মেজর পর্ব ১৩

মেজর পর্ব ১৩
জাকিয়া সুলতানা ঝুমুর

দূর পাহাড়ে মিতু ছুটে যাচ্ছে দিগবিদিক।আ,তংকে সারা মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছে,তার পেছনে তাকে তাড়া করছে এক লাল রঙ্গা কুকুর।মিতু দৌড়াতে দৌড়াতে পাহাড়ের কিনারায় চলে আসে।অচেনা জায়গা অচেনা রাস্তা কোনদিকে যাবে মিতু ঠাহর করতে পারে না।

এদিক ওদিক তাকিয়ে কোনো আলোর দেখা না পেয়ে মিতু ভয়ে ভয়ে লালাভরা জ্বিভ বের করা কুকুরের দিকে তাকায়া,ছোটবেলা থেকেই কুকুরের প্রতি তার খুব ভয়।যেখানে কুকুর থাকতো সেখান থেকে একশ হাত দূরে দিয়েও সে যেতো না কিন্তু আজকে কিনা সেই ভয়ের জিনিসটাই তাকে তাড়া করছে?কুকুরটা কি হাসলো? কুকুর হাসে নাকি কিন্তু মিতুর মনে হলো কুকুরটা হাসছে।সে আস্তে আস্তে পিছু হটতে থাকে আর কুকুরটা সামনে আসতে থাকে।কুকুরটা মিতুকে কামড়াতে যাবে তখনি কারও উচ্চ চিৎকার মিতুর কানে আসে।দূর থেকে দেখেও মিতু মানুষটাকে এক নিমিষেই চিনে ফেলে।মেজর! মুশফিক দ্রুত পায়ে তার দিকে এগিয়ে আসে।মিতু ফুঁপিয়ে উঠলো।কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“মেজর!মেজর!আমি খুব ভয় পাচ্ছি।আমাকে বাঁচান প্লিজ।”
মুশফিক আর ঘুমায়নি।এমন পুতুল পুতুল বউ কাছে রেখে ভালো ছেলে হয়ে ঘুমানো বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার,মনে,দেহে আনাগোনা হচ্ছে হাজারও ইচ্ছার।সে ঘুমন্ত মিতুর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার ঘন কালো ভ্রুযুগল কুঁচকানো।

সে তীক্ষ্ণ চোখে মিতুকে দেখছে।ঘুমের মাঝেই মেয়েটা থরথর করে কাঁপছে,ফুঁপিয়ে উঠছে,পাতলা মসৃণ ঠোঁটগুলো ফুলিয়ে বাচ্চাদের মতো কাঁদছে।ক্ষনে ক্ষনে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রাখছে মুশফিকের হাতের পেশীবহুল বাহু।মুশফিক মিতুর এমন আচরণের কারণ কি সেটাই তাকে ভাবাচ্ছে।মিতু কি স্বপ্ন দেখছে?হয়তো,স্বপ্ন না দেখলে এমন করার প্রশ্নই আসে না।মিতু তাকে কয়েকবার মেজর বলে ডাকে।মুশফিক ধাতস্থ হওয়ার আগেই আবার মেজর বলে ডাকে,আর ফিসফিস করে কিছু বলে।

দক্ষ,ট্রের্নিংপ্রাপ্ত আর্মি অফিসারের কানে এই ফিসফিস করে বলা কথাগুলোই স্পষ্ট হয়ে যায়।সে মিতুকে বুকে নিয়ে বললো,
“মিতুল!এই!”
মেজরের নরম কন্ঠের ডাক মিতুর কানে পৌছায় না।সে ভয়ে-আতংকে চিৎকার করে উঠে।মুশফিকের বুকে লুকিয়ে যেতে চায়।মুশফিক আরও যত্ন করে মিতুকে বুকে জায়গা দেয়।আস্তে করে বললো,

” কি হয়েছে?”
মিতু ততক্ষণে ঘেমে,চোখের পানিতে একাকার।সে ফ্যাকাসে চেহারায় মুশফিকের দিকে তাকায়।মুশফিক মাথায় হাত ভুলিয়ে দেয়।মিতু ফিসফিস করে বললো,
“কুকুর।”
“কোথায়?”

“পাহাড়ের কাছে,আমাকে কা,মড়াতে এসেছে।”
মুশফিক নরম স্বরে বললো,
“ওটা স্বপ্ন ছিলো।তুমি আমার কাছে আছো।”
“আমার ভয় করছে।”
“মেজর তোমার সাথে আছে। মেজর থাকতে তোমার কোনো কিছুতে ভয় পেতে হবে না। ”
মিতুর চুপচাপ শুয়ে থাকে।মুশফিক বললো,

