন্য চা- নাশতা তৈরি করবে বলো? উল্টো আমি তোমার চা-নাশতা তৈরি করব। আমার হাতের তৈরি করা নাশতা আমার সন্তান তোমার মাধ্যমে খাবে। আহ্ কি শান্তি!”

বুকে যে শ্রাবণ তার সিজন ২ পর্ব ৮

এই বলে সাহিল মানে মানে করে জায়গা থেকে কেটে পরল। অমনি অট্ট হাসিতে ফেটে পরল জেনিয়া। তার গর্ভে হাত বুলিয়ে বলল,
“কেমন জব্দ করলাম তোর বাবাকে বল?”

বুকে যে শ্রাবণ তার সিজন ২ পর্ব ১০