“রিলাক্স।ওটা স্বপ্ন ছিলো।বাস্তবে এখানে কোনো কুকুর নেই বরং তুমি মেজরের বুকে আছো। ”
মেজরের ঠোঁটের মুচকি হাসি দেখে মিতু ধাতস্থ হয়।সে গতকাল রাতে মুশফিকের বিছানায় চলে এসেছিলো কিন্তু কখন বুকে চলে এসেছে সেটা মনে নেই।দূর-স্বপ্ন আর এমন আপত্তিকর অবস্থা দেখে মিতু আরও ঘাবড়ে যায়।আস্তে করে উঠে মুশফিকের থেকে দূরে বসে।মুশফিক বললো,

“টেক এ ডিপ ব্রিথ।”
মিতু মুশফিকের দিকে তাকিয়ে থাকে।মুশফিক আবার বললো,
“ফাস্ট।”
মিতু চোখ বন্ধ করে জোড়ে শ্বাস নেয়।তারপর হঠাৎ ঝট করে উঠে দাঁড়ায়।আশেপাশে চোখ তুলে মুশফিকের দিকে তাকায়।মুশফিক শান্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে।ভয় আতংক দূর হয়ে মিতুর মাঝে ভর করে একরাশ লজ্জা।লজ্জায় মুখ লাল হয়ে যায়,নাকের ডগা কেঁপে উঠে।সে মেজরের বুকে ছিলো!অ মাই গড!
সে আমতা আমতা করে বললো,

“রাতে ভয় পাচ্ছিলাম তাই;তাই আপনার বিছানায় এসেছি।”
মুশফিকের ঠোঁটের কোনে মুচকি হাসির রেখা ফুঁটে উঠে।
“আমি কিছু মনে করিনি।মাঝে মাঝে এমন একটু ভয় পাওয়া ভালো,হাজবেন্ড খুশী হয়। ”
মানে?উনি কি মিতুর সানিধ্য কামনা করেন?বিষ্ফোরিত আঁখি মেলে তাকিয়ে থাকে, সুদর্শন মেজরের দিকে।
“আমরা….মানে!”
মেজর মিতুর মনের সুপ্ত কথা বুঝে যায়।

“আমাদের মাঝে কিছুই হয়নি। ”
মুশফিক আবার বললো,
“কিছু হলে অবশ্যই বুঝতে পারতে।”
“আমি খুব ঘুমকাতুরে।”
মুশফিক বাথরুমের দিকে যেতে যেতে বললো,
“ইট’স নট ইজি।”

মিতু লজ্জায় রুমে এসে কম্বলমুড়ি দিয়ে শুয়ে পরে।মেজরকে সবাই যেমন ভদ্র মনে করে এই লোক কিন্তু আসলে এত ভদ্র না,সে খুব দুষ্টু।
মুশফিক নামায পড়তে এসে দেখে মিতু ঘুমিয়ে গিয়েছে।সে আস্তে করে ডাকে।
“মিতু।নামাযের সময় চলে যাচ্ছে।”

মিতু চোখ খুলে তাকায়।সাদা পাঞ্জাবি,টুপি পড়নে মুশফিককে কি যে ভালো লাগছে মিতু বুঝাতে পারবেনা। সুন্দর এক আতরের ঘ্রাণে তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে সে মুশফিকের দিকে তাকিয়ে থাকে।মুশফিক আবার বললো,
“উঠো।”
মিতু উঠে বসে।মুশফিক বললো,
“যাও ওযু করে আস।”

মুশফিক নামাযে দাঁড়ায়।মিতু মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে,একটা লোক এতো সুন্দর হয় কি করে?নাকি তার চোখেই মানুষটা এতো সুদর্শন।মুশফিক নামায শেষ করে মিতুর দিকে তাকিয়ে দেখে মিতু ঠায় বসে আছে।
“যাও।”
মিতু আমতা আমতা করে বললো,
“আসলে আমার..”

মুশফিক মিতুর সমস্যাটা বুঝতে পারে।সে তাকে লজ্জা দিতে ইচ্ছুক না।
“ইট’স ওকে।নরমাল ব্যাপার আমার কাছে এতো লুকানোর কিছু নেই।”
মিতু আস্তে করে শুয়ে পড়ে।মুশফিকের কথায় লজ্জা পেলেও ভালোলাগাও ছিলো।
মুশফিক নাস্তা রেখে অফিসে চলে যায়।এখন সৈনিকদের ব্যায়ামের সময়।
মুশফিক চলে যাওয়ার পরে মিতু উঠে বসে।এতোক্ষণ মিতু ঘুমের ভান করে ছিলো,মুশফিকের সামনে এলেই কেমন লজ্জা লাগে তাছাড়া বুঝা যাচ্ছে মুশফিক বেশ ফ্রী মাইন্ডের,আর খুব যত্নশীল।

সারাদিন মিতু একা একা কাটায়।মুশফিককে ফোন দিতে পারত কিন্তু দেয়নি কেমন আড়ষ্ট হয়ে আছে।সন্ধ্যা নামলেই মিতু রুমে চলে আসে।লজ্জা দূর হয়ে সেখানে ভর করেছে অভিমান।সে না হয় ফোন দেয়নি কিন্তু মুশফিক কি ফোন দিতে পারতো না?উনি কেনো ফোন দিলো না?আজকে মিতু অভিমান করেছে তাই শাড়ি পড়েনি,থ্রী পিছ পড়েছে।মিতু বিমর্ষ হয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়।

সন্ধ্যা পেরিয়ে গিয়েছে সেই কখন এখনো মুশফিকের আসার নাম নেই।তার মন অন্ধকারের কালো মেঘে ছেয়ে আছে যে কোনো সময় বাধ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামবে।তখনি দেখে সামনের কটেজের কাছে মুশফিকের সবুজ জিপগাড়ি থামে।সেখান থেকে লম্বা এক তরুনী বেরিয়ে আসে।লাইটের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে মেয়েটা হেসে হেসে মুশফিকের সাথে কথা বলছে আর হাত নেড়ে বিদায় জানায়।মিতু চুপচাপ সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে।কিছুক্ষণ পরে মুশফিক আসে।অভিমানী কন্যার গম্ভীর মুখ তার নজরে আসে।কিছু না বলে রুমে যায় তার কয়েক মিনিটের মাঝে ফ্রেশ হয়ে আসে।মিতু তখনো ওখানেই দাঁড়িয়ে আছে।

মুশফিক কাছে এসে দাঁড়ায়।
“আমার মোবাইলে চার্জ ছিলো না তাই ফোন দিতে পারিনি।তুমি অপেক্ষায় ছিলে?”
“না।সমস্যা নেই।”
হাসিমুখ যখন গম্ভীর হয়ে যায় তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না যে সমস্যা আছে কি নেই।সে মাথা কাত করে মিতুকে দেখার চেষ্টা করে বললো,
“রাগ করেছো?”
“না।”
“সরি।”
মিতু ফুসে উঠে।

“সরি!কিসের সরি?সারাদিন একা ছিলাম,আপনি যানেন একা থাকা কতো কষ্ট?একটু ফোন ও দেননি।নিষ্ঠুর লোক। ”
প্রিয়তমার অভিমানী মুখ দেখতে তার খুব ভালো লাগছে সে হেসে বললো,
“এই জন্য বুঝি আমাকে শাস্তি দেয়া হচ্ছে।”
মিতু ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে।মুশফিক বললো,

“শাড়ি পড়নি যে,থ্রী পিছ পড়ে আমাকে শাস্তি দিচ্ছো।বউকে শাড়ি না পড়া দেখলে বুকে যন্ত্রণা হয়।”
মিতু গম্ভীর মুখে হাসি ফুটে উঠে।মুশফিক মিতুর পেছনে এসে দাঁড়ায়।কানের কাছে উষ্ঠ ছুয়িয়ে আস্তে করে বললো,
“আজ সারাদিন এত ব্যস্ত ছিলাম বাসায় আসার সুযোগ পাইনি।সরি সোনা।প্লিজ শাড়ি পড়ে আস,তোমাকে ওভাবেই দেখতে চাই।”

মিতুর খুব সুখ অনুভূত হয়।সে চুপ করে থাকে মুশফিক আবার অনুরোধ করে বললো,
“প্লিজ।”
মিতু শাড়ি পড়ে ততক্ষণে মুশফিক নিচে টিভি দেখছে।মিতু শাড়ি পড়ে নিচে যায়।মিতুকে দেখে মুশফিক বললো,
“এখন দেখে মনে হচ্ছে এটা মেজরের বউ।”
মিতু হাসে, মুশফিকের থেকে দূরূত্ব রেখে বসে কিন্তু মুশফিক এইটুকু দূরূত্ব রাখতে নারাজ।সে মিতুর কোলে শুয়ে টিভিতে শাহেদ কাপুর অভিনীত বিবাহ মুভিটা চালু করে।মিতু স্তব্ধ আর শক্ত হয়ে বসে আছে।মুশফিক তার দিকে তাকিয়ে বললো,

“মিতু এমন করে বসো না। এখন থেকে আমরা একসাথে মুভি দেখলেই আমি তোমার কোলে শুয়ে পরবো।অভ্যাস করে নাও প্লিজ।”
মিতু হাসে।সুখের প্রজাপতি যে এতো রঙ্গের হয় তা মুশফিকের সানিধ্যে না আসলে জানতেই পারতো না।সে আস্তে করে মুশফিকের চুলে হাত ভুলিয়ে দেয়।

মেজর পর্ব ১২

বিবাহ মুভিটা খুবই সুন্দর।এটা মুশফিকের পছন্দের মুভি।হঠাৎ মুশফিক মিতুর গালে হাত রেখে বললো,
“তুমি তারার মতো আমার আকাশের প্রতিটা জায়গায় ছেঁয়ে থেকো প্রিয়।”
মিতু হাসে কিন্তু মুখে কিছুই বলে না।দুজনে দুজনের দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে।

মেজর পর্ব ১৪